#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২
‘আম্মু, তুমি আমার সঙ্গে কিন্তু জোরজবরদস্তি করছো। মেয়েটা আমার ছাত্রী, কিভাবে আমি তাকে বিয়ে করবো? আমার রিপোটেশনের প্রশ্ন এখানে, আম্মু।’
শুভ্রর মা আরাম করে পান সোফায় বসে পান বানালেন। তারপর একটা পান নিজে খেয়ে আরেক পান শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘পান খাবি শুভ্র? এটা খাসিয়া পান। খুব তেজ। তোর মাথা ঠান্ডা হবে।’
শুভ্র একদম হতবম্ব। চোখ বড়বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘অসম্ভব, আম্মু। তুমি এই মুহূর্তে, আমার জীবন মরণ প্রশ্নে আমাকে পান সাধতেছো? রিডিকিউলাস।’
শুভ্রর মা আফরোজা বেগম হালকা শব্দে হাসেন। হাত দিয়ে সোফায় তার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন ছেলেকে,
‘রাগ করিস না, আয় আমার পাশে এসে বস। কতদিন তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেইনা। আয় আমার কোলে মাথাটা রাখ।’
শুভ্র মায়ের এক কথায় দরদর করে গলে গেলো। তবুও মুখ ফুলিয়ে থাকলো। আশেপাশে চেয়ে চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রেখে সোফায় দু পা তুলে একদম শুয়ে পড়লো। আফরোজা ছেলের চুলে হাত বুলান। কপালও টিপে দেন। তারপর চুল টেনে দিতে দিতে বলেন,
‘আগে শুনতাম ডাক্তার হলে মাথায় চুল থাকে না, সব ঝরে পরে। শুধু পড়াশোনা থাকে সেখানে। কিম্তু তোর বেলায় ব্যাপারটা উল্টো হলো কেন শুভ্র? চুল তো সেই আগের মতোই।’
শুভ্র মায়ের কথা শুনে অলক্ষ্যে হাসলো। তারপর আবারও মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘তুমি কিম্তু কথা ঘুরাচ্ছ আম্মু। আমার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছিলো।’
আফরোজা বেগম এবার কিছুটা গম্ভীর হলেন। ছেলের কপালে আদুরে হাত বুলিয়ে দেওয়া এবার ক্ষয়ে এলো। তিনি সামনে তাকালেন। বড্ড আনমনা হয়ে বললেন,
‘তুলির মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা স্রেফ বন্ধুত্ব ছিলো না, শুভ্র। এর চেয়েও বেশি কিছু ছিলো, সেটা আমি বুঝতে পারলাম আমার বিয়ের পরে।আমাদের লুকিয়ে বিয়ে ছিলো। ভেবেছিলাম দুজন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর নিজেদের পরিবারকে জানাবো। তবে সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তুই বিয়ের পরপরই আমার পেটে আসিস। আমি তখন ঘাবড়ে গেছিলাম শুভ্র। কোথায় যাব, কাকে বলবো। বাবা মায়ের সম্মান, সমাজ সবকিছু কেমন বাঘের ন্যায় তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল আমায়। তোর বাবা তখন সবে ছাত্র মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুবাধে ওই গুটিকয়েক টিউশনি হাতে ছিলো। তবে সেটার অর্ধেক তোর বাবার দিতে হত তার গ্রামে। আর বাকি অর্ধেক নিজের জন্যে। ঠিক এমন একটা অবস্থায় আমরা দুজন সেইসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, বাচ্চাটা আমরা রাখবো। নিজেদের স্বার্থে আমরা তোকে মেরে ফেলতে পারিনি শুভ্র। তারপর এর কাহিনি খুব মারাত্মক ছিলো। তোর নানু জেনে জান আমার প্রেগন্যান্সির কথা। তারপর ধীরে ধীরে গোটা পরিবার জেনে যায়, তোর মা একজন কলঙ্কিনী। সেসময়টা আমার উপর দিয়ে কী গেছে আমি তোকে বোঝাতে পারবো না শুভ্র। আমাদের বিয়ের কথা একমাত্র তুলির মা ইয়াসমিন জানত। তাঁকে এটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় সে বলে দে, বাচ্চাটা ওমরের। তুই তো জানিসই, আগে তোর বাবাদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। ওদের পরিবার নুন আন্তে পান্তা ফুরায় এমন ছিল। আমাদের পরিবার তখনকার সময় বেশ সচ্ছল, প্রভাবশালী। তোর নানা আমাকে ছোট জাতের সঙ্গে সংসার করতে দেবেন না। তোর বাবাকে ছাড়ার জন্যে আমার উপর অনেক অ ত্যা চার করা হতো প্রতিদিন। বাচ্চা নষ্ট করার পেছনে সবাই যেন হাত ধুয়ে পরে ছিলো। একদিন আমার অবস্থা দেখে তোর বাবাও কেঁদে উঠে বলে, তাকে নাকি আমার এখন ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমরা নাকি একজন আরেকজনের জন্যে তৈরিই না।এ কথাটা আমার কী যে গায়ে লাগল শুভ্র। তাৎক্ষনিক আমি শুধুমাত্র আমার কাগজপত্র, সার্টিফিকেট নিয়ে পালিয়ে আসি তোর নানার বাসা থেকে। উঠি সোজা তোর বাবার মেসে। তোর বাবা মেসে একা থাকতেন, কিন্তু ছেলেদের মেসে আমাকে দেখে তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন। সব শোনার পর সে দিশেহারা। তবুও মানুষটা আমার হাত ছাড়েনি। শক্ত করে ওই হাত চেপে ধরে মেস থেকে বেরিয়ে আসে। আমরা এক রুমের বাসা নেই। আর্থিক অবস্থার দিকে আমাদের অবস্থান ছিলো খুবই শোচনীয়। কত বেলা প্রায়ই না খেয়ে থাকতাম। তখন তুলির বাবা আমাদের দুজনরের জন্যেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।আমি রান্না করতে পারতাম না। রান্নার গন্ধ শুনলেই বমি করতাম। তাই তুই হওয়া অব্দি ইয়াসমিন প্রতিদিন আমাকে রেঁধে পাঠাত। তুই হওয়া থেকে শুরু করে আজকে এই অবস্থানে আমরা আছি, সবকিছুর পেছনে ইয়াসমিন আর ইয়াসমিনের স্বামী ইয়াজিদ ভাইয়ের। এক সত্যিকারের বন্ধুর মতো আমাদের আগলে রেখেছিল তারা, জীবনের বিপরীতমুখী স্রোতে আমাদের পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ তোর বাবা নেই। তবুও ইয়াজিদ ভাই তোকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন। কিন্তু ওদের ট্রান্সফার হওয়ার পর আমাদের তেমন দেখাসাক্ষাৎ হতো না। ইয়াজিদ ভাই বিদেশ চলে যাবার পর ইয়াসমিন নিজেও বাচ্চা সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর আমি তোর বাবা মারা যাওয়ার পর একদম ঘরবন্দী হয়ে গেছিলাম। আজ এতবছর পর এমন এক সুযোগ পেয়ে, আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছি না। আমাদের জীবনের উপর ওদের প্রতিদান হয়তো আমি দিতে পারবো না। কিন্তু ইয়াসমিনের ওই মেয়েকে আমি আমার ঘরে বউ করে এনে মেয়ে হিসেবে রাখতে চাই। এটুকু আল্লাহ আমাকে করার সাধ্য দিয়েছেন। নাহলে আজ তোর বাবা আর আমি পথে-‘
আফরোজা আর বাকি কথা শেষ করতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। শুভ্রর চোখে জল। মায়ের দুঃখ সে কখনোই জানত না। মা তার ভীষণ চাপা স্বভাবের। আজ এত কথা শুনে শুভ্রর কষ্টে বুকটা কেমন যেন জ্বালা করছে। মায়ের দুঃখ গুলো তো সে শুষে নিতে পারবে না।তারচেয়ে বরং কমানোরই একটা চেষ্টা করুক। শুভ্র মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। মাকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। একপর্যায়ে খুব নরম স্বরে বললো,
‘তোমার ঋণ আমি শোধ করবো আম্মু। চাই যাই হয়ে যাক। কেদো না। আরে কান্না থামাও না। এত কাঁদতে আছে? কথায় কথায় আজকাল শুধু কাঁদো।হয়েছে, থামো!’
______________________
শুভ্র মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে বিছানার উপর। মাকে সে কথা দিয়েছে তুলির সঙ্গে একটা সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করবে সে। কিন্তু কিভাবে করবে? লজ্জা লাগছে শুভ্রর। ব্যাপরটা এত অস্বস্তিকর। জীবনেও শুভ্র চিন্তা করেনি, এমন একটা পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হতে পারে। শুভ্র ফোন হাতে নিয়েও বারবার রেখে দিচ্ছে। তারপর মায়ের কান্না ভেজা মুখ চোখে ভাসলে আবার ফোন হাতে নিচ্ছে। একপর্যায়ে শুভ্র নিজেকে শক্ত করলো। কল দিল তুলির নাম্বারে। রিং হলো অনেকক্ষণ। ওপাশ থেকে কল রিসিভও হলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে কেউ বলল,
‘হ্যালো, কে?’
শুভ্রর হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। অত্যন্ত নার্ভাস ফিল করছে সে। শুভ্র গলা পরিষ্কার করে শুভ্র বললো,
‘ঘুমাচ্ছিলে?পরে কল করবো তাহলে?’
শুভ্রর গলার আওয়াজ মুহূর্তেই চিনে ফেললো তুলি। ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘স্যার আপনি? কোন দরকার? এত রাতে?’
শুভ্র হালকা হাসল। মেয়েটা এত প্রশ্ন করে! শুভ্র গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘কালকে তো ভাইভা। প্রিপারেশন কেমন?’
তুলি অবাক হলো। স্যার ফোন করে ভাইবার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? তুলি কিছুটা মিনমিন করে বলল,
‘আজ পড়তে পারিনি তেমন স্যার।’
শুভ্র প্রশ্ন করল,
‘কেন? ফাঁকি দিচ্ছো?’
তুলি তাৎক্ষণিক শুভ্রকে শুধরে দিয়ে বলল,
‘না না স্যার। আজকে তো আমাদের বাড়িতে আত্মীয়রা এসেছিলেন।তাই বাসায় অনেক ভিড় ছিলো। তবুও যতটুকু কভার করা যায় করেছি আমি। সত্যি!’
‘আত্মীয় কেন?’
তুলি এবার থেমে গেলো। ইস, পরিস্থিতিতে এমন অদ্ভুত কেন? তুলির মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে ধরনি গহ্বরে। তার সঙ্গে শুভ্র স্যার। ভাবলেই গা-টা যেমন শিরশির করছে। শুভ্র আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘বললে না কেন?’
তুলি থামল। কিছুক্ষণ পর ইতি অতি চেয়ে ধরা গলায় বলল,
‘ওই-আমাদের-বিয়ের কথা হয়েছে আজ বাসায়।’
#চলবে
এই পর্বে ৮০০ রিয়েক্ট এলে নেক্সট পর্ব আগামিকালই দেব। দেখি আসে কী না। কেমন লেগেছে জানাবেন।বড়বড় মন্তব্য চাই কিন্তু। ভালো থাকবেন।