অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ #অবন্তিকা_তৃপ্তি #পর্ব_১২

0
848

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_১২

শুভ্র সরে এসে তুলির কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে প্রথম কোন পুরুষের স্পর্শে তুলি চোখ তুলে চাইল। দুচোখে ভেসে উঠে শুভ্র নামক এক দায়িত্ববান সুপুরুষ! শুভ্র তুলিকে নিজের কাছে হালকা করে টেনে আনল। তারপর মৃদ্যু হেসে দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো,

‘ওকে, মিট ম্যাই ওয়াইফ। মিসেস প্রত্যাশা হোসেন তুলি।’

শুভ্রর স্ত্রী তুলি? ডাক্তার আরিফ এবিং ফারহান একসঙ্গে বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ওয়াইফ?’

দুজনের এমন চেঁচিয়ে উঠাতে শুভ্র কানে হাত চাপলো। তুলি ভয়ে সেটিয়ে গেলো শুভ্রর গায়ের সঙ্গে। অস্বস্তিতে তুলি রীতিমত জমে যাচ্ছে। শুভ্র কান থেকে হাত নামালো। তারপর দুজনের উদ্দেশ্যে বললো,

‘আগে ঘরে ঢুকি? ডিটেইলস পড়ে বলি, রিয়েকশন তখন দেখাস।’

শুভ্র তুলি এতসময় ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে দুজনেরই হুশ ফিরলো। আরিফ দরজার সামনে থেকে সরে দ্রুত বললো,

‘ওহ হ্যাঁ, ভেতরে আয়। তুলি তুমিও ভেতরে আসো।’

শুভ্র তুলিকে আগে দিলো। তুলি ঘরে ঢুকলে আরিফের স্ত্রী মহু এগিয়ে আসলো। তুলি সালাম করলো তাকে। মহুও ডাক্তার। তবে অন্য মেডিকেলের। তুলিকে দেখে তবুও কিভাবে যেন মহু চিনে ফেললো। কিছু ভেবে বললো,

‘তুমি আরিফের মেডিকেলের স্টুডেন্ট না? তোমাকে মেডিকেলে দেখেছি আমি, চাইল্ড বার্থের উপরে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলে, রাইট?’

তুলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। অথচ তুলির মনে পরছে না সে মহু ম্যাডামকে তাদের মেডিকেল কখনো দেখেছে কিনা। আরিফ শুভ্রর পাশে সোফায় বসে মহুকে বললো,

‘মহু, শুভ্রর ওয়াইফ ও। আর আমাদের স্টুডেন্ট অলসো, তাইনা শুভ্র?’

শুভ্র আরিফের টিটকারি শুনে বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকালো। ছেলেটা এমনিতেই ছোট থেকে ছোট বিষয় নিয়ে শুভ্রকে টিটকারি করে। আর এখন পেয়েছে জলজ্যান্ত বিষয়। টিটকারি আবার করবে না?

মহু প্রথমে অবাক হয়েছে। পরপরই মৃদ্যু হেসে তুলির বাহুতে হাত রেখে আরিফকে বললো,

‘স্টুডেন্ট এটা এত রসিয়ে বলার কী আছে, আরিফ? তুমিও না। এত সুন্দর মেয়ে বিয়ের আগে দেখলে তুমিও লাফাতে!’

আরিফ ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে বললো,

‘মহু, আমাদের রিলেশন করে বিয়ে, ভুলে গেছো? বিয়ের আগেও তো কোন সুযোগই দিলে না, আবার লাফানো!’

মহু মুম ভেঙালো।চোখ পাকিয়ে বললো,

‘চান্স পেলে ট্যাংকি মারতে? ছিঃ! শোধরাবে না তুমি?’

পুরো ব্যাপারটা আরিফের স্রোতের উল্টোদিকে যাচ্ছে দেখে আরিফ কথা থামালো। টপিক পাল্টে বললো,

‘শুভ্র তুই অনেক টায়ার্ড, ক্ষুধাও লেগেছে, না? মহু, চটজলদি নাস্তা দাও তো আমাদের, সঙ্গে গরম গরম চা। চা খেয়েই বেড়িয়ে যাব আমরা।’

মহু আর দেরি করে না। তুলিকে ভেতরে নিয়ে যায়। মহিলারা যেতেই আরিফ এবার পুরোপুরি ঘুরে বসলো শুভ্রর দিকে। শুভ্র বাঁকা চোখে আরিফের পল্টি খাওয়া দেখলো। আরিফ নিজেকে প্রস্তুত করলো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,

‘কাহিনি ঝাড়। তুলি আর তুই? কিভাবে কি? রিলেশন করে বিয়ে আমাকে বলবি না। তুই ওরকম ছেলেই না, আমি জানি।’

ফারহানও ওদিকে উৎসুক চোখে শুভ্রর দিকে চেয়ে আছে। শুভ্র তারপর দুজনকেই পুরো কাহিনি শোনালো। সব শুনে ফারহান বললো,

‘তুলি মেনে নিয়েছে তোকে?’

শুভ্র উত্তর দিলো,

‘বোধহয় ট্রাই করছে।’

‘আর তুই?’

আরিফের প্রশ্নে শুভ্র থামলো। পরপর ছোট্ট করে নিঃশ্বাসনিয়ে বললো,

‘চেষ্টা করছি, আই থিঙ্ক আমার ওকে ভালোই লাগে! শি ইজ অ্যা ম্যাচোর গার্ল, চিন্তা ভাবনা একদম আমার মতো। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তুলি আম্মুর সাথে খুবই ফ্রেন্ডলি। আম্মু তুলির সংস্পর্শে ভালো থাকে, যেমনটা আমি সবসময় চেয়ে এসেছি। বিয়ে নিয়ে আমি সবসময় ভয় পেতাম, জানিস।সবসময় চিন্তা থাকতো, যে মেয়ে আসবে,আম্মুকে আমার মতো ভালোবাসবে কিনা। বাট নাও, আম স্যাটিসফাইড। তুলি সবদিকেই আমার কাছে বেস্ট লেগেছে। বাকিটা এখন ভাগ্য।’

সব শুনে আরিফ এবং ফারহানকে নিশ্চিন্ত হতে দেখা গেলো। ফারহান বললো,

‘এই ট্যুরটা তোদের জন্যে খুব কাজে দিবে। ভালো করেছিস তুলিকে নিয়ে যাচ্ছিস সাথে। তোদের ফার্স্ট হানিমুনও সেরে গেলো ব্যাটা।’

শুভ্র হালকা হাসলো। ওদের কথা বলার ফাঁকে আরিফকে রান্নাঘর থেকে ডাকল মহু। আরিফ উঠে নাস্তা রান্নাঘর থেকে এনে টেবিলে সাজালো। সবাই মিলে নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে গেলো বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে।

আরিফ টিকেট আনতে গেছে সবার জন্যে। শান্তি পরিবহন বাস ঢাকা থেকে খাগড়াছডি অব্দি যাবে। একমাত্র এই বাসেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অব্দি যাবে। তাই তারা এই বাসেই ঠিক করছে সাজেক যাওয়ার জন্যে।

শুভ্র এইফাঁকে তুলিকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু কিনবে? বাসে খাওয়ার জন্যে?’

তুলি আশেপাসে একবার দেখে বললো,

‘আচার পাওয়া যাবে এখানে?’

শুভ্র একবার আশেপাশের দোকান দেখে বললো,

‘আমি দেখি পাই কিনা। তুমি মহুর সাথে দাড়াও।’

শুভ্র তুলিকে মহুর পাশে দাড় করিয়ে রেখে আচার খুঁজতে চলে গেল। মহু জিজ্ঞেস করল তুলিকে,

‘শুভ্র আবার কোথায় যাচ্ছে?’

‘আচার কিনতে।’

‘কে খাবে? তুমি?’

তুলি স্বাভাবিক ভাবে মাথা নাড়লো। মহু হালকা হেসে বললো,

‘আমার কাছে আছে, আবার আনাতে গেলে কেন? আচার তো আমার কাছে কয়েকমাস থেকে সবসময়ই থাকে।’

‘কেন ম্যাডাম? আপনি এত আচার পছন্দ করেন?’

তুলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। মহু মৃদ্যু হাসলো। পেটে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,

‘ইনি আসার পর থেকে রোজ খাওয়ান আমাকে। আচার খেলে বমি কম হয়, তাই আরিফ কয়েক ধরনের আচার এনে রাখে বাসায়।’

তুলি খানিক বিস্মিত হল। বললো,

‘আপনি প্রেগনেন্ট অবস্থায় এতদূর যাচ্ছেন? সমস্যা হবে না?’

‘উহু। বরং আমার মাইন্ড ফ্রেশ হবে। কদিন ধরে মনে হচ্ছে, আমি মেন্টালি খুব উইক হয়ে যাচ্ছি। অযথা চেচাচ্ছি। আরিফের সঙ্গেও কয়েকবার খারাপ ব্যবহার করলাম। ও কিছু বলে না আমাকে, কিম্তু আমি বুঝতে পারছি আমার ফ্রেশ হওয়া দরকার। ডেইলি লাইফের এমন ঝুটঝামেলা থেকে কদিন রেহাই দরকার। তাইই ভাবলাম ঘুরে আসি।’

তুলি অবাক হয়। মানুষটার কী ধৈর্য্য। এমন একটা অবস্থায় এভাবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তুলি হলে বিছানায় ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকত। নিজে যন্ত্রণায় ভুগতো, আশেপাশের সবাইকেও জ্বালিয়ে মারতো। তুলি হালকা হাসলো। এরমধ্যে শুভ্র এসেছে। হাতে পলিথিন। আচারের সঙ্গে আরও হাবিজাবি চকলেটস আর চিপস কিনে এনেছে। আরিফও এরমধ্যে টিকেট কিনে এনেছে।

বাস ছেড়েছে কিছুক্ষণ হয়েছে। মহু শরীর খারাপ লাগছে, আরিফের কাঁধে মাথা হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ফারহানের কাঁধে মাথা হেলিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে আছে দিয়া। তাদের দেখে তুলিরও ইচ্ছে করছে শুভ্রর কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু সঃঙ্কোচের কারণে হচ্ছে না। শুভ্রও তো আগবাড়িয়ে কিছু বলছে না। তুলি মেয়ে হয় কিভাবে বলবে? সেই কখন থেকে ওরা দুজন চুপ করে বসে আছে বাসে। কেউ কি তাদের দেখে বলবে, এরা সদ্য বিবাহিত কোনো কাপল?

তুলি বিরক্ত হয়ে বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে। বাস ক্রমাগত নড়ছে। তুলি তাই ঠিকঠাক মাথা রাখতে পারছে না। উল্টো ব্যাথা পাচ্ছে। তুলি তাও রাগে মাথা সরাল না। ঠেকিয়েই রাখলো। শুভ্র ফোনে এতোক্ষণ কাজ করছিল। একপর্যায়ে তার চোখ গেল তুলির দিকে। তুলি ঘুমে পড়ে যাচ্ছে। তাও কষ্ট করে চোখ খুলে রেখেছে। কপালে কী ব্যাথা লাগছে না তুলির? শুভ্রর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুলি চাইলে শুভ্রর কাঁধে মাথা রাখতে পারে। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচে বলতে পারছে না। তাও সে বললো,

‘তুলি? তুলি? এভাবে ঘুমিও না। কপাল ফুলে যাবে বাসের ধাক্কায়। রাস্তাটা বেশি ভালো না।’

তুলির ধ্যান ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে বসে আবার সোজা হয়ে। শুভ্রর দিকে চায়। ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না তুলি। চোখ ঘুরিয়ে ঘুমানোর জায়গা খুঁজছে। শুভ্র বললো,

‘কী দেখছ?’

তুলি লম্বা হামি তুলে বলল,

‘ঘুমাবো কোথায় আমি? সিটটা পেছনে হেলানো যায় না আর?’

শুভ্র সিটটা হাত দিয়ে একবার দেখলো। তারপর বললো,

‘না আর যাবে না।’

তুলির তখন শুভ্রর মাথায় মারতে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হল, আপনার বুক আর কাঁধ থাকতে আমি কেন সিটে মাথা দিয়ে ঘুমাবো?
কিন্তু বলতে পারল না। তাদের সম্পর্ক আট দশটা স্বাভাবিক কাপলদের মতো নয়।তাই দুজনের কেউই চাইলে স্বাভাবিক কাপলদের মতো আচরণ করতে পারে না। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাল ছেড়ে দিয়ে শেষমেশ সোজা সিটেই হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। সিটে মাথা রেখে চোখ বুজলো। তবে বাসের ধাক্কায় বারবার মাথা পড়ে যাচ্ছে তুলির। শুভ্র সব দেখছে। একবার ফারহান আর আরিফকে দেখে তার খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তুলিকে নিজের কাঁধে মাথা রাখার কথা। কিম্তু গলায় যেন আজ কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে। শুভ্র কথাই বলতে পারছে না ঠিকঠাক। সদ্য বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে তুলি পাশে বসে আছে, হানিমুনে যাচ্ছে তারা। এই ব্যাপারটাই শুভ্রকে বারবার লজ্জা দিচ্ছে।

তুলি ঘুমাতে পারছে না ভালো করে। তাই শুভ্র একসময় নিজেকে শক্ত করল। কাচুমাচু হয়ে তুলিকে ডাকল,

‘তুলি, এই তুলি? উঠো। আমার কাঁধে মাথা রেখে শোও। এভাবে ঘুমালে ঘাড় ব্যাথা করবে তো।’

#চলবে
এরবেশি বড় পর্ব দিতে হলে আমাকে অক্কা পেতে হবে। বড় মন্তব্য করেন না কেন আপনারা? আমি মুখিয়ে থাকি, জানেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here