প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা #Writer_Mahfuza_Akter পর্ব-২৬

0
286

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-২৬

কুয়াশার চাদরে পুরো শহর আবৃত। সাথে গা হিম করে তোলা শীতল হাওয়ায় বার বার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠছে তরীর। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে মধুর দিকে তাকালো সে। মেয়েটা কেমন নীরব, নির্বিকার হয়ে বসে আছে। মধুর এমন অনুভূতিহীন, নিষ্প্রাণ রূপ দেখেনি কখনো কেউ।

মধু তখন সৌহার্দ্য আর প্রহরের সামনে থেকে চলে যাওয়ার পর তরীও মধুর পিছু ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু মধু ততক্ষণে স্কুটার নিয়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তরী পিছু ডাকলেও শোনেনি সে তখন। তরীও ভাগ্যবশত একটা সিএনজি পেয়ে সেটায় উঠে গিয়েছিল মধুকে ফলো করার জন্য। কিন্তু তরীকে অবাক করে দিয়ে মধু নিজের হোস্টেলেই ফিরে এসেছিল। হোস্টেলের পার্কিং এরিয়ায় মধুর স্কুটার দেখে তরী হোস্টেলে প্রবেশ করলো। কিন্তু মধুর রুমের সামনে তালা ঝোলানো দেখে তরী অবাক হয়! পরমুহূর্তেই মধুর বলা একটা কথা মনে পড়ে তরীর,

” জানিস? আমার মন খারাপ হয় না কখনো। মন খারাপ করবো কার জন্য? আমার যে কেউই নেই! কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের জীবনের শূন্যতাগুলো প্রচন্ড ভাবে অনুভব করি আমি। সেই শূন্যতাকে শূন্য হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়ার জন্য নীরবতা খুঁজি তখন। এজন্যই আমার হোস্টেলের ছাদ, খোলা মাঠ আর অন্ধকার ঘর আমার খুব পছন্দ!”

তরী তড়িঘড়ি করে ছাদে উঠতেই দেখলো, মধু ছাদের এক কোণায় পা ঝুলিয়ে বসে আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। তরী নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মধুকে এই মুহুর্তে ওর ঠিক কী বলা উচিত, বুঝে উঠতে পারছে না সে!

“পিছু পিছু ছুটে চলে এলি যে! কী ভেবেছিলি? আমি আবার হারিয়ে যাবো?”

মধু ব্যাঙ্গাত্মক হাসলো যেন! তরী অবাক হলো মধুর কথা শুনে। মেয়েটা এখনো ঘাড় ঘুরিয়ে পর দিকে তাকায়নি, তবুও ওর আগমন বুঝে গেল! মধু আবার বললো,

” অতীত মানুষের পিছু ছাড়ে না। পালিয়ে আর হারিয়ে গিয়ে মানুষ শান্তি খোঁজে। আমিও খুজছিলাম! কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমার আমিকে নিজের মধ্যেই হারিয়ে ফেলেছি আমি!”

তরী গিয়ে মধুর পাশে বসলো। কয়েক মিনিটের নীরবতা মন দিয়ে অনুভব করলো দুজন। তরী হঠাৎই মুখ খুললো। খুবই ম্লান গলায় বললো,

“অতীতকে তো একটা সুযোগ দিতেই পারিস!”

তরী মুখে ‘তুই’ সম্বোধন শুনে একটুও অবাক হলো না মধু। ছোটবেলায় একে অপরের খেলার সঙ্গী ছিল তারা। তরী ওর সাথে এভাবেই কথা বলতো। তাই মধু নির্বিকার ভঙ্গিতে অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

“তুই আমাকে প্রথম দেখায়-ই চিনতে পেরেছিলি, তাই না? তোর যদি ছোটবেলার সব কথা মনে থেকে থাকে, তাহলে আমাকে চিনে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু না!”

“প্রথম দেখে বুঝিনি। নাম শুনে সাথে সাথে চিনে ফেলতে পারিনি। সৌহার্দ্যের বাড়িতে প্রবেশ করার পর আমার চোখ দুটো তোকে অনেক খুঁজেছিল। কিন্তু তোর দেখা না পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। অনুমান করেছিলাম, তুই ঐ বাড়িতে থাকিস না। তোকে দ্বিতীয় বার দেখে হুট করেই তোর নামটার সাথে লিংক খুঁজে পাই, তখন চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারিনি। এমনি প্রহরের সন্দেহের কবলে পড়ে মুখ খুলতে হয়েছে আমায়। সন্দেহের মাত্রা বাড়াতে চাইনি আর। তবে কৌতুহলটা নিজের মধ্যে চেপে রেখেছি আজও। তোর সাথে মিশেছি এতো দিন! তোর কথাগুলো আমাকে নাড়া দিত। মনে হতো, বেশ জটিল কোনো ঘটনা তোর জীবনে ঘটেছে।”

তরীর দৃষ্টিতে কৌতূহল স্পষ্ট। মধু তরীর প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে শুকনো হাসি দিলো শুধু। মুহুর্তের পর মুহূর্ত গড়ালো। মধুর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে তরী। অপেক্ষা করছে মধু কখন মুখ খুলবে!

অন্যদিকে,
প্রহরের দৃষ্টি নামানো। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে নসে আছে সে। সৌহার্দ্য তার ঠিক সামনে মুখোমুখি বসে আছে। প্রহরের পিছু পিছু ওর পার্সোনাল কেবিনে নিজেই এসেছে সৌহার্দ্য। রাগে তার মস্তিষ্ক ট*গ*ব*গ করছে। আর এই সম্পূর্ণ রাগটা প্রহরের ওপরই! অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে প্রহরের দিকে।

“এই দুই হাত দিয়ে তোকে একদিন বুকে আগলে নিয়েছিলাম। ক’লি’জা’র একটা অংশ ছিলি তুই! তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে যে আমি কী করতাম, তুই কল্পনাও করতে পারবি না! মধুর খোঁজ তুই জানতি? অথচ আমাকে একবারও বলিস নি? কী চাস তুই, আমাকে বল তো? তুই জানিস, মধুকে আমরা পাগলের খুঁজেছি?”

সৌহার্দ্যের কথার বিপরীতে প্রহর চোখ তুলে তাকালো। ওর ঘর্মাক্ত কপাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরছে। সৌহার্দ্যের এমন উদগ্রীব অবস্থা দেখেও প্রহর স্বাভাবিক। এক বাক্যে বললো,

“যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না!”

হুট করেই চেঁচিয়ে উঠলো সৌহার্দ্য। প্রহরের ঠিক মুখ বরাবর আঙুল তুললো। ফুঁ*সে উঠে বললো,

“তোর জন্য হারিয়ে ফেলেছি আমি আমার বোনকে! শুধুমাত্র তোর জন্য! তোর কারণে আমার বোন নিজের পরিবার থেকে দূরে সরে গেছে। নিজেকে আড়াল করেছে ও নিজের পুরো চেনা দুনিয়া থেকে। আজকের এই মধুর সাথে দুই বছর আগের মধুর আকাশ-পাতাল তফাৎ! একটা মানুষ ভেতর থেকে কতটা নিঃশেষ হয়ে গেলে নিজেকে তার চেনা পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রাখে ভাবতে পারিস তুই?”

প্রহর অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সে জানে, সবটাই তার দোষ! কিন্তু তার নিজেরও যে অন্য কোনো উপায় ছিল না! সেটা বুঝিয়ে বলার সময় এখনই। অনেক ভেবেছে সে। অনেক চেষ্টা করেছে নিজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার। কিন্তু সবাই তার দিকে শুধু আঙুল-ই তুলছে। কেউ তার অসহায়ত্ব বুঝতে চাইছে না! কেউ জানতেও চায় না তার এমন কাজের পেছনের কারণ! সবার চোখে আজ সে প্রতারক!! সুতরাং তাকে এবার মুখ খুলতেই হবে।

৩৭.
অরুণী ওর বাবার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। এই কয়েক দিনে চিন্তা করতে করতে আরমান সাহেবের চোখ দুটো কোটরে ঢুকেই গেছে একদম। দেখে বোঝা-ই যাচ্ছে, বহুদিন যাবৎ চোখের দুই পাতা একত্রিত করেন না তিনি। চিন্তা, ভীতি, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছে তার মস্তিষ্ক জুড়ে। আরমান সাহেবের ভীতিটা-ই আসলে সত্যি- এটা জানতে পারলে তিনি ঠিক কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, সেটাই ভাবছে অরুণী।

আরমান সাহেব অরুণীর দিকে তাকালেন। চোখের চারপাশে পড়া গাঢ় কালচে দাগটা ওর শুভ্র মুখটায় অতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। তার মেয়েটা আর স্বাভাবিক নেই! তিনিই ওকে অস্বাভাবিক তৈরি করেছেন যদিও! এটার প্রয়োজনীয়তা ছিল অবশ্যই।

আরমান সাহেব সকল ভাবনা কিছু সময়ের জন্য মাথা থেকে দূরে সরালেন। অরুণীর এগিয়ে দেওয়া বড় খামটা হাতে নিয়ে সেটা খুললেন। বেশ কয়েকটা কাগজসহ তরীর দুটো ছবিও বেরিয়ে এলো। ছবি দুটো আড়াল থেকে তোলা হয়েছে, কিন্তু তরীর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আরমান সাহেব ছবি দুটো হাতে নিলেন। ছবিটায় চোখ রাখতেই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। হাতটার অনবরত কম্পন অরুণীর চোখ এড়ালো না। সে অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললো,

“কী হলো, বাবা? অবাক হলে? নাকি ভয় পেয়েছো? এভাবে কাঁপছ কেন?”

আরমান সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। বিস্ময় ঘেরা দৃষ্টি বজায় রেখে থেমে থেমে বললেন,

“এটা… এটা কীভাবে সম্ভব? এই মেয়েটা সৌহার্দ্যের বউ কীভাবে? তুই নিশ্চিত যে, সৌহার্দ্য ওকেই বিয়ে করেছে?”

“হ্যাঁ, এটাই সেই মেয়ে! অবাক হয়েছো দেখে?”

“কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের এতো মিল কীভাবে থাকতে পারে? এটা কাকতালীয় হওয়া কি আদৌ সম্ভব?”

“কাকতালীয় কিছু নয়! পেপার্স গুলো দেখো ভালো করে। তাহলেই সবটা তোমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”

অরুণীর মুখে হাসি, আর আরমান সাহেবের মুখে ভয়। অরুণীর এতো আনন্দের কারণটা আরমান সাহেব বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি কাগজগুলোর দিকে তাকালেন। এগুলো তরীর অফিশিয়াল কাগজপত্র! তরীর বিভিন্ন পরীক্ষার সার্টিফিকেট গুলো এখানে একত্রিত করা হয়েছে। সেদিন অরুণীকে দেখে তরীর সেন্সলেস হয়ে যাওয়াটা অরুণীর মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে। সেই সন্দেহ আরমান সাহেবকে জানানোর পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন তরীর ব্যাপারে সব তথ্য সংগ্রহ করার। এরপর অরুণী-ই এতোদিনে বহু চেষ্টা চালিয়ে সঠিক কাগজপত্র সংগ্রহ করে আরমান সাহেবের সামনে নিয়ে এসেছে।

তরীর ছবিসহ একটা কাগজের ওপর আরমান সাহেবের চোখ আটকে গেল। ছবিটার পাশে স্পষ্ট ভাবে লিখা আছে “অরিত্রী সেহরীশ”। আরমান সাহেবের মাথা ভনভন করে উঠলো যেন। এই মেয়েটার মুখ একদম তার স্ত্রী মালিহার মতো! ওর নাম জেনে আরমান সাহেব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, এটাই তার ছোট মেয়ে। তার মেয়ে আজও পৃথিবীর মাটিতে জী*বিত আছে। সে এখনো মারা যায়নি!

অরুণী নিজের বাবার মাথায় হাত রাখলো। বললো, “অরুণী সেহরীশ-এর বোন অরিত্রী সেহরীশ! মেয়েটা বেঁচে আছে, বাবা! ও সবসময়-ই জিতে এসেছে। আজও সবার অজান্তেই ও জিতে গেল। আমার জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করে ফেললো মেয়েটা। আচ্ছা, ও কি আমাকে নিঃস্ব করার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে?”

অরুণী আবারও হাসলো। আজ সেই হাসি দেখে আরমান সাহেব চিন্তিত হলেন না। অরুণীর অস্বাভাবিক আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে না! যেই আশংঙ্কা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, সেটা যে আজ সত্যি হয়ে গেল। এখন অরুণী-ই হতে পারে তার একমাত্র অ*স্ত্র!

আরমান সাহেব রহস্যময় হাসি দিলেন। তরীর ছবিটা মুখের সামনে তুলে ধরলেন। তার হাসি আরও গাঢ় হলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সব কাগজের নিচে একটা কালো কাগজের প্রান্তভাগ দেখে অবাক হলেন আরমান সাহেব। ভ্রু কুঁচকে সেই কাগজটা নিজের হাতে নিলেন। কাগজের লেখাটা পড়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো আরমান সাহেবের। সেখানে লেখা আছে,

“আমার অজান্তেই আমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া সম্ভব নয়, মিস্টার আরমান। আমি চেয়েছি বলেই আপনি জানতে পারলেন আমার আসল পরিচয়! কিন্তু জেনে অনেক বড় ভুল করে ফেললেন। নিজের আয়ুকে আরও কমিয়ে আনলেন। সেদিনটা আমি ভুলিনি যেদিন আমার মায়ের র*ক্তে নিজের হাত ভি’জি’য়ে আপনি পৈ*শা*চি*ক হাসি হেসেছিলেন। সেদিন আপনার মেয়েকে আপনি নিজে ক*ব*র দিয়েছিলেন ঠিকই! আর সেখানে মৃত্যু ঘটেছিল সেই ভীতু অরিত্রীর। কিন্তু সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে আজকের প্র*তি*শো*ধ কাম্য তরী। সে আজও বেঁচে আছে তার মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য। আপনার অপরাধের শেষ নেই। আপনি আমার মাকে পু*ড়ি*য়ে দিয়েছিলেন! সেই দ*হ*নে আজও আমার মা ছ*ট*ফ*ট করছে। আমি সেটা দেখতে পাই। সেই মায়ের ভেতরে জ্ব*ল*তে থাকা আগুন আপনার র*ক্ত দিয়ে নেভাবো আমি!

~তরী”

-চলবে….

(সবার মন্তব্য প্রত্যাশিত! ভালোবাসা♥️)

All part
https://www.facebook.com/groups/272194598259955/permalink/491050573041022/?app=fbl

Our group link join plz
👇👇
https://www.facebook.com/groups/272194598259955/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here