অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৭।

0
602

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।

‘ফারজাদ রিজাইন লেটার পাঠিয়েছে, জারা।’

খাবারটা কেবলই মুখে তুলেছিল জারা। গলাধঃকরন করার পূর্বেই সেটা তালুতে উঠে যায়। কাশতে আরম্ভ করে। রওফিক সাহেব পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। জারা ঢকঢক করে শেষ করল পুরোটা। তারপর বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল,

‘এটা হতে পারে না।’

রওফিক সাহেব লেপটপটা জারার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,

‘কিছুক্ষণ আগেই মেইলটা পাঠিয়েছে, সে আর একদিনের জন্যও অফিসে আসতে চায় না।’

জারা ঢোক গিলল। তবে কি এত চেষ্টা করেও সে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ’ই হবে? সে কি কোনোভাবেই ফারজাদকে নিজের করে পাবে না? রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে খাবারের প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিল তাই। রওফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা তাঁর রীতিমত উন্মাদ হয়ে পড়েছে। জারা চেয়ার ছেড়ে উঠল। রাগে কটমট করতে করতে বলল,

‘আমি আসছি, আব্বু।’

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘একটা জায়গায়। কাজ শেষে বাসায় চলে যাব, তুমি দুশ্চিন্তা করো না।’

সে বেরিয়ে গেল। রওফিক সাহেব মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটাকে যে কী করে বোঝাবেন সেটা তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না।

__________

চারদিকে ফকফকা রোদ হলেও এই জায়গাটা যেন কেমন অন্ধকার আচ্ছন্ন। কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ আসে এখান থেকে। পরিবেশ’টা জারার মোটেও পছন্দ না। তাও ঠেকাই পড়ে বার বার তাকে এখানেই আসতে হচ্ছে। সে ভেতরে প্রবেশ করে। একজন লোক তাকে আটকে দিয়ে বলে,

‘ভেতরে একজন আছেন, উনি বের হলে আপনি যাবেন।’

জারা দাঁড়াল। গলায় পেঁচানো স্কার্ফটা দিয়ে নাক মুখ ডেকে নিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পর তার পালা এল। ভেতরে গেল অতঃপর। গিয়ে বসল হাঁটু ভেঙে। অসহায় সুরে বলল,

‘এটা কী হলো, বাবা? ভেবেছিলাম কিছু হলেও কাজ হবে, বরং হয়েছে তো তার উল্টো। ফারজাদ এখন চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে।’

অদ্ভুত দেখতে লোকটা দাঁত কিড়কিড় করে উঠল। বাজখাঁই স্বরে বলল,

‘হবে কী করে? কী করে হবে? আমার পোষ্যগুলো তার কাছেও ঘেঁষতে পারছে না। ও কোনো এক শক্তিশালী বন্ধনে বেষ্টিত, ওর ধারে কাছে যাওয়া সোজা নয়। আমার শক্তি পেরে উঠছে না।’

জারা অস্থির গলায় বলল,

‘এবার উপায়?’

‘ওর রক্ত নিয়ে আয়। রক্ত পেলে আমি শক্ত জাদু করতে পারব।’

‘রক্ত? রক্ত আনা তো সম্ভব নয়।’

‘তাহলে তুইও ওকে ভুলে যা।’

জারা মাথা নাড়িয়ে চটপটে সুরে বলল,

‘না না, আমি ওকে ভুলতে পারব না।’

‘তবে যা, যেটা বলেছি সেটা কর গিয়ে।’

জারা উঠে দাঁড়াল। বের হয়ে গেল সেখান থেকে।

গাড়িটা আনমনে চালাচ্ছে। মাথায় ফারজাদের রক্ত জোগাড়ের চিন্তা। কিন্তু, আদৌ এটা সম্ভব হবে কি? এতসব চিন্তার মাঝে সে খেয়ালও করল না যে সে রং রোডে গাড়ি চালাচ্ছে। যার দরুন আচমকা এক গাড়ির মুখোমুখি হলো। হুঁশ ফিরতেই শক্ত ব্রেক কষল জারা। আর একটুর জন্য মারাত্মক এক এক্সিডেন্টের কবল থেকে বেঁচে গেল তাই। সে ঘাবড়ে যায় খুব। নিশ্বাসের মাত্রা বাড়ে। অপর পাশের গাড়ি থেকে একজন নেমে আসে। জারার গাড়ির জানালায় টোকা দিয়ে ইশারায় তাকে কাঁচ নামাতে বলে। জারা কাঁচ নামায়। বিনয়ের সুরে স্যরিও বলে লোকটাকে। অথচ সেই লোক স্যরি মানতে নারাজ। সে উল্টো জারার উপর চড়াও হয়ে বলে,

‘পাগল হয়েছেন? উল্টো রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন কোন আক্কেলে? না-কি রাস্তাটা কিনে নিয়েছেন, কোনটা?’

‘আমি স্যরি বলেছি তো?’

‘স্যরি বললেই সব সমাধান হয়ে যায় না। আর রং সাইডে গাড়ি চালানো একটা অপরাধ। একজন উকিল হিসেবে অপরাধ ধরিয়ে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব।’

জারা চোখ বোজে নিজেকে ধাতস্ত করল। এতসবে বিরক্ত সে। বলল,

‘আমি আবারও স্যরি। দুশ্চিন্তায় খেয়াল করিনি। আর এমন হবে না।’

লোকটা বলল,

‘ওয়েট! আপনার গাড়ির নাম্বারটা আমি নোট করে রাখছি। আবার কখনো এই নাম্বারের গাড়িকে ভুল রাস্তায় দেখলে মামলা ঠুকব।’

জারা এবার রেগে গেল। বলল,

‘কানে কি কথা যায় না আপনার? স্যরি বলেছি, তাতে হচ্ছে না? না-কি মেয়ে মানুষ দেখে মাথায় চড়ে বসেছেন?’

‘এই যে ম্যাডাম, ভদ্র ভাবে কথা বলুন। আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন?’

জারা বিদ্রুপের ছলে বলল,

‘না জানিনা। কে আপনি?’

‘আমি অ্যাডভোকেট আফসার খান, আর আমি চাইলে এক্ষুনি আপনার গাড়িকে থানায় পাঠাতে পারি।’

জারা হেসে বলল,

‘ওহহো, আমি ভীষণ ভয় পেয়েছি। প্লিজ প্লিজ এমন করবেন না, অ্যাডভোকেট আফসার খান।’

আফসার চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’

জারা শক্ত গলায় জবাব দিল,

‘আপনার মতো এমন অ্যাডভোকেটকে আমার বাবা অহরহ কিনছেন, সেখানে আপনার সামান্য হুমকিতে আমি ভয় পাব, সেটা ভাবলেন কী করে?’

আফসার এগিয়ে আসল। আচমকা সে এগিয়ে আসায় জারা পিছিয়ে গেল খানিক। আফসার ক্রূর হেসে বলল,

‘তাই না-কি, ম্যাডাম? আপনার বাবার তো তবে খুব ক্ষমতা। একবার তাঁকে আমার অফিসে আসতে বলবেন, ক্ষমতার পরীক্ষা না হয় সেখানেই হয়ে যাবে।’

এই বলে সে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে জারার কোলের উপর ফেলে বলল,

‘এটা আমার কার্ড। রেখে দিন, কখনো প্রয়োজন পড়লে ডাকবেন, আমার ক্ষমতা দেখাতে চলে আসব।’

আফসার ফিরে গেল নিজের গাড়িতে। জারা কোল থেকে কার্ডটা নিয়ে পেছনের সিটে ছুড়ে মারল। আজ দিনটাই খারাপ যাচ্ছে তার। সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আফসারের গাড়িটা তার গাড়ির বরাবর আসতেই আফসার চোখে চশমা লাগিয়ে জানলার কাঁচটা তুলে দেয়। ভেতরে থেকে দেখা যায় তার বাঁকা হাসি। জ্বলে উঠে জারা। ঢিল ছুড়ে জানলার কাঁচটা ভেঙে দিতে পারলে কিছুটা শান্তি পেত বোধ হয়। তা করার সাধ্য নেই বলে আপাতত সেও নিজের গাড়িটা ঘুরিয়ে সঠিক পথে এগোয়।

____________

পাকিস্তানে এসেছে। থেকেছে অনেক দিন। কিন্তু এতসব ঝামেলার মাঝে নতুন দেশ, নতুন জায়গাটা আর ঘুরে উঠা হয়ে উঠেনি প্রিয়তার। অনেক অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে এই দেশে এলেও ফিরে যেতে হচ্ছে খালি হাতে। তাই যাওয়ার আগে আরো সুন্দর কিছু মুহুর্ত তৈরির জন্য মৌমি জেদ ধরল, আজ তারা সবাই মিলে ঘুরতে যাবে। আর ফারজাদও না করতে পারেনি। রাজি হলো।
বিকেলের দিকে তৈরি হচ্ছে সবাই। টকটকে লাল রঙের একটা সেলোয়ার কামিজ পরেছে মৌমি। চুলগুলো বেনি করা। তার মৃগনয়নাগুলো সাজিয়েছে নিকষ কালো কাজলে। ঠোঁটযুগল রিক্ত শূণ্য। লিপস্টিকের খানিকটা রং আঙ্গুলের ঢগায় নিয়ে ঠোঁটে ঘষে নিল। ব্যস, তৈরি। ওড়না ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হলো অতঃপর। অপর পাশ থেকে বের হলো নীহালও। সেও শার্টের হাতা ভাঁজ করায় ব্যস্ত। যার দরুন দুজনের মাঝে ঘটে একটা ছোটখাটো সংঘর্ষ। আচমকা ধাক্কা লাগায় মৌমি দ্রুত দূরে সরে দাঁড়ায়। নীহাল তার দিকে তাকিয়ে স্যরি বলতে নিয়েও কেন যেন আর বলতে পারল না। সে আবিষ্কার করল, একটা আস্ত টকটকে লাল গোলাপ দেখছে সে। মৌমি ইতস্তত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীহাল ভ্রু কুঁচকাল। মেয়েটা এত কাজল দিল কেন? এই কাজলে কি নেশা জাতীয় কিছু আছে না-কি? নয়তো তার শরীর’টা হঠাৎ এমন লাগছে কেন? কিছু কি হচ্ছে? ভয়ানক কিছু? নীহাল ঢোক গিলল। বুকের বা পাশে হাত রাখল সে। তা দেখে ড্যাবড্যাব করে চাইল মৌমি। বুঝতে পারল না কিছু। নীহাল নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘কী লাগিয়েছেন চোখে? আমার বুকে ব্যথা করছে কেন?’

মৌমি থতমত খায়। বলে,

‘আমার চোখের সাথে আপনার বুকে ব্যথার কী সম্পর্ক?’

নীহাল বিরক্ত গলায় বলল,

‘সেটা আমি কী করে বলব? চোখে হাবিজাবি কী লাগিয়েছেন, তার জন্যই তো আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে।’

মৌমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার কাজলের জন্য আপনার বুকে ব্যথা? আশ্চর্য! এটা কেমন যুক্তি?’

নীহাল ঢোক গিলল। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘না, আপনি বুঝবেন না। ছোট মানুষরা এতকিছু বোঝে না।’

অতঃপর চলে গেল সে। মৌমিকে ফেলে গেল বিশাল গোলকধাঁধায়। লোকটার কথা তার বোধগম্য হয়নি মোটেও। সে চোখের নিচে হাত রেখে আনমনে ভাবল,

‘আমার কাজলের জন্য উনার বুকে ব্যথা হবে কেন?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here