#তবে_ভালোবাসো_কী
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১২
রাতে বাসায় পৌঁছায় মাহানুর। আরহাম ব্যস্ত থাকায় বাসার ভিতরে ঢুকে না। হাতে ব্যাগ নিয়ে সদর রুমে প্রবেশ করে। মাহানুরের বড় বাবা আর বাবা সোফায় বসে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করছিল। মাহানুরকে দেখে তারা বসা থেকে উঠে এগিয়ে আসে। মেহরাব খান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-মা তোরা না কাল আসতি? (মেহরাব)
-হ্যাঁ বাবা। হঠাৎ কিছু সমস্যার কারণে এখনই ঢাকায় আসতে হলো।(মাহানুর)
-সব ঠিক আছে তো? (মেহরাব )
তাঁদের কথোপকথনের মাঝে এক এক করে সকলেই চলে আসে। এলিয়েনের মতো দেখতে থাকে মাহানুরকে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাহানুর বলে,
-সব ঠিক আছে চিন্তায় কোনো বিষয় নেই। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর তোমাদের সব বলছি। (মাহানুর)
-হুম যা মা। (মেহরাব)
মাহানুর সোজা তার রুমে চলে আসে। ব্যাগটা কিনারে রেখে কাবাড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে এসে বিছানায় বসে। চুক শুকানোর পর নিচে যেয়ে ডিনার করে আর সবাইকে সেখানে কী কী করেছে এইসব বলতে থাকে। ভাইয়েরা একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকে। তাঁদের প্রশ্নে জানো শেষ নেই! মাহানুর সবাইকে দেখে মনে মনে বলে,
-যেখানেই যাই না কেনো নিজ ফ্যামিলির সাথে থাকলে যে শান্তি পাওয়া যায় সেটা অন্য জায়গায় পাওয়া অসম্ভব!
🌸
দেখতে দেখতে চারমাস চলে যায়। ভালো দিনগুলো একটু জলদিই কেটে যায় মাহানুরের মতে। সামনেই মাহানুরের ফাইনাল পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপ একটু বেশিই। প্রতিরাতে আরহামের সাথে কথা হয় তার। এই চারমাসের মধ্যে একবারও আসেনি আরহাম। সে বলেছে একবারে বিয়ে করার সময় আসবে। মাহানুরের মনে একটু একটু অভিমান জমেছে আরহামের প্রতি। নতুন নতুন দম্পতিরা কত ঘুরাঘুরি করে। কিন্তু আরহামের কাছে তার জন্য সময়ই নেই! মাহানুর নিজেই নিজেকে বারে বারে বলে, “কেনো আর্মি মানুষকে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম!”
এখন রাত বারোটা। ফোন নিয়ে আকুপাকু করছে মাহানুর। একবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার দেয়ালে লাগানো টিভির দিকে। চোখ বন্ধ করলেই ঘুম আসবে তাই জেগে থাকার জন্য একটা ইংলিশ অ্যাকশন মুভি দেখছে। তবে এখন তার মুভির প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পুনরায় ফোনের দিকে তাকাতেই তীব্র আওয়াজ করে বেজে উঠে ফোন। খুশিতে লাফিয়ে উঠে মাহানুর। কল রিসিভ করে বেলকনিতে চলে যায়। দোলনায় বসতে বসতে রাগী স্বরে বলে,
-তো জনাবের কল দেওয়ার সময় হলো?
আরহাম স্মিত হাসলো। সেই হাসির কোনো শব্দ নেই। শান্ত কণ্ঠে বলে,
-ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। এমন কী খাওয়া দাওয়া করারও সময় পাই নি এখন পর্যন্ত! মাত্রই নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে তোমাকে কল দিলাম।
-একজন আর্মিকে বিয়ে করা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল!
-তাই নাকি! তো ডিভোর্স লাগবে?
আরহাম শয়তানির ছলে কথাটা বলে। মাহানুর ভড়কে যায়। রুক্ষ কণ্ঠস্বরে আরহামকে ধমকে বলে,
-আবার এই ডিভোর্স এর নাম মুখে নিলে বটগাছের সাথে উল্টো করে ঝুঁলিয়ে রাখবো। বদমাইশ বেটা!
-আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে তোমার এই অদ্ভুত কথা শুনতে শুনতে।
-ভালো কিছু করার নেই শুনতে হবেই হবে। খেয়েছেন?
-খাচ্ছি আর কথা বলছি।
-বদমাইশ লোক আগে ভদ্রর মতো খান তারপর আমাকে পুনরায় কল করুণ।
কল কেটে দিলো মাহানুর। বসে বসে হাতের নেইল দেখতে থাকে। একটু ফেইসবুক ঢুকে তন্দ্রার মেসেজ চেক করে আসে। কয়েকটা ফানি পোস্ট শেয়ার দেয়। এর মধ্যেই আরহাম পুনরায় কল দেয়। মাহানুর দ্রুত গতিতে রিসিভ করে। আরহাম বলে,
-জানো কাল আমার এক ফ্রেন্ডের বিয়ে।
-ওওওও।
-হুম আমাকে ইনভাইট করেছে। কিন্তু আমি তো যেতে পারব না। কতক্ষন রাগারাগি করল! অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেনেজ করেছি তাকে।
-আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান কবে হবে?
-পরীক্ষা কবে?
-এক সপ্তাহ পর।
-উম তাহলে দুই কী তিন মাস পর ইনশাআল্লাহ আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। এখন ছুটি পেলেই হলো।
-আমি শশুরবাড়ি যেতে চাই।
-যাবে খুব শিগ্রই।
-জামাইর সাথে ঘুরতে চাই অনেক জায়গায়।
-বেঁচে থাকলে সেটাও পূরণ হবে।
-আমি তিনটা বাচ্চার মা হতে চাই! আর কতকাল অপেক্ষা করবো?
আরহাম শব্দ করে হেসে দিলো। যে মেয়ে স্বামী একটু কিস করায় অজ্ঞান হয়ে যায় সেই মেয়ে নাকি তিনটা বাচ্চার মা হবে! আরহাম ঠাট্টার স্বরে বলে,
-তিনটা বাচ্চার মা হবে! গাড়ির কথা মনে আছে মিসেস?
-ভাই সেদিনের কথা তুলবেন না। হঠাৎ এমন করায় আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রথম কিস ছিল!
-আমারও প্রথম।
-সুনহেরা আপুর বেবিকে দেখেছেন?
-হ্যাঁ ভিডিও কলে দেখলাম।
-আমি তো কাল বিকেলে গিয়েছিলাম দেখতে। কী ছোট বাচ্চা! একদম বিড়ালের বাচ্চার মতো!
-এক সপ্তাহে বাচ্চা আর কত বড় হবে?
-আমি সেটা বলছি না গোড়ার ডিম। অনেক বছর পর বাচ্চা দেখেছি না তাই একটু আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম।
-কয় বছর পর নিজেরও দেখবে।
আরহামের কথায় চুপ হয়ে গেলো মাহানুর। লজ্জারা ঘিরে ধরে তাকে। ঠোঁটে ঠোঁটে কামড়ে লাজ কমানোর চেষ্টা করল। ঐপাশে আরহামও মাহানুরের অবস্থা বুঝতে পারে।
-কী সরমে লাল হয়ে যাচ্ছ নাকি?
-সরম পাবো কেনো?
-তাই! শুনো পড়াশোনা ঠিক মতো করো। ভালো একটা ফলাফল পেতে হবে কিন্তু।
-হ্যাঁ চেষ্টা করব।
-তারপর কী মাস্টার কমপ্লিট করতে চাও?
-অবস্থা বুঝে ভেবে দেখবো। তবে আমার সংসারই করার ইচ্ছে।
-ঠিক আছে।
-আমাকে ফিল্মি স্টাইলে প্রপোজ কবে করছেন?
-তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা সেধে প্রপোজ চাচ্ছে!
-তো কী করব? আপনি ভালোবাসেন আমাকে?
-আগে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই?
মাহানুর চুপ হয়ে গেলো। সরমে আর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। আরহাম নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে,
-তবে ভালোবাসো কী?
-বাসি।
-কতটুকু?
-যতটুকু বাসলে একজন মানুষকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে জাগে।
-বাহ্! তারছেঁড়া মাহানুরও দেখি সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারে!
আরহামের এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল মাহানুরের সুন্দর মেজাজকে বিগড়ে দেওয়ার। অত্যাধিক রেগে মাহানুর বলে,
-ঐ বেটা তুই ফোন রাখ। কোনো কথা নাই তোর সাথে।
-আচ্ছা সরি তো এতো রেগে যাও কেনো? কী তুই মুই বলে আমার ১৪ গুষ্টি উদ্ধার করে!
-আমি এমনই।
-আচ্ছা সরি। রাখি তাহলে এখন?
-হুম।
-ভালোবাসি মাহানুর।
মাহানুর প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। মুচকি হেসে কল কেটে দেয়। একা একাই কিছুক্ষন হেসে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
_________________🖤
পরীক্ষা শুরু হয় মাহানুরের। চার বেস্টফ্রেন্ডের চার রুমে সিট্ পড়েছে। জানপরান দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করছে মাহানুর। রাত একটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। আরহাম এক সপ্তাহ পর পর কল দেয়। পরীক্ষা জানো শুধু মাহানুরের একার নয় খান বাড়ির সকলের! সকালে বাড়ির সকলে মিলে মাহানুরকে পরীক্ষার হলে দিয়ে আসে। আবার পরীক্ষা শেষ হলে নিয়ে আসে। এতো মানুষ দেখে আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাহানুরের সেদিন ভ্রু ক্ষেপ নেই। সে লাকি। তাইতো এইরকম একটা পরিবারের পেয়েছে।
আজ শেষ পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হলো মাহানুর। মাঠেই দাঁড়িয়ে আছে তন্দ্রারা। আজ যেহেতু শেষ পরীক্ষা তাই মাহানুর বাসার কাউকে আসতে নিষেধ করেছে। মাহানুর এগিয়ে যায় তাঁদের দিকে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,
-অবশেষে চার বছরের সাধনা শেষ হলো ভাই!(মাহানুর)
-হুম, এবার এক এক করে সবার বিয়ার পালা!(তন্দ্রা)
-প্রথমেই আমাগো মাহানুর তারপর তোর পালা। (ইয়াসিন)
-আমি বিয়া করমু না। মাহানুরের তো বিয়া হইছেই খালি ফাঙ্কশন করব। (তন্দ্রা)
-ঐ একই তো। (ইয়াসিন)
-চল আজ অনেক ঘুরবো। (মাহানুর)
-হো পুরা এলাকার ভাইজ্জা খামু!(ইয়াসিন )
মাহানুর আহাম্মক বনে গেলো ইয়াসিনের কথা শুনে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কী কইরা খাবি? (মাহানুর)
-আরেহ বললাম পুরা এলাকার ঘুরুম। (ইয়াসিন)
___________________🖤
সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় আসে মাহানুর। ড্রইংরুমে আরহামের মা বাবা ও নিজের পুরো পরিবারকে বসে থাকতে দেখে চমকে যায়। ভদ্র মেয়ের মতো সালাম দেয় শশুর শাশুড়িকে। জিয়া উঠে মাহানুরকে জড়িয়ে ধরে। মাহানুরের গালে হাত দিয়ে বলে,
-পরীক্ষার চাপে আমার মেয়ের চকচকে চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছে! (জিয়া)
মাহানুর হালকা হাসলো জিয়াকে ধরে জিজ্ঞেস করে,
-মা ভালো আছেন আপনারা?
-হ্যাঁ মা। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে তারপর এসো।
-জি ঠিক আছে।
মাহানুর ওপরে যেতে যেতে চোখে ইশারায় আয়াসকে ওপরে আসতে বলে। রুমে ঢুকার পর পরই আয়াস উপস্থিত হয়। মাহানুর তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করে,
-কিরে আমার শাশুড়ি শশুর কেনো এসেছে?
-বিয়ের তারিখ ফিক্স করতে।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় মাহানুর। আজই পরীক্ষা শেষ হলো আজই বিয়ের ডেট ফিক্স হবে! মাহানুর খুশিতে আয়াসের হাত ধরে ওকে ঘুরাতে লাগলো। বেচারা আয়াস হতবাক হয়ে যায়। মাহানুরকে দাঁড় করিয়ে বলে,
-ভাই মাথা ঘুরিয়ে পরে যামু আমি। পাগল ছেড়ি!
-আরহাম তো এখনও আসেনি। তাহলে কার সাথে আমাকে আবার বিয়ে দেবে?
-বুদ্ধু, আরহাম ভাই নিজেই বলেছে। সে দুই তিনদিনের মধ্যে আসবে তাই দ্রুত সব করতে বলেছে।
-ওওও আচ্ছা।
মাহানুর আর নিচে গেলো না। তার ভীষণ সরম করছিল। ড্রইংরুমে সবাই বিয়ের বিষয় আলোচনা করছে। সব দিক বিবেচনা করে আজ থেকে ছয়দিন পর বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। মেহরাব বলে,
-যেহেতু দুই ছেলে-মেয়ের ইচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠান বাসায়ই হবে তাহলে এটাই রইলো। (মেহরাব)
-হ্যাঁ ভাইজান। আমরাও বাসায় করব। (জিয়া)
মেহরাব খান হালকা হেসে হামযা খানকে ইশারায় কিছু একটা বুঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু হামযা খান বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে মেহরাব খান নিজেই বলে,
-ভাবি, আমাদের একটা মাত্র মেয়ে। আমরা চাই একদম পরিপূর্ণ ভাবে তাকে অন্যের বাসায় পাঠাতে। (মেহরাব)
-শুনেন ভাই, আমরা কিন্তু বউ নেবো না মেয়ে নেবো আমাদের বাসায়। আপনারা নিজেদের আদরের মেয়ে দিচ্ছেন এটাই আমাদের জন্য অনেক এর বাদে আমাদের কিছু লাগবে। (জিয়া)
হাজেরার মন ভরে যায় জিয়ার কথা শুনে। বড় একটি হাসি দিয়ে বলে,
-আমার মাহানুর আসলেই ভাগ্যবান তাই তো আপনার মতো একজন শশুর হিসেবে মা পেয়েছে। (হাজেরা)
-কিন্তু ভাবি, (মেহরাব)
-কোনো কিন্তু নয় ভাই। আরহামও তার শশুর বাড়ি থেকে কিছু নেবে না। যদি আপনি নিজের মেয়েকে একান্ত কিছু দিতে চান তাহলে সেটা অন্য বিষয়। (জিয়া)
-হ্যাঁ মেহরাব ভাই জিয়া ঠিক বলছে। (জাহিদ চৌধুরী)
মেহরাব খান খুশি হয়ে ছল ছল নয়নে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। তার মুখেও বড় একটি হাসি। মেহরাব তাহলে বাবা হিসেবে নিজের মেয়েকে একটি যোগ্য পরিবারের কাছে তুলে দিয়েছে! খুশিতে প্রফুল্ল হয়ে বলে,
-অনেক ধন্যবাদ ভাই। (মেহরাব)
-এখন আর ভাই ভাবি চলবে না। শুধুই বিয়াই বিয়াইন। (রামিশা)
সবাই একত্রে হেসে দেয় রামিশার কথা শুনে। মাহানুর দুতালার বারান্দা দাঁড়িয়ে এতক্ষন সবই দেখছিল। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে তার। এতদিন তো সে ভাবেই নি যে তাকে অন্যের বাড়িতে চলে যেতে হবে। আজ যখন তার বাবার ছল ছল আঁখিজোড়া দেখলো তখন বুকে পীড়া অনুভব করে মাহানুর। এক দিকে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে চিরকালের জন্য পেয়ে যাবে। অন্যদিকে পুরোনো ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে চলে যেতে হবে! ভয়ংকর এক পরিস্থিতি! একমাত্র মেয়েরাই অনুভব করে এই বেদনা।
>>>>চলবে।