#এক_চিলতে_রোদ
#Writer_Nondini_Nila
#Part_37
ভাইয়া এসে আমাকে ধরে বালিশে হেলান দিয়ে বসালো। আমি ভয়ার্ত মুখ করে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে। আমার হাত সাবধানে হাঁটুর উপর রেখে দিলো ভাইয়া। আমি অসহায় মুখে চেয়ে আছি তার মুখ পানে। এখন আমাকে ধমক খেতে হবে সেটা আমি সিউর। আমি চোখ ভাইয়ার থেকে সরিয়ে হাতের দিকে দিলাম। ভাইয়ার পরিয়ে দেওয়া আংটি আমার হাতে চিকচিক করছে।
আংটিটা চাচি নেওয়ার পর আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
এই সামান্য আংটির জন্য আমার এতো কষ্ট কেন হচ্ছিলো আমি বুঝতে পারিনি। এখন সেই কষ্ট অনুভব করতে পারছি না। আংটিটা আবার পাওয়ার জন্য কি ছটফটানি কমছে।
ভাইয়াকে আংটি নেওয়ার ব্যাপারে না জানানোর জন্য আমাকে বকবে জানি। আচ্ছা শুধু কি বকবে নাকি মারবে ও। আমি আবার ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভয় হচ্ছে খুব আমার। ভাইয়া দিকে বিস্মিত হলাম।
ভাইয়া আমার দিকে না তাকিয়ে আছে রেগে । আর না রেগে আছে। না বকার চেষ্টা করছে। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই খাবারের প্লেট নিজের দিকে নিয়ে খাবার মাখতেছে। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া আমাকে বকছে না কেন?
ভাইয়া খাবার মেখে আমার মুখের সামনে ধরলো। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি চোখ বড় করে।
“এমন বড় চোখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
আমি চমকে মাথা নিচু করে ফেললাম। ভাইয়া এতো অবাক কেন করে আমাকে। তাহলে কি বকবে না? আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ভাইয়া তখন বললো,” মাথা নিচু করে বসে না থেকে খাবার শেষ কর।”
আমি চকিতে মাথা তুলে তাকালাম।
“আপনি খাবার দিচ্ছেন কেন? আমি নিজেই খেতে পারবো আপনার খাইয়ে দিতে হবে না।”
আমার কথা শুনে ভাইয়া রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো তোর ইডিয়েট! এই হাতে নিজে খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছিস?”
আমি ভাইয়া কঠিন গলার স্বর শুনে চুপসে গেলাম। আর কিছু বলতে পারলাম না। ভাইয়ার হাতে আমাকে খাবার খেতে হলো। খাওয়া শেষ হতেই ভাইয়া আমাকে পানি খাইয়ে দিলো। ওষুধ খাইয়ে দিলো তারপর ব্যাসিং এ গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। আমি তখন শুধু ভাবছি ভাইয়া আমাকে বকলো না কেন? আমার চিন্তার মাঝে ভাইয়া আওয়াজ আমার কানে এলো আমি চমকে উঠলাম।
“এতো কিছু কোন সাহসে আমার থেকে আড়াল করেছিস?”
ভাইয়ার গম্ভীর গলায় বলা কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো।
যেই ভয় এতোক্ষণ পাচ্ছিলাম এখন তাই হলো। কিন্তু দেরিতে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপছি। ভাইয়া আমার সামনে বসে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি জানি। আমার সেই রাগী চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।
এতো সাহসী তো আমি না।
“এ্যান্সার মি ঊষা। তুই আমার থেকে এসব লুকালি কোন সাহসে? আমার দেওয়া আংটি আম্মু তোর থেকে কেড়ে নিলো আর তুই চুপ করে দেখলি। কোন প্রতিবাদ করলি না কেন? এটা আমার জিনিস আমি তোকে দিছি এখন তোর আর তোর জিনিস কেউ নিয়ে নিলো তুই চুপ করে হাত পা গুটিয়ে বসে রইলি। এমন হলে দেখবি একদিন আমাকেও কেউ তোর থেকে নিয়ে নিবে আর তুই চুপ করে দেখবি।”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাইয়ার কথা শুনছি। ভাইয়ার গম্ভীর গলায় কথা শুনে কেপে কেপে উঠছি। ভাইয়ার শেষের কথা শুনে থমকে মাথা উঁচু করে তাকালাম। না চাইতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো আমার। ভাইয়া রাগে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি ভাইয়া দিকে ঢোক গিলে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ” আমি চাইনি এটা নিয়ে আবার ঝামেলা হোক, ঝগড়া হোক। এসব আমার ভালো লাগে না। আমার জন্য চাচির সাথে আপনার দ্বন্দ্ব দেখতে একদমি ভালো লাগে না। ”
ভাইয়া বললো, ” তোর কি মনে হয় এটা না বললেই আম্মু সব ভুলে চেঁচামেচি অফ করে দিবে। তোর সাথে লাগবে না। আচ্ছা তুই তো আংটির কথা বলিসনি তাহলে কাল মার খেলি কেন?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমি জানি এসব চাচি করবেই। কেননা আমাকে সহ্য করতে পারে না। এখন ভাইয়া এসবের মধ্যে এখন আরো রেগে আমার উপর চাচি। কাল তো ভাইয়ার রুমে যাওয়ার জন্য। আমার চোখ ছলছল করে উঠলো মায়েদের মতো একটু ভালোবাসলে কি হতো চাচির?
“কি হলো কথা অফ হয়ে গেলো কেন? আম্মুর সাথে আমার ঝামেলা নিয়ে আর কখনো ভাববি না। আর কখনো নিজের জিনিস কাউকে কেড়ে নিতে দিবি না বুঝেছিল?”
আমি চোখ ভর্তি জল নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,, ” আমার কি কিছু আছে যে কাউকে নিতে দেবো না।”
ভাইয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর আমার গালে নিজের হাত ডুবিয়ে দিয়ে বললো,
” কিছু না থাকলেও যেটুকু আছে তাই আগলে রাখার চেষ্টা করবি। কাউকে নিতে দিবি না। এই আংটিটা তো তোর হয়ে গেছে এটা কেন নিতে দিলি। আটকাতে পারতি না তুই। পারতি, কিন্তু চেষ্টা করিস নাই।সব কিছু সহ্য করিস বলেই সবাই তোকে ইচ্ছে মতো কষ্ট দিতে পারে কিন্তু যদি প্রতিবাদ করতি তাহলে এসব হতো না।”
আচমকা আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম শব্দ করে।
ভাইয়া আমার কান্না দেখে ঘাবড়ে গেলো।
উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে?
আমি কান্না গলায় থেমে বলতে লাগলাম,
” আমি সত্যি নিজের জিনিস রাখতে পারিনা। সব হারিয়ে ফেলি। এই যেমন, মাম্মা বাপি কে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। কোন দিন তাদের পাবো না। চিরদিনের জন্য আমাকে এই পৃথিবীতে একা রেখে চলে গেছে। আমি তাদের নিজের কাছে রাখতে পারিনি। চাচি তো ঠিকিই বলে আমি রাক্ষসী নিজের বাবা মা কেও বাঁচতে দেয়নি। ”
ব্যাথা হাত উঠিয়ে মুখে চেপে ধরে কান্না করছি। বুকটা ফেটে কান্না আসছে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে আমার? এতোটা আপন বিহীন এই পৃথিবীতে আমার এখন বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। ইহান ভাই এগিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিলো মুখে থেকে আর শান্ত হতে বললো। আমি পারছি না থামতে আমার কান্না আজ থামতেই চাইছে না।
কান্নার মাঝেই আমার মাথা ঘুরাতে লাগল আমার আর কিছু মনে নাই।
কাল মাথায় আঘাত পেয়েছি আর তার মাঝে শরীর এ জ্বর তাই কান্নার ফলে আমি জ্ঞান হারিয়েছি।
জ্ঞান ফিরে রুমে একা পাই নিজেকে। আমি আসতে আসতে উঠে বসতেই লতা আসে আর বলে ভাইয়া অফিসে গেছে। আমাকে বিছানা থেকে উঠতে বারন করেছে।
আমি উঠে গোসল করলাম । খাবার লতা খাইয়ে দিলো ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পরলাম। শরীর ব্যাথা নরতে ইচ্ছে করে না। রাতে ভাইয়া বাসায় এসে অফিসের পোশাক পরেই আমার রুমে এলো। আর আমার মাথা হাত দিলো। আমি তখন জেগে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাইয়ার স্পর্শে আমি চোখ মেলে তাকালাম। ভাইয়ার আমার গালে হাত দিয়ে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? জ্বর তো কমেনি ডাক্তার ডাকবো?”
ভাইয়া খুব নরম গলায় বললো। আমি কথা বললাম না চুপ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার দিকে। এই মানুষটি চোখে আমার ব্যাথা কষ্ট দেখতে পায়। দেখতে ভালো লাগে কেউ আমার জন্য কষ্ট পায়। আমাকে নিয়ে চিন্তা করে। খুব ভালোলাগে।
জ্বর বেড়েছে অনেক আগেই আমার দুপুরে খাওয়ার পর থেকে এই ভাবেই শুয়ে আছি তাকাতে পারিনি। এখন ও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ভালো লাগছে তাকিয়ে থাকতে।
ভাইয়া আমার আওয়াজ না পেয়ে কিছু বললো না। লতা বলে হাক ছেড়ে ডেকে উঠলো। লতা দৌড়ে আসলে ভাইয়া ওকে আমার কাছে রেখে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ভাইয়া গেঞ্জি আর ট্রাইজার পড়ে এলো চুলে পানি। গোসল করেই এসেছে বুঝা যাচ্ছে।
ভাইয়া লতাকে দিয়ে পানি আনিয়ে আমার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো। কাউকে কল করে বললো আমার কথা সে কি বললো জানি না ভাইয়া কথা শেষ করে খাবার স্যুপ খাইয়ে দিলো আমাকে। আরেকটা কথা এইটা ভাইয়া নিজে বানিয়েছে আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ভাইয়ার দিকে। আমার জন্য খাবার তৈরি করলো। আমি থমকে খাবার খেয়ে নিলাম। রাতে ভাইয়া আমার মাথার কাছেই বসে রইলো। আমি যতক্ষন জাগানা ছিলাম তাই তো দেখেছি। হয়তো আমি ঘুমানোর পর চলে গেছিলো।
সকালে ভাইয়া কে আর দেখিনি। আমার জ্বর কমে এসেছে ।আমি রান্না ঘরে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে কাজ করতে।
লতা অবাক হয়ে বললো,’তুই এখানে কেন?’
‘কাজ করবো না এইভাবে বলছিস কেন?’
‘ তুই কাজ করবি কেন? আল্লাহ ভাইজান জানলে কিন্তু খবর আছে তোর শয়তান চাচি আবার বলেছে তাইনা!’
আমি বললাম, ‘না আমি নিজে থেকেই এসেছে।’
‘ হায় হায় কেন? চলে যা ভাইজান কিন্তু কাজের লোক রেখেছে এতো কাজ নাই এখন। তুই এখানে এসে বকা খাস না।এমনিতেই জ্বর তোর।’
‘ কিছু হবে না এমন জ্বর গায়ে কতো কাজ করেছি হিসেব নাই।’
‘ হুম এখন তো তোর কাজ করা মানা তুই এই বাড়ির হবু বউ ভুলে গেছি। ভাইজান কিন্তু রাগ করবে? ‘
‘করুক আমি তো পরিক্ষার জন্য কাজ থেকে দূরে থেকেছি। তাই বলে সারাজীবন এর জন্য নাকি? আমাকে তো করতেই হবে।’
কাজ করা থেকে লতা আমাকে আটকাতে পারলো না। আমি তেমন কাজ পেলাম না তাই থালাবাসন ধুয়ে নিলাম। লতা ঝাড়ু দিতে চলে গেলো রেগে মেগে।
আরেকটা কাজের মহিলা তার বয়স বেশি তিনি রান্নার যোগার করছেন।
হাতের গা শুকিয়ে গেছে হাল্কা ব্যাথা থাকলেও তাই কাজ করতে পারছি। চাচি কটমট করে তাকিয়ে ছিলো কথা বলেনি।
আমি মাথা নিচু করে থেকেছি। রাতে ভাইয়া বাসা আসতেই ফাজিল লতা সব বলে দিয়েছে আর আমি এখন আসামির মতো ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাইয়া তার বিছানায় বসে রেগে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়েই ভষ্স করে দেবে।
আমার শরীর কাঁপছে জ্বর আসলো নাকি আবার?
ভাইয়া বলে উঠলো, ‘ তোর খুব কাজ করার শখ তাই না।’
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম।
ভাইয়া আবার বললো, ‘ আচ্ছা ফাইন আজ থেকে আমার সব কাজ তুই করবি? কতো কাজ করতে পারিস আমিও আমিও দেখবো।’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
আর মিনমিন গলায় বললাম, ‘ কি কাজ আপনার?’
‘ আমার অনেক কাজ আছে। এই যেমন,আমার জামা কাপড় ধুয়ে দেওয়া, রুম গুছানো, শার্ট আয়রন করা, অফিসে যাওয়ার আগে আমার সব জিনিস এগিয়ে দেওয়া রুমে থেকে, আসার পর ঠান্ডা পানি দিবি, আরো যা আছে আস্তে আস্তে জেনে যাবি। এখন থেকে তোর আমার যাবতীয় কাজ করতে হবে। তোর কাজের শখ মেটাবো। ‘
#চলবে
( ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।)