শান্তিসুধা ৭.

0
319

#শান্তিসুধা
৭.
ছোটোবেলা থেকে খেতে ভালোবাসে শান্তি। মা ছাড়া মানুষ হলেও তার যত্নে ত্রুটি ছিল না। সবকিছুর মতো খাবারদাবারেও সে ছিল প্রচণ্ড বিলাসী। তাসলিমা বেগমের রান্নার হাত ভালো। হাসানের একটা গান আছে না? আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই তাই দুঃখ হয়ে যায়। তাসলিমা বেগমের ক্ষেত্রেও এভাবে বলা যায়, সে তার জাদু হাতে যে রান্না করে তাই সুস্বাদু হয়ে যায়। নুবাইদের দাদি বলতেন, ‘ বড়ো বউয়ের হাতের ভাতও মিষ্টি লাগে। ‘ শাশুড়ি মায়ের কাছে এমন প্রশংসা যে নারী পায়। সে নারীর রান্নার স্বাদ নিয়ে সন্দেহ রাখার প্রশ্নই আসে না। শান্তি প্রতিটি আইটেম দিয়ে খুব আয়েশ করে ভাত খেল। প্রশংসাও করল শাশুড়ি মায়ের।

‘ সুপার্ব আন্টি সুপার্ব। সাতসকালে ভাত খেতে ইচ্ছে করছিল না৷ ভাগ্যিস নাফের জোর করল। ‘

শাশুড়িকে এ কথা বলেই নাফেরের দিকে তাকাল। বাম হাত বাড়িয়ে নাফেরের কাঁধে দুবার মৃদু চাপড় দিয়ে বলল,

‘ আপনার এই সুঠাম দেহ তৈরিতে জিমের পাশাপাশি আন্টির হাতের সুস্বাদু রান্নারও ক্রেডিট আছে বলুন। ‘

হতভম্ব হয়ে গেল নুবাইদ। কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শান্তির দিকে। শান্তি সে দৃষ্টিতে তাকিয়ে কয়েকবার পলক ফেলল। মুখ ভেঙচি দিয়ে মন দিল খেতে। এদিকে শাশুড়িকে আন্টি সম্বোধন। পরিবারের ছোটোবড়ো সবার সামনে স্বামীকে নাম ধরে ডাকা। কাঁধে চাপড় দেওয়া। জড়তা হীন অবলীলায় বলা বাক্যটি হজম করতে পারল না কেউ। অবাক হওয়ার পাশাপাশি হুমু মিটিমিটি হাসতে লাগল। বৃদ্ধ দাদাভাই বিনয়ের স্বরে শান্তিকে বুঝিয়ে বলল,

‘ নাফেরের আম্মু তো তোমারো আম্মু শান্তি। আন্টি নয় আম্মুই ডাকবে তাকে। ‘

তাসলিমা বেগম মৃদু হাসার চেষ্টা করল। বউটা এত বেশি ছটফট করে কেন? একটু বেশি অবুঝ, বাচ্চা হয়ে গেল বোধহয়! সহসা দুঃশ্চিন্তা এসে ভর করল তার মাথায়৷ যদিও এই বয়সে সে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল৷ তবুও শান্তিকে নিয়ে এক টুকরো অশান্তি সৃষ্টি হলো মনে। তার পক্ষে সম্ভব হবে তো? একে গড়ে পিঠে নেওয়ার। তানজিনা বেগম এমনিতেই চটে ছিল। খেতে বসে শান্তির এহেন আচরণ দেখে রাগে মাথা দপদপ করে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ শাশুড়িকে আন্টি ডাকছ! স্বামীর সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করছ। এগুলো কেমন অভদ্রতা? পরিবার থেকে কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে শশুর বাড়িতে পাঠায়নি? বাংলা সিরিয়াল দেখে নিশ্চয়ই এসব অবান্তরশিক্ষা অর্জন করেছ? ‘

ত্বরিত পানি খেয়ে ছোটো ছোটো দৃষ্টিতে তানজিনা বেগমের দিকে তাকাল শান্তি। কী আশ্চর্য! এই মহিলা এমন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? যেন সে তার আজন্মের শত্রু। কী রাগ চোখে, কী ঝাঁজ কথায়৷ সেও শান্তি। তার রাগ, ঝাঁজও কম না হু৷ ভেবেই অকপটে জবাব দিল,

‘ বিয়ে করে শশুর বাড়ি আসতে হলে ট্রেনিং নিয়ে আসতে হয় নাকি? কোথায় আমাকে তো নানুভাই, নানু মনি, মামিরা কিছু বলল না। আর ছোটো আন্টি, আমি বাংলা সিরিয়াল দেখি না, পাকিস্তানি সিরিয়াল দেখি৷ ‘

হুমু ফিক করে হেসে উঠল৷ নুবাইদের চোখে সীমাহীন বিস্ময়। দাদাভাই শান্তির স্পষ্টবাদীতায় আনন্দ পেল। অল্প বয়েসী মেয়েবউ এজন্যই তার এত ভালো লাগে। এদের অন্তরে ঘোরপ্যাঁচ কম।

তানজিনা বেগমকে উক্ত উত্তর দিয়ে তাসলিমা বেগমের দিকে তাকাল শান্তি। বলল,

‘ আমি কখনো কাউকে আম্মু ডাকিনি। আপনাকে যদি কখনো ডাকতে ইচ্ছে করে তাহলে ডাকব। এখন আমার আন্টি ডাকতেই ভালো লাগছে। এতে কি আপনার অসুবিধা আছে? ‘

আমি কখনো কাউকে আম্মু ডাকিনি। শুনতেই নুবাইদের বুক কেঁপে উঠল। কথাটায় কী মেশানো ছিল কে জানে? তাসলিমা বেগমের মাতৃ হৃদয়ও হোঁচট খেল। প্রগাঢ়ভাবে স্মরণ হলো, ‘ শান্তির তো মা নেই। দুধের শিশু রেখেই মারা গেছে। আহারে মেয়েটা মা কি জিনিস বুঝে না। মায়ের ভালোবাসা ছাড়া বড়ো হয়েছে। ‘
.
অফিসে না গেলেও ঘরে বসে ল্যাপটপে অফিশিয়াল
কিছু কাজ সেরে নিচ্ছিল নুবাইদ৷ এমন সময় ঘরে এলো শান্তি৷ এতক্ষণ সে নিচে শাশুড়ি মায়ের কাছে ছিল। তাসলিমা বেগমের আন্তরিকতায় সে কিছুটা নরম হয়েছে। কিন্তু তানজিনা বেগমের খোঁচা দেওয়া কথা শুনলেই ওর মুখ ছুটে যায়। ঘরে এসে নুবাইদকে কাজে মগ্ন দেখল শান্তি৷ নুবাইদ ওকে দেখে দৃষ্টি তুলল। তাকিয়ে দেখল শান্তির সুশ্রী মুখ৷ আপাদমস্তক দেহ। এই যে দৃষ্টি উঠল৷ সে দৃষ্টি আর নামল না। কী একটা নেশা যেন পেয়ে বসল ওকে। শান্তি খেয়াল করল ওই দৃষ্টি। তীক্ষ্ণ হলো ওর নীলচে মণির চোখ দুটো। রয়েসয়ে বসল বিছানায়। নুবাইদ কাউচে বসে ট্রি টেবিলে ল্যাপটপ রেখে কাজ করছিল। এমতাবস্থায় শান্তি এলে সে দৃষ্টি তুলে আরাম করে কাউচে গা এলিয়ে দিয়েছে। শান্তি তার হাবভাব বুঝে মনে মনে গালি দিল,

‘ শা’লা নাফেক্যাফেডাফে! অমন করে চোখে গিলছিস কেন রে? এখন চোখে গিলবি পরে মুখে গিলবি। এই তোর ধান্ধা। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। ‘

ভেবেই কী উপায়ে নুবাইদকে শায়েস্তা করা যায় ভাবতে লাগল সে। কয়েক মুহুর্ত পরেই দারুণ দুষ্টুমি ভর করল মাথায়। সেলফোনটা হাতে তুলেই একটা গান প্লে করল।
” সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই,
একলা রাধে জল ভরিতে যমুনাতে যায়
পিছন থেকে কৃষ্ণ তখন আড়ে আড়ে চায়,
জল ভরো, জল ভরো, রাধে, ও গোয়ালের ঝি
কলস আমার পূর্ণ করো, রাধে বিনোদি,
কালো মানিক হাত পেতেছে, চাঁদ ধরিতে চায়
বামন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়?
কালো কালো করিস না লো, ও গোয়ালের ঝি ”

এ পর্যন্ত গান শুনাতেই নুবাইদের টনক নড়ল। পলক ফেলল নির্নিমেষ চোখ দুটো। শান্তি মজা পেল ভীষণ। এরপর ” কালো মানিক হাত পেতেছে, চাঁদ ধরিতে চায়
বামন কি আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়?
কালো কালো করিস না লো, ও গোয়ালের ঝি ” এই লিরিকস বার বার প্লে করল। চোখে, মুখে দুষ্টুমি ভরে হাসি। নিজের রূপ নিয়ে সর্বাঙ্গে আশ্চর্য অহমিকা। সমস্তই টের পেল নুবাইদ। এরপর সন্তর্পণে মন দিল নিজের কাজে৷ অল্পসময়ে সব গুছিয়ে নিল। শান্তি ততক্ষণে তাকে শায়েস্তা করার কাজ থেকে বিরতি নিয়েছে। ভিডিয়ো কলে কথা বলছে বাড়ির লোকের সাথে। নুবাইদ অপেক্ষায় ছিল কখন শান্তির কথা বলা শেষ হয়। দীর্ঘক্ষণ পর অপেক্ষার অবসান হলো। কথা শেষে ফোন রেখে ফেসবুকে নিউজফিড ঘুরছিল শান্তি। নুবাইদ আড় চোখে সেটা দেখে নিয়ে ফোন কানে দিল। কাউকে কল করেনি। তবুও ভাবখানা এমন যেন তার খুবই প্রিয় বন্ধুকে কল করেছে। অতঃপর অভিনয়টা যেমন ছিল,

শান্তিকে মিছামিছি বুঝাল, ফোনের ওপাশে প্রিয় বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছে,

‘ দোস্ত কী অবস্থা নতুন জীবন কেমন লাগছে?’

‘ আর অবস্থা! অভিজ্ঞতা সুবিধার নয়। ‘

‘ কেন ভাই সুন্দরী বউ পেয়েছিস সুবিধা তো উড়ে উড়ে আসবে। ‘

গলা চড়াও করে নুবাইদ বলল,

‘ কী বললি সুন্দরী বউ পেলে সুবিধা উড়ে আসে? ‘

একটু তাচ্ছিল্য মিশিয়ে হাসল নুবাইদ। ফের বলল,

‘ সুন্দরী বউ? কে বলল আমার বউ সুন্দরী? ‘

এতক্ষণ নুবাইদের কথায় পাত্তা না দিলেও এ পর্যায়ে চমকে উঠল শান্তি। সে সুন্দরী নয়? কী বলছে এসব নাফের! আশ্চর্য মুখে তাকাল শান্তি। নুবাইদ বলতেই থাকল,

‘ আরে না রে। তেমন সুন্দরী না৷ গায়ের চামড়াই যা সাদা। দেখ দোস্ত, সাদা চামড়া সবার কাছে সুন্দরী হলেও আমার কিন্তু এটাতে ঘোর বিরোধিতা আছে। এরচেয়ে আমার পার্সনাল এসিস্ট্যান্ট আছে না? ওই যে সুমা নামের মেয়েটা। চামড়া সাদা না হলেও আমার বউয়ের চেয়ে ঢেরবেশি সুন্দরী। ‘

সুমা নামের কোনো অস্তিত্ব নুবাইদের চারপাশে কোনোকালেই ছিল না৷ অপরিণত কিশোরী, দুষ্ট শান্তির পাল্লায় পড়ে সেও যেন কিছু সময়ের জন্য অপরিণত, দুষ্ট বনে মেতে উঠল। পুনরায় বলল,

‘ কী বললি? তাহলে বিয়ে কেন করেছি? আরে বললাম না ফ্যামিলির চাপে। নাহলে কি অল্পবয়সী, অপরিণত, দেখতে ভালো না মেয়ে আমি বিয়ে করি? ‘

স্তম্ভিত শান্তি। হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এরপর যা বলল তাতে ওর মাথায় রক্ত ছলকে উঠল,

‘ শুধু কি অসুন্দরী, প্রচণ্ড বাঁচাল আর ঝগরুটে একটা মেয়ে। তোদের বাড়ির পাশে রহিমা খালা আছে না? যার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামী গৃহত্যাগ করেছে। আমার কি মনে হয় জানিস দোস্ত, দুদিনেই যা অবস্থা সাতদিনের মাথায় না আমাকে গৃহত্যাগী হতে হয়। ‘

ব্যস! শান্তিকে আর পায় কে? রাগে কাঁপতে কাঁপতে নুবাইদের ফোন নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। এরপর ফুঁসতে ফুঁসতে কলার চেপে ধরে বলল,

‘ আমি অসুন্দরী, বাঁচাল, ঝগরুটে? আমার জন্য অতিষ্ঠ হয়ে তোকে গৃহত্যাগী হতে হবে। আমার চেয়ে সুমা ঢেরবেশি সুন্দর। ‘

দাঁতে দাঁত পিশে, চোখ কটমট করে লাল হয়ে গেল শান্তি৷ নুবাইদ হকচকিয়ে গেল এই রূপ দেখে। দুষ্টুমির জবাব দুষ্টুমি দিয়ে দিচ্ছিল। ফলাফল যে এত ভয়ংকর হবে বুঝতে পারেনি। কীভাবে সামলাবে এখন? ঢোক গিলল সে। আলতোভাবে ধরল শান্তির দুহাতের কব্জিতে। টের পেল তীব্র রাগে এতটাই জোর খাটিয়ে ধরেছে। এবার সে যদি পাল্টা জোর খাটাতে যায় ব্যথা পাবে খুব। আহারে বাচ্চা বউ তার। সে কি ব্যথা দিতে পারে? ভেবেই আলগোছে এক হাত নামিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল। অপর হাতে গাল ছুঁয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

‘ শান্তি, শান্তি। ‘

রাগ কমতে গিয়েও বেড়ে গেল শান্তির। কলার ছেড়ে এবার দু’হাতে লাগাতার কিল, ঘুষি দিতে শুরু করল নুবাইদের বুকে। পাশাপাশি শুদ্ধ ভাষায় গালি। কিল-ঘুষি সহ্য করলেও গালি সহ্য করতে পারল না নুবাইদ৷ তাই আচমকা ওর মুখে হাত চেপে, কোমরে চেপে রাখা হাতটা আরো জোরালো করে কাছে টেনে নিল৷ শান্তির পুরো শরীরটা ছুঁয়ে গেল নুবাইদের শরীরে। দুজনার চোখ এক হলো। শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে লাগল একই সঙ্গে। শান্তির নরম বুক ছুঁয়ে রইল নুবাইদের পুরুষালি পোক্ত বুকে। অদ্ভুত শিহরণে শরীরের লোমকূপ পর্যন্ত কেঁপে উঠল নুবাইদের। শান্তির রাগ ক্রমশ কমতে শুরু করল। অপরিচিত অনুভূতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে। নরম হয়ে এলো রাগত চোখ দুটো। মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠল। সর্বাঙ্গ ধরে রাখার ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে গেল নিমিষে। দেহের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিল কিছুক্ষণ পূর্বের রাগত, অস্থির মেয়েটা।
তাতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না৷ কারণ নুবাইদ সুকৌশলে নিজ আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে বউকে। চোখ বুঁজে আছে শান্তি। নুবাইদ ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। কিছুক্ষণ ঝুঁকে বসে থমকানো চোখে তাকিয়ে রইল। এরপর যখন উঠতে উদ্যত হয়। তখন আচমকা শান্তি চোখ খুলে। কলার টেনে ধরে নুবাইদের। রাগ নয়, জেদ নয়। সরল দুটো চোখে তাকিয়ে নরম স্বরে বলে,

‘ আমাকে আপনার পছন্দ নয় নুবাইদ! আপনিও কি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়বেন? ‘

আকস্মিক এমন একটি প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না নুবাইদ। বিস্মিত হলো সে। অবুঝ, উশৃংখল এই মেয়েটা পরকীয়া শব্দটির মানে বুঝে? এলোমেলো হয়ে গেল নুবাইদ। এই এলোমেলো শুধু প্রশ্নটুকুর জন্য নয়। বাচ্চা একটা মেয়ের ভয়ানক এই প্রশ্নটির সঙ্গে মিশে থাকা অসম্ভব ঘৃণা, হতাশা ভাবিয়ে তুলল গভীরভাবে। উলোটপালোট হতে লাগল হৃৎপিণ্ড!

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here