অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ #অবন্তিকা_তৃপ্তি #পর্ব_৬

0
715

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_৬

শুভ্র আজ মেডিকেল থেকে ছুটি নিয়েছে। আজ আফরোজা কড়া কণ্ঠে বলে দিয়েছেন, আজ এ বাড়ি থেকে মেডিকেলে যে যাবে, তাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে মেডিকেলে যাওয়ার শখ গুচিয়ে দেওয়া হবে। মা রেগে আছেন দেখে শুভ্র না চাইতেও ছুটি নিয়েছে মেডিকেল থেকে। মেডিকেল নেই দেখে শুভ্র বেশ আরাম করে ঘুমালো আজ। ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে খেতে বসল নাস্তা। আফরোজা শুভ্রর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। শুভ্র বসলে উনি ডিম পোজ আর পরোটা এগিয়ে দেন। শুভ্র খেতে খেতে বললো,

‘আজ ছুটি নেওয়ালে যে? কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?’

আফরোজা এবার মুখ ভরে হাসলেন। খাওয়া থামিয়ে ছেলের দিকে চেয়ে গদগদ কণ্ঠে বললেন,

‘আজ তোর আর তুলির আকদ করানো হবে।’

‘আকদ’ কথাটা শুনে শুভ্র খাবারের মাঝেই কেশে উঠল। আফরোজা সঙ্গেসঙ্গে উঠে শুভ্রর পিঠে মালিশ করে দিতে লাগলেন। শুভ্র পানি খেয়ে শান্ত হলো কিছুটা। তারপর কড়া চোখে আফরোজার দিকে চেয়ে বললো,

‘আকদ এখন কেন ঠিক করলে আম্মু? আমাদের আরও চেনাজানা হওয়া উচিত ছিলো। এভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করলে দুজনেই সংসার করতে পারবো না। আমাদের সম্পর্কটা তেমন না।ইটস ডিফ্রেন্ট।’

আফরোজা ছেলের দিকে তাকালেন সন্দেহ নিয়ে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,

‘তুই কী তুলির সঙ্গে প্রেম করতে চাইছিস শুভ্র?’

শুভ্র এ প্রশ্নে শুনে মায়ের দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। মাঝেমধ্যে শুভ্রর মা এমন অদ্ভুত কথা বলে নে শুভ্রর তখন মন চায়, দেয়ালে মাথা টুকতে। শুভ্রর এভাবে তাকানোর কারণে আফরোজা মুহূর্তেই শুধরে গেলেন। বললেন,

‘সরি। তুই তো আর প্রেম করার মতো ছেলে না। তুই হলি নিরামিষ। তোকে দিয়ে প্রেম হবে না জানি আমি।’

শুভ্র মায়ের করা অপমানে হা হয়ে মায়ের দিকে চাইলো। কোন মা আছে পৃথিবীতে, যে ছেলেকে প্রেম করার জন্যে উষ্কে দিতে পারে? শুভ্রর জানা নেই। শুভ্র তাকালে, আফরোজা বললেন,

‘আচ্ছা বল। কী করতে চাইছিস? আকদ করবি না ঠিকাছে। তাহলে কী করবি? তোকে তুলির সঙ্গে ইয়াসমিন আকদ ছাড়া মিশতে দিবে না। ওদের পরিবারে এইটা নেই। আর আকদ শুধুমাত্র করানো হবে তোদের সম্পর্ককে আগে বাড়ানোর জন্যে। ইয়াসমিন এর মতে, তুলি সংসার করবে না আপাতত মেডিকেল শেষ করার আগ অব্দি। হাতে তুই তিন থেকে চার বছর পাচ্ছিস। সেটা দুজন দুজনকে জানার জন্যে যথেষ্ট নয়?’

শুভ্র ভাবলো অনেকক্ষণ। সে বিয়ে এখন করুক আর তিন বছর পর, তুলিকেই করতে হবে। তাহলে একটা হারাম সম্পর্কে জড়ানোর কী মানে? আকদ করে রাখলে সমস্যাতো নেই তেমন। শুভ্র ঘুরেফিরে আফরোজার কথাই ঠিক ধরলো। আফরোজা শুভ্রর মতিগতি বোঝার জন্যে তার দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে আছেন। শুভ্র খেতে খেতে তারপর বললো,

‘ঠিকাছে, আকদ করবো আমি। কিন্তু সেটার জন্যে কেনাকাটা করা লাগবে না? আজকে আকদ হলে কেনাকাটা করবে কখন?’

আফরোজা এবার বিজয়ের হাসি হাসলেন। মুখ ভরে হেসে বললেন,

‘সব কেনা শেষ। তুই শুধু চুপচাপ আকদ করতে বসে যা।’

শুভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। বললো,

‘কখন কিনলে? তুমি তো আমাকে ছাড়া কোনোদিন শপিং করো নি।’

আফরোজা উত্তর দেন,

‘ওই যে ওইদিন তুলিকে নিয়ে গেলাম না মার্কেটে? ওইদিন সব কিনে ফেলেছি। তুলির মাপের গোল্ডের আংটিও কিনেছি। দাড়া, দেখাচ্ছি এনে তোকে।’

আফরোজা চলে গেলেন নিজের রুমে আংটি আনতে। শুভ্র অবাক হয়ে মায়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মা কতটা ধুরন্দর তার, শুভ্র জেনে হতবম্ব। তার বিয়ে নিয়ে মায়ের খুশির শেষ নেই। আনন্দের আতিশয্য এ সকল অসুখ ভুলে তার বিয়ে নিয়ে মেতে আছেন। শুভ্র মায়ের আনন্দে সুখ সুখ অনুভব করছে ভীষণ। মায়ের একটা হাসির জন্যে শুভ্র নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে। এতো সামান্য বিয়ে।

আফরোজা এলেন, হাতে একটা ছোট্ট বক্স। শুভ্রর কাছে এসে বসলেন। বক্সটা শুভ্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘দেখ তো। তোর বউয়ের আংটি পছন্দ হয় কী না।’

‘শুভ্রর বউ’ কথাটা শুভ্রর বেশ লাগলো কেন যেন। মায়ের দিকে আবারো কোনা চোখে চেয়ে শুভ্র বক্স খুলে দেখলো। মাঝারি আকারের এক আংটি। আংটি খুঁটিয়ে দেখল শুভ্র। তারপর আবার বক্সে রেখে দিলো। আফরোজার দিকে বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘দেখলাম। সুন্দর হয়েছে।’
‘তোর বউকে দিয়েই পছন্দ করিয়েছি। ওর জন্যে কিনছি বলিনি।’

শুভ্র মায়ের এই বারবার ‘তোর বউ-তোর বউ’ বলা দেখে কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে। শুভ্র বললো,

‘বারবার বউ বউ বলছ কেন? বউ হয়নি এখনও!’

‘হবে তো, আজকে রাত থেকে।’

‘প্রোগ্রাম আজকে রাতে?’

‘হ্যাঁ। আমার বাড়ি, আর তোর দাদাবাড়ির কিছু মানুষকে দাওয়াত করেছি। ওরা দুপুরে আসবেন। অনুষ্ঠান খুব বড় করে হবে না।বিয়ে তো হবেই কয়েক বছর পর। তখন বড় করে করব কী বলিস শুভ্র?’

‘তুমি যা ভালো মনে করো।’

শুভ্রর খাওয়া শেষ। ময়লা বাসনগুলো মায়ের সঙ্গে শুভ্র কিচেনে ডিশ ওয়াশে রেখে আসলো। মায়ের পানি ছানতে কষ্ট হবে দেখে শুভ্র বেশ কয়েকমাস আগে একটা ডিশ ওয়াশার কিনে এনেছিল। সেটাই ব্যবহার হচ্ছে এখন। শুভ্র বাসন রেখে আসতে আসতে আফরোজা টেবিল পরিষ্কার করে ফেললেন।

শুভ্র রুমে এলো। রুমে এসে শুভ্র ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসলো। ল্যাপটপে কিছু কাজ শেষ করল। হঠাৎ শুভ্রর মনে পরল, তুলি তাকে ঘড়ি দিয়েছে। সে অনুযায়ী শুভ্ররও উচিত তুলিকে কিছু দেওয়া নিজের পক্ষ থেকে। শুভ্র ভাবলো। ল্যাপটপ বন্ধ করে রেডি হয়ে নিলো। টিশার্টের উপর জ্যাকেট জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আফরোজা ছেলেকে কোথাও যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এত সকালে কই যাচ্ছিস? মেডিকেলে?’

শুভ্র যেতে যেতে বললো,

‘তোমার বউমার জন্যে গিফট আনতে যাচ্ছি। ফিরতে লেইট হবে। দরজা সিটকিনি দিয়ে দাও, আম্মু।’
_____________________
শুভ্র আর তুলিকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। শুভ্রর কোলে জোবায়ের। ছেলেটা শুভ্র এলেই কোলে উঠে বসে থাকে শুভ্রর। সে আজকে আকদ-টা শেষ হওয়ার পরপরই শুভ্রকে দুলাভাই ডাকা শুরু করবে, কোনো থামাথামি নেই। এ কথা ইতিমধ্যে তার কয়েক শত বার বলা হয়ে গেছে শুভ্রকে। কবুল বলার সময় এসে গেছে। তুলির ফুপাতো ভাই জোবায়েরকে শুভ্রর কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে এলো। শুভ্র আর তুলির সামনে কাজী হুজুর বসে আছেন। শুভ্র আড়চোখে তুলির দিকে তাকালো। তুলির কপাল নাকের উপর ঘেমে একাকার। মেয়েটা ভয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে, কবুল বলবে কী। শুভ্রও নার্ভাস প্রচণ্ড। সে তাও তুলির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,

‘ভয় পাচ্ছো?’

তুলি তাকাল। মিথ্যে করে না বোধক উত্তর দিলে শুভ্র হাসলো। যেন মুহূর্তেই শুভ্রর মিথ্যে ধরে ফেলার অভ্যাস কত আছে! শুভ্র বললো,

‘ঘেমে গেছো একেবারে দেখছি। জোরে একটা নিশ্বাস নাও। নিজেকে রিলাক্স করো। হাত এভাবে চেপে না রেখে সুন্দর করে ছেড়ে রাখো। নিশ্বাস আটকে রেখেছ কেন? ছাড়ো সেটাকে। ভালো ফিল করবে।’

তুলি শুভ্র যা যা বললো সব করল। সত্যি তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। মাথা থেকে গরম ধোয়া বের হচ্ছে। যেন মগজে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। শুভ্রর কথামতো কাজ করায় এখন বেশ ভালো ফিল করছে। তুলি কৃতজ্ঞ হল শুভ্রর প্রতি। শুভ্রর দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসালো,

‘থ্যাংকস।’

শুভ্র মৃদ্যু হেসে তুলির দিকে তাকালো। দুজনের চোখে চোখ পরলো। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো তুলি।

কবুল বলার মুহূর্ত এলো। তুলিকে কবুল বলতে বলা হল। তুলি কিছুটাসময় নিলো। তারপর আড়চোখে আবারও শুভ্রর দিকে চেয়ে দেখলো। শুভ্রও তাকাল তখন।তুলি ভয় পাচ্ছে ভীষন। নতুন একটা সম্পর্কে জড়ানোর অভিজ্ঞতার ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তুলিকে। তুলি চুপ, ইয়াসমিন পাশে থেকে মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। তুলির হাত চেপে ধরলেন নিজের হাতে। তুলির চোখ বেয়ে অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল। ইয়াসমিন মেয়ের চোখ মুছে দিলেন আদরে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে তারপর বললেন,

‘মা, কবুল বল। কাজী অপেক্ষা করছেন না?’

মায়ের আশকারা পেয়ে তুলি কিছুটা শান্ত হলো। শুভ্র পাশ থেকে তুলির কান্না দেখছে। ইয়াসমিন পাশে না থাকলে তুলিকে কিছু বলা যেত, ভরসা দেওয়া যেত। এখন এত মানুষের সামনে কথা বলাও দুষ্কর। শুভ্র তুলির দিকে তাকিয়ে। তুলি ইয়াসমিনের থেকে চোখ সরিয়ে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র মৃদূ হাসলো তখন। হঠাৎ কী যে হলো তুলির! মনের অজান্তেই তুলির মুখ থেকে বের হয়ে এলো তিনটা শব্দ,

‘কবুল, কবুল, কবুল।’

তুলি যখন কবুল বলেছে শুভ্র সে সময়টায় তুলির দিকে ঠাই চেয়ে ছিলো। দুজন দুজনের চোখের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুসময়। উচ্চস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার আওয়াজে দুজনেরই ঘোর ভাঙলো।এতোক্ষণ ঘরভর্তি মানুষের ভিড়ে এভাবে চেয়ে ছিলো তারা? শুভ্র লজ্জায় অন্যদিকে তাকালো। তুলিও লজ্জায় মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। বাকিটাক্ষণ কেউই আর কারো দিকে তাকালো না।

এবার শুভ্রকে কবুল বলতে বলা হল। শুভ্র আফরোজার দিকে চেয়ে দেখলো একবার।আফরোজা খুশিতে কেঁদেই ফেলছেন প্রায়। আফরোজাকে একহাতে জড়িয়ে আছেন ইয়াসমিন। দুজনের চোখেই অশ্রু টলমল করছে। ইয়াসমিনের আঁচল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জোবায়ের। তার টালমাটাল চোখে আকাশসম বিস্ময়। এভাবে যে কেউ বিয়ে করে, হয়তো সে জানে না। তার প্রশ্নবোধক চোখ বারবার শুভ্র-তুলিকে দেখেই চলেছে। শুভ্র তুলির দিকে চায়। মাথা নিচু করে বসে আছে তুলি। কিন্তু শুভ্র জানে, কান তুলির শুভ্রর দিকেই তাক করা। শুভ্র কিছুটা সময় নেয়। তারপর মৃদু হেসে ধীরে ধীরে বলে,

‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল, কবুল, কবুল।’

সারাঘরময় একঝাঁক প্রশান্তি যেন উড়ে গেলো শুভ্রর কথায়। তুলির বুকটা ছলাক করে উঠলো। শুভ্র এত সুন্দর করে কবুল বলেছে যে তুলি মোহিত হয়ে গেলো একদম। মাথা তুলে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র এতোক্ষণ তুলির দিকেই চেয়ে ছিলো। অতঃপর দুজনের চোখাচোখি হলো। বরাবরের মতো তুলি চোখ সরিয়ে নিয়েছে।

কথা হচ্ছে বড়দের মধ্যে। বিয়ের বাকি কথা এখনি সেরে নিচ্ছেন তারা। বিয়ে হতে বাকি হাতে চার বছর আরও। শুভ্র আর তুলি সেসময় নিজেদের জেনে নিতে পারবে। সংসার করার মূলকাঠিই তো একে অপরকে জানা, বোঝা, ভালোবাসা। শুভ্র বড়দের কথার মধ্যে বিরক্ত হচ্ছিলো কিছুটা। তুলি পাশে নেই। চাচাতো বোন এসে রুমে নিয়ে গেছে। শুভ্রর বিরক্তি বুঝে, ইয়াসমিন বললেন,

‘শুভ্র, বাবা তুমি ঘরে গিয়ে বসো নাহয়। তুলিকে আমি রুমে পাঠাচ্ছি!’

#চলবে
বিয়ে ডান, মানে আকদ আরকী! আসল রোমান্স তো এখন শুরু হবে, বি রেডি টু কল মি অ্যা রোমান্টিক লেখিকা। ভালো মন্তব্যের আশাবাদী🤍

বি:দ্র- আমি একদিন পরপর, অথবা মাঝেমাঝে কাজ থাকলে দুইদিন পরপর গল্প দেই। ক্লাস, ব্যক্তিজীবনের যাঁতাকলের কারণে প্রতিদিন গল্প দেওয়া সম্ভব হয়না আমার জন্যে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here