#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫০
হাত খসে নিচে পড়লো চিঠি। আদ্রিতা স্তব্ধ বনে খাটে বসে পড়লো। আদিব মাথা নুইয়ে দরজার কর্নারে দাঁড়িয়ে। চাঁদনীও নেই যে আদ্রিতাকে বোঝাবে। সামলাবে। আদ্রিতার হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠলো। চোখের পাপড়ি ভিজে আসলো আপনাআপনি। পেটে হাত রাখলো নীরবে। আদ্রিতার এত কষ্ট হচ্ছে, পাষাণ লোকটা এভাবে ব্যাথা দিয়ে চলে গেল। আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,“চলেই যখন যাবে তখন এসেছিলে কেন? সেই এক পশলা ঝুম বর্ষায় এলাহী কান্ড ঘটিয়ে আমার হৃদয় নাড়িয়ে ছিল কেন? আমাদের গন্তব্য কি এতটুকুই ছিল বখাটে সাহেব? আমি তো তোমায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলাম। একটু পারলে না আমার মতো স্বার্থপর হতে। এখন এই ভাঙামন নিয়ে আমি কিভাবে চলবো ফারিশ। আমাদের সন্তান তাকেই বা কি জবাব দিবো? তুমি এমনটা কেন করলে? একেবারেই কি না করলে হতো না?”
আদ্রিতা ভেঙে পড়েছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারপাশ বুঝি ফারিশের শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আদ্রিতা নিজের মাথা চেপে ধরলো। আদিব এগিয়ে আসলো তখন। তারও তো কষ্ট হচ্ছে। ফারিশ ভাই খুব বাজে কাজ করেছে। এটা না করলে কি সত্যিই হতো না। আদিব আদ্রিতার পাশে এসে বসলো। আদুরে গলায় বলল,“ডাক্তার ভাবি।”
আদ্রিতা অশ্রুমাখা চোখ নিয়ে তাকালো আদিবের দিকে। শান্ত গলায় বলল,“কাজটা কি ঠিক করলো আদিব ভাইয়া?”
আদিব সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিতে পারে না। চুপ থাকে। কিছু সময় যায়। আদিব কথা সাজায়। এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,“প্রথম প্রথম আমারও মনে হয়েছিল ভাই কাজটা ঠিক করে নি ডাক্তার ভাবি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বোধহয় দরকার ছিল। ফারিশ ভাই নিতে পারছিল না ব্যাপারটা। তার কষ্ট হচ্ছিল। আঘাত লাগছিল। আমি আঁচ করতে পারছি ভাই কতটা যন্ত্রণা নিয়ে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না ভাবি। ভাই আমায় বলেছে, চার-পাঁচ বছর পর ভাই ফিরে আসবে। তারপর আমরা নতুন করে বাঁচবো। জানো তো ভাই আমায় কখনো মিথ্যে বলে না। ভাই তোমায় চিঠিতে বলেছে না এসব?”
আদ্রিতা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ,’বলেছে।’
আদিব খুশি হলো। বলল,“পাঁচবছর খুব বেশি সময় না ভাবি। দেখবে দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ভাই আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। বলেছে, ভাই যতদিন না ফিরে আসে ততদিন আমি তোমার খেয়াল রাখি। তুমি কোনো চিন্তা করো না ভাবি আমি আছি তো। আর চাঁদনীও তো আছে। ভাই ফিরে আসবে ভাবি, দেখে নিও ভাই তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।”
বলতে বলতে গলা ধরে আসছে আদিবের। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। পাঁচবছর সত্যি কি খুব কম সময়? আদিব নিজের চোখ মুছতে মুছতে আবার বলল,“তুমি কষ্ট পেও না ভাবি। দেখো না আমিও কষ্ট পাচ্ছি না।”
আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে আদিবের দিকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে আদিব কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে তবুও মুখে বলছে কষ্ট পাচ্ছে না। কি অদ্ভুত!’
দুজনের মাঝে নীরবতা চলল অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরণীতে। দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসছে। আজান দিচ্ছেন তিনি। আদ্রিতা নিজেকে শক্ত করল। চোখ মুছে বলল,“আমায় জেলখানায় নিয়ে চলো আদিব ভাইয়া আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই।”
আদিব কিছু সময় চুপ থেকে বলে,“ওনারা কি দেখা করতে দিবে?”
আদ্রিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে,“তুমি নামাজ পড়ে আসো ভাইয়া। তারপর আমরা পুলিশ স্টেশন যাবো।”
কথাটা বলেই ওয়াশরুমে ঢুকলো আদ্রিতা। ওজু করতে হবে। আদিব উঠে দাঁড়ালো। নিচে উল্টে পড়ে থাকা ফারিশের চিঠিটা উঠালো। তবে পড়লো না। কারণ ফারিশকে যখন কিশোর হাতে হ্যানকাপ পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আদিব ছিল ঠায় দাঁড়িয়ে। বুক জুড়ে চলছিল কি বিষাদ! ঠিক সেই সময় ফারিশ আদিবের হাতে এই চিঠিটা ধরিয়ে দেয়। আদেশস্বরূপ বলে,“এটা আদ্রিকে দিও। আর শোনো, তুমি এই চিঠি খুলবে না আদিব। এটা একান্তই আমার বউয়ের জন্য লেখা। তুমি ভুলেও খুলবে না। পড়বে না।”
আদিব সেই কথা রেখেছে সে চিঠি খোলেও নি,পড়েও নি। কারণ আদিব কখনো ভাইয়ের হুকুমের অবাধ্য হয় না। আজও হয় নি। আদিব টেবিলের উপর চিঠিটা রেখেই রুম থেকে বের হলো। নিজ রুমে গিয়ে নামাজের টুপিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।’
–
তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আদ্রিতা আর আদিব দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ স্টেশনের বাহিরে। আদিব ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে পায় না। কারণ ফারিশ ভাই তাকে বারন করেছে পুলিশ স্টেশন আসতে। আদ্রিতা বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলো। সে বলল,“তুমি দাঁড়াও ভাইয়া আমি একাই যাচ্ছি।”
কথাটা বলে আদ্রিতা একাই চলে গেল। আদিব দাড়িয়ে রইলো। ভিতরে ঢোকার সাহস এলো না।’
আদ্রিতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ভিতরটা কেমন কেমন করছে। আদ্রিতা আশপাশ দেখলো। তাকে প্রথমেই নজরে পড়লো কিশোরের। সে মিষ্টি হেঁসে বলল,“আসুন ডাক্তার সাহেবা। আমি জানতাম আপনি আসবেন।”
আদ্রিতা নীরবে এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,“আমি একটু ফারিশের সাথে দেখা করতে চাই অফিসার।”
কিশোর নাকচ করলো প্রথমে। বলল,“আমরা তো এভাবে দেখা করতে দিতে পারি না ডাক্তার সাহেবা।”
আদ্রিতা মিনতির স্বরে বলল,“একটু দেখি।”
কিশোর বুঝলো। বলল,“ঠিক আছে। তবে একটুই যেন দেখেন।”
আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল লকাপের দিকে।’
গায়ে ধূসর রঙের শার্ট। কালো প্যান্ট। অগোছালো চুল। আর শ্যামবর্ণের মুখখানা নিয়ে মাথা নুইয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ফারিশ। আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো এমন দৃশ্য দেখে। বুকখানায় এত কষ্ট হচ্ছে তখন। আদ্রিতা নিজের চোখ মুছে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”
তড়িৎ চমকে উঠলো ফারিশ। চোখ তুলে চাইলো তক্ষৎণাৎ। আদ্রিতার মুখটা দেখলো। কেমন থমথমে হয়ে আছে। ফারিশের হৃদয়খানায় বুঝি হাহাকার করে উঠলো। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে আসলো। প্রশ্ন করলো,“তুমি কেন এসেছো বেলীপ্রিয়া?”
আদ্রিতা মলিন মুখে চায়। বলে,
“এমনটা করা কি খুব দরকার ছিল ফারিশ?”
ফারিশ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বোধহয় ছিল।”
“আমি যে ভালো নেই তুমি কি দেখতে পাচ্ছো?”
“পাচ্ছি।”
“আমি যে তুমিহীনা ভালো থাকবো না এটা জানতে না?”
“জানতাম।”
“তবুও কেন করলে?”
“আমি যে বাধ্য ছিলাম। তুমি তো জানো।”
“একটু কি স্বার্থপর হওয়া যেত না?”
“বোধহয় যেত কিন্তু সস্থি পাচ্ছিলাম না।”
“আমার ভালোবাসা তোমায় সস্থি দিত না ফারিশ?”
ফারিশ কথা বলে না। চুপ করে রয়। মাথা নুইয়ে ফেলে। আদ্রিতা আবার বলে,“আমায় ছেড়ে যাওয়ার এত তাড়া তোমার।”
ফারিশ চোখ তুলে তাকায়। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানায়,
“আমার কষ্ট হয় বেলীপ্রিয়া।”
মলিন মুখে হাসলো আদ্রিতা। কি বলবে ভেবে পায় না আর। ফারিশ মাথা নুইয়ে বলে,“চলে যাও।”
আদ্রিতা লকাপের শিকে হাত রাখে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধায়,“এতটা পাষাণ কিভাবে হলে?”
ফারিশ ছলছল নয়নে তাকায়। আদ্রিতার হাতটা ধরে। আদ্রিতার শরীর ফারিশের স্পর্শে আরো কাতরে উঠল তখন। ফারিশ বলল,“আমায় ভুল বুঝছো বেলীপ্রিয়া?”
আদ্রিতা জবাব দিতে চায় না। ফারিশ মৃদু হেসে বলে,“সত্যি করে বলো তুমি কি এমনটা চাওনি আদ্রি?”
আদ্রিতা চোখ তুলে সরাসরি তাকায়। এবারও কিছু বলে না। ফারিশ হেঁসে বলে,“বাড়ি যাও বেলীপ্রিয়া। এখানে আর এসো না।”
আদ্রিতা গেল না। ঠায় দাড়িয়ে রইলো। তবে কোনো কথাও বললো না। চুপচাপ পাথর মনে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফারিশ বলে,“আমার ভাইটার যত্ন নিও আদ্রি, ও খুব ভীতু। জানোই তো। আমার শাস্তির কথা ওকে এখনই জানিও না। আমার কেসটা যেদিন কোটে উঠবে ওইদিন তুমি বা আদিব কেউই এখানে থেকো না। দূরে কোথাও চলে যেও কেমন।”
এই বলে আদ্রিতার দু’গাল চেপে চোখের পানি মুছে দিল। এরপর খুশি মনে বলল,“এবার বাড়ি যাও। নিজের যত্ন নিও বেলীপ্রিয়া। আমি থাকি বা না থাকি নিজের যত্ন নিতে ভুলো না কিন্তু।”
আদ্রিতা আর সেখানে দাঁড়াতে পারছে না। বুকের ভেতর যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা এত সহজে ঘুচবে না। আদ্রিতা বলল,
“আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।”
আঁতকে উঠল ফারিশ। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলল,“হুস! এভাবে বলে না। আমি ফিরবো দেখো।”
আদ্রিতা আর কিছু বলতে পারলো না। একরাশ অভিমান। জড়তা, ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে ছুটে আসলো। ফারিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো।’
–
পরেরদিনটা যেন বিষণ্নের সকাল। বাংলাদেশের সমস্ত টিভি চ্যানেলে ফারিশের কেচ্ছার কথা জানালো হলো। ঔষধ কোম্পানির আড়ালে ফারিশের এই বেআইনি কারবার। আফিমসহ সকল নেশালো দ্রব্য এবং দেশীয় অস্ত্রের সবটা টিভিতে দেখানো হল। একদল জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ফারিশের ঔষধ কোম্পানিতে ভাংচুর চালালো, কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিল। ফারিশের তৈরিকৃত সকল ঔষধ ব্যান করা হলো। যদিও তাতে কোনো ভেজাল ছিল না। তবুও!’
আদ্রিতার কলিগ,বাবা,মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এমন নিউজে। একের পর এক কল আসছে আদ্রিতার বাবা,মা, ভাইর ফোনে। তারা ফোন তুলছে না। ফারিশের বাড়িতে ভাংচুর করা হলো। ভাগ্যিস তখন বাড়ির ভিতর আদিব আর আদ্রিতা ছিল না। খবর পেয়ে সূদুর চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসছে চাঁদনী। এই একদিনের ব্যবধানে কি ঘটে গেল সে বুঝতে পারছে না। ফারিশ ভাই মাফিয়া এই যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আদ্রিতার বন্ধুমহলের সকল সদস্য। মৃদুল,রনি,মুনমুন,আশরাফ ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে আদ্রিতার খোঁজে। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীটার কি অবস্থা হচ্ছে এটা তারা ধরতে পারছে না। আদিবকে কল করা হয়েছে। সে একটা এড্রেস দিয়েছে। সেই এড্রেসের উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিয়েছে সবাই। এই বিষয়টা সম্পর্কে আদিব ফারিশ ছাড়াও নয়নতারা জানতো। কিন্তু ফারিশ বারণ করায় কাউকে কিছু বলতে পারে নি সে। এজন্য খানিকটা ক্ষিপ্ত আশরাফ। চাপা উত্তেজনায় ভরপুর ঢাকার শহর। আজকের নিউজ চ্যানেলগুলোতে যেন ফারিশেরই উদ্ভাবন।’
–
বেলা এগারোটা। পুলিশ স্টেশনের বাহিরে এসে থামলো একটা রিকশা। সেখান থেকে নামলো একটি মেয়ে। পরনে সাদা রঙের থ্রি-পিস। সে ভিতরে এগিয়ে আসলো। কিশোরের মুখোমুখি দাড়িয়ে হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,“আমি ফারিশ মাহমুদের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.