ওহে_প্রিয় #জান্নাতুল_নাঈমা #পর্ব_২৭ (শেষ অংশ)

0
610

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৭ (শেষ অংশ)

-‘ কথায় আছে চুন খেয়ে মুখ পুঁড়লে দই দেখলেও ভয় লাগে। চুন দেখতে সাদা বলে মোহবিষ্ট হয়ে তা মুখে নিয়ে জিহ্বা পুঁড়িয়েছিলেন আপনি আর শাস্তি ভোগ করলাম আমি। আপনার গায়ের বর্ণ নিয়ে বিদ্রুপ করেছিলো আমার বান্ধবী রা অথচ তাঁর শাস্তিও ভোগ করলাম আমি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! উপরওয়ালার ইচ্ছে তে আমার গর্ভে আপনার সন্তান এলো আবার তাঁর ইচ্ছে তেই চলে গেলো এর শাস্তি সরূপ আপনি আমায় ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন৷ শাস্তি শাস্তি আর শাস্তি। সব ঠিক ছিলো সব মেনে নিলাম কিন্তু নিজ সন্তানের হত্যাকারীও বানিয়ে দিলেন? বিনা দোষে শুরু থেকেই শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি। প্রতিবাদ করেও করিনি কিন্তু আজ যখন নিজের সন্তানের হত্যাকারী উপাধি দেওয়া হলো আমায় তখন কি করে চুপ থাকি আমি বলুন তো? আপনি আমায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছেন বিশ্বাস করুন বিন্দু প্রতিবাদও আমি করতাম না কিন্তু যখন আমার সন্তানের হত্যাকারী বানিয়ে দিলেন তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। একজন মেয়ে হয়ে নিজের সম্মান কে মূল্যায়ন করিনি। একজন স্ত্রী হয়ে নিজের সম্মানের দিকে গুরুত্ব দেইনি। সর্বত্রই ব্যাক্তিত্বহীনের পরিচয় দিয়েছি শুধু মাত্র পরিবার আর সমাজের কথা ভেবে,মানবিকতা দেখিয়ে। কিন্তু একজন মা হয়ে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আপনার মতো কিছু মেরুদণ্ডহীন,কাপুরুষরা কখনো নিজেদের দোষ,নিজেদের ভুল দেখতেই পারেনা। সবসময় অন্যের দোষগুণ বিচার করে বেড়ায় এরা। নিজের দোষটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে মহাপুরুষ ভাবা আপনার মতোই কাপুরষদেরই কাজ। মানবজাতির জঘন্যতম একটি স্বভাব হলো নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আর সেই জঘন্য স্বভাবের অধিকারী আমি হতে চাইনি দিতে চাইনি কোন দোষ আপনাকে। আমি ভাগ্যকে মেনে নিতে জানি। আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। আমার সন্তান যিনি দিয়েছিলেন তিনিই নিয়ে গেছেন। তবুও আমি আজ আপনার দোষ ধরার জন্য বলবো এই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি শুধু মাত্র আপনার জন্য। আপনার সন্তানের হত্যাকারী আমি নই বরং আমার সন্তানের হত্যাকারী আপনি। হ্যাঁ জঘন্য এই স্বভাবটা আজ আমি ধারণ করলাম কেনো জানেন? কারণ আমার মা আমাকে ছোট সময় অসংখ্য শিক্ষার ভীরে মহামূল্যবান একটি শিক্ষা দিয়েছিলো। ছয় বছর বয়সে পাড়ার মেয়েদের সাথে খেলতে গিয়ে যখন তাঁদের খামচি খেয়ে বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিলাম মা আমাকে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে হাতের তালুতে দুটো বাড়ি দিয়ে বলেছিলেন, ‘লজ্জা করেনা খেলতে গিয়ে হেরে গিয়ে বেহায়ার মতো কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিস। আজকের পর আর কোনদিন যদি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতে দেখি দুবেলা খাবার বন্ধ। বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হলেও ফিরতে হবে হাসতে হাসতে। কখনো হেরে গিয়ে আমার কোলে ফিরবি না। মায়ের কোল এতো সস্তা না মায়ের কোল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একটি শান্তির জায়গা সেখানে ফিরতে হলে সবসময় মাথা উঁচু করে জিতেই ফিরতে হবে। কেউ তোকে দশটা আঘাত করলে তুই অন্তত একটা আঘাত তাঁকে করবি। কেউ তোকে বিনাদোষে একশ বাক্য শোনালে তুই বেশী না এক বাক্যই শুনিয়ে আসবি যা তাঁর অন্তর জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর যদি না পারিস আমার মেয়ে বলে কখনো কাউকে পরিচয় দিস না’। সেই মায়ের আদর্শকে স্মরণ করে আমার যে অংশ বিলীন হয়ে গেছে, যা হারিয়েছি সেই হারানোর যন্ত্রণাকে স্মরণ করে আজ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি’।

ক্ষণকালের জন্য থামলো আহি। হ্যাভেন দুহাত মুঠো বন্দি করে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। যদি তাঁর সম্মুখে কেউ অবস্থান করতো তাহলে হয়তো দৃশ্যমান হতো তাঁর রক্তিম চোখে অসংখ্য জলকণার ভীরগুলো। যদি কেউ তাঁর বক্ষঃস্থলের অতিনিকটে এসে একটিবারের জন্যও কানপেতে দিতো তাহলে শুনতে পেতো তাঁর শাসরুদ্ধকর হাহাকারগুলো।

আশেপাশে অস্থির ঝাপসা দুটি নজর বুলিয়ে আবারো নিজেকে শক্ত করে নিলো আহি এক ঢোক গিলে উৎকন্ঠা হয়ে বললো,

-‘ আমি ক্ষমাপ্রার্থী বাবা,মা সমতুল্য, ভাই,বোন সমতুল্য সকলের সম্মুখে সব লজ্জা বিসর্জন দিয়ে এসব বলতে আজ বাধ্য হচ্ছি। যদিও কথাগুলো একান্ত বলার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি আজ সকলের সম্মুখে বলতে বাধ্য করছে। এবং পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছে কথাগুলো একান্ত হ্যাভেন নয় সবারই জানা উচিত ‘।

হ্যাভেনের দিকে এবার শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আহি। তাঁর গলায় এসে ভর করলো তীব্র ত্যাজ। হিংস্র বাঘিনীর মতো যেনো গর্জে ওঠলো সে।

-‘ এই লোকটা আমায় বিয়ে করেছে জোর করে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে৷ না আমি একে চিনতাম না এ আমাকে চিনতো। অথচ বলির পাঠা করলেন ওনি আমায়। বলি হলাম আমি। এই লোকটার পুরো জীবনটার শুরু থেকেই ছিলো অন্যায় আর ভুলে ভরা। জীবনসঙ্গী বেছে নিতে ভালোবাসার মানুষ চিহ্নিত করতে ভুল করলেন এই লোকটা। শাস্তি কিন্তু নিজে একা ভোগ করেনি পুরো পরিবার সহ অচেনা একটি মেয়েকেও তুলে নিয়ে এলেন শাস্তি ভোগ করার জন্য। সেই শাস্তিগুলোকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে সেগুলোর ভীরে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়েই জানতে পারি লোকটার ভগ্ন হৃদয়ের গল্প। জানতে পারি তাঁর অসুস্থ মন এবং মস্তিষ্কের গল্প। কিন্তু আমার তো ভগ্ন হৃদয় ছিলোনা। আর না ছিলো অসুস্থ মস্তিষ্ক বা অসুস্থ মন। এই লোকটা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে আমাকে। ব্যবহার করেছে আমার শরীরটাকে। আমি সাধারণ পরিবারের একটি মেয়ে। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলো সাধারণ ছিলোনা। দিনের পর দিন রাতের পর রাত অসাধারণ সব স্বপ্ন বুনে যেতাম আমি। অসাধারণ এক জীবনও কাটাতাম আমি। বাবা,মায়ের বুকভরা ভালোবাসা পেয়ে,ছোট বোনকে বুকভরা ভালোবাসা দিয়েই আমার দিন গুলো বেশ কেটে যেতো। সেসব দিনে অবশ্যই স্বপ্ন দেখতাম কোন এক স্বপ্নপুরুষকে নিয়ে। রূপকথার কোন এক রাজকুমার কে নিয়ে। যে কিনা সাত সাগর তেরো নদী পারি দিয়ে আমার কাছে আসবে। পক্ষীরাজের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাবে তাঁর রাজ প্রাসাদে। সীমাহীন ভালোবাসা দিয়ে নিজের বুকে জরিয়ে নেবে আমায় আমার স্বপ্নপুরুষ আমার রূপকথার রাজকুমার। প্রাণভরে শ্বাস নিবো আমি তাঁর ভালোবাসাময় উন্মুক্ত বুকে মুখ গুঁজে’। এটুকু বলেই একটু থামলো আহি বারকয়েক শ্বাস নিয়ে ধরা গলাকে আরো শক্ত করে নিলো। হ্যাভেন যে ফুঁসে ওঠে তাঁর দিকে ঘুরেছে এবং তাঁর দিকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে সেদিকে তোয়াক্কা না করে সে আবারো বলতে শুরু করলো,

-‘ আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলেন ওনি৷ স্বপ্নপুরুষ হয়ে নয় স্বপ্নভঙ্গের কারিগর হয়ে আমার জীবনে প্রবেশ করলেন হ্যাভেন তালুকদার।রাজকুমার হয়ে নয় রাজদৈত্য হয়ে এলেন। পক্ষীরাজ নয় নিজের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে এলেন ওনার প্রাসাদে। দিনের পর দিন মানসিক,শারীরিক দুভাবেই টর্চার করতে শুরু করলেন। দূর্ভাগ্যবশত এই মানুষ টাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম পুরুষ এই মানুষটার স্পর্শই ছিলো প্রথম। আমি আমার সতীত্ব হারিয়েছি এই মানুষ টার কাছে। রোজ রোজ আমার সারা অঙ্গে বৈধতার স্পর্শ দিয়েছে এই মানুষ টা। জোর করে হোক তবুও এই মানুষ টার নাম করে তিন কবুল পড়েছি আমি। রাত নেই দিন নেই ওনার ক্ষিপ্ততার স্বীকার হয়েছি আমি। সেই ক্ষিপ্ততার মাঝেই একটুখানি ভালোবাসা খুঁজে বেড়িয়েছি। বোকার মতো ভুল ধারণা করে দ্বিতীয় বার যখন ওনাকে ছেড়ে চলে গেলাম ওনার মনের গভীরে আমার জন্য অসীম ভালোবাসা রয়েছে এই ধারণা করেই উন্মাদের মতো ফিরে এসেছিলাম। ইচ্ছের বিরুদ্ধে, জোর পূর্বক নয় মন থেকে স্বামী রূপে গ্রহণ করে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি। ভালোবাসার মায়ায় আঁটকাতে চেয়েছি। কিন্তু আমি পরাজিত হয়েছি বার বার ওনার হিংস্রতার কাছে। একজন নিরীহ স্ত্রী হয়ে ওনার সঙ্গ দিতে গিয়েছি আমি আর ওনি বিধ্বস্ত করে ছেড়েছেন আমায়। আমি গিয়েছি ভালোবাসার দাবি নিয়ে স্ত্রীর অধিকার নিয়ে। আর ওনি এসেছেন স্বামী রূপে পশুত্বকে বরণ করে। তবুও সবটা মুখ বুজে সহ্য করেছি শুনেছি ভালোবাসা দিয়ে পাথরের বুকেও ফুল ফোটানো যায়। শোনা কথাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলাম আজ আমি ব্যার্থ। এই নরপশুটা আমাকে আমার সন্তানের হত্যাকারী দাবি করে। একটা বারও কি পশুটা নিজেকে প্রশ্ন করেছে এই সন্তান কিসের ফল? না সম্মান, না শ্রদ্ধা, না ভালোবাসা, না স্নেহ এই সন্তান ছিলো ওনার হিংস্রতার ফল। ভালোবাসার জোরই আলাদা। ভালোবাসা থাকলে আমি আমার সন্তান কে হারাতাম না। আর পাঁচ টা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার আর ওনার মধ্যে সেই স্বাভাবিকতা কখনোই ছিলোনা। শুরুটা আমি চাইনি সেখানে যুক্তি ছিলো শেষটায় সে কেনো চায়নি? কেনো স্বাভাবিক জীবন বেছে নেয়নি সে? কেনো অস্বাভাবিকতাকে বেছে নিলো? আজ সব ঠিক থাকলে স্বাভাবিক থাকলে আমাদের সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলে আমরা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারতাম। একে অপরকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারতাম৷ একে অপরের প্রতি যত্নশীল হতে পারতাম। আমাদের জীবনে একটি ছোট্ট প্রাণ নিয়ে আসার জন্য দুজনেই দুজনের দিক থেকে প্রিপেয়ারড হতাম। যেখানে সম্পর্কই এলোমেলো, যেখানে মানসিকভাবে সর্বক্ষণ অশান্তি ভোগ করতে হচ্ছে। যেখানে একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক লোককে প্রতিটা দিন সামলাতে হচ্ছে। সেখানে নিজের প্রতি একটু যত্নশীল হওয়ার সুযোগ আমি কোথায় পেয়েছি, কখন পেয়েছি, কিভাবে পেয়েছি? আজ যদি এই লোকটা ঠিক থাকতো তাহলে কি কোনভাবেই আমার এই দূর্ঘটনাটা ঘটতো নাকি আগে থেকেই সচেতন হতে পারতাম। আমি নই আমার সন্তানের হত্যাকারী আপনি মি.হ্যাভেন তালুকদার ‘। শেষ বাক্যগুলো প্রচন্ড উচ্চ স্বরে বলে ওঠলো আহি।

তাঁর প্রতিটা কঠিন বাক্যে উপস্থিত সকলের মস্তিষ্ক হয়ে গেলো শূন্যকুম্ভ। তাঁরা প্রতিটি ব্যাক্তিই খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলো আজ তাঁদের সামনে অত্যান্ত সাধারণ পরিবারের সাধারণ একটি মেয়ে বা ধনাঢ্য পরিবারের বেঁকে যাওয়া সন্তানের শান্তশিষ্ট ঘরণী দাঁড়িয়ে নেই৷ বরং তাঁদের সম্মুখে আজ দাঁড়িয়ে আছে এক সন্তান হারা মা। মায়ের শক্তি যে অনেক বেশী প্রখর। আহির বলা প্রতিটি বাক্য প্রত্যেকের মস্তিষ্কে আঘাত করলেও হ্যাভেনের শুধু মস্তিষ্কে নয় বুকের অত্যন্ত গভীরে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করে দিয়েছে। তাঁর হৃদয়ের ক্ষতবিক্ষত হওয়ার শুরুটা কি টেরপাবে আহি?

লজ্জায় মাথা নিচু করে রয়েছে প্রতিটি ব্যাক্তিই শুধু হ্যাভেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহির মুখপানে। হুমায়ুন তালুকদার এই মূহুর্তে সকলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বাচ্চা মেয়েটার বিক্ষিপ্ত রূপ দেখতে খুবই ক্লেশবোধ করছিলেন৷ লজ্জাবোধ,ক্লেশবোধ কে যন্ত্রণা বোধ করার জন্য আহির বলা পরবর্তী বাক্যগুলোই যথেষ্ট ছিলো।

-‘ ইচ্ছে করে পুকুরে ঝাপ দিয়েছিলেন আপনি হ্যাভেন। অসাবধানতাবশত পা ভেঙে যেতেই পারে। আপনার কি উচিত ছিলো না ভাঙা পা জোরা লাগিয়ে আগের ন্যায় সুস্থ, স্বাভাবিক চলাফেরা করা? কিন্তু না আপনি জেদ ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলবেন এতে যদি ব্যাথা হয় যন্ত্রণা বোধ হয় দোষ দিবেন ভাগ্যের। দোষ দিবেন আপনার পারিপার্শ্বিক অবস্থানরত প্রতিটি মানুষকে। চলার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু পড়ে গিয়ে ওঠার কথা ভাবতে ভুলে যেতে শুধু আপনার মতো মেরুদণ্ডহীনরাই পারে৷ ওঠতে চেষ্টা তো করেনইনি কেউ ওঠাতে আসলেও সন্দেহ করে বসেছেন নিশ্চয়ই আপনাকে ওঠানোর পিছনে কারণ একটাই ওঠিয়ে আবার ফেলে দেবে। একবারো বোঝার চেষ্টা করেননি এ পৃথিবীতে প্রিতিটি মানুষ সমান নয়৷ এ পৃথিবীতে প্রতিটি পুরুষ যদি আপনার মতো কাপুরষ হতো তাহলে আপনার বাবার মতো মহাপুরুষ একটিও খুঁজে পাওয়া যেতোনা। শুনেছি আপনার মাকেও জোর পূর্বক তাঁর পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওঠিয়ে নিয়ে এসে বিয়ে করেছিলেন আপনার বাবা। সেদিকে গেলাম না শুধু একটুকু মনে রাখবেন আপনার বাবা আর আপনার মাঝে বিশাল ফারাক সেই ফারাক থাকায়ই সে মহাপুরুষ আর আপনি কাপুরষ। এ পৃথিবীতে প্রতিটি নারী যদি রূপসার মতো হতো তাহলে আমার আপনার মায়ের অস্তিত্ব কি করে রয়ে গেলো পৃথিবীর বুকে? যাইহোক বোঝানোর দিন,সময় সবটারই ইতি ঘটেছে আজ। তবুও শেষ বোঝাপড়া টুকু করেই যাই। এতোগুলো দিনে বেশ বুঝতে পেরেছি আপনার সঠিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। আপনার বাবা,মা আপনাকে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ আপনি বরাবরই একরোখা, জেদি ছিলেন। আপনার এই জেদের কারণেই বরাবর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তেও দাঁড়িয়েছেন আপনি। রূপসাকে নিজের জন্য বাছাই করেছিলেন আপনিই৷ নিজের সিদ্ধান্তকে, নিজের চাওয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাবা,মায়ের সিদ্ধান্তের পরোয়া না করেই বিয়ে করেছিলেন রূপসাকে। যাকে বলে বড়লোক বাবার বেঁকে যাওয়া অবাধ্য সন্তান। আপনার অবাধ্যতাকে বরাবরই প্রশ্রয় দিয়েছে আপনার বাবা,মা৷ শুরু থেকে শেষ অবদি আজো আপনার অবাধ্যতাকে তাঁরা প্রশ্রয় দিচ্ছে। রূপসাকে বিয়ে তারপর বিচ্ছেদ তারপর মানসিক রোগি হয়ে পড়ে থাকা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পরিবারের সাপোর্ট ডক্টরের সঠিক চিকিৎসাই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু আপনার জেদের কাছে পরাজিত হয়েছে আপনার পরিবার। প্রতিশোধের আগুন ধাও ধাও করে জ্বলছিলো আপনার মস্তিষ্কে। সেই প্রতিশোধ নিলেন। রাজনীতি করে আপনার জায়গাটাও আপনার প্রাক্তন কে দেখিয়ে দিলেন৷ তাঁর থেকেও সুন্দরী ঘরণী যোগার করলেন৷ সবটাই ভীষণ শান্ত,স্বাভাবিক এবং ঠান্ডা মস্তিষ্কে সম্পন্ন করেছেন। শুধু অশান্ত হয়েছেন আমার বেলায়। অস্বাভাবিক হয়েছেন আমার কাছে।
সুস্থ ভাবে নিজেও বাঁচবেন না কাউকে বাঁচতেও দেবেন না আবার কাউকে প্রতিবাদও করতে দেবেন না৷ আপনি একটা জঘন্যতম অসুখের রোগী। ঘৃণা করি আমি আপনার এই অসুস্থ মস্তিষ্ক, অসুস্থ মনটাকে। ঘৃণা করি আমি এই আপনি পুরোটাকেই।
কথার সমাপ্তি ঘটতে না ঘটতেই আবারো সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আহি,

-‘ একবারো ভেবে দেখেননি আপনারা আজ আমার জায়গায় যদি আপনার বাড়ির মেয়ে হিয়া থাকতো তাহলে আপনাদের অনুভূতি কি হতো? মি.হ্যাভেন আপনারও তো একটা ছোট বোন রয়েছে সেও তো কোন না কোন একদিন কারো ঘরের বউ হবে। আমার সাথে যা ঘটেছে তাঁর বিন্দু পরিমাণ কষ্টও যদি তাঁর ভাগ্যে জোটে আপনাদের সহ্য করার ক্ষমতা কতোটা থাকবে? নিজেদের ঘরের মেয়ে বলে খুব গায়ে লাগবে নিশ্চয়ই? ক্ষমতার জোরে নিজের বাড়ির মেয়েকে সেভও নিশ্চয়ই করবেন? আর আমি পরের বাড়ির মেয়ে বলে সবটাই আমাকে দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হবে। কারণ আমার তো ক্ষমতাবান বাবা নেই ক্ষমতাবান একটা পরিবার নেই আমার বাবা যে খুবই সাধারণ একজন মানুষ’?

সকলে স্তব্ধ হয়েই রইলো। যদিও হ্যাভেনের স্তব্ধতায় সকলেই বিস্ময়ান্বিত। তবুও সে স্তব্ধতা বজায় রেখেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আহির আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করলোনা৷ এবার সে মুক্তি নিয়ে মুক্তি দিয়েও যাবে। চিরকালের জন্য ত্যাগ করবে এই ঘর এই সংসার এই অসুস্থ মানুষ টাকে। দুহাত মুঠো করে হাতকড়ার মতো করে নিজ সম্মুখেই ধরলো আহি। দুহাতে তাঁর চিকন দুটো স্বর্ণের বালাতে অগ্নি চক্ষু তে কিছু সময় চেয়ে রইলো। অতঃপর এক মূহুর্তও সময় নিলো না সে বালা দুটো খুলে ফেলতে। রুবিনা তালুকদার আঁতকে ওঠলো সে খানিকটা টের পেয়ে গেছে বালা দুটো খুলে ফেলার কারণ। আহির কাছে এসে বাঁধা দিতে নিলেই আহি ছিঁটকে সড়ে গিয়ে ট্রিটেবিলের ওপর বালা দুটো রাখলো। হুমায়ুন তালুকদার, হ্যারি,হিরা, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রমার চোখ বেয়ে অঝড়ে পানি ঝড়ছে। বলাবাহুল্য হ্যারি, হিরার চোখ দুটোও চিকচিক করছে। হুমায়ুন তালুকদারের বুক অনুতাপের আগুনে পুঁড়ছিলো। কারণ তিনিও যে এক কন্যা সন্তানের বাবা। অনেক বড় অন্যায় হয়ে গেছে তাঁদের দ্বারা। নিজ স্বার্থে মগ্ন থেকে কখনোই এই মেয়ে বা এই মেয়ের পরিবারের কথা ভাবা হয়ে ওঠেনি। কখনো খেয়াল করেও খেয়াল করা হয়নি নিজ ছেলের বর্বরতা।

রুবিনা তালুকদার শত বাঁধা দিয়েও আহিকে আটকাতে পারলোনা। আহি বালা দুটো খোলার পর কানের ছোট্ট দুলজোরা, গলায় থাকা চিকন স্বর্ণের হার সহ নাকের নাক ফুল টাও খুলে ফেললো। নাক ফুল খোলার পর মূহুর্তেই প্রবল অস্থিরতা চেপে ধরলো হ্যাভেনকে। পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা তাঁর। এতোটা সময় সে যতোবার কিছু বলতে চেয়েছে যতোবার কিছু করতে চেয়েছে অদৃশ্য এক বাঁধা অদৃশ্য এক অনুতাপ আঁটকে দিয়েছে তাঁকে। কিন্তু যেই মূহুর্তে আহি ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীর দেওয়া সকল চিহ্ন খুলতে শুরু করলো সেই মূহুর্তেই তাঁর অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে গেলো চারগুন। বুকের ভিতর টা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তাঁর। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে। পুরো পৃথিবী টা কেমন যেনো ঘুরছে। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে ক্রমাগত। তাহলে কি সে ঢলে পড়বে পৃথিবীর বুকে? তাহলে কি আবারো পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে খুবই নৃশংসভাবে ? এতো বেশী অসহনী যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে তাঁর? কেনো মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে বড় সম্পদটাই আজ হারাতে বসেছে সে? এতো বেশী দহন কেনো হচ্ছে তাঁর বক্ষঃস্থলে?

এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়লো আহি। শত জোর করেও রুবিনা তাঁকে আটকাতে পারেনি। হ্যারি,হিরাকে হুমায়ুন তালুকদার যেতে বললেও আহি ক্রোধান্বিত স্বরে বলেছে তাঁর পিছু কেউ নিলে সে ক্ষণেই সে নিজেকে শেষ করে দেবে। তাঁকে শত চেষ্টা করেও শত জোর দিয়েও আজ ফেরানো যাবেনা। যদি কেউ ফেরায় তাহলে লাশ হয়ে বেরিয়ে যেতে খুব একটা সময় সে নেবে না। ভয়ে হ্যারি,হিরা দুজনেই চুপসে গিয়ে সদর দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বিক্ষিপ্ত আহির চলে যাওয়া দেখলো। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে রমা, রুবিনা তালুকদার, হুমায়ুন তালুকদার ছুটে এলেও আহিকে আর পেলো না, তাঁরা আসার পূর্বেই সিএনজি তে ওঠে পড়েছে আহি। শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে মেইন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো হ্যারি,হিরাকে। তাঁরা তিনজনও অশ্রু সিক্ত নির্বাক দৃষ্টি মেললো রাস্তার দিকে। কিন্তু তাঁরা কি জানে সকল অভিযোগ, সকল পাপের ভীরে চাপা পড়ে গিয়ে তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তান জ্ঞানশূন্য হয়ে ঢলে পড়েছে গৃহতলে।

চলবে…
গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় বাদ পড়লেও পড়তে পারে। আপাতত ভাবতে পারছিনা৷ পরবর্তী তে মনে পড়লে এড করবো। আহি সত্যি সত্যিই চিরকালের জন্য সম্পর্ক ছেদ করে অবশেষে যেতে পারলো। দেখা যাক এবার কোন দিকে মোড় নেয় গল্প। আমি বাস্তব জীবনে সাইকো দেখেছি খুব কাছ থেকে। তাই আমি জানি একজন সাইকোর সঙ্গে জীবন কাটানো জাষ্ট অসম্ভব। তবে যে কাটিয়েছে সেই বুঝে এই অসম্ভব টা কতোখানি অসম্ভব যা আহি বুঝেছে। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আমি সকলকে রিপলাই করতে পারিনা কিন্তু সকলের করা মন্তব্য খুবই গভীরভাবে দেখি গভীরভাবে নিই❤।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here