#এই_অবেলায়_তুমি
#বোনাস_(পর্ব _২৫)
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
চোখের পলকে যেনো দুইটা দিন চলে গেলো। আজ বাদে কাল বিয়ে। চৌধুরী বাড়ির ছেলেদের শেষ বিয়ে বলে কথা।কোনো কিছুর কমতি রাখেনি।
ফুলে ফুলে পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে, লাইটিং করা হয়েছে। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি টইটুম্বুর। বিয়ের আগের দিন এতো মানুষ আসার মানে টা বুঝলো না নূর। ঠিক আছে বিয়ে দাওয়াত দিয়েছে কাল কে আসবে। আজ এসে কেনো বাড়িটাকে মাছের বাজারের মতো বানিয়ে রেখেছে।
বর কনে তো এক বাড়ির তাই দুই পক্ষের আত্মীয় স্বজনরা ও এক বাড়িতে এসেছে। তাই বাড়িতে এত মেহমান।
হলুদ সন্ধ্যায়,
মাহিকে খুব সুন্দর করে হলুদ আর লাল পাড়ের শাড়ি, হলুদ আর লাল মিশ্রিত গহনা দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। মাহি তো দেখতে এমনিতে মাশাল্লাহ খুব সুন্দর। পার্লারের মেয়েরা মাহি কে সাজিয়ে নূূরের দিকে তাকালো।
নূর গালে হাত দিয়ে ওর আপুর দিকে তাকিয়ে আছে।
মাহি নূর কে ঠিক হয়ে দাড়াতে বললো। উনারা শাড়ি পরাবে।
নূর বিরক্তিতে মহিলা গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার শাড়ি আমি পড়ে নিতে পারবো। আপনারা রুম থেকে বের হন।’
যেহেতু উনাদের কাজ শেষ তাই উনারা বেরিয়ে যেতে নিলে মাহি রেগে বলে উঠে, ‘ আপনারা দাঁড়ান। আর তুই বেশি পন্ডিত হয়ে গেছিস না। চুপচাপ দাঁড়া এখানে। তোকে আমার মতো সাজিয়ে তারপর তারা বের হবে৷ আর না হলে আমি একে একে সব খুলে ফেলবো। ‘
নূর নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,’ তাহলে উনাদের বলো আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে।’
মাহি এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো, কেনো..?
নূরঃ ইরিন আসছে তাই। এক সাথে হলুদের জন্য রেডি হবো।
মাহির হঠাৎ আদিবার কথা মনে পরলো । ইসস বিয়ের খুশিতে সে তো আদিবার রেডি হওয়ার কথাই ভুলে গেছে।
মাহি নীল কে ফোন দিলো ওর রুমে আসার জন্য।
কিছুক্ষন পর রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই নূর এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে।
দরজা খুলতেই দেখলো নীল বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।
নূরঃ হনুমানের মতো মুখ করে আইছিস কেনো..?
নীলঃ একদম হনুমান বলবি না। নিজের চেহারা একবার আয়নার মধ্যে দেখ গিয়ে। পেঁচার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছিস। আমার মতো একটা সুদর্শন যুবক কে হনুমান বললে তোর জীবনে ও বিয়া হইবো না।
নূরঃ কি তুই সুদর্শন যুবক!! বলেই নূর হাসা শুরু করলো।
নীলঃ আজাইরা পেঁচাল বাদ দে। আগে বল হরিণ কই। আসতে বলছ নাই..?
নূরঃ কেনো ওকে দিয়ে তোর কি কাজ..? আর ও কেনো আসবে আমাদের বাড়ির বিয়েতে। ও এই বাড়ির কি হয়..? ও জাস্ট আমার কলেজের ফ্রেন্ড।
নীল রেগে বলে উঠলো, ‘ তোরা মেয়েরা এক নাম্বার পল্টি বাজ।এতো দিন গলায় গলায় ভাব আর আজ কে জাস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলো। সর তো সামনে থেকে।
নূর কিছু বলবে তার আগে মাহি ভেতর থেকে নীল কে বললো,’ ওই ঝগড়া থামা। আমার গায়ে হলুদ শেষ হয়ে যাবে তোরা দু জনের ঝগড়া শেষ হবে না। নীল গিয়ে আদিবা কে বল মাহি ডাকছে।
ইরিন আসার পর নূর বললো আগে ইরিন কে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে। ইরিনের পর আদিবাকে সাজালো তারপর শুভ্রতা, তারপর নূর। সবাইকে ঠিক এক রকম ভাবে সাজিয়েছে শুধু মাহির সাজটা একটু ভিন্ন। যেনো বউ কে চিনতে অসুবিধা না হয়।
আর এদিকে আমাদের রুহি ভাবি উনার ঠিক করা পার্লারের মেয়েদের কাছে সেজেছে তাকেও খুব সুন্দর লাগছে।
ছেলেরা সবাই পরেছে হলুদ পাঞ্জাবিতে লাল, সাদা সুতার কাজ করা।
রুদ্র আব্বু রেগে নিজের রুমে বসে আছেন। ছেলে তার দিন দিন বেয়াদবের খাতায় নাম তুলে নিচ্ছে। আজ তার গায়ে হলুদ বাড়ি ভর্তি লোকজন কিন্তু ছেলের কোনো খবর নেই।বিয়ের জন্য তো দুই দিনের ছুটি নিতে পারে হসপিটাল থেকে। এই নিয়ে না হয় ১০০+কলের উপরে কল দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু রুদ্র কল রিসিভ করছে না।
ছাঁদে খুব সুন্দর করে হলুদের স্টেজ সাজিয়েছে। মাহি কে নিয়ে সবাই ছাঁদে গেলো৷ একটু পর মেহেদী দিয়ে দেওয়ার জন্য পার্লার থেকে মেয়ে আসবে।
নীল সাথে করে চারটা মেয়ে নিয়ে ছাঁদে আসলো।
নীলের সাথে চারটা সুন্দরী মেয়ে দেখে ইরিন রেগে নূরের হাত খামচে ধরলো।
নূর হঠাৎ এমন আক্রমনে ‘আহহহ’ বলে আর্তনাদ করে উঠলো।
নূরের মুখে আর্তনাদ শুনে সাথে সাথে ইরিন ছেড়ে দিলো নূরের হাত। অপরাধীর মতো মুখ করে নূরের দিকে তাকালো।
নূর হেসে বলে উঠলো, ‘ একদম এভাবে তাকাবি না। ‘
ইরিনঃ সরি জান্স..এই নীলের সাথে মেয়ে গুলো কে..?
নূর চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো, ‘ তুই জেলাস..!
ইরিন নূরের থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠলো, ‘ মুটে ও না। ‘
মেয়েগুলো এসে মাহির সামনে একজন বসলো। বাকি তিনজন শুভ্রতা, আদিবা কে দিয়ে দিচ্ছে।
নূর আর ইরিনের সামনে একজন দাঁড়িয়ে আছে।
নূরঃ আপনি ইরিন কে দিয়ে দেন। আমি মেহেদী দিবো না।
ইরিনঃ তুই না দিলে আমিও দিবো না নূর।
নূরঃ চুপচাপ বসে থাক। বেশি কথা একদম বলবি না৷
মাহি কে মেহেদী পড়ানো মেয়েটা বলে উঠলো, ‘ আপু বরের নামটা একটু বলেন৷ ‘
এমন সময় ছাঁদে প্রবেশ করলো রুদ্র আর ফায়াজ৷
ফায়াজ কালো পাঞ্জাবি পড়েছে। শ্যামলা চেহারার পুরুষটাকে কালো রং টায় মারাত্মক সুন্দর লাগছে। আর রুদ্র সাদা শার্ট আর কালো টাউজার।
রুদ্রের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো নূর। বেটার আজ বাদে কাল বিয়ে। আজ গায়ে হলুদ সে কি না শার্ট আর টাউজার পড়ে আছে৷
মাহি ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো”ফায়াজ”
মেহেদী পড়ানো মেয়েটা ভাবলো হয়তো বরের নাম ফায়াজ সুন্দর করে মাহির হাতে ফায়াজের নামটা লিখে দিলো।
ফায়াজ ছাঁদে এসে মাহির দিকে এক বার ও তাকালো না। ওই দিনের পর একটা কল ও দেয়নি। রাস্তার পাশে এসেও দাঁড়ায় নি।
রুদ্র গিয়ে মাহির কাছে কি যেনো বললো, মাহি লজ্জায় মাথা নিচু করে মাথা নাড়লো।
নূর এটা দেখে রেগে নিচে নেমে গেলো৷ ইরিন ও মেহেদী দেওয়া বাদ দিয়ে নূরের পিছু পিছু দৌড়ে দিলো৷
———
ছাঁদে এখন কেউ নেই সবাই কে নিচে নামিয়ে দিয়েছে রুদ্র।
ছাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আর মাহি৷
মাহি লজ্জায় রুদ্রের উল্টো দিকে ফিরে আছে৷ আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব লজ্জা যেনো মাহির মধ্যে এসে ভীড় জমিয়েছে।
রুদ্র নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো, ‘ মাহি তুমি কি এই বিয়েতে রাজি..?
মাহি রুদ্রের কথায় অবাক না হয়ে মনে মনে বলে উঠলো, ‘এটা কেমন কথা রে ভাই৷ আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি রাজি না। কাল বিয়ে আজ এমন আজগুবি চিন্তাভাবনা মানে কি। ‘
মাহিঃ জ্বি ভাইয়া আমি রাজি।
রুদ্রের নির্লিপ্ত জবাব,’ কিন্তু আমি রাজি না।’
মাহি চমকে রুদ্রেদিকে তাকালো।
নাহ রুদ্রের মুখ দেখে তো মনে হয় না৷ উনি মজা করছে।
মাহি চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠলো, ‘আপনি জানেন আপনি কি বলছেন..?’
রুদ্রঃ জানি মাহি.. আমি যেটা বলছি এটা এই মুহূর্তের জন্য একদম বলা উচিৎ নয়। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।
মাহিঃ কেনো জানতে পারি..?
রুদ্রঃ এক মনে তো আর দুই জনকে জায়গা দেওয়া যায় না।
মাহিঃ সেটা এত দিনে মনে হলো৷ আজ বাদে কাল বিয়ে। আর আপনি এখন বলছেন।
রুদ্রঃ আমি আরো আগে বলতে চেয়েছি। কিন্তু সময় হয়ে উঠে নি৷
মাহিঃ আপনি কি এটা ছেলে খেলা পেয়েছেন। সময় হয়ে উঠে নি!! এই কথাটা বলতে কি একটা দিন লেগে যেতো।না হয় পাঁচ মিনিট লাগতো এই সময়টাই আপনার কাছে হয়ে উঠে নি। ওকে সব বাদ কালকে এত গুলো মানুষকে বড় আব্বু কি জবাব দিবে,একবার ভেবে দেখেছেন..?
রুদ্রঃ তুমি চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে মাহি। শান্ত হয়ে কথা বলো।
মাহিরঃ আমি চাইলে! নিজে বড় আম্মুকে বললেন বিয়ের কথা আবার আপনি বলছেন অন্য কাউকে ভালোবাসেন।মাঝ খানে আমার এই ছোট্ট মনটাকে কেনো টানলেন রুদ্র ভাইয়া। ছলছল চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো মাহি।
রুদ্র সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো।
রুদ্রঃ আমি তো তোমার কথা বলিনি। ঘরের মেয়ে বলেছি..
মাহিঃ সেটাই তো ঘরের মেয়ে বলেছেন। ঘরের মেয়ে বলতে আর কাকে বুঝিয়ে ছেন..?
রুদ্রঃ কেনো আর কেউ নেই..?
মাহি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলো, “নূর!!”
রুদ্র কিছু বললো না।
মাহিঃ আপনার বড় আম্মুকে নূরের নামটা বলার দরকার ছিলো। কারন এখন ঘরে বড় আমি আর তাই ঘরের মেয়ে বলাতে আমাকে বুঝেছে।
রুদ্রঃ তুমি চাইলে সব ঠিক হতে পারে মাহি।
রুদ্রের কন্ঠে কি ছিলো আকুতি..?
মাহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমি কিভাবে..? ‘
রুদ্রের চোখ পরলো মাহির মেহেদী দেওয়া হাতে। যেখানে বরের জায়গায় “ফায়াজ” নামটা জ্বলজ্বল করছে। চোখ সরিয়ে রুদ্র মুচকি হেসে বললো।
রুদ্রঃ তুমি খুব ভালো জানো। এখন কিভাবে ঠিক করবে।
মাহি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো৷ প্রিয় মানুষটির না হয় এই টুকু উপকার করলো।
মাহিঃ ঠিক আছে।
রুদ্র মাহির মুখে ঠিক আছে শুনে খুশিতে মাহিকে জড়িয়ে ধরলো।
মাহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রুদ্র ছাঁদ থেকে নেমে যেতেই মাহি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। অনেক কষ্টে এতক্ষন নিজেকে শক্ত রেখে ছিলো৷ এই কয়দিন সাজানো হাজারো স্বপ্ন গুলো কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। না এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। তাহলে কেনো হলো..?সবি কি নিয়তির খেলা।
আধাঘন্টা পর মাহি ছাঁদ থেকে নেমে ফায়াজ কে খুঁজা শুরু করলো। ড্রয়িং রুমে সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে ফায়াজ। মাহি গিয়ে ফায়াজের সামনে দাঁড়ালো।
ফায়াজ এই চারদিনে এই প্রথম মাহির দিকে চোখ তুলে তাকালো।
মাহি ফায়াজের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো।
ফায়াজ অবাক হয়ে মাহির দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ের আবার কি হলো?।
মাহি গিয়ে থামলো বড় আব্বুর সামনে।
উনি মাহিকে এভাবে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হয়েছে মাহি। কিছু বলবি মা..?’
মাহি চোখ গুড়িয়ে দেখলো এখানে ওর আম্মু, বড় আম্মু, আব্বু, বড় আব্বু সহ, ফুপিমণি সবাই বসে আছে।
মাহিঃ বড় আব্বু তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো দিবে প্লিজ।
বড় আব্বু কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ দেওয়ার মতো হলে দিবো।’
মাহি ভয়ে ফায়াজের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো, ‘ আমি ফায়াজ স্যারকে ভালোবাসি….
চলবে..
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।