#এই_অবেলায়_তুমি
#পর্ব_২৪
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
সেই বৃষ্টিতে ভেজার পর টানা তিনদিন তুমুল জ্বর ছিলো।এত জ্বর এসে ছিলো যে বিছানা থেকে উঠতে পারেনি নূর। এই তিনদিন মাহি আর রুদ্র ওর খুব খেয়াল রেখেছে। মাহিতো পাঁচ মিনিটের জন্য নূরকে রেখে কোথাও জায়নি। ভার্সিটিতেও জায়নি।তিনটা দিন বেহুঁশের মতো পরে থেকে চতুর্থ দিনে প্রায় অনেকটাই সুস্থ হয়েছে।
আজ ইরিন ফোন দিয়ে জানিয়েছে ক্লাস টেস্ট পরিক্ষা আজকে। ও যদি সুস্থ হয় তাহলে যেনো আসে।
নূর উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিচে গেলো। হালকা নাস্তা করে বেরিয়ে পরলো কলেজের উদ্দেশ্যে। পিছন থেকে আনিতা বেগম অনেক বার ডাকলেন মেডিসিন খেয়ে যাওয়ার জন্য। ঔষধ দেখলেই নূরের শরীর গুলায়।
ক্লাস রুমে নূর আর ইরিন বসে কথা বলছে।এমন সময় কয়েকটা ছেলে মেয়ে এসে বললো,’ সরি নূর আমাদের ক্ষমা করে দাও।আমরা বুঝতে পারিনি ওই দিন তোমার সাথে বাজে ব্যাবহার করে ফেলেছি।তোমার সাথে বাজে ব্যাবহারের জন্য আমরা লজ্জিত্য।’
নূর দেখলো ওই দিন ওকে আর শুভ ভাইকে নিয়ে অপমান করা ক্লাসের ছেলে মেয়ে গুলো আজকে ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো৷ কিন্তু সেই হাসি আর বেশি সময় থাকলো না।
পাশে থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো, ‘ সরি ভাবি আপনার আগে বলার উচিৎ ছিলো আপনি শুভ ভাইয়ের হবু বউ।তাহলে তো আমরা আপনাকে ভুলেও কিছু বলতাম না।’
নূরের কান দিয়ে মনে হচ্ছে গরম ধুঁয়া বের হচ্ছে রাগে।চোখ মুখ খিঁচে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।একটু সামনে যেতেই ফায়াজ স্যারের সামনে পরলো। ফায়াজ নূরকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘ কেমন আছো নূর..?’
নূরঃ জ্বি স্যার আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি..?
ফায়াজঃ আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি। জ্বর কমেছে.?
নূরঃ একদম ভালো হয়ে গেছি স্যার।
ফায়াজঃ তাহলে ক্লাস রুম ছেড়ে ওই দিকে কোথায় যাচ্ছো..?
নূরঃ ভালো লাগছে না স্যার তাই ভাবলাম ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাক।
ফায়াজঃ একটু আগেই তো বললে ভালো হয়ে গেছো। আবার ডাক্তারের কাছে কেনো..?
নূরঃ ওফ্ফ স্যার আপনি এই সব গোয়েন্দাগিরি না করে। রাট বারো টায় লোকের বাসার বারান্দায় ডিল না মেরে জলদি বিয়ে করে নেওয়ার প্লেন করেন কাজে দিবে।
ফায়াজ নূরের কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হেসে উঠলো।
ফায়াজঃ যাই বলো নূর তোমরা দুই বোন খুব ডেঞ্জারাস মহিলা।
নূরঃ মহিলা!!
ফায়াজ নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে দিলো নূর ও ফায়াজের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো । এই কয় দিনে ফায়াজের সাথে খুব ভাব জমে গেছে।
——
আবির আদিবাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আদিবা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
আদিবার এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে। আদিবা মনে মনে বলছে,
~এই বেটাকে তো বিয়ের আগে একদম ভদ্র ছেলে মনে হয়েছে।ওফ্ফ এখন তো একদম লুচ্চুদের খাতায় নাম উঠিয়ে ফেলেছে।একটু পরেই আমার আবার নিচ থেকে ডাক পরবে। দরজাটা ও খোলা কেউ যদি আমাকে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই অনেক কথা শুনাবে।
ইরিনঃ আপনি অফিস থেকে কেনো এসেছেন..?
আবিরঃ ঘরে সুন্দরী বউ রেখে কাজে মন বসে না।তাই বসের থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। ভাবছি হানিমুনে যাবো। আচ্ছা কোথায় যাওয়া যায় বলো তো..?
আদিবার হানিমুনের কথা শুনেই চোখ কপালে।
——
কলেজ ছুটির পর নূর বাসায় না এসে হসপিটালে চলে গেলো ইরিনের আম্মুকে দেখতে। আন্টি হার্ট অ্যাটাক করেছে হসপিটাল ভর্তি।
নূরকে দেখে ইরিনের আম্মু অনেক খুশি হলেন।উনার সাথে অনেকক্ষন কথা বলে উঠে দাঁড়ালো নূর।
নূরঃ তাহলে আন্টি আসি।
~আচ্ছা মা। ইরিনের সাথে আমাদের বাসায় আসবে ঠিক আছে।
নূরঃ অবশ্যই আসবো আন্টি।
নূরকে এগিয়ে দিতে ইরিন ও নূরের সাথে বের হলো। আসার সময় হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা পরিচিত মুখের মধ্যে।পাশের ক্যাবিনে রুদ্রকে দেখে অবাক হয়ে গেলো নূর।
ইরিনঃ কি হয়েছে বলে তাকিয়ে ওর চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। পরক্ষনে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো, ‘ ভুলেও আর কারো উপর ক্রাশ খাবো না। আমি ভালো মেয়ে হয়ে গেছি.’
রুদ্র রোগী দেখে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।
রুদ্রঃ নূর তুমি এখানে কেনো..?
নূর হালকা হেসে ওর পাশে ইরিন কে দেখিয়ে বললো ওর আম্মুকে দেখতে এসেছি।
ইরিন ভদ্র মেয়ের মতো সালাম দিলো।
রুদ্র সালামের উওর দিয়ে কিছুক্ষন ইরিনের সাথে পরিচিত হলো।
রুদ্র ইরিনের সাথে কথা বলে নূরের দিকে এগিয়ে এসে। নূরের কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বর আছে কি নেই।
নূর প্রথম ঘাবড়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো।
রুদ্র নূরকে আর ইরিন কে বললো ওর ক্যাবিনে যেতে নূর বললো বাসায় যাবে। অন্য একদিন আসলে ক্যাবিনে যাবে ইরিনও বললো পরে কোনো এক সময় যাবে।
রুদ্র চলে যেতেই ইরিন বলে উঠলো, ‘ দুস্ত এতো সুন্দর পুলা ঘরে থাকতে তুই এখনো সিঙ্গেল কেমনে। আমি হলে কবে টুকুস করে প্রেম করে বিয়ে করে চার পাঁচটা বাচ্চার আম্মা হয়ে যেতাম।
নূর ইরিনের কথা শুনে রাগ করলো না হুঁ হুঁ হুঁ করে হেসে উঠলো। সাথে ইরিন ও হেসে দিলো।
———
মাহি ভার্সিটি থেকে বের হতেই সামনে ফায়াজ পরলো।
মাহিঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ফায়াজ সালামের উওর দিয়ে বললো, ‘ মাহি একটা কথা ছিলো। তুমি কি ফ্রী আছো..?’
মাহিঃ জ্বি স্যার।
ফায়াজঃ আমার সাথে একটু মার্কেটে যাবে৷ আসলে আমি তো মেয়েদের কিছুই চিনি না বুঝি না। তাই তোমাকে দেখে বললাম।
মাহিঃ কার জন্য..?
ফায়াজঃ আম্মুর আজকে বার্থডে তাই ভাবলাম হঠাৎ কিছু নিয়ে চমকে দেই।
মাহি খুশি হয়ে বললো,’ তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো চলুন। ‘
———
রাতে রুমে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে নূর। মাহি নূরের রুমে ঢুকেই নূরকে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিলো। তারপর খুশিতে নূরকে নিয়ে ঘুরা শুরু করলো। মাহি খুশিতে কি করছে সে নিজেও বুঝছে না৷ নূর অবাক হয়ে গেছে মাহির এমন পাগলামি দেখে।
নূরঃ আসতে আসতে আপু আমি পরে যাবো তো।
মাহিঃ নূর! নূর আমি আজকে এত এত খুশি যা আমি তোকে কেনো কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না।
নূর অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘ কেনে রে তুই কি কোনো জব পেয়েছিস। নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ‘
মাহি লাজুক হেসে মাথা নাড়লো।
নূর কিছুক্ষন থমকে তাকিয়ে আছে।
মাহি অবাক হয়ে বললো,’ কি হয়েছে নূর। কিছু বলছিস না কেনো…’
নূর একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘ সত্যি আপু তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে.? নাকি আমার সাথে মজা করছিস।
মাহিঃ তোর কি মনে হয় বিয়ের মতো এমন একটা সিরিয়াস কথা নিয়ে আমি মিথ্যা বলবো। বলে বিছানায় বসলো মাহি।
মাহির বিয়ের কথা শুনেই নূরের চোখের সামনে ফায়াজের মুখটা ভেসে উঠলো।
নূরঃ ছেলের নাম কি? বাসা কোথায়? বিয়ে ঠিক হলো কবে? তোমাকে দেখতে আসলই বা কবে?
মাহিঃ ওরে বইন একটু শ্বাস ফেলে প্রশ্ন কর। আর ছেলে দূরের কেউ না।
নূরের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠলো মনে মনে বলে উঠলো, ” তাহলে কি ফায়াজ স্যার”
নূর খুশিতে মাহি কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘ তাহলে ছেলেটা কে শুনি..?
মাহিঃ আমাদের রুদ্র ভাইয়া.. বলেই দু’হাতে মুখ ডেকে নিলো।
নূরের মনে হচ্ছে ও ভুল শুনেছে। রুদ্র ভাইয়া!! এটা কি করে হতে পারে। আর আপু এতো খুশি। আপুকি আগে থেকে ভাইয়া কে পছন্দ করতো..? আর রুদ্র ভাইয়া কে দেখে তো মনে হয়নি কখনো আপুকে ভালোবাসে।
মাহি আবার বলে উঠলো, ‘ দেখলি রুদ্র ভাইয়া কে দেখে তো একদমি মনে হয়নি উনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু তলে তলে বিয়ের প্রস্তাব ও উনার আম্মুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজকে রাতে বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন সবাই বসে।
নূর অবাক হয়ে গেলো মাহির কথা শুনে। ওর কেনো বার বার ফায়াজের মুখটা ভেসে উঠছে। সেই মুখটা যেটা, প্রতি দিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মাহির বারান্দার দিকে। তাহলে কি আরো একজনের মন ভাঙ্গার গল্প শুনা যাবে।একতরফা ভালোবাসার গল্প। রুদ্র ভাইয়া কি এক বারও বুঝতে পারেনি তার বেস্ট ফ্রেন্ড এর মনের খবর নাকি রুহির মতো সব বেস্ট ফ্রেন্ড তার বন্ধুর মন ভেঙে শান্তি পায়।
ফায়াজ রাতে মাহি কে পড়াতে এসে শুনতে পায়৷ মাহির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মহূর্তেই ফায়াজের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। রাগে ফায়াজ হাত দুটো মুষ্টি বদ্ধ করে রেখেছে। চোখ দিয়েই যেনো আগুন বের হচ্ছে। ও কখনো কারো বাসায় গিয়ে টিউশনি করায় না। রুদ্র একবার বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গিয়ে ছিলো কারন মেয়েটা যে মাহি ছিলো।
ফায়াজঃ ছেলের বাসা কোথায়..?
মাহি লজ্জা মাখা মুখে বলে উঠলো স্যার ছেলেটা রুদ্র ভাইয়া।
ফায়াজ হঠাৎ একদম শান্ত হয়ে গেলো।না চাইতেও চোখের কোনে পানি জমা হচ্ছে । মুচকি হেসে বলে উঠলো, ‘ আরে বাহ্ খুব ভালো তো। তো বিয়ে কবে..? আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম তাও একবার বলার প্রয়োজন মনে করলো না।!’
ফায়াজ মাহির রুম থেকে বেড়িয়ে চলে যাবে এমন সময় নূর পিছন থেকে ডেকে উঠলো।
ফায়াজ পিছন ফিরে নূরকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বললো,’ কিছু বলবে নূর..?’
নূর ফায়াজের চোখের দিকে তাকালো। চোখে চিকচিক করা হালকা পানি ঠোঁটে হাসি মারাত্মক লাগছে ফায়াজ কে। ওর আফসোস হচ্ছে কেনো এই মানুষটার। এমন মন কাড়া হাসি ওর বোনের চোখে পরলো না। এই যে চোখে চিকচিক করা জলটা। এটা হলো না বলতে পারা কথাগুলোর ব্যথা।এই ব্যথাগুলো সবার সামনে দেখানো যায় না। সবাই যে এই ব্যথা বুঝে না। যাকে বুঝানো প্রয়োজন সে না বুঝে নিলে, অন্য কাউকে বলে লাভ কি। যে সে কতটা ব্যর্থ, নিজের ব্যর্থতার গল্প।
ফায়াজঃ কি হলো নূর কিছু বলবে..?
নূরঃ হুহ্,, না না স্যার কিছু বলবো না।
ফায়াজ ড্রয়িং রুমে যাওয়ার সাথে সাথে আনিতা বেগম ফায়াজকে খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে বসলেন। উনার জেদ এর কাছে পরাজিত হয়ে খাবার খেয়ে যেতে হলো ফায়াজ কে।
আনিতা বেগম মনে করেন ফায়াজ যেনো ওনার ছেলেরজ মতো৷ এই ছেলেটার প্রতি উনার মায়া জমে গেছে।প্রতি দিন মাহিকে পড়িয়ে যাওয়ার সময় খাবার না খাইয়ে ছাড়েন না।
বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে আজ থেকে তিনদিন পর বিয়ে…. মাহি তো খুশিতে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। বুকে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে….
চলবে…
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।