#তবে_ভালোবাসো_কী
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ০২
সূর্যের ঝলমলে কিরণ মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় আরহামের। চোখ মুখ কুঁচকে আশেপাশে চোখ বুলায়। ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। এখন সকাল সাতটা বাজে। প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে ঘুম ভেঙে যায় আরহামের। দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে তার রুমের বেলকনিতে চলে আসে। এখন কিছুক্ষন শারীরিক ব্যায়াম করবে। তার নিত্যদিনের কাজ এটা। ক্যাপ্টেন আরহাম চৌধুরী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অফিসার সে। বয়স ৩২ এর কোঠায় পড়েছে। শান্ত, ভদ্র, গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। ফ্যামিলি বলতে বাবা মা আর ছোট দুই বোন। ব্রাইট ফিউচারের জন্য বিয়ে করা আর হয়ে উঠেনি। আরহামের বাবার স্বপ্ন ছিল তার ছেলে একজন সেনাবাহিনী হবে। তাই আরহামও পূরণ করেছে বাবার স্বপ্ন। আরহামের মতে বিয়ে মানেই একটি বেড়াজাল! বর্তমান যুগের মেয়েগুলো ছেলেদের থেকেও খারাপ। আরহাম ভেবেছিলো জীবনে বিয়েই করবে না। সিঙ্গেল থেকেই জীবন পাড় করে দিবে। কিন্তু আরহামের পরিকল্পনার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ালো আরহামের মা জিয়া চৌধুরী। একটা মাত্র ছেলে তার। বয়স হয়ে যাচ্ছে এখনও বিয়ে করছে না! মারা যাওয়ার আগে অন্তত নিজের একমাত্র ছেলের বউকে দেখে যাবে না! মায়ের জ্বালায় বিরক্ত হয়ে আরহাম রাজি হয় বিয়ে করতে। মেয়ে তো অনেকই দেখেছে কিন্তু নজরে পড়ার মতো মেয়ে আজ পর্যন্ত আরহাম দেখেনি। কলেজ লাইফে একজনকে পছন্দ করতো। এখন তারও তিন বছরের একটি ছেলে আছে!
পুসাপ করতে করতে হঠাৎই আরহামের মনে পরে যায় কালকের সেই ধাক্কা খাওয়া মেয়েটির কথা। কী জল্লাদ মেয়ে ছিল বাবা! সানগ্লাস এর কারণে সে মাহানুরের আঁখিজোড়া দেখতে পারেনি কিন্তু মুখশ্রী দেখেছে। ব্যায়াম করতে করতে বিড়বিড় করে বলে,
-মেয়েটার তেজ দেখায় মতো ছিল! এইরকম ঝগড়াটে মেয়ে যার কপালে আছে তার আর অন্য কোনো অশান্তির প্রয়োজন নেই!
খান বাড়িতে সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। টুকটাক কথা বলছে আর খাচ্ছে। মাহানুর ভার্সিটির জন্য একবারে রেডি হয়ে নিচে নামে। ডায়নিং টেবিলে বসতে বসতে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
-গুডমর্নিং সবাইকে। (মাহানুর)
-গুডমর্নিং মা। (মেহরাব খান)
-এখনও অফিসে যাওনি বাবা? (মাহানুর)
-কিছুক্ষণ পরই যাবো। তুই রেডি সেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছিস মা? (মেহরাব খান)
-আর কোথায়! ভার্সিটি যাচ্ছি। (মাহানুর)
-আজ না গেলে হয় না আম্মা? শরীর এমনেই তো ভালো না। (হামযা খান)
-হ্যাঁ তোর বড় বাবা ঠিক বলছে মাহানুর। আজ বাসায় থেকে রেস্ট কর। (মেহরাব খান)
-না বাবা, কিছুদিন পর আমাদের টেস্ট পরীক্ষা। আজ সাজেসশন দিবে না গেলে তো পাবো না। (মাহানুর)
-কিন্তু, (মেহরাব)
-চিন্তা করো না তোমরা আমি জলদি এসে পড়বো আজ। তোমাদের কথা কী আমি ফেলতে পারি বলো? (মাহানুর)
হাজেরা খান সবাইকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলো মাহানুরের কথা শুনে ভীষণ খুশি হয় সে। মাহানুরের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-একদম মায়ের মতো হয়েছে! তোর মা ও অনেক সংস্কারি ছিল রে মাহানুর। পুরা মাটির মানুষ। (হাজেরা)
মাহানুর মেকি হাসে। হাজেরা মাহানুরের পাশে বসে নিজ হাতে যত্ন করে খাইয়ে দিতে থাকে মাহানুরকে। মাত্রই সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসেছে সায়রীন মাহানুরের চাচাতো ভাইয়ের বউ। মাস কয়েক আগে বিয়ে হয়েছে তাঁদের। মেয়েটা ভীষণ হিংসুটে! মাহানুরের সাথে প্রত্যেকটা ভীষণ নিয়ে হিংসা করে। মাহানুরও কম কিসে! ইচ্ছে করে আরো বেশি জ্বালিয়ে মারে সায়রীনকে। হাজেরার আহামরি আদর দেখে মুখ বাঁকায় সায়রীন। একটি চেয়ার টেনে বসে পরে। নিজ মতো খেতে থাকে। মাহানুর খেতে খেতে বলে,
-সায়রীন ভাবি আমের জুসটা একটু এদিকে দেও তো। (মাহানুর)
সায়রীন বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে মাহানুরের ওপর। মাহানুর সেটা দেখে বাঁকা হাসে। জুসের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে সায়রীন বলে,
-তো মাহানুর হবুবরকে কেমন দেখলে কাল?(সায়রীন)
-একদম আপনার বড় ভাইয়ের মতো ছিল ছেলেটা! দেখতে নেশাখোর টাইপ। এখন আমি কী কোনো নেশাখোরকে বিয়ে করবো নাকি! আমার মতো মেয়ে কী নেশাখোর ডিজার্ভ করে বড় বাবা বলো?
সায়রীন বুঝলো মাহানুর তাকে ও তার ভাইকে ইন্সাল্ট করে কথাটা বলেছে। সায়রীনের বড় ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো মাহানুরের জন্য। কিন্তু তার ভাই নেশাপানি করায় মাহানুরের বাবা সাফ মানা করে দেয়। এই কারণে সায়রীন আরো বেশি বিরক্ত মাহানুরের ওপর।
-একদম না! আমার আম্মা রাজপুত্র ডিজার্ভ করে। (হামযা খান)
মাহানুর মুচকি হাসলো। খাওয়া হয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ায়। সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। মাহানুর অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়ছে। বয়স ভালোই হয়েছে তবে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। এখন যেমন মুক্ত
স্বাধীন ঘুরেফিরে বিয়ে হলে সেটা করতে পারবে না। এই পর্যন্ত দশটার মতো বিয়ের প্রস্তাব রিজেক্ট করেছে পাত্রের খুঁত দেখিয়ে।
গাড়ি ভার্সিটির গেটের সামনে আসতেই থেমে যায়। মাহানুর ছটপট নেমে পরে। ড্রাইভারকে বলে,
-আঙ্কেল তুমি নিতে এসো না আমি রিকশা করে বাসায় চলে যাবো।
-কিন্তু আম্মা বড়জন যে বললো তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে?
-সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। চিল মুডে বাসায় চলে যাও। টাটা।
সম্পূর্ণ এটিটিউড নিয়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকে মাহানুর। তন্দ্রা মাহানুরকে দেখে এগিয়ে আসে। মাহানুর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে টিপতে থাকে।
-কিরে শরীর কেমন এখন?
-আমাকে দেখে কী অসুস্থ লাগছে?
-না।
-তাইলে আবার জিজ্ঞাস কে? আমার বকা শুনতে?
-আর কতকাল লুকিয়ে লুকিয়ে ফোন চালাবি?
-জানি না রে ভাই!
-আয়াস ভাই তোকে ফোনটা গিফট করেছিল বলে, না হলে এই জীবনে আর তুই ফোন পেতি না দোস্ত!
-ঠিক বলেছিস। ভাইদের মধ্যে একমাত্র আয়াস(হামযা খানের মেজো ছেলে)ভাই-ই আমাকে ভালোবাসে বুঝলি।
-ঐ দেখ কে আসছে!
মাহানুর ফোন থেকে মাথা তুলে সামনে তাকায়। হা*বলা মার্কা হাসি দিয়ে মাহানুদের দিকে এগিয়ে আসছে দুইটা ছেলে। মাহানুর বিরক্তিটে কপাল কুঁচকে ফেলে। তন্দ্রার মতো এই দুইজনও মাহানুরের বেস্টফ্রেন্ড। একটার নাম ইয়াসিন। আরেকটার নাম সিয়াম।
-কিরে কোথার থেকে আসলি তোরা দুইটায়? (মাহানুর)
-মাইয়া পটাতে গেছিলাম দোস্ত। (সিয়াম)
-তো পটেছে? (মাহানুর)
-আন্ডা! ভাও দেয়না আমাদের!(ইয়াসিন)
-কোন ইয়ারের? (তন্দ্রা)
-সেকেন্ড। (ইয়াসিন)
-জুতা ফিক্কা মারেনি তোদের মুখে এটাই অনেক বুঝলি মামাহ! মেয়ে পটাবি ভালো কথা। কিন্তু জুনিয়র কেনো সিনিয়র মেয়ে পটা না। (মাহানুর)
-আ*বাল ছেড়ি, আমরা ছেলে মানুষ। আমরা তো জুনিয়রই পটাবো প্রতিবন্ধী!(সিয়াম)
-ওহহ হ্যাঁ, আমি ভুলেই গেছিলাম তোরা যে ছেলে! আসলে কী করার, আমাদের সাথে থাকতে থাকতে তোদের দুইজনকেও এখন মেয়েদের মতো লাগে! নেভার মাইন্ড। (মাহানুর)
সিয়াম ইয়াসিন ভেবছেঁকা খেয়ে গেলো মাহানুরের কথা শুনে। এই মেয়ে সবসময় এইরকমই করে। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে মাথা ঘুরিয়ে ফেলে! তন্দ্রা নিজের হাসি থামিয়ে বলে,
-চল তাহলে আজ কোথায় ঘুরতে যাই? আমার ক্লাস করতে মন চাচ্ছে না। (তন্দ্রা)
-কই যাবি? (ইয়াসিন)
-লেকে চল। ওয়েদারটাও আজকে সেই! অনেক মজা হবে। (সিয়াম)
-ঠিক আছে চল তাহলে। (মাহানুর)
-দূর আগে জানলে আমি আমার গফকেও আসতে বলতে পারতাম!(ইয়াসিন)
__________________
সারাদিন ঘুরাঘুরি করে বিকেল দিকে বাসায় আসে মাহানুর। ড্রইংরুমে কাউকে না দেখতে পেয়ে ভীষণ অবাক হয় সে। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসতেই রুমে ঢুকে হাজেরা, সায়রীন, লুৎফা। মিনেশা তাঁদের একসাথে দেখে ঢোক গিলে। হাজেরা তার হাতের জিনিস গুলো বিছানায় রেখে দেয়। মাহানুরের পাশে বসে বলে,
-আজ এতো দেরি কেনো হলো আসতে? (হাজেরা)
-এক্সট্রা ক্লাস হয়েছে তো আজ তাই দেরি হয়েছে। (মাহানুর)
-ওহ আচ্ছা। (হাজেরা)
-এইসব কী বড় মা? (মাহানুর)
-এখানে শাড়ী ও কিছু জুয়েলারি আছে মা। (হাজেরা)
-কেনো? আবার কেউ দেখতে আসবে নাকি? (মাহানুর)
-হ্যাঁ আসবে। কাল যে ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি আজ ওর পরিবার আসবে সাথে পাত্রও। (লুৎফা)
-কী বলো আমি না তাকে রিজেক্ট করেছি? (মাহানুর)
-সকালে তোর বড় বাবা ফোন দিয়েছিলো ছেলের বাবাকে। কাল তুই যাকে দেখেছিস ও পাত্রের বন্ধু ছিল। তাই বড়রা ভেবে ডিসিশন নিয়েছে আজ সন্ধ্যার পর তারা আসবে। তোকে দেখে যাবে তুইও পাত্রকে দেখবি। (হাজেরা)
হাজেরার প্রত্যেকটি কথা মাহানুরের মাথার ওপর দিয়ে যায়। যে বিয়ে করার থেকে সে দশ হাত দূরে দূরে থাকছে সেই বিয়েই কেনো বার বার তার জীবনে আসছে! মাহানুরের মন চাইলো ঘরের সব জিনিস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। হাজেরা মাহানুরকে চুপ থাকতে দেখে বলে,
-আমি খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে সুন্দর মতো তৈরি হবি। চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। তারা আসবে তোকে দেখে আবার চলে যাবে। (হাজেরা)
মাহানুর কিছু বললো না। বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে বসে রইলো। সায়রীন মাহানুরের অবস্থা দেখে হাসে। আনন্দে মনে মনে বলে,
-এবার যদি বিদায় হয় এই নয়াবজাদি!
__________________
সন্ধ্যায় সুন্দর করে শাড়ী পরিয়ে তৈরি করা হয় মাহানুরকে। মাহানুর পারছে না তাঁদের মুখের ওপর না করতে। কী এক জ্বালা! পরিবারের খুশিও সে চায় আবার নিজের খুশিও। কিন্তু মাহানুরের কাছে এই পরিবারই সব। সে ভালোবাসা মানেই বুঝে নিজের ফ্যামিলি। তাইতো এখন বাধ্য মেয়ের মতো তৈরি হয়ে নিলো। টুকটুকে লাল রঙের জামদানি শাড়ী পড়ানো হয়েছে তাকে। দেখতে অবশ্য মন্দ লাগছে না! মূর্তির মতো বিছানায় বসে আছে। মনে মনে ভাবছে যেভাবেই হোক প্রতিবারের মতো এবারও বিয়ে ভাঙতে হবে।
অবশেষে সন্ধ্যা সাতটা বাজে আরহাম ও তার পুরো ফ্যামিলি আসে খান বাড়িতে। ড্রইংরুমে বসানো হয় তাঁদের। মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত খান বাড়ির সকলে। আরহামের বাবা জাহেদ চৌধুরী তো বন্ধুকে পেয়ে কথায় মশগুল। জিয়া চৌধুরী ভীষণ মুগ্ধ হয় বাড়ির সকলের ব্যবহার দেখে। মনে মনে ভাবে,”যে পরিবারের সবাই এতো ভালো না জানে তাঁদের মেয়ে কত ভালো হবে!”
আরহাম গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে সবার এতো আদিখ্যেতা দেখে। কোনো মতে জলদি বাসায় যেতে পারলেই হলো! জিয়া চৌধুরী কথার ফাঁকে বলে,
-এবার তাহলে মাহানুরকে নিয়ে আসুন আপা। (জিয়া)
-জি এখনই আনছি। (লুৎফা)
মাহানুর তার রুমে বসেছিল এতক্ষন। এখন এতো মানুষের সামনে যাবে ভাবতেই অস্বস্থি লাগছে তার। লুৎফা মাহানুরকে শাড়ীর আঁচল দিয়ে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে দেয়। মাহানুর মনে মনে বলতে লাগলো,
-হে সৃষ্টিকর্তা, আজ আমার ওপর একটু দোয়েয়া করো। এখনই জমিন ফাঁক করে একটা গর্ত করে দেও আমি সেই গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ি। প্লিজ।
সৃষ্টিকর্তা শুনলো না মাহানুরের কথা। লুৎফা আর সায়রীন মিলে মাহানুরকে ধরে ধরে নিচে নিয়ে যায়। আরহাম তখন মিনেশার ভাই ও চাচার সাথে কথা বলছিল নিচের দিকে তাকিয়ে। সায়রীন একটি সোফায় বসিয়ে দেয় মাহানুরকে। ভদ্র মেয়ের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে মাহানুর। জিয়া মাহানুরের পাশে এসে বসে পরে। মাহানুরের থুতনি ধরে মুখ ওপরে তুলে। জিয়া চৌধুরী মুগ্ধ চাহনিতে মাহানুরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-মাশাআল্লাহ! ভীষণ মায়াবী।
>>>>চলবে।