#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৮১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
হলুদিয়া সজ্জায় সেজে উঠেছে কমিউনিটি সেন্টার। ইতিমধ্যেই সকলে কাঙ্ক্ষিত স্থানে চলে এসেছে। অর্পণ এবং ইরার পুরো পরিবারের সকলেই উপস্থিত৷ ফটোসেশান শুরু হয়েছে অর্পণ ইরা স্টেজে আসার সঙ্গে সঙ্গেই। অর্পণের পুরো কাজিনমহল ছবি তোলায় ব্যস্ত। গায়ে হলুদের আয়োজন কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে যাবে। প্রলয় এখনো এসে পৌঁছায়নি। সকলে তারই জন্য অপেক্ষা করছে। তারউপর মৃত্তিকা এখনো আসেনি। অর্পণও তার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তখন কল করেছিল কিন্তু মৃত্তিকা জানিয়েছে সে সবে রওনা দিয়েছে৷ পৌঁছাতে কিছুক্ষণ সময় লাগতে পারে। গায়ে হলুদ দেওয়া যাতে শুরু করে দেয়।
“ভালো আছেন তো? কাল ব্যস্ততার জন্য বিয়াইনকে আলাদা ভাবে আপ্যায়ন করতে পারলাম না৷”
তৃপ্তি এবার আরশকে আপাদমস্তক দেখল৷ হলুদ রঙা পাঞ্জাবি পড়েছে। তার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথাগুলো বলছিল৷ তৃপ্তিও সৌজন্যপূর্ণ হেসে বলল‚ “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷”
“আপনাকে কিন্তু হলুদ শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে।”
“ফ্লার্ট করছেন বুঝি!”
“এ বাবা আপনার কী তাই মনে হলো?”
“হুম! সেটাই তো মনে হচ্ছে।”
“মোটেও না। আপনাকে সত্যিই দারুণ লাগছে।”
এরই মাঝে আরশের ডাক পড়ল। শাহাদাৎ মোড়ল ডাকছেন তাকে। আরশ বিরক্ত হলো কিছুটা৷ সবে তৃপ্তিকে পটানোর চেষ্টা করছিল৷ বয়স হচ্ছে তো। তারও উচিত এবার বিয়ে করে নেওয়া৷ সমবয়সী সবগুলোই বিয়ে করে নিয়েছে। এতদিন অর্পণটা সিঙ্গেল ছিল। এখনো তারও একটা হিল্লে হয়ে যাচ্ছে৷ বাকি পড়ে রয়েছে শুধু সে৷ কিন্তু তার বাবা তা হতে দিলে তো? সেই তার পরিশ্রমে জল ঢেলে দিলেনই। আরশ বিরক্ত কাঁদো কাঁদো গলায় বলল‚
“আচ্ছা বিয়াইন— পরে কথা হচ্ছে।”
হাসি মুখে তৃপ্তি বলল‚ “হুম!”
আরশ চলে গেল৷ তৃপ্তি এবার গাল এলিয়ে হেসে উঠল। সে বুঝতে পেরেছে আরশ তাকে পটানোর চেষ্টা করছিল৷ কারণ বিয়ে বাড়িতে তো এমনটা হরহামেশাই হয়ে থাকে। বিষয়টা স্বাভাবিক নয় কী? তৃপ্তি চলে গেল পূর্ণতা পুষ্পিতার কাছে। তার একটা টেবিলের চেয়ারে গোল হয়ে বসে রয়েছে৷ লাম আর লামিয়াও রয়েছে। তৃপ্তি গিয়ে বসল পূর্ণতার পাশে৷
“কোথায় গিয়েছিলে আপু?”
“এখানেই ছিলাম। ডেকোরেশন বেশ ভালো হয়েছে তাইনা?”
“হ্যাঁ! এক কথায় দারুণ।”
পুষ্পিতা বলে উঠল‚ “গ্রুপ সেলফি তুলব না আমরা?”
সকলে একসঙ্গে বলে উঠল‚ “অবশ্যই।”
ওরা গ্রুপ সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্পণ আর ইরা সেই আগের ভঙ্গিতে স্টেজে বসে ফটোশুট চলছে। এরই মাঝে চলে এলো প্রলয়। সে একটা কাজে বের হয়েছিল৷ ভাইয়ের বিয়ে বলে তো আর নিজের কাজ ফেলে রাখতে পারে না। সবকিছুর উর্ধ্বে হচ্ছে তার রাজনীতি। ইদানীং রাজনীতি থেকে পিছু হটে যাচ্ছে সে। যেই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তার স্বপ্ন ছিল এখন তার প্রতি বেড়েছে দূরত্ব। তবে প্রলয় আর কোনো দূরত্বকে নিজের প্রিয় জিনিসগুলোর দিকে ঝুকতে দেবে না। প্রলয়কে পেয়ে অর্পণ খুশি হয়ে গেল৷ নিজে ফোন থেকে মৃত্তিকার নাম্বারে আবার কল লাগাল। এটা জানার জন্য যে‚ তারা এখন কোথায় আছে! তবে কল করে যে জানতে পারল মৃত্তিকারা প্রায় চলে এসেছে আর মিনিট পাঁচেক সময় লাগতে পারে৷
কেটে গেল আর বিশ মিনিট…
অর্পণ আর ইরাকে হলুদ লাগানো শুরু করা হয়েছে৷ মাধুরী খুব তাড়া দিচ্ছিলেন। এখন তো সবে রাত নয়টা বাজছে৷ এখনো অনেক আয়োজনের বাকি রয়েছে। ছেলে মেয়ে গুলো নাচের রিহার্সাল করেছে অর্পণের বিয়েতে নাচবে বলে৷ তার হলুদ দেওয়ার কাজটা আগেই সেরে রেখেছেন৷ অর্পণ যখন দেখল তার বোন চলে এসেছে তখন ইরাকে ইশারায় বলল মৃত্তিকাকে যেন স্টেজ ডেকে নিয়ে আসা হয়৷ ইরাও সেটাই করল। সে তার একজ বান্ধবীকে দিয়ে মৃত্তিকার কাছে পাঠাল। তনুজাকে নিয়ে স্টেজের কাছে গেল মৃত্তিকা৷ তাকে দেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে প্রলয়। আজ অন্য রূপে দেখছে সে তার ভূমি কন্যাকে। ধরিত্রীতে যেন হলুদিয়া পরী নেমে এসেছে৷ যার সর্বাঙ্গে নেই কোন সাজ আর নেই কোনো ভূষণ। এতেই যেন ভূমি কন্যাকে মারাত্মক সুন্দর দেখাচ্ছে৷ মৃত্তিকা আর তনুজা গেলে অর্পণ আর ইরাকে হলুদ লাগাতে।
মৃত্তিকা আর তনুজা স্টেজ থেকে নিচে নামলেন। তনুজা চলে গেলেন হাত পরিষ্কার করতে৷ উনার হাতে অনেকটা হলুদ লেগেছে৷ এটা মুছে না নিলে শাড়িতে লেগে যেতে পারে৷ এদিকে মাধুরী এসে মৃত্তিকা হাত ধরে টেনে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললে‚
“তুমি বেঁচে আছ? তাহলে এতদিন কেন আমাদের বাড়িতে ফিরে এলে না কেন? তোমার জন্য আমার ছেলেটা গুমরে গুমরে ম’রছে৷”
আশেপাশের কয়েকজনের দৃষ্টি এখন মৃত্তিকা আর মাধুরীর দিকে৷ মহিলাদের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে৷ ফিরোজাও এগিয়ে এলেন। মৃত্তিকাকে দেখে তিনিও বেশ অবাক হলেন। খুশি হয়ে কাছে টেনে নিলেন। কিছু সময়ের জন্য চুপ করে থাকলেও এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না মৃত্তিকা। ফিরোজাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে আর মাধুরীর হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে সে বলল‚
“আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আমি বুঝতে পারছি না সবার কেন একই ভুল হচ্ছে? প্রত্যেককে বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত। সত্যিই আমি ক্লান্ত!”
ফিরোজা বললেন‚ “আমাদের প্রতি বুঝি খুব অভিমান জমেছে?”
“আপনারা কীসব কথা বলছেন? আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে! কারা আপনারা?”
এমন হেয়ালি পছন্দ হলো না মাধুরীর। তিনি বললেন‚ “ভূমি এবার একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
“প্লিজ আমাকে ভূমি বলে ডাকবেন না। কতবার করে বলছি আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে— বুঝতেই চাইছেন না! দিস ইজ টু মাচ!”
প্রলয় এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মৃত্তিকার দিকে৷ তার ভূমি কন্যার এক অন্য রূপ দেখছে সে৷ সেই শান্ত মেয়েটার মাঝে আজ আকাশ পাতাল তফাৎ৷ দুজনের মাঝে ভিন্নতার দেয়াল আকাশসম৷ আগের সেই ভূমি কন্যাকে মৃত্তিকার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রলয় এগিয়ে তার মায়ের পাশে দাঁড়াল৷ তাকে দেখতে পেয়ে মৃত্তিকা বলল‚
“অহ এই যে এমপি সাহেব ওরফে মি. সেহরিশ আরশান প্রলয় প্লিজ বোঝান আপনার ফ্যামিলিকে। নাকি আপনার পুরো ফ্যামিলিই এমন? জনে জনে এসে মানুষকে বিরক্ত করা বুঝি আপনার ফ্যামিলির স্বভাব? দেয়ার শুড বি অ্যা লিমিট টু টলারেন্স!”
মৃত্তিকার এতগুলো কথাতেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না প্রলয়৷ চুপটি করে বুকে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মৃত্তিকাকে এতগুলো কথা বলতে দেখে মাধুরী তেতে উঠে বললেন‚ “তোমার সাহস কী করে হয়ে এত গুলো কথা বলার?”
“এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না আন্টি। প্লিজ এন্ড দিস ম্যাটার!”
“হাঁটু বয়সী মেয়ের কত দেমাক!”
“আপনি আপনার লিমিট ক্রস করছেন আন্টি৷ শুধু শুধু এভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার কোনো মানেই হয় না৷”
“বড়োদের সঙ্গে তর্ক করাই বুঝি তোমাকে তোমার মা শিখিয়েছেন?”
তনুজা এসে দেখলেন মৃত্তিকার সঙ্গে কারো ঝামেলা লেগে গিয়েছে। তিনি গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। এবার স্টেজ থেকে নেমে এলো অর্পণ আর ইরা৷ অর্পণের তো মাথায় হাত৷ কোথায় সে ভাবল মৃত্তিকা আর প্রলয়কে আবার এক করবে কিছু হচ্ছে সবই উল্টো। এরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে৷ বউ শাশুড়ীর লড়াই চলছে। এখানে কেউ কারো থেকে কম যায় না৷ মাধুরীকে উদ্দেশ্য করে তনুজা বললেন‚
“আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না।”
“আপনি কে এ কথা বলার?”
“যার সঙ্গে আপনি বাজে ব্যবহার করছেন আমি তার মা হই।”
মাধুরী কিছু বলতে নেবেন তার আগেই অর্পণ উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল‚ “এটা কী আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান নাকি বিচার সভা?”
চুপ করে গিয়েও কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে মাধুরী বললেন‚ “মা যেমন মেয়েও তো তেমনই হবে।”
পুরোনো ক্ষ’ত আবারও তাজা হয়ে গেল। এই কথাটা একবছর আগেই মাধুরীই তাকে বলেছিলেন। আজ একবছর পর আবারও তিনি সেই একই কথা বললেন। এবার পুরো রূপে তেতে উঠল মৃত্তিকা৷ মাধুরীকে কিছু না বলে ইরাকে বলল‚
“ইরা তুমি কী আমাদেরকে এখানে অপমান হবার জন্য ইনভাইট করেছিলে? দিস ইজ রিয়েলি টু মাচ।”
একটা ছোটো কথা কাটাকাটি নিয়ে বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে৷ গায়ে হলুদের পুরো অনুষ্ঠান থেমে গিয়েছে৷ সকলের মনোযোগ এখন এখানেই। ভীড় জমেছে বলতে গেলে৷ প্রলয় এবার তার মাকে থামিয়ে বলল‚
“এবার একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? প্রত্যেকবার তুমি এমন কিছু কাণ্ড ঘটাও যার কারণে আমাদের মা ছেলের মাঝে দূরত্ব বাড়ছেই৷ হয়তো এই দূরত্ব কখনোই কমবে না৷ কারণ আমার মা তো নিজেকে কখনো বদলাবেই না৷”
প্রলয়ের কথাটা একেবারে বুকে গিয়ে লাগল৷ মাধুরী কষ্ট পেলেন। চোখ জোড়া অশ্রুপ্লুত হলো। প্রলয়ের কথায় কোনো ভুল নেই। ভূমির সঙ্গেও তিনি এমনই আচরণ করতেন। ছেলের পছন্দের গুরুত্ব উনার কাছে ছিলই না যার কারণে তিনি প্রতিনিয়ত ভূমির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে গিয়েছে। কখনো আপন করার চেষ্টাই তিনি করেননি। ভূমি বহুভাবে চেষ্টা করেছে উনার মন জুগিয়ে চলার৷ এই কথাটা তিনি মনে মনে হাজারবার স্বীকার করেন৷ আজ একটা অনুষ্ঠানের মাঝে তিনি অহেতুক একটা সন্তান সমতূল্য মেয়ের বিবাদ শুরু করেছিলেন। মাধুরী অনুশোচনা বোধ করলেন। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললেন‚
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।”
প্রলয় তার মায়ের খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল৷ মাধুরী এবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “আপনারা প্লিজ কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা ভুলে যান। এটা জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি।”
মৃত্তিকাসহ বাকি সকলেই মাধুরীর ব্যবহারে অবাক। আর যাই হোক সে তো এই মহিলাকে হাড়ে হাড়ে চেনে৷ সংসার জীবনে তাকে তো কম কষ্ট দেননি এই মহিলা। কোনো কিছুই সে ভুলেনি। আর না কোনোদিন ভুলতে পারবে।
চলবে?…..
বাকি পর্বগুলো কবে দিবেন?? একটু তাড়াতাড়ি দিন প্লিজ..