#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩+৪
______________________
বিয়ে শব্দটি নিয়ে প্রতিটি মেয়েরই মনের সুপ্ত কোনে থাকে একরাশ অনুভূতি। বিয়ে দু অক্ষরের সমন্বয়ে একটি শব্দ হলেও এর সাথে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য আবেগ,অনুভূতি, ভালোবাসা, বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা। একটি বিয়ের সম্পর্কে শুধু দুটো মানুষের মনের মিল বা দুটো মানুষের বোঝাপড়ার বিষয়টি মূখ্য ভূমিকা পালন করে না। বিয়ে মানে নির্দিষ্ট দুটো মানুষের মনের মিলের পাশাপাশি দুটো পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভরসা,বিশ্বাস। কিন্তু এসব ঠুনকো হয়ে যায় যেদিন থেকে বিয়ে নামক পবিএ সম্পর্কের বন্ধনে খুব বাজেভাবে জড়িয়ে পড়ি আমি।
শুনেছিলাম বিয়েকে বলা হয় শান্তির প্রতিক। কিন্তু যেখানে স্বামী নামক মানুষ টা থাকে অপ্রিয়, ঘৃণ্য সেখানে শান্তি কি করে আসবে?
.
বিছানার একপাশে গুটিশুটি হয়ে অনবরত অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। আমার ঠিক সামনাসামনি সোফায় বসে আছে হ্যাভেন। সকাল আটটা বাজে তখন। লোকটা সোফায় গা এলিয়ে বসে ট্রি টেবিলে দুপা মেলে দিয়েছে। দৃষ্টি তাঁর ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় কি করে হতে পারে? এই একটি প্রশ্নই যেনো বার বার বুকের ভিতর কড়া নাড়ছিলো। আঠারো বছর বয়স আমার তখন। প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে নিজেকে জড়ানোর কথা কখনো ভাবতেও পারিনি৷ বিয়ে নিয়েও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলামনা। অনুভূতির কোঠা ছিলো একেবারেই শূন্য৷ সেই শূন্য অনুভূতি তে মানসিক, শারীরিক দুদিক থেকেই বিধ্বস্ত করা হয় আমাকে। সে মূহুর্তে বাকশূন্য হয়ে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না আমার।
আমার ফুঁপানির শব্দে হ্যাভেন বিরক্ত হয়ে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায়৷ আমাকে দেখে মুচকি হেসে ফোনটা একপাশে রেখে টানটান হয়ে বসে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে,
-‘ ওহে সুন্দরী কেনো এতো বিচলিত হচ্ছো? তোমার সৌন্দর্যের বিসর্জন হয়েছে তোমারই মতোন খাঁটি। মুক্তোর দানার মতো অশ্রু আর কতো ঝড়াবে ‘?
আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না৷ শুধু কান্নার বেগ কমিয়ে দিলাম। ওনি বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। আমার কাছে ওনি পুরোটাই ছিলেন বিরক্তিকর। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিরক্তিকর আচরণ যেটা পরিলক্ষিত হয় তা হলো হঠাৎ হঠাৎ খুব বিশ্রিভাবে হেসে ওঠেন ওনি। তখনো বেশ উচ্চস্বরে হেসে ওঠলেন৷ কান্না থামিয়ে তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম৷ এমন অদ্ভুত মানব পৃথিবীতে আর দুটো দেখিনি আমি। যদি সম্ভব হতো ঐ মূহুর্তে ওনার গলায় দড়ি ঝুলিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে টাঙিয়ে দিতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয় তাই স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। আর ওনি ঘর কাঁপিয়ে হাসছে আর ঘুরপাক খাচ্ছে। অতিরিক্ত লম্বা মানুষ টা, গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণ চোখ জোরা থাকে সব সময় লালআভাযুক্ত। কালো বর্ণের মানুষদের চোখ লাল কি ভয়ংকরই না লাগে৷ আমার কাছে ওনার ঐ রক্তিম চোখই ওনার সকল হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ।
আচমকাই ওনি আমার খুব কাছে চলে এলেন। আমার চিবুকে আলতো ছুঁয়ে প্রশ্ন করলেন,
-‘ বান্ধবীর নাম কি ‘?
আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই ঘৃনায় অন্যদিকে চোখ সড়িয়ে নিলাম। ওনি আমার মুখোমুখি হয়েই ছিলেন আবারো প্রশ্ন করলেন,
-‘ নাম কি তাঁর ‘?
-‘ কার কথা বলছেন আপনি ‘? মুখে বিরক্তির ছাপ তুলে রাগি গলায় প্রশ্নটি করলাম।
-‘ বউয়ের নেশায় পড়ে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। সেই বান্ধবী যার জন্য এমন পূর্ণিমার আলো আমার ঘরে স্থাপিত হলো ‘।
ওনি মিনার কথা বলছিলেন বুঝতে পেরে আমি তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললাম,
-‘ কেনো এবার মিনার পালা নাকি ‘?
আমার কথায় ওনি আবারো হাসতে শুরু করলেন। আমার থেকে খানিকটা সড়ে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে শরীর ছেড়ে দিলেন। বিছানার সাথে সাথে আমিও কেঁপে ওঠলাম। ওনি হাসি থামিয়ে ওনার লোলুপ দৃষ্টি ছুঁড়লেন আমার দিকে। আমার গা ঘিনঘিন করে ওঠলো। ওনি চোখ ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন,
-‘ তোমাকে বউ করে এনেছি এর পিছনে রয়েছে বহু কারণ তাঁর মধ্যে সর্বপ্রথম কারণটি হলো তোমার ঐ বান্ধবী। আমি এই হ্যাভেন তালুকদার কে তাচ্ছিল্য করে কেউ পাড় পেয়ে যায় নি। ভুলক্রমে এই সাহস যে দেখায় তাঁর পরিণতি কতোটা ভয়ংকর হয় তা তাঁর ধারণারও বাইরে৷ আর আমাকে প্রত্যাখান করার শাস্তি কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তা আশা করি তুমি বুঝে গেছো ‘?
রাগে,ক্ষোভে খুন করতে ইচ্ছে করছিলো লোকটাকে। আমি তাঁর দিকে ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ে ছিলাম। ওনি এক পলক আমার সে চাহনী দেখে এক লাফে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-‘ আমি ভীষণ অভদ্র তবুও ভদ্রতা দেখাতে গিয়েছিলাম। আফসোস আমার ভদ্রতা তোমার কপালে সইলো না। এলেম আছে বলতে হবে নয়তো হ্যাভেন তালুকদারকে থাপ্পড় দেওয়ার সাহস যে সে মেয়ে করবে না ‘।
আমি চমকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ওনি আবারো বিশ্রি ভাবে হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন,
-‘ বিয়েতো সভ্যভাবেই হতো যদি না এই সুন্দর মুখে তিক্ত বুলি শোনাতে যদি এই নরম হাতের কঠিন স্পর্শ না দিতে। যাক সে কথা ডোজটা বোধ হয় বেশী হয়ে গেছে সুন্দরী এরপর কাজে বাঁধা না দিলেই মঙ্গল ‘।
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। হিংস্র হয়ে ওনার কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বললাম,
-‘ আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি না আর না মানি এই বিয়েটাকে৷ জোর করে সব পাওয়া যায় না মি. হ্যাভেন তালুকদার ‘।
ওনি এক ঝটকায় আমাকে ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন,
-‘ গলাটা নামিয়ে এই স্পর্ধা যেনো দ্বিতীয় বার আর না দেখি। জোর করে সব পাওয়া যায় কি যায় না সেটা এখনো বোঝার বাকি আছে ‘?
কিছুক্ষণ থেমে আবারো বললেন,
-‘ লিসেন সৌন্দর্য সবার জীবনে সৌভাগ্য বয়ে আনেনা। তোমার সৌন্দর্য তোমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমার কালদিন নিয়ে এসেছি আমি। এতো দূর্দশায় তোমার সৌভাগ্য এটাই বিয়ে করেছি ভোগ করেছি কিন্তু ছেড়ে দেইনি ‘।
– ‘ আপনার ছাড়ার অপেক্ষা আমি করবো না জাষ্ট একটা উপায় হোক এখান থেকে নিজেকে আমি মুক্ত করবোই ‘।
হ্যাভেন মেঝেতে তিনবার থুথু ফেললো। ভয়ংকর কন্ঠে গর্জন ছাড়লো,
-‘ সে উপায় এ জীবনে আর হবে না। বউ কে সহজ হাতে হ্যান্ডেল করার মতো বোকা আমি না। ভালোবেসে বিয়ে করিনি সুন্দরী। চিনতাম না জানতাম না হুট করে এক পলক দেখে বিয়ে কি এমনি এমনি করেছি নাকি? এর পিছনে বহুকারণ রয়েছে তাঁর মধ্যে তিনটি কারণ স্পেশাল এক. তুমি রূপসী আমি কুৎসিত। দুই. তুমি পবিত্র আমি অপবিত্র। তিন. নাহ এটা না হয় সঠিক সময়ে বলবো’।
ওনি দরজার দিকে এগুতে লাগলো আমি কান্না জড়িত গলায় অনুরোধ করে বলে ওঠলাম,
-‘ আপনি আর কারো কোন ক্ষতি করবেন না। সব শাস্তি আমি পেয়েছি তাহলে কেনো মিনাকে শাস্তি দেবেন আপনি ‘?
বিনিময়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ওনি বললেন,
-‘ আই লাইক ইট। এতো আপসেট হইয়ো না সুন্দরী। যার জন্য এমন বউ পেলাম তাঁর ক্ষতি করতে পারি নাকি? শুধু দেখিয়ে দেবো বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা অসম্ভব সুন্দর মানিয়েছে ‘।
.
দরজা খুলতেই আমার ছোট বোন অনা সামনে পড়ে। অনাকে দেখে ওনি ওনার সেই বিশ্রি ভয়ংকর হাসিটা দেয়। অনা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। আমি দ্রুত গিয়ে অনাকে বুকে জড়িয়ে নেই আর ক্রুদ্ধ হয়ে বলি,
-‘ দয়া করে আমার ছোট বোনটার সামনে এমন বিশ্রি রূপ বের করবেন না ‘।
ওনি কথা না বাড়িয়ে গুনগুন করতে করতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আর আমি অনাকে নিয়ে রুমে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়া রুমে আসে। বলে রেডি হয়ে নিচে যেতে ও বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী নতুন বউ কে সকলকে খাবার বেড়ে দিতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হলো আমাকে। যাওয়ার আগে ভালোভাবে শাড়ি পড়িয়ে দুহাতে মোটা মোটা বালা। গলায় ভারী হার পড়িয়ে দিলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো সকলের সামনে যেনো ঘোমটা না খুলে যায়৷ তাহলে আমার শশুর নাকি অসন্তুষ্ট হবেন। অযথা কথা না বাড়িয়ে হিয়ার সাথে নিচে চলে যাই। খাবার টেবিলে মা,বাবাকে দেখতে পেলাম অনা গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। একে একে ও বাড়ির সবাই এসে বসলো। সেদিনই প্রথম সবাইকে ভালোভাবে খেয়াল করলাম আমি। আমার শাশুড়ী মা অমায়িক সুন্দরী। অথচ শশুর মশাই আর চাচা শশুর কৃষ্ণবর্ণের। আমার দুই দেবর হ্যারি আর হিরা বিদেশীদের মতো ফর্সা। তিন ভাই’ই সুঠাম দেহের অধিকারী বডি ফিটনেস দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত জিম করে এরা। তিনভাইই একসাথে বসেছে কিন্তু হ্যারি,হিরার পাশে হ্যাভেনকে আমার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না৷ দুভাই কি সুন্দর নিচের দিকে মাথা রেখে খাচ্ছে আর ঐ অসভ্য, ইতর টা বেহায়ার মতো আমার দিকে চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এতোগুলা সভ্যমানবের মাঝে এই একটা অসভ্য মানব কি করে ঠাই পেলো?
আর এই চরম বেয়াদবের হাড্ডি টা আমার কপালেই কেনো জুটলো? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাশুড়ী যা যা বলছিলো করছিলাম। খাবার শেষে শাশুড়ী এক বাটি পায়েস হাতে ধরিয়ে দিলেন বললেন হ্যাভেনকে দিতে। ততোক্ষণে হ্যাভেন রাক্ষসের মতো তিন প্লেট পোলাও মাংস গিলে উপরে চলে গেছে। আমি আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম শাশুড়ীর মুখের দিকে সে বললো,
-‘ চিন্তা করোনা খেতে পারবে দশ বাটি ভাত খেলেও খাওয়া শেষে এক বাটি পায়েস না খেলে ওর পেট ভরে না ‘।
কথাটা শুনে মন চাচ্ছিলো পায়েসের সাথে বিষ মিশিয়ে তারপর পেট ভরাই৷ দুদিন ধরে ঠিকভাবে পেটে দানাপানি পড়েনি আমার খিদায় পেট চু’চু করছিলো। কিন্তু নিজে থেকে খাওয়ার কথা বলতেও পারছিলাম না। আমার মা তখন অনাকে পোলাও খাওয়িয়ে দিচ্ছিলো মনে মনে আফসোস করতে থাকলাম – ‘ ও আম্মু একটু এদিকে নজর দাও তোমার বড় মেয়ে খিদের জ্বালায় কোমায় চলে যাচ্ছে সশরীরে শেষ দেখাটুকু একটু দেখে নাও গো আম্মু ‘।
_________________
বিয়ের সাতদিন কেটে যায়। বাবা,মা বোনও চলে যায় নিজ বাড়িতে৷ যাওয়ার সময় অনেক কান্না কাটি করি আমি। যাতে এই নরকে আমাকে একা রেখে না যায়৷ কিন্তু লাভ হয় না বাবা,মা এক গাদা জ্ঞান দিয়ে বুঝিয়ে চলে যায়। মায়ের বলা শেষ কথাটা বার বার কানে বাড়ি খায় আমার৷ ‘ আহি মা জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে সবই ঐ উপরওয়ালার হাতে৷ বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেনো হ্যাভেন তোর স্বামী। তাঁকে তুই কখনো অসম্মান করিস না, তাঁর অবাধ্য হবি না কখনো। কতো বড়লোক বাড়ির বউ হয়েছিস তুই বলতো? এতো বড় বাড়িতে আমরা কোনদিন তোকে বিয়ে দিতে পারতাম না৷ তোর শাশুড়ীর সাথে কথা হয়েছে ওনি বলেছেন তোকে পড়াশোনা করাবো। যতো পড়তে চাস পড়াবে কোন অসুবিধা নেই রাজরানী করে রাখবে তোকে’। আমি মায়ের কথা মানতে নারাজ ছিলাম বলে মা বলেন,’ দেখ আহি এ বাড়ির লোক যদি খারাপ হতো জামাই বাবা যদি খারাপ মানুষ হতো আমাদের এতো খাতির যত্ন করতো না। আর তোকেও বউয়ের স্বীকৃতি দিয়ে সারাজীবন নিজের কাছে রাখতে চাইতো না। বিয়ে যখন হয়ে গেছে মেনে নে সবটা৷ দেখবি খুব সুখী হবি তুই আমার দোয়া সব সময় আছে তোর সাথে। শুনেছি জামাই বাবা ক্ষেপাটে হলেও মনটা খুব ভালো তোকে খুব ভালো রাখবে ‘।
মাকে সেদিন বলতে পারিনি -‘ মা গো তোমার জামাই এতো ভালো দিয়ে কি হবে? সে তো তোমার মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি৷ সে তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে নিজের জেদ বজায় রাখতে। রূপের নেশায় পড়ে বিয়ে করেছে ওনি আমায়। সুখ কাকে বলে? ভালোবাসা বিহীন সুখ কেমন হয়’?
.
অচেনা জায়গা অচেনা মানুষ জনদের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। সারাদিন শাড়ি পড়ে সং সেজে ঘুরে বেড়াই। রাতের বেলা ঐ ঘৃণ্য মানুষ টার সংস্পর্শে মরে থাকি। দিনগুলো যাও কাটে রাতগুলো কাটে খুবই ভয়ংকর। নিজের প্রতি জীবনের প্রতি তৈরী হয় বিতৃষ্ণা। মিনা আর আঁখিকে এর মধ্যে একদিন হ্যাভেন নিয়ে আসে। ওদের সামনে হ্যাভেন আমার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
-‘ কি,,,বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা দেখতে কেমন লাগছে ‘?
উত্তরে ওরা দুজনই নির্বাক ছিলো। সামান্য একটা বিষয় এভাবে এতোদূর গড়িয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি ওরা৷ অপরাধীর মতো মাথা নত করে চলে যায় ৷ একদিন হ্যারি ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে হিয়ার সাথে হাসি, ঠাট্টা করছিলো। আমি গিয়ে হিয়ার পাশে বসতেই হ্যারি মাথা নিচু করে ওঠে যায়। আমি অবাক হয়ে তাকাই হিয়ার দিকে। হ্যারি আর হিরা বিয়ের পর থেকে একবারো চোখ তুলে তাকায়নি আমার দিকে কি আশ্চর্য! সম্পর্কে তো ভাবি হই আমি তাহলে এরা এমন করে কেনো? হিয়াও যৌক্তিক কোন উত্তর দেয়নি শুধু বলেছিলো লজ্জা পায় অথচ এদের তিনভাইকে দেখেই বোঝা যায় এরা সেরা লাজহীন। হ্যারি আর হিরা যে লজ্জা পেয়ে আমার থেকে পালিয়ে বেড়ায় না এটা বুঝতেও কষ্ট হয় না আমার৷ বেশ কিছুদিন কেটে যায়। শাশুড়ী আর ননদের সাথে মিশতে ইদানীং ভালোই লাগে। কথার ফাঁকে জানতে পারি হ্যাভেন আর হ্যারির জন্ম অস্ট্রেলিয়া তে৷ আমার শশুর আর চাচা শশুর বউদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থাকতেন৷ সেখানেই জন্ম হয় হ্যাভেন আর হ্যারির। হ্যারি হ্যাভেনের থেকে বয়সে মাএ দের বছরের ছোট। আমার শশুরের বন্ধু ওদের দুজনের নাম রেখেছে৷ এজন্যই নামের মধ্যে অন্যদেশীয় আভাস পাওয়া যায় এদের। কিন্তু আমার মনে হয় হ্যারি অস্ট্রেলিয়া জন্মালেও হ্যাভেন নির্ঘাত আফ্রিকায় জন্ম নিয়েছে। আমার শাশুড়ী মা হয়তো কোন মিসটেক করছেন। সেগুলো অবশ্য রেগে ধারণা করতাম।
.
বিয়ের পঁচিশ দিনের মাথায় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি৷ আশ্চর্য হলেও সত্যি অসুস্থতার পুরো সময়টা হ্যাভেন আমার সাথে কোন বাজে আচরণ করেনি। বিয়ের পর অসুস্থ হওয়ার সুবাদেই হ্যাভেনের বুকে ঠাই হয় আমার৷ নিজের চাহিদা ছাড়া বিয়ের পর হ্যাভেন আমার কাছে আসেনি। চাহিদা মিটে গেলেই ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলেছে। অথচ সেদিন আমায় পরম আদরে বুকে টেনে নেয়। হাজার হোক স্বামী তো? অদৃশ্য এক মায়া অনুভব করি তাঁর জন্য। কিন্তু প্রকাশ করিনা৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই একবার চেষ্টা করে দেখবো মন থেকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার। হয়তো ভালো কিছুও পেতে পারি। কখনো জেনে বুঝে কোন অন্যায় করিনি তাহলে আমার সাথে কেনো এতো বড় অন্যায় হবে? যা হয়েছে তা দূর্ভাগ্য হিসেবে গ্রহণ না করে সৌভাগ্য মনে করে সুখী তো হওয়াই যায়। শুনেছি ভালোর সংস্পর্শে এলে খারাপও ভালো হয়ে যায়। আমি আমার সব ভালোটা দিয়ে কি পারিনা এই মানুষ টার খারাপ কে মুছে দিতে? কথায় আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। বড় লোকের ছেলে তারওপর রাজনীতি করে। সঙ্গই তো খারাপ একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না ফলাফল কি দাঁড়ায়?
.
পুরো সাতদিন পর সুস্থ হই আমি। আর হ্যাভেনের কাছে আবদার করি আমাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। চার দেয়ালে বন্দি থাকতে কারই বা ভালো লাগে? একমাস ধরে বাড়ির বাইরে পা দেওয়া তো দূরের কথা ছাদে অবদি যেতে দেওয়া হয়নি আমাকে। আমার আবদারে হ্যাভেন সেই বিশ্রি হাসিটা দিলো৷ আমি ঐ বিশ্রি হাসিটাকে মধুর নজরে দেখার ভান করে হজম করার চেষ্টা করলাম। শাড়ি পড়ে হালকা গয়নাগাটি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। ড্রয়িং রুমে আসতেই হ্যাভেন আমার হাতটা চেপে ধরলো। গাড়িতে গিয়ে বসলাম তবুও হাত ছাড়লো না। ড্রাইভার কাকুকে দেখে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিলো। ওনাকে নিচু স্বরে বললাম,
-‘ হাতটা ছাড়ুন গাড়িতে বসেও হাত ধরে রাখতে হবে কেনো ড্রাইভার কাকু দেখে কি ভাবছে বলুন তো ‘?
-‘ ওনার ভাবাভাবি কে কেয়ার করলে আমার তো চলবে না সুন্দরী ‘।
বিরক্তিতে আর কথা বাড়ালাম না৷ এই লোকটার সবেতেই বাড়াবাড়ি। একটা ভালো স্বভাবও এর মাঝে লক্ষ করা যায় না। পুরো সময়টা হাত চেপে ধরে ছিলো। গাড়ি থেকে নেমেও হাত ছাড়েনি। সোজা একটি রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকে এক জোড়া কাপলের সামনে গিয়ে বসে এবং আমাকে বসতে বলে৷ ভাবলাম হয়তো কোন বন্ধু আর বন্ধুর বউয়ের সাথে দেখা করাতে নিয়ে এসেছে। মৃদু হেসে সালাম দিলাম। আমাকে দেখে ঐ দুজন এমনভাবে চেয়েছিলো যেনো আফ্রিকান বাঁদর হ্যাভেন না আমি নিজেই। ইতস্ততভাবে হ্যাভেনের পাশে বসলাম আমি।
.
পরিচয় পর্ব শেষে হ্যাভেন সামনে বসা অতি সুদর্শন ছেলেটা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘ আমার ভাইয়েরা আমার ওয়াইফের দিকে শুভ দৃষ্টিই নিক্ষেপ করার সাহস দেখায় না আর তুই অশুভ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিস? আই ডোন্ট লাইক ইট। কি জিসান আর কতো চেয়ে থাকবি নিজের পাশেরটার দিকে অন্তত একবার তাঁকা ‘।
ওর কথা শুনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আমিই তাকালাম পাশের মেয়েটার দিকে৷ আশ্চর্য মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে জিসানের দিকে চেয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তিনজনকে দেখে যাচ্ছি। হ্যাভেন টেবিলে এক আঙুল দিয়ে ঠকঠক করতে করতে সেই হাসিটা দিয়ে চোখ টিপ মারলো জিসানকে আর আমাকে দেখিয়ে বলে ওঠলো,
– ‘ একদম ইনটেক ছিলো। আচ্ছা বলতো তোর পাশেরটা ইনটেক ছিলো ‘? উৎসুক হয়ে চেয়ে প্রশ্নটি করলো হ্যাভেন৷
গা ঘিনঘিন করে ওঠলো আমার৷ লজ্জায়,ঘৃনায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। সামনের মেয়েটার চোখ উপচে পানি বেড়িয়ে এলো। জিসান দাঁত চিবিয়ে বললো,
-‘ নিজেকে কি বাহাদুর মনে করছিস ‘?
-‘ মনে না করার মতো কিছু ঘটেছে নাকি? সব পুরুষ গলা ফাটিয়ে হাজার মানুষের সামনে নিজেকে মহাপুরুষ দাবি করতে পারে কিন্তু নিজেকে মহাপুরুষ অনুভব করতে কি সব পুরুষ পারে রে পাগলা ‘?
-‘ আর এক মূহুর্ত এখানে বসছি না। রূপসা ওঠো এখান থেকে ওর বউ দেখাতে চেয়েছিলো দেখেছি দ্যাটস ওকে ‘।
-‘ ওয়েট ওয়েট আসল খেলা তো এবার শুরু জিসান। সময় এখন আমার বলছিলাম তোর পাশেরটা আমার ইউজ করা হলেও আমার পাশের টা একদম আনইউজড ছিলো পানির মতো স্বচ্ছ ‘। বলেই এক চোখ টিপলো।
চলবে।
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন৷ গল্প টিতে একটি মেয়ে তাঁর অতিত জীবনের কাহিনী বলছে। বর্তমান, ভবিষ্যত না পড়েই নেগেটিভ মন্তব্য করবেন না কেউ। শুধু মার্জিত ভাবে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন শুধরে নিবো।