এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️ #লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️ — পর্বঃ৪৯

0
500

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৯

পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে পুরো কক্ষ জুড়ে। জানালার কার্ণিশ ছুঁইয়ে ছুটে আসছে বাতাস। রোদের আলোতে ভরপুর পরিবেশ। আদিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ আগে ফারিশের ডাকে ছুটে এসে দাঁড়াল। ফারিশ কিছু বলছে না চুপচাপ বিছানা বসে। ফারিশ গায়ের কম্বলটা পা থেকে সরালো। একঝলক আদিবের দিকে তাকিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। মাথা নুইয়ে বলল,“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আদিব।”

আদিব তড়িৎ চমকে তাকালো ফারিশের দিকে। খানিক ভীতু স্বরে শুধাল,“কি সিদ্ধান্ত ভাই?”

ফারিশ চুপ হয়ে গেল। কথা আঁটকে আসছে নাকি। কি সাংঘাতিক! ফারিশের এত বছরের জীবনে এমন আকস্মিক ঘটনা কখনও হয় নি। ফারিশ দম ছাড়লো। আদিব হতভম্ব হয়ে চেয়ে। খানিক এগিয়ে প্রশ্ন করল,“কি হলো ভাই? কথা বলছো না কেন?”

ফারিশ চাইলো আদিবের দিকে। চোখ জোড়ায় বিষণ্ণের হইচই। আদিবের বুক হঠাৎ অজানা ভয়ে কামড়ে উঠলো। সে নিচে বসে পড়লো আচমকা। তড়তড় করে ফারিশের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,“আমাদের ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করছো না তো ভাই?”

ফারিশের চোখেমুখে অসহায়ত্বতা ফোটে। ছোট্ট প্রশ্ন করে,“চাঁদনী কি ঘরে?”

আদিব মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,“না। ও তো খুব ভোরে চট্টগ্রাম গেছে।”

এবার ফারিশ হাত ধরলো আদিবের। আদিব থমকে গেল হঠাৎ। ফারিশ ভাইয়ের আচরণ ঠিক লাগছে না। ফারিশ বলল,“তোমায় একটা কাজ করতে হবে আদিব?”

আদিব বিমুঢ় চেয়ে। বলে,
“কি কাজ ভাই?”
“তুমি এই শহর ছেড়ে চলে যাবে। তোমার যে ফারিশ নামের একটা পাতানো ভাই আছে এটা তোমায় ভুলতে হবে।”

আদিব বিস্মিত হয়ে গেল ফারিশের কথা শুনে। এসব কি বলছে ফারিশ ভাই। চলে যাবে, ভুলে যাবে। এগুলোর মানে কি? আদিব হতাশার ঘোরে বলল,
“এসবের মানে কি ভাই? ভুলে যাবো কেন?’
“মানে একটাই তুমি এই শহর ছাড়ছো।”
“কেন ছাড়বো? আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। আর আচমকা এসব কি?”
“বাচ্চাদের মতো জেদ করো না আদিব।”
“তুমি অবুঝের মতো কথা বলছো। আচমকা শহর ছাড়বো কেন?”
“তুমি আমার সাথে থাকলে বিপদে পড়বে।”
“কিসের বিপদ?”
“আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো আদিব।”

তড়িৎ উত্তর ফারিশের। মুহূর্তের মধ্যে থমকে গেল আদিব। স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশে। এখনও যেন ফারিশের ঠান্ডা স্বরে বলা কথাটা কানে বাজছে আদিবের। ‘আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো আদিব।’– আদিব বিমুঢ় চেয়ে রইলো। তার চোখ জ্বলছে। পানি জমা হতে শুধু করছে বোধহয়। ফারিশ নিরাশ হলো। আদিবের হাত মুঠোবন্দি করে আঁকড়ে ধরলো। নিরুপায় ভঙ্গিতে বলল,“এভাবে বাঁচা যায় না আদিব।”

আদিব কিছু বলে না। শুধু চেয়ে রয়। কিছুসময় পর টের পায় তার চোখ বেয়ে লাগামহীন অশ্রু পড়ছে। বুকের ভেতর ভয়ার্ত এক অনুভূতি হচ্ছে। ফারিশ বোধহয় ধরতে পারলো আদিবের অবস্থা। সে ধমকের স্বরে বলল,“ভয় পাবে না আদিব।”

আদিব তখনও কিছু বলে না। অনেক সময় পর ফারিশ বুঝায়,“একটা জিনিস কি জানো? আমরা যতক্ষণে না নিজেদের পাপটা উপলব্ধি করতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত পাপী কাজটাকে আঁকড়ে থাকবে পারি। আমাদের মনেই হয় না আমরা প্রতিনিয়ত অন্যায় করছি। কিন্তু যেই উপলব্ধি করি ভুল হচ্ছে, প্রিয় মানুষদের সাথে অন্যায় করছি তখনই কষ্ট হয়। শুরুতে তো সব ঠিকই ছিল। কিন্তু এখন আর নিতে পারি না। কাজটা করতে চাচ্ছি না আবার ছেড়ে দিতেও পারছি না। তাই ভেবে দেখলাম আমার পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করাটাই ঠিক হবে। আমি শুনেছি নিজ থেকে আত্মসমর্পণ করলে শাস্তি কম পাওয়া যায়। ওনারা নিশ্চয়ই পাঁচ ছয় বছর পর আমায় ছেড়ে দিবেন। তখন তো আমি ফিরেই আসবো। সব ছেড়েছুড়ে সাধারণ জীবন গড়বো।”

আদিব তড়িৎ বলে ওঠে,“যদি না ছাড়ে।”
ফারিশ বিছানায় থেকে নামলো। আদিবকে বসা থেকে উঠালো। হেঁটে হেঁটে বুঝাল,“কেন ছাড়বে না? আমি নয়নতারার সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে নিজ থেকে আত্নসমর্পণ করলে শাস্তি কম হয়। কিন্তু কিশোর যদি আমায় ধরতে পারে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু।”

আদিবের রুহু বুঝি কেঁপে উঠল ফারিশের শেষ কথা শুনে। ফারিশ বলে,“এবার বুঝচ্ছো তো আদিব আমি কেন নিজ থেকে ধরা দিতে চাইছি।”

আদিব কান্নামিশ্রীত স্বরে বলে,“আমার খুব ভয় হচ্ছে ভাই। আমিও যাই তোমার সাথে। আমারও তো দোষ আছে। শাস্তি তুমি একা কেন পাবে? আমিও পেতে চাই।”

ফারিশ তড়িৎ রেগে যায়। ধমকের স্বরে বলে,“কিসের শাস্তি পাবে তুমি। তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি নিষ্পাপ। যা পাপ করার আমি একা করেছি।”

আদিব মানতে চায় না। সে বলে,“আমি ওসব জানি না। আমিও তোমার সাথে যাবো ভাই।”

ফারিশ চাইলো আদিবের দিকে। ছেলেটা যে এত কেন ভালোবাসে তাকে কে জানে? ফারিশ মিষ্টি হাসলো। বলল,“সবাই চলে গেলে আমার বউ, তোমার বউ এদের দেখবে কে?’ তাছাড়া তুমি পাপী নও আদিব। পাপী আমি। আমাদের আবার দেখা হবে তো।”

আদিব বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে,
“সব বুঝলাম কিন্তু আমায় শহর ছাড়তে হবে কেন?”
“কারণ আমি যতদিন জেলে থাকবো ততদিন তুমি আমার সাথে দেখা করতে যাবে না। আমি যে অবস্থাতেই থাকি না কেন তুমি যাবে না। এই শহরে থাকলে, না তুমি এই শহর নয় এই দেশ ছাড়বে আদিব। সঙ্গে করে আদ্রিতা আর চাঁদনীকেও নিয়ে যাবে।’

ফারিশের হঠাৎ মনে হলো। সে একটা ভুল করেছে দেশ ছাড়ার বিষয়টা তার আরো আগে ভাবা উচিত ছিল। খুব বড় ভুল হলো একটা।’

আদিব রাগ দেখালো এবার। কপট তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানাল,“সে কোথাও যাবে না। যা হবে সবটা সে নিজ চোখে দেখবে।”

ফারিশ মানতে চাইলো না। এই নিয়ে আদিব আর ফারিশের মাঝে মোটামুটি একটা দ্বন্ধ চললো। শেষমেশ ফারিশ রেগে বলে,“তুই আমার রক্তের ভাই যে তোকে সবটা দেখতে হবে। কিছু দেখবি না। তুই আজকের মধ্যে দেশ ছাড়বি।”

আদিবও একপর্যায়ে রাগ নিয়ে বলে,“আপনিও আমার রক্তের ভাই নন যে আপনি যা বলবেন আমাকে শুনতে হবে।”

ফারিশ আহত হলো। এ ছেলে সহজে কিছু মানতে চায় না কেন? ফারিশ অসহায় ভঙ্গিতে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। আদিবও বসে। নীরবতা চলে বেশক্ষণ। হঠাৎ আদিব হাত ধরে ফারিশের। মিনতির স্বরে বলে,“এসব না করলে হয় না ভাই। চলুন না সব ছেড়েছুড়ে আমরা চারজন দূরে কোথাও চলে যাই।”

ফারিশ শুঁকনো হেঁসে বলে,“তোমার কি মনে হয় এতে আমরা ভালো থাকবো। আমার সাথে যাদের লেনদেন, ব্যবসায়ের আদান প্রদান চলছে তারা এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে আমাকে।”

আদিব কিছু বলে না। ফারিশ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত স্বরে বলে,“আমায় যেতে দেও আদিব। দেখে নিও আমি ফিরবো। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে। আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচবো। কতদিন হয়ে গেল আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেই না। আমি প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই আদিব। কাল আমার ছেলেমেয়ে হলে তারা যেন কোনোদিন বলতে না পারে তাদের বাবা খুব খারাপ মানুষ। একজন দেশ বিরোধী মাফিয়া। আমি শুধু চাই আমি যতদিন না ফিরবো, ততদিন তুমি আমার ভাই, আর আমার বউয়ের যত্ন নিবে। তাদের ভালো রাখবে। তারপর আমি ফিরে এসে একটা সৎকাজ ধরবো এই ধরো ঝালমুড়ির ব্যবসা।”

শেষ কথা শুনে আদিব অতি দুঃখেও হেঁসে দেয়। আবার সব চুপচাপ হয়। অতঃপর আদিব হেরে গেল। ভাঙাচোরা মন নিয়ে বলল,“কখন পুলিশ ডাকবেন ভাই?”

ফারিশ নিরুপায় ভঙ্গিতে বলে,“ডাকা হয়ে গেছে। যখন তখন এল বলে।”

আদিব কিছু বলে না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে তার ফারিশ ভাইকে। লোকটা কি দারুণ দাঁত বের করে হাসছে। যেন পুলিশের জেলখানায় দাওয়াত খেতে যাচ্ছে।’


গোধূলি বিকেল। চারপাশ লালচে হয়ে আছে পুরো। জানালার কার্ণিশ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পর্দা নড়ছে। ফারিশের রুম ফাঁকা। ফারিশ নেই। আদ্রিতা খুশি মনে ছুটে আসল ঘরে। আজ একটা খুশির দিন আদ্রিতা মা হতে চলেছে। আদ্রিতা বাড়ি বয়ে আসতে আসতে ভেবেছে সে ছুটে এসেই ফারিশকে জড়িয়ে ধরে বলবে,“আপনি বাবা হতে চলেছেন মিস্টার বখাটে।”

ঘরে ঢুকেই আদ্রিতার মুখ ফ্যাকাসে হলো। ফারিশ ঘরে নেই। গেল কই?– এই লোকটা আর ঠিক হলো না আদ্রিতা এতবার বললো বাহিরে না যেতে তাও গেল। আদ্রিতা উচ্চ আওয়াজে ডাকলো,“আদিব ভাইয়া…

আদিব দ্রুত পায়ে ছুটে আসলো। তার চোখ ফুলোফুলো। আদ্রিতা আদিবের উপস্থিতি টের পেতেই জিজ্ঞেস করল,“তোমার ভাই কই?”

আদিব জবাব দেয় না। আদ্রিতা ঘুরে তাকায় আদিবের দিকে। চোখমুখের বেহাল অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে,“তোমার কি হয়েছে ভাইয়া?”

আদিব শক্ত মনে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে আদ্রিতার হাতে দিল। বলল,“পড়ো।”

আদ্রিতা বিস্মিত হয়ে চিঠি খোলে। কোনো প্রশ্ন না করেই পড়তে শুরু করল। যেখানে শুরুতেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল,

‘প্রিয় বেলীপ্রিয়া’
আমি জানি তুমি বাড়ি এসে আমায় না দেখে খুব উত্তেজিত হবে। আমায় খোঁজার জন্য ছটফট করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো এগুলো করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করে দিয়েছি। আমার যত বেআইনি কারবার সব বলে দিয়েছি। আমার যাদের সাথে বেআইনী কারবার ছিল তাদের কথাও বলে দিয়েছি। তুমি কি রাগ করেছো। রাগ করো না গো সখি। আমি জানি তুমি আমায় বুঝবে। আমি যে পাপী এটা তো সত্য বলো। তোমায় সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতে না আমি খুব ভেবেছি। তুমি পবিত্র মানুষ, কত মানুষদের চিকিৎসা করে সুস্থ করো। আর আমি কিনা অপবিত্র মানুষ হয়ে তোমার সাথে থাকছি। আমার খুব কষ্ট হয় বেলীপ্রিয়া। আমি মানতে পারি না। গত একটা বছর আমি কতটা অসহায় হয়ে তোমার সাথে মিশেছি। আমার কিছু ভালো লাগে না। তোমার নিষ্পাপ মুখটা দেখলেই আমি ভেঙে পড়ি। আমার ভিতরটা মচকে যায়। ইচ্ছে করে কোনো এক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করি। আমার এত পাপী শরীর তুমি সাদরে গ্রহণ করছো এও যেন আমার কাছে বিষাক্ত লাগে। নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়। আমি শুধু দিনরাত ভেবেছি, এই পাপী মানুষটার সাথে এত নিষ্পাপ মুখের মিলন ঘটলো কি করে?
কোথাও গিয়ে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমায় একটা সুযোগ দিয়েছেন পাপ ছেড়ে পুন্যে আসার। আমি সেটাই করেছি। আমি জানি না আমি ফিরবো কি না। আদিবের সাথে আমি একটা মিথ্যে বলেছি আমার সাজা পাঁচ বছর জেলখাটা হবে না। হবে আরও অধিক। হয়তো বছর পনের– কুড়ি পরে। তুমি কি ততদিন আমার অপেক্ষায় থাকবে। একটা কথা কি জানো এই কুড়ি পনের বছর পড়েও আমি বেঁচে থাকতে পারবো কি না জানা নেই। আমার সাথে যারা কাজ করতো তাদের ধরিয়ে দিচ্ছি। কেউ যদি বেঁচে যায়। তবে সে নিশ্চয়ই আমায় মারবে। দেখা গেল জেল থেকে বেরিয়েই বুক বরাবর গুলি। আমি ওখানেই শেষ। আর যদি কারাগার থেকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তবে তো… যাক বাদ দেও। আচ্ছা আমি মরে গেলে তুমি কি ভালো থাকবে বেলীপ্রিয়া? আমি বলবো, ভালো থেকো।’ অন্তত পাপী পুরুষ থেকে তো মুক্তি পেলে। আজ তবে গেলাম। যদি ফিরি তবে আমাদের আবার সংসার হবে। আর যদি না ফিরি তবে।.. শুনেছি মানুষ অপূর্ণতা নিয়ে মরে গেলে তাদের নাকি আবার জন্ম হয়। কথাটা কতটুকু সত্য জানা নেই। যদি সত্য হয় তবে,

“তুমি আবার জন্ম নিও বেলীপ্রিয়া। দেখেও নিও, আমি সেবারেও তোমারই প্রেমে পড়বো।”

ইতি-
তোমার বখাটে সাহেব,
ফারিশ মাহমুদ!’

#চলবে…

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। এত অপেক্ষা করাচ্ছি আর ভালো লাগে না। 🙂! পর্বটা হয়তো একটু অগোছালো হয়েছে তার জন্য দুঃখিত!’]

#tanjil_mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here