#শান্তিসুধা
৫.
উষ্ণ গরম জলে গোসল করে তরতাজা হয়ে উঠল নুবাইদ। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে পরিষ্কার। মনের ঘরে ফুরফুরে আমেজ। মাথা ভর্তি ছোটো ছোটো ভেজা চুল। হাত চালিয়ে দিতেই বিন্দু বিন্দু জলকণা পড়ল গায়ে, ফ্লোরে। শ্যামলাটে পোক্ত শরীরটা আঢাকা। শুধু কোমরে বাঁধা রয়েছে, ফিকে কমলা বর্ণের একটি টাওয়েল। যেটা একটানে খুলে ঝটপট ট্রাউজার পরে নিল। দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। শব্দ পেয়ে কান সজাগ করে প্রশ্ন করল,
‘ কে? ‘
‘ আপনার বউ। ‘
তিরিক্ষি মেজাজে বলা দুটো শব্দ শুনতেই ঝড়ের গতিতে দরজা খুলল নুবাইদ। দেখতে পেল ক্লান্ত মুখে শান্তি দাঁড়িয়ে। তার বউ। সদ্যই বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। প্রথমবার শান্তি তার ঘরে প্রবেশ করছে। উহুম তার নয় তাদের। এই ঘর আর শুধু তার নেই। তাদের হয়ে গেছে। দরজা খুলেই সরে দাঁড়াল নুবাইদ৷ শান্তি গোল গোল চোখ করে ভেতরে প্রবেশ করল। হুমু দাঁড়িয়ে দরজার বাইরে। নুবাইদ বলল,
‘ ভেতরে আয়। ‘
মিটিমিটি হেসে হুমু বলল,
‘ ভাবিকে তোমার রুম চেনাতে এসেছিলাম ভাইয়া। তোমরা কথা বলো। আমি পরে আসব। ‘
মাথা দুলিয়ে দরজা চাপিয়ে দিল নুবাইদ। শান্তি মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। কোমরে দুহাত রেখে রুমজুড়ে চোখ বুলাচ্ছে। চারদেয়ালের রঙ অফ হোয়াইট। উত্তর, দক্ষিণ করে পাতা আলিশান বিছানা। বিছানার চাদর, বালিশের কভার ধবধবে সাদা। সাইট টেবিলে দারুণ একটি টেবিল ল্যাম্প। বিছানার অপজিটে আকর্ষণীয় কাউচ। একে একে ড্রেসিং টেবিল, বিশালাকৃতির কাঠে তৈরি কাপবোর্ড, বেলকনির দরজা। সবটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নুবাইদের দিকে তাকাল শান্তি। লম্বাটে, বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহের মানুষটাকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝল, পুরো বাড়ি আর ঘরের মতো এই নাফেরের মাঝেও আলিশান, আলিশান ব্যাপার আছে। গায়ের রঙ শ্যামলা। কিন্তু শরীরটা বেশ মজবুত। নির্ঘাত নিয়মিত জিম করে! নাহলে এমন শরীর হয় নাকি? মনে মনে ভেঙচি কাটল শান্তি। চামড়ার কালার দিয়ে মুগ্ধ করতে পারেনি বলে উদাম শরীর দেখিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। কত্ত বড়ো ফন্দিবাজ! সেও শান্তি। তার সাথে ফন্দি করে কেউ সুবিধা করতে পারেনি৷ এই নাফেরও পারবে না৷
একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবনায় বিভোর শান্তি। নুবাইদ এসে মুখোমুখি দাঁড়াল ওর। গভীর চোখে তাকাল নীলচে চোখ দুটোয়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে আচ্ছন্ন গলায় বলল,
‘দুঃসাহসিক এই চোখ দিয়ে ঘায়েল করছো না হচ্ছো?’
নিমেষে পলক পড়ল শান্তির। তেতে উঠে বলল,
‘এগুলো কোন ঢংয়ের প্রশ্ন? আমি সোজা কথা বুঝি। ঢং, প্যাঁচ বুঝি না। ‘
অধর উল্টে, ভ্রু বাঁকিয়ে ফেলল নুবাইদ। সরে গিয়ে বের করে রাখা ফুল স্লিভ টিশার্ট পরতে পরতে বলল,
‘ বাচ্চা তো, তাই রোমান্টিক কথা বোঝো না। ব্যাপার না, বড়ো হলে বুঝতে পারবে। তখন এগুলো ঢং, প্যাঁচ মনে হবে না। আমার মুখের একেকটা বুলি তখন স্বর্গ, স্বর্গ অনুভূতি দেবে। ‘
‘ ওরে আমার স্বর্গরে, আপনি একটা বয়স্ক, পাজি লোক। বিয়ে করে এনে নিজে রুমে আরাম করছেন৷ এদিকে আমি মাথা আর শরীর ব্যথায় অশান্তিতে ভুগছি। ‘
তর্জনী উঁচু করে কথাগুলো বলতেই নুবাইদ কাছে এলো৷ ছোটো-ছোটো চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কথাটা সুন্দর করে বুঝিয়েও তো বলা যায়। ঝগড়ার তালে কেন বলতে হবে? আর আটাশ বছরের টাটকা আমিতে বয়স্ক শব্দের কলঙ্ক দিচ্ছ বেশ। পরে যেন আফসোস করতে না হয়। ‘
চোখ কুঁচকে ফেলল শান্তি। আফসোস, সে কেন আফসোস করতে যাবে? মনের প্রশ্ন মুখে আনতে উদ্যত হতেই আচমকা নাফের ওর হাত চেপে ধরল। কিছু বুঝে উঠবার আগেই টেনে নিয়ে গেল ওয়াশরুমে। বলল,
‘ আলাদা জায়গা। অসময়ে গোসল করার দরকার নেই। হাতমুখ ধুয়ে এসে রেস্ট করো। ‘
বুক ধড়ফড় করে উঠল শান্তির। কী শক্ত হাত। চেপে ধরলে সে ছাড়াতেই পারে না। মুহুর্তেই তার রুমে থাকাকালীন আচমকা নুবাইদের করা প্রথম চুমুর কথা স্মরণ হলো। কপালের ওই আলতো পরশেও ঠিক এভাবেই বুক ধুকপুক করে উঠেছে। হায়, হায়। কী সাংঘাতিক লোক। ছুঁয়ে দিলেই বুক কেঁপে উঠে। নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্র জানে। শান্তি সাবধান। সাহস করে রুমে এলি। এবার নিজের সেফটি নিজে দিতে হবে তোকে। সচেতন ভাবে ঢোক গিলল শান্তি। পরিকল্পনা করে ফেলল কীভাবে এই নাফেরকে হাতের মুঠোয় রাখবে।
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। নুবাইদ নিচে গিয়েছিল। প্রতিবেশী চাচি, বোনরা আর এক দাদি এসেছে। নতুন বউকে দেখতে। তাই ঘরে এলো নুবাইদ। শান্তি হাতমুখ ধুয়ে আরাম করে শুয়েছে। তাকে দেখেই হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ এই নাফের, আপনার কোলবালিশ নেই? কোলবালিশ ছাড়া শুয়ে আমার একটুও আরাম লাগে না। ‘
বিরক্ত মুখে উঠে বসল শান্তি। নুবাইদ প্রথমে হকচকিয়ে গেল ওর ডাক শুনে। ‘ এই নাফের ‘ আহা কী টোন। যেন সমবয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে দশ বছর সম্পর্ক করে বিয়ে করেছে। যদিও নাম ধরে ডাকা নিয়ে তার সমস্যা নেই। তবুও একটু ভড়কে গেছে। এই মেয়েটা নিশ্চয়ই ভুলবশত তার অনেক পড়ে পৃথিবীতে এসে পড়েছে। আরো আগে আসা উচিত ছিল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল নুবাইদ। ভেবেচিন্তে উত্তর দিল,
‘ আমার কোলবালিশ ইউজ করা নিষেধ। শুধু আমার না এই ঘরেই কোলবালিশ আনা নিষেধ। ‘
‘ নিষেধ! কেন, কে নিষেধ করেছে? ‘
‘ আছে একজন পরে বলব। আজান দিয়েছে। চলো নামাজ পড়বে। বিয়ের পড়ানোর পর তো নামাজ পড়া হয়নি। মাগরিব পড়ে ওটাও পড়ে নিব চলো।’
নিরাসক্ত গলায় শান্তি বলল,
‘ আমি নামাজ পড়তে জানি না। ‘
সহসা গলা উঁচু করে নুবাইদ বলল,
‘শেম অন ইউ!’
আচমকা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শান্তি। আঙুল উঠিয়ে বলল,
‘ সত্যি বলতে এই শান্তি লজ্জা পায় না। আপনার সাহস তো কম না আমাকে ধমক দেন! ‘
জ্বলে উঠতে গিয়েও নিভে গেল নুবাইদ। শীতল চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে শান্তির তর্জনী আঁকড়ে ধরল। শান্ত গলায় বলল,
‘ চলো ওজু করে নামাজ শিখিয়ে দেবো। ‘
‘ যাব না। আপনি আমাকে ধমক দিয়েছেন। ‘
ফুঁসছে শান্তি। হেসে ফেলল নুবাইদ। মুখ নিচু করে শান্তির ছোট্ট, মসৃণ কপালে চুমু খেল। বুক ধক করে উঠল শান্তির। সেই তখনকার মতো। এই চুমুতে কী আছে? বুকের ভেতর এমন এমন করে কেন? হাঁটুও কেঁপে উঠল কেমন করে। নুবাইদ তখন মুখ নামিয়ে ওর কানের কাছাকাছি রেখেছে। পুরুষালি নিঃশ্বাসের উষ্ণ পরশে শান্তি দম আঁটকে আছে। তাই সে নরম স্বরে বলল,
‘ নিঃশ্বাস ছাড়ো। ‘
নিঃশ্বাস ছাড়ল শান্তি৷ নুবাইদ বলল,
‘ ধমক দিইনি শান্তি। যেদিন ধমক দেবো সেদিন টের পাবে আজ আমি ধমক দিইনি। ‘
বিস্মিত হয়ে তাকাল শান্তি। নুবাইদ সরে গিয়ে মুচকি হেসে ফের বলল,
‘ বিয়ের প্রথম দিন বউকে ধমক দিতে নেই। চলো নামাজ পড়ে নিচে যেতে হবে। পাড়ার চাচি, দাদি এসেছে। বউ দেখবে আমার। ‘
ওজু শিখিয়ে, নামাজের নিয়ম বুঝিয়ে আস্তেধীরে নামাজ পড়ে নিল দুজন। নামাজ শেষে শান্তি অনেকটাই শান্ত। নুবাইদ জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে আসতেই সে বলল,
‘ শুনুন, আপনি আমাকে আর ছুঁবেন না। ‘
‘ তাহলে কাকে ছুঁবো?’
‘ মানে? ‘
‘ পুরুষ মানুষ বউকেই তো ছুঁবে। ‘
‘ আমি বাচ্চা মানুষ। আপনার লজ্জা করে না আমাকে ছুঁতে। ‘
‘ কথার ঝাঁজে তো মনে হয় না বাচ্চা।’
মনে মনে নুবাইদ এ কথা বললেও মুখে অমায়িক হাসি টেনে অন্য কথা বলল,
‘ বাচ্চা মানুষকে বিয়ে করতে লজ্জা করল না এখন ছুঁতে লজ্জা করবে? আশ্চর্য! ‘
ফের রেগে গেল শান্তি। তেড়ে এসে তর্জনী উঁচু করে বলল,
‘ বদমায়েশি করলে ফল খারাপ হবে। ‘
‘ বউয়ের সঙ্গে বদমায়েশি করলে ফল ভালো হয় শান্তি।’
তর্জনী আঁকড়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে কথাটা বলল নুবাইদ। শান্তি কপাল কুঁচকে তার সুগভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে ফের বলল,
‘ কিন্তু আমি এখন বদমায়েশি করে ফলটল আনতে চাই না। আগে তুমিময় কাঁচা ফলটাকে পাকিয়ে নিই।’
‘ মানে! ‘
‘ পরে বোঝাব। এবার নিচে চলো। সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। ‘
কথাটা বলেই মাথায় ওড়না তুলে দিল। শান্তি ফোঁস করে উঠে ওড়না ফেললে সে আবার তুলল। এরপর কড়া আদেশ করল,
‘ একটু সময় ঘোমটা দিয়ে থাকলে কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। বরং শীতের সময় কানদুটো আরামে থাকবে। নিচে গিয়ে সবার সঙ্গে সুন্দর করে মিষ্টি ভাষায় কথা বলবে। এরপর ডিনার করে একদম বেডরুমে আসবে। ‘
দু-হাতে বুকের পাটায় ধাক্কা মেরে নুবাইদকে দূরে সরিয়ে দিল শান্তি। বারকয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি আপনার সাথে এক বিছানায় ঘুমাব না।’
‘এই শীতে আমিও অন্য কোথাও ঘুমাতে পারব না। বউ যখন হয়েছ বেড শেয়ার করতেই হবে। ‘
এরপর গলার স্বর নামিয়ে পুনরায় বলল,
‘ মন আর শরীর তো শেয়ার করতে হচ্ছে না। এত ভয় কিসের? ‘
চকিতে তাকাল শান্তি। বলল,
‘ আপনি আমার সাথে স্বামীদের মতো করবেন না তো?’
‘ স্বামীদের বলতে? ‘
‘ আহ ন্যাকা বুঝেন না? ওই যে যেসব করলে বাসর হয়। ‘
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকাল নুবাইদ। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কত স্মার্ট সে কী জানে না? গা ঝাড়ার মতো করে তাই জবাব দিল,
‘ আমার অতো দায় পড়েনি শান্তি। ‘
‘ মানে? ‘
‘ এত মানে বোঝাতে পারব না৷ জাস্ট আমার দায় পড়েনি তার সাথে ইন্টিমেট হতে যে আমাকে বারংবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। বিয়ে করেছি, বউ পেয়েছি দ্যাটস এনাফ। ‘
নুবাইদ মুখে এসব বললেও ওর ভেতরের পৌরুষ হাহাকার করে উঠল। ঢের মিথ্যা, ঢের মিথ্যা। দীর্ঘ আটাশ বছরের সংযম। হায় বিধান! এই অল্পবয়সী ধানিলংকাই ছিল কপালে? দেখুক এবার অবশিষ্ট কতদিন পারে উপবাসে থাকতে।
শান্তির দুঃশ্চিন্তা কেটে গেল অনেকটাই। তবে পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারল না নুবাইদকে। একটু সন্দেহ রেখেই সে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। চলনবলন এর শব্দ শুনে নুবাইদ হুঁশে ফিরে বিড়বিড় করে বলল,
‘ শান্তি, শান্তি। ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
প্রিয় পাঠক যারা পড়ছেন অবশ্যই রেসপন্স করবেন। আর আমার দ্বিতীয় বই বাইজি কন্যার প্রি-অর্ডার কিন্তু শেষের পথে। যারা এখনো প্রি-অর্ডার করেননি তাদের জন্য কমেন্টে লিংক দিয়ে দিচ্ছি।