#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৮
ফারিশ চুপ থাকে। পুরো কক্ষজুড়ে নীরবতা বয় বেশক্ষণ। দূর আকাশের থালা বেশের চাঁদটা তা দেখে বুঝি লাজুক হাসে। বেশক্ষণের নীরবতার দড়ি ছিন্ন করে অভিমানী স্বরে বলে আদ্রিতা,“আপনি আমায় এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারেন নি তাই না ফারিশ?”
ফারিশ খানিক বিস্মিত হয়। আদ্রিতাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে আওড়ায়,“এমন মিথ্যে কে বলল তোমায়?”
আদ্রিতা স্মিথ হাসে। চোখভরা অশ্রুগুলোর একফোঁটা গড়িয়ে পড়ে নিচে। ফারিশ অবাক হয়। আদ্রিতার দু’গাল চেপে অস্থির কণ্ঠে বলে,
“আশ্চর্য! তুমি কাঁদছো কেন?”
“আমার আচরণে আপনি দুঃখ পান এককথা আমায় বললেন না কেন?”
ফারিশের আর বুঝতে বাকি রইলো না আদ্রিতার দুঃখ পাওয়ার কারণ। এই আদিবটা না আর বড় হলো না। সেই বলেই দিল। ফারিশেরই ভুল হয়েছে কথাগুলো বলার পর কড়া করে বলা উচিত ছিল,“শোনো আদিব, এইকথাগুলো ভুল করেও তোমার ডাক্তার ভাবিকে বলবে না।”
ফারিশ নিরাশ শ্বাস ফেললো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। শক্ত করে। আদ্রিতা অনুভব করলো না তা। নীরবে চোখ বুঝিয়ে নিল। এই লোকটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলে আদ্রিতার এত ভালো লাগে। সস্থি লাগে। প্রশান্তিকর অনুভূতি হয় তা বুঝানোর মতো নয়। ফারিশ বলতে শুরু করে,“আমি তোমায় অবিশ্বাস করি না,তোমায় অবিশ্বাস করা কি আমার সাজে বলে। আমার খালি ভয় লাগে। এই না তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও। আমার মাফিয়া পেশাটা তুমি কিভাবে নিচ্ছো আমি বুঝতে পারছি না।”
এবার আদ্রিতা বলে,“আমার আপনার মাফিয়া পেশা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই ফারিশ। আমি আপনায় ভালোবাসি। গোটা আপনিটাকেই ভালোবাসি। আমি জানি আপনার মানুষরূপের দুটি সত্তা আছে যার একটিতে আছে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড। আপনি চাইলেও এই কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসতে পারবেন না। আমি এটাও জানি। তাই আমি চাই না আপনি ফিরে আসুন। পিছে কোনো বিপদ ঘটলে তখন। আমি শুধু চাই আপনি আমার হয়ে থাকুন। এতবছর যেভাবে সবার থেকে বিষয়টা লুকিয়ে রেখেছেন বিশেষ করে কিশোরের থেকে সেভাবেই লুকিয়ে থাকুন। আমি জানি এই কথাগুলোয় স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে। তবুও আপনার জন্য আমি স্বার্থপর হতে রাজি ফারিশ। দয়া করে এই বিষয়টা নিয়ে আপনি আর কষ্ট পাবেন না।”
ফারিশ চুপ করে থাকে। অতঃপর প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করে,“এগুলো তুমি সাজিয়েছো?”
আদ্রিতা ফারিশের বাম দিকের বুকের অংশে নাক ঘষে ‘না’ বুঝায়। জানায়,
“আদিব ভাইয়া করেছে?”
“আর বিলীন হওয়ার কথাটাও বুঝি আদিব শিখিয়ে দিয়েছে?”
দুষ্টু হেসে বলে ফারিশ। আদ্রিতা লজ্জা পায়। ফারিশের থেকে নিজেকে দূরে সরায় তক্ষৎণাৎ। লাজুক স্বরে বলে,“আপনি একটা অসভ্য লোক। এই কথা আদিব ভাই ক্যামনে বলে দিবে। সে কি আপনার মতো বেহায়া। অবশ্য তার বউয়ের সাথে হতে পারে আমার সাথে ক্যামনে হবে।”
শেষ কথাটায় আদ্রিতা মুখ ভাড় করে ফেলে। ফারিশ দেখতে পেয়ে হাসে। নিদারুণ দেখায় হাসি। কপাল কুঁচকে চোখ দুটো ডেবে যায় সেই হাসিতে। ফর্সা দাঁত বের হয় খানিকটা। আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখে সেই হাসি। ফারিশ তাকায় আদ্রিতার দিকে। জর্জেট শাড়িটাতে যেন বেশ মানিয়েছে আদ্রিতাকে। শাড়ির ভাঁজে আদ্রিতার ফর্সা পেটটা খানিকটা দৃশ্যমান। এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি ফারিশ। আচমকা কেমন নেশাগ্রস্ত লাগলো নিজেকে। ফারিশ এগোলো একটু। আদ্রিতার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে আনলো। আদ্রিতা থমকালো। ফারিশকে লক্ষ্য করলো। ফারিশের চাহনি নেশালো। ফারিশ আদ্রিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে নেশাভরা কণ্ঠে বলে,“এমন বেসামাল শাড়ি পড়েছো কেন,আমি কিন্তু বদ্ধ উম্মাদনায় ভুগছি।”
আদ্রিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সরে আসবে। হঠাৎ ফারিশ এক আকস্মিক কান্ড ঘটালো। সে চুমু কাটলো আদ্রিতার ঘাড়ে। আদ্রিতা কেঁপে উঠল এতে। সর্বাঙ্গ বুঝি শিহরিত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। ফারিশ কোলে তুলে নিলো আদ্রিতাকে। দুষ্টুস্বরে বলল,“আজ এই মাফিয়া সাহেবের থেকে আপনায় কেউ বাঁচাতে পারবে না ডাক্তার ম্যাডাম।”
আদ্রিতা সে কথার জবাব দিল না। লজ্জায় মুখ লুকালো ফারিশের বুকে। ফারিশ আদ্রিতাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে মৃদু হাসলো। খাটের পাশের টেবিলটায় সাজিয়ে রাখা শুভ্ররঙের মোমটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। এরপরই নিজের হাত দু’খানা ডুবিয়ে দিল আদ্রিতার দু’হাতে। ধীরে ধীরে বিলীন হলো একে অপরের।’
হঠাৎ আকাশ কেঁপে উঠলো। ঝিরিঝিরি শব্দে শুরু হলো বৃষ্টিপাত। তীব্রতার বেশ নিল মুহুর্তেই। আকাশের সুন্দর চাঁদটাকে তখনও দেখা যায়। জ্বলজ্বল করছিল খুব। বোধহয় বলছিল একেই বলে সঠিক সময়ের ‘মধুময় প্রেমবর্ষণ।’
–
সময়! সময় বড়ই অদ্ভুত একটা জিনিস। এই সময় মানুষের জীবনটা হঠাৎ হঠাৎ বদলে দেয়। হঠাৎ দুঃখ বয়ে আনে,আবার দুঃখ হাটিয়ে সুখ দেয়। কারো জীবনে নতুন মানুষের আগমন ঘটায়। কাউকে দেয় বিষাক্ত বিচ্ছেদের বিষাদ। সময়ে সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ বদলায়,প্রকৃতি বদলায়,বদলে যায় দিন,ক্ষণ, তারিখ! তেমনই বদলে গেছে আদ্রিতা ফারিশের জীবন। বদলেছে আদিব চাঁদনীর জীবন। বদলেছে মৃদুল মিথিলার জীবন। বিয়ে করেছে মুনমুন আর রনি। সবশেষে বিয়ের কথাবার্তা চলছে নয়নতারা আর আশরাফের। দেখতে দেখতে ফারিশ আদ্রিতার সংসার জীবনের কেটে গেল একটি বছর। যাকে দিনে হিসেব করলে হয় তিনশো পঁয়ষট্টি দিন। কেমনে যে চলে কেউ ধরতেই পারলো না।’
আজ রবিবার। মাস জানুয়ারির মাঝপথ। খানিক শীত খানিকটা গরমের হাবভাব। এবছরটায় খুব একটা শীত পড়ে নি। আদ্রিতা খুব সকাল সকাল বের হচ্ছে হসপিটাল। পরপর কয়েকটা সার্জারীর অপারেশন আছে তার। পুরো দিনটাই ব্যস্ত আজ। ফারিশ বিছানায় শুয়ে। বেঘোর ঘুমে মগ্ন। গায়ে জড়ানো মোটা কম্বল। আদ্রিতা পরিপাটি পোশাক পড়ে বিছানার দিকে তাকালো। ঘড়িতে সকাল ন’টার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। আদ্রিতা ফারিশ দিকে তাকিয়ে বলল,“বখাটে সাহেব শুনতে পাচ্ছেন, আমি কিন্তু যাচ্ছি।”
ফারিশ নড়লো না একচুলও। আদ্রিতা দ্রুত সামনের জানালাটার সাদা পর্দা সরালো। সঙ্গে সঙ্গে এক ফালি রোদ্দুর চোখের উপর পড়লো ফারিশের। ফারিশ খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো এতে। মিহি কণ্ঠে বলল,“উফ! বেলীপ্রিয়া কি হচ্ছে? আমি ঘুমাই না।”
আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে ফারিশ মুখের সামনে দাঁড়ালো। এতে ছায়া পড়লো ফারিশের চোখে। আদ্রিতা বলল,“ওঠো না কেন? আমি যাবো এখন।”
ফারিশ চোখ খুলে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে। বিস্ময়কর চাহনী নিয়ে বলে,“যাবো মানে? কোথায় যাবে তুমি?”
আদ্রিতা বিছানায় বসলো। ফারিশও উঠে বসলো তখন। শরীর জুড়ে ক্লান্তি তার। আদ্রিতা বলে,“তোমায় কাল বললাম না আজ আমার পরপর কয়েকটা অপারেশন করাতে হবে। তাই যাচ্ছি। বেলা গড়িয়ে ফিরবো। তুমি চিন্তা করো না কেমন।”
কথাটা বলে ফারিশের গালে চুমু কাটে আদ্রিতা। এরপর নিজের গালটাও এগিয়ে দেয় ফারিশের দিকে। ফারিশও ঘুম জড়ানো চোখে নিজের অধর ছোঁয়ায়। এটা নিয়ম। কেউ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে এক অপরের গালে চুমু কাটে। আদ্রিতা নিজের ব্যাগটা নিল। উঠে দাড়িয়ে বলল,“যাই তবে।”
ফারিশ উত্তর দিল না। হাত টেনে ধরলো আদ্রিতার। আদ্রিতা অবাক হয়ে বসলো খাটে। চোখের ইশারায় বুঝাল,’কি হলো?’
ফারিশ সে ইশারা বুঝেও জবাব দিল না। আদ্রিতা ঠায় চেয়ে। নিরাশ স্বরে বলে,“কিছু বলবে না?”
ফারিশ সে’কথার জবাব না দিলেও কাছে টেনে নেয় আদ্রিতাকে। বুকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ। আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে বলে,“সকাল সকাল এত প্রেম! বাহ্ বাহ্!
ফারিশের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। আদ্রিতা উপলব্ধি করলো তা। কিছু বলল না। ফারিশ মলিন মুখে প্রশ্ন করল,“তোমার অপারেশন শুরু কয়টায়?”
আদ্রিতা কিছুটা অবাক হলেও ভাবলো না তেমন। বলল,
“দশটা পনের।”
“এখন বাজছে কয়টা?”
“ন’টা পাঁচ।”
“তার মানে আমার কাছে এখনও সময় আছে সত্তর মিনিট।”
“কিসের সময় বলো তো?”
“কেন তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকার।”
“আমি তো এখন বের হবো?”
“এখনও তো এক ঘন্টার বেশি বাকি একটু বসে গেলে হয় না।”
“তুমি তো জানো আমি অপারেশনের একঘন্টা আগে হসপিটাল যাই। একটু নিজেকে গোছাই।”
“আজ একটু অনিয়ম করলে হয় না।”
ফারিশ শেষ কথাটা এমন মলিন স্বরে বলল যে আদ্রিতা চেয়েও বারণ করতে পারলো না। মিষ্টি হেঁসে বলল,“ঠিক আছে।”
ফারিশ খুশি হলো। সময়টা তখন টিপটিপ করে বাড়ছে। ফারিশ চুপচাপ বসে আদ্রিতা জড়িয়ে ধরে। কোনো কথা বলছে না। সময় চলতে চলতে দশটা পনের বাজতে ত্রিশ মিনিট বাকিতে ঠেকে। তখন আদ্রিতা বলে,“এবার যাই। আমার পৌঁছাতেও তো সময় লাগবে।”
ফারিশ মেনে নিল। ছেড়ে দিল আদ্রিতাকে। কপালে চুমু কেটে বিষণ্ণ স্বরে শুধাল,“কেমন যেন আমার মনে হচ্ছে তুমি গেলেই আমি হারিয়ে যাবো।”
আদ্রিতা কপট রাগ দেখালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“যাওয়ার সময় এ কেমন কথা।”
ফারিশ চমৎকার শব্দ করে হাসলো। বলল,“তোমাকে রাগাতে আমার এত ভালো লাগে কেন?”
আদ্রিতা জবাব দিল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ফারিশ হেঁসে বলল,“যাও,তোমার লেট হচ্ছে।”
আদ্রিতাকে অসয়হায় দেখালো। একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজের ব্যাগটা নিল। নিরাশ ভঙ্গিতে বলল,“কোথাও যাবে না। বাসায় বসে থাকবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় আসবো।”
ফারিশ বলল,“আচ্ছা। এখন যাও।”
আদ্রিতা যেতে নিল। আবার দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে মলিন মুখে বলল,“কোথাও যাবে কিন্তু।”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে জানান দিল,“যথা আজ্ঞা মাই বেলীপ্রিয়া।”
ফারিশের কান্ডে ফিক করে হেসে দিল আদ্রিতা। বলল,“আসছি।”
অতঃপর আদ্রিতা চলে গেল। ফারিশের উজ্জ্বল মুখখানা হঠাৎ মলিন হলো। নিরাশাতায় ভরে উঠলো চারপাশ। সে গলা ছেড়ে ডাকলো,
“আদিব..।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.