অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ #অবন্তিকা_তৃপ্তি #পর্ব_৩

0
766

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_৩

তুলি থামল। কিছুক্ষণ পর ইতি অতি চেয়ে ধরা গলায় বলল,

‘ওই-আমাদের-বিয়ের কথা হয়েছে আজ বাসায়।’

শুভ্র থমকে গেলো। অস্বস্তি দুজনকেই কেমন জড়িয়ে নিলো নিজের মধ্যে। শুভ্র আবারও গলা পরিষ্কার করলো। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বললো,

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে তো মেডিকেল আছে। ঘুমিয়ে পড়ো।’

তুলি মৃদু স্বরে সায় দিলো। সালাম দিয়ে ফোন কাটলো। শুভ্র ফোন হাতে বিছানার উপর মাথা নিচু করে বেশ কিছুসময় এভাবেই বসে থাকলো। কেমন মাথা ধরেছে শুভ্রর। শুভ্র যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান পুরুষ। তার মতো মানুষের কাছে এই বিয়ে, নিছক বিয়ে নয়। বরং তার সম্মান ধুলোয় মেশানো। একই মেডিকেল কলেজে চাকরি করে, ওই মেডিকেল কলেজের ছাত্রীকে বিয়ে করা কেউই ভালো চোখে দেখবে না। কানাঘুষা হবে, মানুষ পিছনে কথা শোনাবে। শুধু শুভ্রর নিজেকে নিয়ে তেমন ভয় না হলেও, তুলির জন্যে ভাবছে সে।, হয়তো এতে তুলির জীবনও বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। তুলি মেয়ে, তার জন্যে এসব বিশ্রী সমালোচনা ভালো কিছু বয়ে আনবে না।শুভ্র ভাবলো। তারপর ফোনটা বিছানার উপর রেগে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।ধপ করে বিছানার উপর থেকে উঠে সোজা গিয়ে দাড়ালও দেয়ালে টাঙানো মৃত বাবার ছবির দিকে। কিছুক্ষণ বাবার ছবির দিকে চেয়ে তারপরই শুরু হলো তার অভিযোগের বাহার। শুভ্র বললো,

‘আব্বু, এটা কেমন বিচার বল তো? আমি শুভ্র এমন বিয়ে করব, ভাবিনি। তুমি কেন আম্মুকে এত অসহায় করে চলে গেলে। আম্মু এখন বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। শুধু কাদে সারাক্ষণ। তুমি জানো, আম্মু কাঁদলে আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। নিজেকে তখন পাগল পাগল লাগে। আম্মু যখন আমাকে তোমাদের ব্যাপারে বলল, আমি তখন কেন সেটা শুনতে গেলাম? আম্মুর কষ্ট শুনলেই আমার খারাপ লাগে। এই যে, এই খারাপ লাগা থেকে তুলিকে বিয়ে করতে হবে আমায়। এটা হয় আব্বু বলো? তুলি কে? তুলি আমার ছাত্রী। তাকে আমি বিয়ে করব, আমি শুভ্র? অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভবকে তোমার বউ সম্ভব করার জন্যে উঠেপোরে লেগেছে।’

তারপর শুভ্র থামলো। খানিক পর বললো,

‘আমার অস্বস্তি হচ্ছে আব্বু।এভাবে হয়না। তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়ে একদম ভালো করো নি। আম্মুকে আমি কিভাবে সামলাবো আব্বু।আমার আর ভালো লাগে না।’

শুভ্রর বাবা ছবিতে হেসে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছেন। ছবি তো কথা বলে না। তাই শুভ্রর বাবাও কথা বলে নি। ছবি কথা বললে হয়তো শুভ্রর বাবা মৃদু হেসে বলতেন,

‘পাগল বেটা, তুই তোর মায়ের কাছে আছিস বলেই তো আমি এত নিশ্চিন্তে আছি। ঠিক হয়ে যাবে সব। আমার বেটা স্ট্রং। আই নো দ্যাট!’
___________________
শুভ্র ক্লাস করাচ্ছে। লেকচার স্লাইড মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে বড় করে দেখানো হচ্ছে। শুভ্র পুরো লেকচার খুব সুন্দর করে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। ক্লাসের মধ্যেই শুভ্রর চোখ না চাইতেই তুলির দিকে যাচ্ছে। তুলি মনযোগ দেখানোর চেষ্টা করছে ক্লাসে। কিন্তু যতবার শুভ্র তাকাচ্ছে, তুলি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। তুলি হাত কাঁপছে, লেকচার ঠিকভাবে নোট করতে পারছে না। শুভ্র তুলির নারভাসনেস বুঝলো। বাকিটাসময় আর তুলির দিকে তেমন একটা তাকাল না। একসময় ক্লাস করিয়ে বেরিয়ে গেলো শুভ্র। শুভ্র বেরিয়ে যেতেই তুলির ফ্রেন্ড তুলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল বেশ সন্দেহ নিয়ে,

‘তুলি, আজ শুভ্র স্যার তোর দিকে এভাবে বারবার তাকাচ্ছিলো কেন? উনাকে চাওয়া দেখে আমার কিন্তু সুবিধার মনে হয়নি।’

তুলি ভেতরে ভেতরে থতমত হলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। বই খাতা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে মৃদু হেসে বললো,

‘হয়তো রেগে তাকিয়েছেন। আমি তো উনার কাছে লাস্ট ভাইভা তেমন একটা ভালো দেইনি। বললাম না তোকে, আমাকে অ প মা ন করল যে ভাইবা টেবিলে।’

আয়েশা তবুও ভাবলো। তার সন্দেহ এখনো যায়নি। আয়েশা তারপর বললো,

‘না রে। ওইটা রেগে তাকানো ছিলো না। স্যার তোর দিকে বেশ সফ্ট চোখেই চেয়ে ছিল। আমি লক্ষ্য করেছি।’

তুলি আয়েশার এমন পরপর করা প্রশ্নে একপর্যায়ে উত্তর দেওয়ার ধৈর্য্য হারালো। আয়েশার মাথায় কলম দিয়ে টোকা দিয়ে বললো,

‘সারাক্ষণ কোরিয়ান ড্রামা দেখিস দেখেই আজগুবি চিন্তা এসব মাথায় ঘুরে। এখানে দাঁড়িয়ে এত প্রশ্ন করলে, নেক্সট লেকচার ক্লাসের টাইম এখানেই কেটে যাবে।দ্রুত চল।’

আয়েশা লেকচার ক্লাসের কথা মনে পড়ায় দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিলো। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আয়েশা বললো,

‘যতই বলিস তুলি। শুভ্র স্যার তোর দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে এভাবে তাকালে আমি রাগ করতাম না। আমাদের এই থার্ড ইয়ারে একমাত্র এজ স্যারটাই সুন্দর দেখতে। বাকিরা তো বয়স বেশি নাহলে দেখতে ভালো না। পুরো ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার কাটিয়ে এই পর্যায়ে এসে শুধুমাত্র একজন স্যারকেই তেমন ভালো লেগেছে। বাকিরা তো সারাক্ষণ খিটখিট করত আমাদের উপর। কী দিন গেল রে আমাদের তুলি।’

অফিস রুমে বসার সঙ্গেসঙ্গে দুজন কলিগ এসে ঢুকলেন শুভ্রর রুমে। শুভ্র তাদের দেখে মৃদু হেসে সালাম দিলো। ডাক্তার আরিফ ও ডাক্তার ফারহান শুভ্রর সামনে চেয়ারে বসল। শুভ্র বললো,

‘কী ব্যাপার? দুজনেই আজ একসঙ্গে আমার রুমে?’

ডাক্তার আরিফ মুচকি হেসে শুভ্রর দিকে তাকালো। তারপর টিটকারি করে বললো,

‘আগে চা আনা তিনকাপ। তোর সঙ্গে মারাত্মক আলোচনা আছে।।’

শুভ্র হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। সে কাউকে ডেকে চা দিতে বললো। আরিফ কথা তুললো,

‘শুভ্র, কাল কোথায় গেছিলি? তাও একদম আন্টিকে বগলদাবা করে?’

শুভ্র যা ভেবেছে তাইই। চা এসেছে। শুভ্র হালকা স্বরে বলল,

‘জানিস ই তো সব। জিজ্ঞেস করে আবার মজা নিস?’

ফারহান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

‘মেয়েটা কে? বিয়ে কবে করছিস?ঠিক হয়েছে তারিখ?’

শুভ্র এবার থামলো। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বললো,

‘বিয়ে এখনও ঠিক নয়। হলে জানবি অবশ্যই!’

‘মেয়েটার ছবি আছে? দেখি তোর সাথে মানায় কী না।’

শুভ্র হালকা হাসলো। বাকা চোখে তাকিয়ে জবাব দিলো,

‘বন্ধুর বউর ছবি চাস? মতলবটা কী তোর?’

ফারহান এবার শুভ্রর কথায় ধরে ফেললো। একটু উঁচু হয়ে হইহই করে উঠে বললো,

‘এই, তুই না বললি বিয়ে ঠিক না। বিয়ে ঠিক না তো তুই আরেক বেটার মেয়েকে বউ বলিস কেন? ভদ্র শুভ্র অভদ্র হয়ে গেলো কবে থেকে? ভেরি ভেরি সন্দেহজনক!’

শুভ্র থতমত হয়ে গেলো। পরপর সে পুরো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলো। বললো,

‘আর কতকাল ভদ্র থাকবো। এত ভদ্র থাকলে আর বউটউ জুটবে না কপালে।’

বন্ধুরা আরো কিছুসময় হাসাহাসি করে আবার যারযার কাজে লেগে গেলো। তারা যেতেই শুভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কাজ শেষ হলে, শুভ্র দুপুর দুইটায় অ্যাটেনডেন্স শীট সাইন করে বেরিয়ে যায়। লিফটে কল আসে আফরোজা বেগমের। শুভ্র লিফ্ট এ থাকায় কল ধরতে পারে না। লিফ্ট থেকে নেমে কল ঘুরায়। রিং বাজার সময়টায় শুভ্র গাড়িতে উঠে গাড়ি ঘুরায়। আফরোজা বেগম কল ধরেন। শুভ্র সালাম করে, জিজ্ঞেস করে,

‘কোনো দরকার আম্মু? আমি হসপিটাল থেকে বেরিয়েছি!’

আফরোজা বেগম বললেন,

‘শোন না শুভ্র! আমি দোকানে যাবো। শাড়ি কিনবো ভাবছি। তোর শার্ট-গুলোও কেমন পুরনো হয়ে গেছে। তোর জন্যেও কিছু কিনে নিবো। তুই ফ্রি আছিস?’

শুভ্র হালকা হাসলো। সারাদিন ক্লাস, ওয়ার্ড আর রোগী দেখে মাথাটা ম্যাজম্যাজ করছে। ঘাড়টাও ব্যথায় টনটন করছে। কিন্তু মায়ের এক-কথা তার কাছে শিরোধার্য। শুভ্র মৃদু হেসে বললো,

‘ফ্রি আছি আমি। তুমি রেডি হও। আমি আসতেসি।’
‘আচ্ছা, দ্রুত আয়।’

শুভ্র অপেক্ষা করছে মায়ের ফোন কাটার। কিন্তু আফরোজা বেগম ফোন কাটছেন না। শুভ্র জিজ্ঞেস করলো,

‘আর কিছু লাগবে আম্মু?’

আফরোজা বেগম গড়িমসি করতে লাগলেন। তারপর বলেন,

‘শোন না শুভ্র। তুই তো ইয়াসমিনের বাসার গলি পেরিয়েই আসবি বাসায়। ওই, বলছিলাম কি। তুলিকে যদি নিয়ে আসতি একবার? মেয়েটাকে কিছু একটা কিনে দিতাম। সঙ্গে ইয়াসমিন আর জুবায়ের এর জন্যেও কিনে দিলাম, ভালো হবে না? ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তো তেমন কোনো উপহার বা কিছু দেওয়া হয়নি। তুই কী বলিস? তোর কাছে টাকা আছে তো শুভ্র?নাকি আরও পরে কিনে দিবো ওদের?’

শুভ্র বুঝতে পারল তার মায়ের অভিলাষ। খুঁজে খুঁজে মায়ের ধান্দা থাকে, কিভাবে তুলি আর শুভ্রকে কাছাকাছি আনা যায়। শুভ্র তুলিকে মানবে না এতো সহজে, আফরোজা বেগম জানেন। তাই খুঁজে খুঁজে তুলিকে শুভ্রর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার গেইমে নেমেছেন আফরোজা। মায়ের বুদ্ধি মুহূর্তেই ধরে ফেললো শুভ্র। তবুও অগোচরে তার মা-কেই জিতিয়ে দিয়ে বললো,

‘ঠিকাছে, নিয়ে আসবো তোমার বান্ধবীর মেয়েকে। আর টাকার চিন্তা তুমি করবে না, এটা তোমায় কতবার বলেছি আম্মু। আমার কাছে টাকা না থাকলে, ভিক্ষা করেও আমি তোমার শখ মেটাবো, বুঝেছ তুমি?’

আফরোজা হেসে উঠেন শব্দ করে। ছেলের একেকটা কথায় হাজারটা দোয়া বেরিয়ে আসে বুক চিড়ে। গর্বে সবার সম্মুখে বিনা সংকোচে আফরোজা স্বীকার করেন, ‘তার স্বামী তাকে মরার আগে একজন সন্তান দিয়ে গেছেন, যে সন্তানের কাছে আফরোজা মানেই সবকিছু। আফরোজার হাত চেপে ধরে রাখার মতো স্বামী নেই, কিন্তু সেই হাতে হাত রেখে ভরসা দেওয়ার মতো তার একটা শুভ্র আছে। শুভ্র, তার সন্তান।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here