#এক_ফালি_সুখ🌼 |৪|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
দুপুরের কাঠফাটা রোদ শেষে সন্ধ্যায় এসে একটু শীতল বাতাসের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া গেলো। খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে শুয়েছিল মৌরিন,কখন যে চোখ লেগে গেছে তার নিজেরই খেয়াল নেই। মারুফাও আর ডেকে দেয়নি, মাগরিবের আযান এর ধ্বনি কানে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় মৌরিন এর। অবাক হয় সে, এতক্ষন ঘুমালো! আসরের নামায টাও পড়া হলো না, বাড়িওয়ালার বাসায় ও যাওয়া হলো না।
তবুও একটু ঘুমিয়ে বরং ভালোই হয়েছে, শরীরটা হালকা লাগছে এখন। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ওযু করে নামাযটা পড়ে নিলো মৌরিন। চুল আছড়ে নিয়ে ঘরের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় সে। বাতাসের বেগে পর্দাগুলো কয়েক হাত দূড়ে পর্যন্ত উড়ে চলে যাচ্ছে, বাতাস থামলে তারা আবারো পূর্বের জায়গায় ফিরে আসছে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন এর জন্য সেই শীতল বাতাস উপভোগ করলো মৌরিন। জীবনটাকে তার এই বাতাসের সঙ্গেও তুলনা করতে ইচ্ছে হলো। কখনো কখনো এই শীতল বাতাসে শরীর কাটা দেয়, বাহ্যিক সবকিছু ভুলে কেবল সেই সময়টাকেই উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়। আবার কখনো সেই বাতাস একদমই থেমে যায়, রোদের মাঝে একটুখানি বাতাসের প্রয়োজন হলেও তার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়না।
মৌরিন এর জীবনটা বোধহয় এখন সেই দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে, জীবনের গতিও একদমই থেমে গেছে। তবে সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, প্রকৃতির মতোই তার জীবনে আবারো শীতলতা আসবে। তার কাজ শুধু ধৈর্য ধরা, আর জীবনটাকে সচল রাখার চেষ্টা করা।
ইতিমধ্যে মারুফাও নামায শেষ করে হিজাব পড়া অবস্থাতেই ঘরে এলেন। তার উপস্থিতি টের পেয়েই চোখ খুললো মৌরিন, শেষবারের মতো লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুড়ে দাঁড়ালো সে। বিছানার উপরে রাখা সুতির গোলাপি রঙের ওড়নাটা হাতে নিলো। সুন্দর করে মাথায় ওড়নাটা টেনে নিজেকে আবৃত করে নিলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মারুফার সামনে এসে বললো,
_”আমায় ডাকতে পারতে মা, বলে এসেছিলাম বিকেলে যাবো কথা বলতে।”
_”কাকে বলে এসেছিস?”
_”বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের ছেলে বোধ হয়। থাক, দেড়ি যখন হয়েই গেছে তখন আর বেশি দেড়ি না করি। আমি গিয়ে বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আসি কেমন?”
মারুফা চোখ ছোট করে বললেন,
_”ওনার আবার ছেলেও আছে নাকি?”
কয়েক সেকেন্ড মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মৌরিন। সামান্য ঘাড় বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে মৃদু হেসে মারুফার এক কাঁধে হাত রেখে বলে,
_”খামোখা চিন্তা করোনা মা। তোমার মেয়ে এত অপরূপা সুন্দরি নয় যে, যেকেউ নজর দিয়ে দিবে।”
মৌরিন এর এই কথাটা খুব একটা পছন্দ হলোনা মারুফার। তিনি প্রতীবাদ রূপে বললেন,
_”আমার মেয়ে, আমার চোখে সবার থেকে সুন্দর।”
_”হুম বুঝেছি, এখন যাই আমি? বেশিক্ষণ লাগবে না, ভাঁড়ার ব্যাপারে কথা বলেই চলে আসছি।”
মারুফা ছোট করে “যাহ” বলে মাথা নাড়লেন। মৌরিন ওড়নাটা আরো একবার ঠিক করে বাসা থেকে বের হলো, গন্তব্য হলো বাড়িওয়ালার বাসা।
কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই দোতলায় চলে এলো মৌরিন, বাড়িওয়ালার দড়জার সামনে এসে পূর্বের ন্যায় কলিং বেল চাপ দিলো। এবার দড়জা খুললো অন্য কেউ, তাকে মৌরিন আগেও দেখেছে, বাসার কাজের লোক হবে হয়তো। পোষাক দেখে তো তাই মনে হয়। মৌরিন তাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
_”আঙ্কেল আছেন?”
মহিলা কিছুটা পাশে সরে গিয়ে হাসিমুখে বলেন,
_”হ্যা আছে তো, ভিতরে আসেন।”
মৌরিন স্মিত হেসে ভিতরে প্রবেশ করতেই সোফায় বসে থাকতে দেখে আফজাল সাহেবকে। মনোযোগ দিয়ে কিছু কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন তিনি। মৌরিনকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে তার সালাম এর উত্তর দিয়ে বলে,
_”দুপুরেও নাকি এসেছিলে? কোনো দরকার?”
হাতের ইশারায় মৌরিনকে সোফায় বসতে বলেন আফজাল। মৌরিন সোফায় বসে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
_”আঙ্কেল কিছু মনে করবেন না। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় তো কথা ছিলো একমাস এর এডভান্স দিতে হবে, তাহলে এখন আবার দু মাস এর কথা উঠছে কেন?”
_”সবাই দু’মাসের এডভান্স দিয়েই ওঠে, তোমাদের হয়তো আগে জানানো হয়নি। এখন জানিয়ে দিলাম।”
_”আগে তো জানানো উচিৎ ছিলো,তাইনা?”
_”এত কথা বাড়ানোর ইচ্ছে বাবা আমার নেই। সবাই যেহেতু দু’মাসের ভাড়া এডভান্স করে তাই তোমাদের ও তাই করতে হবে। বেশি সমস্যা থাকলে কদিন পরে দিও, তবে দিতে হবেই।”
আফজাল সাহেবের কথার ধরণেই বোঝা গেলো তিনি বেশ বিরক্ত। মৌরিন তাই আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করলো না। বসা থেকে উঠে বলে,
_”উঠে যখন পরেছি তখন নিয়ম থাকলে তো দিতেই হবে। তবে এরপর থেকে সবাইকে আগে থেকে জানিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন আঙ্কেল। আসছি..”
আফজাল সাহেব মৌরিন এর কথা তেমন গ্রাহ্যই করলেন না,তাই প্রতিত্তরে কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। মৌরিন
বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবে সেই মুহূর্তে তার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয় আরাফ অর্থাৎ আফজাল সাহেবের ছেলের সঙ্গে। আরাফ মৌরিনকে দেখেই তার হাতে থাকা ফোনের থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
_”তুমিই তো দুপুরে এসেছিলে তাইনা? হয়েছে আব্বুর সাথে কথা বলা?”
মৌরিন শুধুমাত্র “হুম” বলেই দড়জা খুলে বেড়িয়ে গেলো। আরাফ আফজালের সামনে সোফায় বসে বলে,
_”নতুন ভাড়াটিয়া নাকি আব্বু?”
_”হ্যা,ঐ তিনতলায় নতুন উঠেছে এক সপ্তাহ হলো।”
বিরক্ত হয়ে বলেন আফজাল। আরাফ দড়জার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
_”তা কি নিয়ে কথা বলতে এসেছিল?”
_”একমাসের এডভান্স দিয়ে উঠেছিল। এখন আরেকমাসের কথা বলায় নাকি ভুল হয়েছে আমার।”
একটু থেমে আফজাল আবার নিজে থেকেই বললেন,
_”বাপ ম’রা মেয়ে তো, পারিবারিক অবস্থাও তেমন ভালো না। আমিও তো একটু ছাড় দিলাম, কয়েক দিন পরে দিতে বললাম। এরচেয়ে বেশি ছাড় বাবা আমি দিতে পারবোনা।”
উত্তরে কিছু বললোনা আরাফ। একনজর আফজালের দিকে তাকিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে করতে নিচে চলে গেলো সে। আফজাল ও পূর্বের ন্যায় নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন।
____
বাসায় এসে আরো কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে মৌরিন রাতুলের বলা কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। অন্তত বেশ কয়েকটা টিউশন জোগাড় করার আগ পর্যন্ত। জমানো টাকা দিয়ে আর কতদিন ই বা চালানো যাবে, কিছু তো একটা করতেই হবে। মারুফা কয়েকবার সেলাই এর কাজ করতে চেয়েছিলেন, তবে মৌরিন তাতে বাধা দিয়েছে। কোমড়ে ব্যাথা নিয়ে তাকে এই সেলাই এর কাজ করতে দিবেনা মৌরিন।
ফোন থেকে রাতুলের নম্বর বের করে কল দেয় মৌরিন। দু’বার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ হয়।
_”হ্যালো..”
_”আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,আমি মৌরিন।”
_”ওহ আচ্ছা, হ্যা বলো মৌরিন।”
_”আপনি যে কাজের কথা বলেছিলেন আমি তাতে রাজি আছি ভাইয়া। কখন কোথায় থাকতে হবে বলে দিয়েন।”
_”বাহ,এতো বেশ ভালো কথা। এমনিতেই একটা মেয়ে অসুস্থ হয়ে পরায় ঝামেলায় ছিলাম। তুমি থাকলে আর প্রবলেম হবে না, কালকেই শুটিং আছে। খুব একটা দূড়ে নয়, আমি তোমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে দিলে আসতে পারবে না?”
_”হ্যা পারবো ভাইয়া।”
_”ঠিক আছে আমাকে এই নম্বরেই হোয়াটস অ্যাপ এ নক দিও, ঠিকানা পাঠিয়ে দেবো।”
_”জি ভাইয়া, আল্লাহ হাফেয।”
কলটা কেটে রাতুলের সেই নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ এ মেসেজ দেয় মৌরিন। এরপর বিছানায় বসে অপেক্ষা করে তার রিপ্লাই এর জন্য। শুটিং এর যায়গায় থাকা, স্ক্রিপ্ট এগিয়ে দেওয়া, কারো কিছু দরকার হলে তা এনে দেওয়া এসব কাজই হবে হয়তো। এতে তেমন কোনো সমস্যা নেই মৌরিনের, তবে অনেক মানুষের মাঝে থাকতে হবে,এটাই সামান্য সমস্যা।
____
সকাল সকাল শুটিং স্পট এ এসে হাজির হয়েছে তূর্য, রাতুল সহ আরো অনেকে। তবে নায়িকা এখনো আসেনি। কাঙ্ক্ষিত নায়িকাও দু মিনিটের মাথায় খোলা মাঠের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলো। সেটা আর কেউ নয়, তন্নি। তূর্য এখানে এসে জানতে পেরেছে সেটা,যদিও এর আগেও তারা একসঙ্গে নাটক করেছে। এটা নতুন কিছুই নয়।
বিশাল একটা মাঠ,এখানেই শুটিং হবে আজকে। তন্নি যেখানে এসে গাড়ি থেকে নেমেছে তার একটু পাশেই তূর্য বসে ছিলো। তন্নি ওর সামনে আসতেই বলে ওঠে,
_”তুই আবার এত লেট লতিফ হলি কবে থেকে?”
_”ভাই আমি ভোরবেলায় একটা শুট এ গিয়েছি,সেখান থেকে ডিরেক্ট এখানে এসেছি। এখনো কিছু খাওয়াও হয়নি।”
তূর্য উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
_”তাহলে এই কাজটা না করলেই পারতি,এত প্রেশার নেওয়ার কি দরকার?”
তন্নি হাত দিয়ে ঘাড়ে স্লাইড করে বলে,
_”স্ক্রিপ্ট ভালো লেগেছিল তাই।”
তূর্য বাঁকা হেসে তন্নির কানের দিকে এগিয়ে বলে,
_”স্ক্রিপ্ট ভালো লেগেছে নাকি স্ক্রিপ্ট রাইটার।”
_”আলতু ফালতু কথা বলবিনা তূর্য।”
নজর লুকোনোর চেষ্টা করে কথাটা বলে তন্নি। তূর্য তা দেখে হো হো করে হাসতে শুরু করে, কদিন মেয়েটাকে ভালোই পচাতে পারবে ও।
এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় রাতুল। তন্নির দিকে ঘড়ি দেখিয়ে বলে,
_”এত দেড়ি করলে চলে তন্নি?”
_”সরি সরি ভাইয়া আসলে একটু কাজ ছিলো তো। আর ইশিতা আমাকে রাতে মনেও করিয়ে দেয়নি আজ শুট আছে, তাহলে আগের শুট’টা বাদ দিয়ে দিতাম। আমার তো সকালে উঠে মনে পরলো।”
_”ইশিতা আর আসছেনা, দুদিন আগেই অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ওর। পায়ের যা অবস্থা ছয় মাসের আগে দাঁড়াতে পারবেনা।”
_”আহারে বেচারি,খারাপ লাগছে ওর জন্য।”
_”তবে আজ থেকে নতুন একটা মেয়ে আসবে,আমার পরিচিত।”
#চলবে?
[বড় পর্ব দিয়েছি কিন্তু। এবার আপনারাও বড় কমেন্ট করে যাবেন কেমন?
শুটিং এর বিষয়ে আমার খুব বেশি ধারণা নেই,তাই বাস্তবের সাথে মেলাবেন না। আমি যতটা জানি সেভাবেই লিখার চেষ্টা করবো।
হ্যাপি রিডিং।]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/