#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৭
নিঝুম বিকেল। সারাদিন তোড়জোড় আর হৈ-হুল্লোড় করে নিচে মাদুর পেতে বসে ফারিশ আর আদিব। তাদের সামনেই আদ্রিতা আর চাঁদনী ঘুরে ঘুরে সেলফি তুলছে। এই মেয়েদুটোর আর কোনো কাজ নেই বোধহয়। সেই আসার পর থেকেই শুধু সেলফি আর সেলফি। ফারিশরা খাবার বানালো এখানে এসে। ওই যে ছোট্ট কুটির ঘর ছিল সেখানে বসে। ফারিশ আগে থেকেই সব বন্দোবস্তো করে রেখেছিল। দুপুরের লান্স হিসেবে ছিল গরম গরম ভাত, সিদ্ধ আলুর ভর্তা আর ফারিশের হাতের ডিম ভাজা। এই প্রথম ফারিশ নিজ হাতে রান্না করেছে। আদিব তো তা দেখে দারুণ অবাক। খাবার দাবার খুব সাদামাটা থাকলেও আনন্দের রেশ ছিল বেশ। সে কি উৎসবমুখর পরিবেশ! তবে এত উৎসবের মাঝেও আদিব লক্ষ্য করেছে ফারিশ ভাই হঠাৎ হঠাৎ চুপ হয়ে যান। গভীর ভাবনায় মগ্ন হন। যেমন এখন হচ্ছে। ফারিশ ভাই তাকিয়ে তো আছে ডাক্তার ভাবির দিকে তবুও চোখে মুখে কোথাও গিয়ে বিষণ্ণতা। আদিব নড়েচড়ে বসলো। মাদুরের মধ্যখানে রাখা জুসের বোতলটা নিলো। জুস ঢাললো গ্লাসে। এরপর ফারিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাই তুমি হঠাৎ হঠাৎ নেতিয়ে যাচ্ছো কেন? ডাক্তার ভাবি কি খুব পীড়া দিচ্ছে?”
ফারিশের হুস হাসে। সে তাকায় আদিবের দিকে। জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মলিন মুখে বলে,“তেমনটাই।”
আদিব অবাক হয়। বিস্মিত কণ্ঠে আওড়ায়,“মানে?”
ফারিশের ঠোঁটে জড়নো তখনও মলিন হাসি। আদিব সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিছু একটা বুঝে। অতঃপর আচমকা ফারিশের হাত চেপে বলে,“কিছু কি হয়েছে ভাই?”
ফারিশ জুসের গ্লাসের চুমুক দেয়। বিষণ্ণ চোখে তাকায়। আগের সেই এক উত্তর তার,“কি হবে?”
আদিবের হঠাৎ বিতৃষ্ণা লাগলো। বারে বারে ফারিশ ভাইয়ের ভণিতা করা এক উত্তরে বিরক্ত বোধ করলো। আদিব কপট রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে শুধাল,“আমার সাথে বার বার মিথ্যে বলছো কেন?”
আদিবের রাগ দেখে ফারিশের হাসি আরো চওড়া হয়। চোখ ছলছল করে। দৃষ্টি নত করে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“তুমি আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছো আদিব?”
ফারিশ মলিনের কণ্ঠস্বরে আদিব রাগের পানি হয়ে গেল। মন ছটফট করলো। খানিকটা আঘাত রাখলো বুকে। সে বলল,
“আমি রাগ দেখাতে চাই নি ভাই।”
ফারিশ সরাসরি তাকালো আদিবের দিকে। মলিন মুখে বিতৃষ্ণার ছোয়া এঁটে বলে,“আমার কিছু ভালো লাগে না আদিব। সব কিছু থেকেও কোথাও যেন সুখ নেই।”
আদিব বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“এমনটা কেন হচ্ছে ভাই?”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,“জানি না।”
আদিব মাথা নুইয়ে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলে “বিয়েটা করে কি সুখ হও নি ভাই?”
ফারিশ একঝলক তাকালো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটা সেই সূদুরে ছুটে ছুটে ছবি তুলছে। সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে বসছে। নানানভাবে ভণিতা করে মুঠোফোনে আবদ্ধ করছে নিজের ছবি। গায়ে জড়ানো শুভ্র কামিজে কি নিদারুণ সুন্দরী না দেখাচ্ছে তাকে। ফারিশ পলকবিহীন তার দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিল,“তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”
সস্থি পেল আদিব। নিশ্চিতের শ্বাস টেনে বলল,
“তাহলে সমস্যা কি?”
এবার ফারিশ সহজ হলো। নিজের কঠিন হৃদয়টাকে আঁটকে রেখে লাগামহীন বলতে লাগল,
“আমার কেন যেন কিছু ঠিক লাগছে না আদিব। এই ডাক্তার ম্যাডামের আচরণও আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। মেয়েটা জানে আমি একজন মাফিয়া। মাদকের ব্যবসা করি। তাও কিছু বলছে না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছে না। এমন আচরণ করছে যেন কিছুই জানে না। ওর তো উচিত আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া। ও তো ডাক্তার, কি করে মেনে নিচ্ছে মানুষের ক্ষতি করা এই মানুষটাকে। আমি যে ওর এই অস্বাভাবিক আচরণে আঘাত পাচ্ছি। ও কেন বুঝচ্ছে না। আমি ভিতর থেকে সস্থি পাচ্ছি না। প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছি না। মাথার উপর পাপের ভাড়ি বোঝাটা আমাকে ভিতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছি। আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার হচ্ছে। হাতুড়ি পেটার মতো বুকটা হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি কাতরাচ্ছি। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি কি করবো? বুঝচ্ছি না। পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে দিবো আদিব। আচ্ছা একজন দেশবিরোধী মাফিয়ার শাস্তি কি খুব ভয়ংকর হয়?”আমার শাস্তি কি হবে মৃতুদন্ড। নাকি সারাজীবনের জেল! আমার জেল হলে আমার প্রেয়সী কি ভালো থাকবে? তুমি ভালো থাকবে আদিব? আমিহীনা নিজেকে মেলাতে পারবে তো সমাজের সাথে?”
আদিব থমকে গেল। স্তব্ধ লাগলো চারপাশ। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ফারিশের মুখপানে। এসব কি বলছে ফারিশ ভাই? আদিবের আচমকা চোখ ভেসে আসলো। বাচ্চাদের মতো করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,“তুমি কোথাও যাবে না ভাই?”
ফারিশ হাসলো। সে জানতো তার ছোট ভাইর উত্তর এমনটাই হবে। আদিবের মাথায় হাত বুলালো ফারিশ। আশ্বাস দিয়ে বললো,“ভয় পেও না যাবো না।”
আদিব তাও শান্ত হতে পারলো না। ফারিশ ভাই ছাড়া তার জীবন যে শূন্য। সেই ছোট বেলা থেকে ফারিশ আদিবকে আগলে রেখেছে। নিজে না খেয়ে আদিবকে খাইয়েছে। অস্ত্র হাতে আদিবকে বাঁচাতে খুন করেছে। এই যে এখনকার পরিস্থিতি, ফারিশের নামের পাশে ট্যাগ আসে মাফিয়ার এটার দায়ও অধিকাংশ আদিবের। আদিবের সব এলেমেলো লাগলো হঠাৎ। মাথায় তীব্র জ্বালা পোড়া শুরু হলো। ফারিশ বুঝি আদিবের পরিস্থিতি বুঝলো। সে আলতো হাতে আদিবকে বুঝালো,“আমি এসব কিছু করবো না আদিব।”
আদিব মলিন মুখে আওড়ায়,“সত্যি করবা না তো ভাই?”
ফারিশ চোখের ইশারায় বুঝায়। যার অর্থ,“ভয় নেই করবো না।”
আদিব অত্যাধিক ভীতু একটা ছেলে। বিশেষ করে যখন তার ফারিশ ভাই তার আশেপাশে থাকে না। চারপাশ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বিষণ্ণ জাগে মনে,ভয় হতে থাকা এই সুন্দর ধরণীকে। সেই বর্ষণের রাতে ভয়ানক ঘটনা চোখে ভাসে। আদিব আগে নিজের রুমের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতো। কিন্তু জীবনে চাঁদনী আসার পর সেই ভয় খানিকটা হলেও কমেছে আদিবের। তবুও ফারিশ ভাইহীনা আদিব অচল। আদিব জানে না ভবিষ্যতে কি হবে? যদি সত্যিই সত্যিই ফারিশ ভাই পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করে দেয় তখন কি হবে? আদিব কিভাবে বাঁচাবে ফারিশকে? আদিবের হঠাৎ ভয় লাগলো। তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করলো। ফারিশের গম্ভীর আওয়াজ ফের আসলো তখন। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো ফারিশ,“আমি ভয় পেতে বারণ করেছি। এত সহজে তোমার জীবন থেকে ফারিশের ছায়া সরবে না আদিব। তুমি নিশ্চিত থাকো!”
আদিবের চোখ জ্বলে উঠলো। প্রাণপণ দিয়ে চেষ্টা চালালো। বোঝাতে চাইলো,“ফারিশ ভাই বিশ্বাস করুন আমি ভয় পাচ্ছি না।”
ফারিশ চেয়ে চেয়ে দেখে সেই অসহায় ছেলেটির কান্ড। ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করে ছেলেটির ব্যর্থতার মুহুর্ত। মনে মনে হাসে আর বলে,“হচ্ছে না আদিব। হচ্ছে না।”
—–
নিকষকালো অন্ধকারে ভরপুর চারপাশ। ফারিশ নিজ কক্ষে আসে তখন। তারা বাড়ি ফিরে এসেছিল সেই সন্ধ্যায়। এরপর ফারিশ যায় কাজে। ফিরে মাত্র। আদিব নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারিশ রুমে ঢুকতেই অবাক। কারণ তার পুরো রুম মোম আর ফুল দিয়ে সাজানো। ফারিশ পুরো রুমে চোখ বুলায়। দেখে জানালার ধারে জর্জেটের লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। ঘনকালো লম্বা কেশ কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো। চোখেমুখে হাল্কা সাজ। বাহিরের চাঁদের আলো এসে লাগছে অাদ্রিতার মুখে। ফারিশ বিস্ময়ের ন্যায় এগিয়ে যায় সেদিকে। পিছন থেকে আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট প্রশ্ন করে,“এসব কি করেছো বেলীপ্রিয়া?”
ফারিশের বেলীপ্রিয়া চমকে ওঠে তখন। বুকের ধুকপুকানি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে প্রায়। লজ্জায় সর্বাঙ্গ বুঝি ছুঁয়ে যায়। ফারিশ শীতল স্বরে আওড়ায়,
“এত সেজেছো কেন, আমার ধ্বংস চাই?”
আদ্রিতা কোনোরকম ‘না’বোধক মাথা নাড়ায়। লজ্জামিশ্রীত কণ্ঠে শুধায়,“আপনাতে বিলীন হতে চাই।”
#চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.