প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা #Writer_Mahfuza_Akter পর্ব-০৭

0
350

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৭

অবসন্নতা ঘেরা সন্ধ্যা। তরী জানালার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে দেখছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য। মাঝে মাঝে তার নিজেরই পাখি হতে ইচ্ছে করে। তাহলে তো আজকে তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না! জীবনে এতো শূন্যতা অনুভব করতে হতো না। নিজের মধ্যে এক বুক কষ্ট থাকলেও সেটা মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে দিতে পারতো সে। উড়ে যেত, হারিয়ে যেত বহুদূর! যেখানে কোনো কষ্ট-ই তাকে ছুঁতে পারবে না। সেখানে চলে যেত, যেখনা প্রিয়রা হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে।

হর্ণের শব্দে চমকে ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে এলো তরী। গেইট দিয়ে সৌহার্দ্যের গাড়ি ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। আজ হঠাৎ এতো দেরি করে এসেছে কেন সৌহার্দ্য? মিস্টার রায়হানের অসুস্থতার একমাস প্রতিদিন সৌহার্দ্যকে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখেছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত বাবার পাশে বসে থাকতো সে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঘর থেকে প্রায়ই বের হতে দেখে সে সৌহার্দ্যকে। বাবা-মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ আগে কখনো কারো মধ্যে দেখেনি তরী।

জ্ঞান ফেরার পর মিস্টার রায়হান কথা বলতে পেরেছিলেন প্রায় দু সপ্তাহ পর! যেদিন তিনি প্রথম কথা বলেছিলেন, সেদিন সৌহার্দ্যের হাত আঁকড়ে ধরে অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলেন,

-“বাবাকে এতো ভালোবাসিস! এতো শ্রদ্ধা করিস! অথচ এতোটুকু ভরসা রাখতে পারিসনি আমার ওপর? তোর জন্য আমি সঠিক সিদ্ধান্তটা-ই নিয়েছি, সৌহার্দ্য! তরীর সব যোগ্যতা আছে তোর পাশে দাঁড়ানোর।”

তরী চোখ বড় বড় করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মিস্টার রায়হানের দিকে সেদিন। সৌহার্দ্য একবার তরীর দিকে একপলক তাকিয়ে আবার বাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল শুধু। তরীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে এটাই বলে যে, সৌহার্দ্য ওকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না। ওর সাথে সংসার করা তো দূরের কথা!

সৌহার্দ্য বাড়িতে প্রবেশ করলো তার দাদীকে নিয়ে। বৃদ্ধ বয়সে অহেতুক চিন্তা করবেন বলে তাকে মিস্টার রায়হানের অসুস্থতার খবর জানানো হয়নি। কিন্তু গতরাতে সুজাতা হঠাৎ মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছে ফোনে কথা বলার সময়। সেই থেকে দাদী গোঁ ধরে বসে আছেন ছেলেকে দেখার। কান্নাকাটির ঝামেলায় বিরক্ত হয়ে সৌহার্দ্য আজ গ্রামে গিয়ে নিয়ে এসেছে দাদীকে।

সৌহার্দ্যের দাদী বাড়িতে প্রবেশ করেই ছেলেকে এক পলক দেখে এলেন। এরপর সুজাতার ওপর চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন,

-“কী গো, বউমা! তোমার থেইকা এইটা আশা করি নাই আমি। আমার ছেলের অসুখ, শয্যাশায়ী অবস্থা, এইটা তুমি আমারে জানানোর প্রয়োজন মনে করলা না? তোমার সংসারে কখনো নাক গলাইতে আসি নাই আমি। তাই বইলা আমার ছেলের ভালোমন্দের খবরও আমারে দিবা না?”

সুজাতা বরাবরই স্পষ্টভাষী। সে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো,

-“আপনি অযথা চিন্তা করবেন ভেবেই দেইনি। এমনিতেই শরীরের অবস্থা ভালো না আপনার। আর আমার সংসারে নাক গলানোর কথা বলছেন? আমি তো সবসময়ই আপনাকে বলি গ্রামছেড়ে আমার বাড়িতে চলে আসতে। আপনিই তো শহরে থাকতে পারেন না।”

দাদী খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে এলেন। সোফায় বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন,

-“নাহ্! এখন থেইকা এই খানেই থাকবো। আমি বুইঝা গেছি, তুমি আমারে কোনো কথাই কইতে চাও না। আমার ছেলেটা ম*রে গেলেও দেখা যাইবো আমারে কিছু জানাও নাই। সেইটা হইতে দেওন যাইবো না। আসলে সত্যি কথা কী জানো? পর সবসময় পর-ই থাকে। পরের বাড়ি থেকে বউ হয়ে আসা মেয়েমানুষ তো পর-ই হইবো।”

সুজাতা চোখ বন্ধ করে কথাটা হজম করে নিলেন। এসব কথা অনেক শুনেছেন তিনি নিজের জীবনে। তাই অনেকটা সয়ে গেছে। কিন্তু আজ খুব করে উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে,

-“আপনিও তো পরের বাড়ি থেকেই বউ হয়ে এসেছেন। আপনি তাহলে আপন হলেন কী করে?”

কিন্তু কথায় কথা বাড়ে। এখন তর্কাতর্কি করার মানসিকতা নেই সুজাতার। মাথা ঠান্ডা করে সৌহার্দ্যকে বললেন,

-“তরী তোর বাবাকে বিকেলের ওষুধ খাওয়াতে দিলো না। আজকে চেকআপ করিয়ে নতুন ওষুধ দিবি বলে মেডিসিন অফ রেখেছে আজ।”

সৌহার্দ্যের দাদী ভ্রু কুঁচকালো। জহুরি নজরে তাকিয়ে বললো,

-“তরী? এইটা কে রে?”

সুজাতা আর সৌহার্দ্য দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। সৌহার্দ্য নিজের মায়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,

-“সব কথা মুখ ফসকে বের হয়ে যেতে হবে তোমার? একটা কথাও কি পেটে রাখা যায় না? এবার কী হবে ভাবতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে!”

সুজাতা ভীত মুখশ্রী বানিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। তরীর কথা জেনে গেলে ইনি ভ*য়ং*ক*র কোনো ঘটনা না ঘটালেই হয়!

-“কী রে? চুপ করে আছিস কেন তোরা? বল! তরী কে? কাজের লোক?”

‘কাজের লোক’ কথাটা সৌহার্দ্যের পছন্দ হলো না কেন যেন! তাই সব ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে সত্যটা-ই বলে দিলো,

-“তরী তোমার নাত-বৌ, দাদী!”

-“কীহ্?”

বসা থেকে ঝড়ের বেগে উঠে দাঁড়ালেন সৌহার্দ্যের দাদী। গর্জে উঠে বললেন,

-“কী বললি? তুই বিয়ে করছোস? তই আমারে না জানাইয়া বিয়ে করছোস? তুই-ও তোর মায়ের মতো আমারে পর কইরা দিলি রে! তোর মা তোদের বাপ-ছেলেরে কী জাদু করছে, আমি বুঝতে পারছি না। একটা বিয়ে হয়ে গেল, আর আমারে কেউ জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?”

-“দাদী, তুমি যেমন ভাবছো, তেমন কিছু না। তরীর সাথে তো বিয়েটা হ…..”

সৌহার্দ্যকে বর্ণনা করার কোনো সুযোগ-ই দিলেন না ওর দাদী। হুকুমের সুরে বললেন,

-“এখনি তোর বউরে আমার সামনে আন। এখনি আন। আজ সবকিছুর একটা বিহিত না করলেই নয়!”

সুজাতা ঢোক গিললেন। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। তার শাশুড়ীকে তিনি ভালো করে চেনেন। এতো বছরে অনেক ক্ষো*ভ জমেছে তার মনে। আজ তরীর ওপর সেগুলো না ঢাললেই নয়!

চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে তরী ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সৌহার্দ্যের দাদী তরীকে এখনো খেয়াল করেননি। তিনি আবারও চেচিয়ে উঠে বললেন,

-“আমার কথা কানে যায় না তোদের? নাকি আমার কথার কোনো দাম….”

বলতে বলতে ঘুরে তাকাতেই কথা আটকে গেল তার! তরীর মুখের ওপর দৃষ্টি আঁটকে গেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তরীর মুখের দিকে।

সৌহার্দ্য আর সুজাতার কপালে চিন্তার ভাজ। দাদী এমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কেন? তার তো এখনি তেড়ে যাওয়ার কথা তরীর দিকে? নাকি ঝড়ের আগে যেই শান্ত পরিবেশ বিরাজ করে, তারই একটা লক্ষন এটা?

সৌহার্দ্যের দাদী তরীর দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে গেলেন। নুয়ে যাওয়া দেহটাকে সোজা করার চেষ্টা করে মুখটা উপরে তুলে তরীর কাছাকাছি দাঁড়ালেন। তরী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার চোখভর্তি পানিগুলো! একি! ইনি কাঁদছেন কেন? তরী বিস্ময়কে আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্যের দাদী তরীর সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-“এই চেহারার আদল যে আমার বড্ড চেনা! সেই চেনা চোখ, চেনা মুখ, চেনা চাহনি। এটা কী করে সম্ভব? আমি যে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না! ”

এমন লথা শুনে তরী, সুজাতা আর সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দাদীর দিকে।

১৫.
মধ্যদুপুরের গরমে ত্যা’ক্ত-বিরক্ত রাস্তা-ঘাটের মানুষজন। মধু চিন্তিত ভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর কালকের ব্যাপারটা মনে করছে। ছেলেটার নাম অভীক শাহরিয়ার কীভাবে হয়? আর সে তরীকে নিয়ে ওর কাছে কেন জানতে চাইলো? সবচেয়ে বড় কথা, সে মধুকে কীভাবে চেনে?

গতরাতে….

-“আপনাকে আমি কোথায় দেখেছি বলুন তো!”

প্রহর মুখ চওড়া করে হাসলো। বললো,

-“দেখেছিলে, সেদিন সন্ধ্যায়! তোমার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হলো যে! আর…”

-“ওহ্! কালো চশমা? হ্যাঁ, হ্যাঁ! মনে পড়েছে। কিন্তু আপনার মতলব কী বলুন তো? আমার সাথে দেখা করতে কেন এসেছেন?”

-“তোমায় আমার সাথে একটা এগ্রিমেন্টে যেতে হবে।”

-“এগ্রিমেন্ট? কীসের?”

-“তোমার পরিচিত একটা মেয়ে। নাম হলো তরী। ওর সাথে রিলেটেড ব্যাপারটা। আর তোমাকে কাজটা করতেই হবে!”

কথাগুলো এখনো কানে বাজছে ওর। কাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি মধু। প্রহরের কথা অনুযায়ী কাজ করতেই হবে। এর বাইরে আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু মধু তো একটা অসহায় মেয়ে। ওর সাথে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করাটা কি ঠিক হবে?

-চলবে…..

(কাল রাত আটটার দিকে গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো। সব রহস্যের সমাধান আসবে সঠিক সময়ে। সবার মন্তব্য প্রত্যাশিত 🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here