রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া ০৩

0
832

রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা
লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া

০৩
কাঠফাটা তপ্ত দুপুরের রোদের অতিষ্ঠ ধরণী। প্রহর তাপে যখন সূর্যটা মাথা উপর থাকে, তখন মানুষ অবস্থা প্রায় সিদ্ধ আলুর মতোন হয়। আমার অবস্থাটাও ঠিক সিদ্ধ আলুর মতোন হয়েছে। উঁহুম! আমার একা অবস্থা নয় বরং অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর অবস্থা এই মূহুর্তে সিদ্ধ আলুর মতোন। প্রতিটা মানুষই কেমন ঘেমে-ঘুমে যা-তা অবস্থা উফফ!
এই যে আমরা যারা মাঠে চেয়ার পেতে বসে আছি শুধু মাত্র আমাদের অবস্থাটাই সিদ্ধ আলুর মতোন হয়েছে বাকিরা সবাই ভালোই আছে। স্টেজের বিশেষ অতিথিবৃন্দের জন্য বিশেষ যান্ত্রিক ফ্যানের ব্যবস্হা তোড়জোড় ভাবে করা থাকলেও মাঠে আসনে বসা শিক্ষার্থীবৃন্দের জন্য তেমন একটা যান্ত্রিক ফ্যানের ব্যবস্হা ছিল না। যাও গুটি কয়েকটি ফ্যান রয়েছে সেগুলো বেশ দূরে দূরে সেট করা। যার ফলে এই যান্ত্রিক ফ্যানের বাতাস যে কোথায় কার গায়ে লাগছে আল্লাহ জানে। আর এদিকে, উফফ! এই অতিষ্ঠ গরমে এবার সত্যিই মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। গরমে আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু পায়ের জ্বালা-পোড়া সহ্য হয়না একদমই। বলতে গেলে প্রচন্ড গরমে আমার বডিতে তেমন সমস্যা হয়না কিন্তু পায়ে ভিষণ রকমের জ্বালাপোড়ার সমস্যা হয়। যা এখনো হচ্ছে। খোলা মাঠের মঞ্চে পিছনে সারিতে প্রথম চেয়ারটাতে বসে ছিলাম আমি। আমার সাথে জুই! জুইয়ের সাথে আমাদের চট্টগ্রাম একটা নতুন বান্ধবী বসেছিল নাম শ্রেয়া। তিনজনের হাতেই একটা করে রজনীগন্ধা ঢালার সাথে গোলাপ ফুল বাঁধা তোড়া ছিল। অন্য হাতে ছিল খাতার শক্তপোক্ত উপরের কার্ভার পেইজটা। যেটা দিয়ে নিজেদের অনবরত বাতাস করছিলাম গরম থেকে বাঁচার জন্য আর স্টেজে বসা অতিথিবৃন্দের একের পর এক ভাষণ শুনে শেষ করছি। শরীরে গরম আর পেটে ক্ষুধা থাকতে মানবতার ভাষণে যতটা মনোযোগী হওয়া যায় আমি ঠিক এই মূহুর্তে ততটাই মনোযোগী ছিলাম সংশ্লিষ্ট ভাষণে। যার জন্য প্রায় ঘাড় এদিক সেদিক ঘুরিয়ে রাস্তা খুজছিলাম এখান থেকে উঠে যাওয়ার। আমার চেষ্টা বরাবরই ব্যথ হচ্ছিল চারপাশে সিনিয়রের প্রহরদারীর জন্য। ব্যর্থতা আর অমনোযোগীতায় ফের চোখ ঘুরালাম স্টেজের দিকে। সারিবদ্ধ ভাবে সকলেই বসা সেখানে। আমাদের বিশেষ অতিথিবৃন্দরাও রয়েছে সেখানে। পিন্সিপাল স্যার, আরাফ খান, নিহাল খান, রিদ খান সবাই আছে একের পর এক বসা অবস্থায়। ইতিমধ্যে আমি সবার নামটাও জেনে নিয়েছি শ্রেয়া থেকে। যেহেতু শ্রেয়া চট্টগ্রামের মেয়ে তাই চট্টগ্রামের মানুষের খবর ওর ভালো জানা। তবে সবচাইতে বেশি যেটা আমার নজর কেঁড়েছে সেটা হলো রিদ খানের পরিবার নাকি বংশগতসূত্রে তাঁরা চট্টগ্রামবাসি। আর পারিবারিক ভাবে অর্ধেক পরিবার নাকি রিদ খানের সাথে ঢাকা থাকে আর বাকি অর্ধেক পরিবার নাকি চট্টগ্রাম শহরে থাকে নিহাল খানের সঙ্গে। তারমানে রিদ খানের বাবা-মা একসঙ্গে থাকেন না। এবার কেন তারা এক সঙ্গে থাকেন না সেটা আমি আরও অনেক পরে জেনেছিলাম। আচ্ছা যায় হোক এবার মূল কথায় আসি। রিদ খানের বাপ-দাদারা বংশগতভাবেই তারা রাজনৈতি করে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনৈতি খাতায় নাম তাদের। বর্তমানে রিদ খান এই কলেজের ফাংশনে এটেন্ড করার মূল উদ্দেশ্যও হলো উনার বাপ-দাদাকে রাজনৈতিক বিষয়ে সমথর্ন করা। রিদ খানের বাবা নিহাল খান বর্তমান চট্টগ্রাম সদরে মন্ত্রী। জাতীয় সংসদ সদস্যের আসন প্রাপ্ত নেতা হওয়ায় তিনি চট্টগ্রামেই থাকেন বাবা আরাফ খানও বাকি পরিবারদের নিয়ে। রিদ খান ঢাকা থাকেন মাকে নিয়ে, তবে উনাকে প্রায়শই নিজের বাবার সঙ্গে দেখা যেত ভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত অবস্থায়। আমাদের কলেজের ফাংশনটা ছিল রিদ খানের জন্য তেমন একটা উদ্দেশ্য মাত্র বাবাকে সমর্থন করার। তবে আমার এই বিষয়ে সঠিক ধারণা ছিল না। তবে বলতে হবে লোকটা(রিদ) সত্যিই অনেক দারুণ দেখতে। ফিদা হবার মতো সকল দিকই আপাতত উনার মধ্যে ছিল। এই যে, এই মূহুর্তে উনি(রিদ) উনার বাবার পাশে বসে গম্ভীর মুখ নিজের দাদাভাইয়ের ভাষণ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করছে এই বিষয়টিও চোখে লাগার মতোন ছিল। উনার গম্ভীর্য, উনার পার্সোনালিটি, সবকিছুই মনোমুগ্ধকর। আর এজন্য আমার আশেপাশে প্রায় অনেক মেয়েই স্টেজের ছবি তুলার বাহানায় শুধু উনার ছবিই তুলছে ঝুম করে করে। আমি সেটা দেখছি আর মনে মনে কি ভাবছিলাম জানেন? শুনতে হাস্যকর লাগলেও এটাই সত্যি যে, সেদিন আমি পিছনে সারিতে বসে বসে শুধু লোকটার কয়টা গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে সেটার হিসাব করছিলাম। আরে ভাই আপনি বলুন, হিসাব করবই বা না কেন? সুন্দর মানুষ চোখে পরলে সর্বপ্রথম আমাদের মাথায় এই কথায় আসে যে, তার হয়তো কোটি খানিক গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড আছে। তাছাড়া একজন সুদর্শন নেতা বলে কথা! নিশ্চিত তার বস্তা ভরে ভরে গার্লফ্রেন্ডও আছে। নেতারা কি আর ভালো চরিত্রের মানুষ হয় নাকি! তলে তলে যে কতো ঘাটে পানি খায় এরা তার হিসাব এরা নিজেরাও দিতে পারবে না। রিদ খানের করা অপমানটার জন্য আমি সেদিন তাকে একদল দুশ্চরিত্র নেতাদের দলে ফেলে মনে মনে বেশ করে শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু কেন জানতো আমার এই শান্তিটা মাত্র অল্প সময়ের জন্য স্হায়ী ছিল। রিদ নামক লোকটার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হয়েছিল সুলতানা ম্যামের অফিসে। বিকাল তখন তিনটার ঘরে। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান শেষ করে আমি গিয়েছিল ম্যামের কাছে, আমার ব্যাগ আর আরিফ ভাইয়ার ফোন ফিরিয়ে আনতে যেটা আমি তখন তাড়াহুড়োই ভুলে এসেছিলাম ম্যামের কাছে। জুই আমার জন্য কলেজ গেইটে অপেক্ষা করছিল শ্রেয়ার সাথে। বাকি স্টুডেন্টরা যার মতো করে বাসায় ফিরে যাচ্ছিল। আমরাও চলে যাব। কিন্তু ব্যাগের জন্য পুনরায় ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে সুলতানা ম্যামের কাছে।

দরজা বাহিরে দাঁড়িয়ে ম্যামের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই হতভম্ব হয়ে যায় আমি। এতক্ষণ যাও একটু সাহস ছিল মনে এখন পুরপুরি নার্ভাস আর চুপসে যায় কক্ষে ভিতর রিদ খানের উপস্থিতি দেখে। প্রচন্ড হাসফাস করে চোখ তুলে রুমের উপস্থিত তিনটা মানুষকেই দেখে নেয়। রিদ খান ল্যাপটপে সম্মুখে বসে কিছু একটা দেখছেন। আর উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা রিদ খানকে ল্যাপটপের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখতে সাহায্য করছে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলে। আমি বুঝলাম হয়তো তারা জরুরি কোনো প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করছে। আমি রুমে ঢুকতে প্রথমে চোখাচোখি হয়েছিল রিদ খানের সঙ্গে। সেজন্য তখনকার অপমানিত চক্ষু লজ্জাটা বেশি লেগেছিল আমার। অতিরিক্ত টেনশন আর নার্ভাসনেসের জন্য উনার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ম্যামের দিকে তাকালাম। ম্যাম আমার দিকেই তাকিয়ে আছে কপাল কুঁচকে হাতে কিছু কাগজ পত্র নিয়ে। হয়তো তাড়াহুড়োই ম্যাম এই কাগজ গুলো গুটাচ্ছে। আমাকে দেখেই ম্যাম বলে উঠলো..

‘ কি চায়?

আমি হাসফাস করে আড়চোখে রিদ খানের দিকে তাকাতে চায়লাম, দেখলাম উনি এক পলক আমাকে দেখে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ হয়ে গেছেন ইতি মধ্যে। তারমানে আমার দিকে আপাতত উনার মনোযোগ নেই। আমি অস্বস্তিতে হাসফাস করে ইতস্তত গলায় বললাম ম্যামকে…

‘ ম্যাম আমার ব্যাগ আর ফোনটা চায়।

‘ ওহ! তোমার ব্যাগ আর ফোন আমি টিচার্স রুমে রেখে এসেছিলাম তখন। তুমি অফিস সহকারী সাজিদকে বলো আমার কথা, সে তোমার ব্যাগপত্র দিয়ে দিবে যাও।

‘ জ্বিই ম্যাম।

জড়তা মাথা নাড়িয়ে ম্যামকে সম্মতি দিয়ে আর কোনো দিক না তাকিয়ে চলে যেতে চাইলাম, চুপিসারে সোজা ঘুরে বের হতে চাইলে। তখনই শুনলাম রিদ খানের গম্ভীর গলা…

‘ আপনি খেয়েছেন?

কিছুটা চমকেই পিছন ফিরলাম। রিদ খান নামক একজন অপরিচিত মানুষ আমার খাওয়া দাওয়াত কথা জিগ্যেসা করছে বিষয়টি আমার কাছে বেশ অবাক করা ছিল। তাই পিছন ঘুরার সাথে সাথে রিদ খানের উদ্দেশ্য মিহি স্বরে বলে ফেললাম…

‘ নাহ স্যার!

আমার উত্তরের সাথে সাথে তৎক্ষনাৎ আরও একটি উত্তর আসল আমার কানে। পাশ থেকে রিদ খানের কথার উত্তর দিয়ে সুলতানা ম্যাম বললো..

‘ না স্যার! খাব একটু পর!

বুঝলাম ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছি আমি। ‘আপনি খেয়েছেন’ সমাদরের কথাটা রিদ খান আমাকে নয় বরং সুলতানা ম্যামকে জিগ্যেসা করেছিল। আমি মাঝ থেকে ভিন দাওয়াতী মেহমান হয়ে গেলাম তাদের মধ্যে। না বুঝেই অন্যের কথার উত্তর দিয়ে নিজের লজ্জিত হলাম। উফফ কি লজ্জা! কি লজ্জা! আসলে
বিভ্রান্তিকর লজ্জাজনক পরিস্থিতি কাকে বলে সেদিন আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম রিদ খানের সামনে। আজও আমার সেদিনের লজ্জাজনক পরিস্থিতির কথাটা মনে হলে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করে। উফফ কি লজ্জাটা নাই পেয়েছিলাম আমি। লজ্জায় কারও দিকে তাকাতেও পারছিলাম না। বরং লজ্জািত হয়ে আমি যখন নিজের দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই শুনলাম রিদ খানের পুনরায় গম্ভীর গলা স্বর। তিনি ম্যামকে বললেন…

‘ আপাতত আপনার এখানের কাজ শেষ ম্যাডাম। যান আপনি গিয়ে খেয়ে আসুন। বাকিটা আসিফ দেখে নিবে।

রিদ খানের কথায় সুলতানা ম্যাম আপত্তি করে বলতে চাইল…

‘ জ্বিই স্যার যাচ্ছি। কিন্তু আপনার…

ম্যামকে বলতে তিনি পুনরায় বলল…

‘ আপনি এখন আসতে পারেন ম্যাডাম।

উনার অবাধ্য গলায় আমি চমকে উঠে চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। তারমানে এতক্ষণ যাবত উনি আমার দিকে তাকিয়েই কথা গুলো ম্যামকে বলছিল। প্রচন্ড অস্তিত্ব দ্রুততার সঙ্গে নিজের দৃষ্টি নিচে নামিয়ে নিলাম। এতক্ষণ যাবত বোকার মতো উনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি বিষয়টি বোধগম্য হতেই আস্তে ধীরে ম্যামের পিছন পিছন আমিও বের হতে চাইলাম। কিন্তু পিছন ঘুরতেই রিদ খানের ডাক কানে আসলো তৎক্ষনাৎ…

‘ আপনি থাকুন মিস!

আমি এবার আর বোকার মতো দাঁড়ালাম না। ভাবলাম এই কথা গুলো মনে হয় সুলতানা ম্যামকে বলেছেন তিনি। তাই ভালোই ভালোই চলে আসতে চাইলে রিদ খানের শক্ত গলার ধমকে মূহুর্তে কেঁপে উঠলাম আমি…

‘ এই মেয়ে তোমাকে থাকতে বলছি না আমি। কোথায় যাচ্ছ তুমি?

ধমক খেয়ে সাংঘাতিক চমকে ছিলাম আমি। লোকটা তো সুবিধা নয়। সাংঘাতিক অসুবিধা মানুষ তিনি। চেনা নেই জানা নেই একটা অপরিচিত মেয়েকে এতো বড় ধমক দিবে? আল্লাহ! সকালের পিন্সিপাল স্যারের রুমে অপমান করলো আর এখান শাসাচ্ছে। কিন্তু কেন? কি দোষ করেছি আমি? নাকি আমরা পূর্ব পরিচিত? কই আমার তো কিছুই মনে পরছে না জীবনে কখনো এই ব্যক্তি সাথে আমার দেখা হয়েছে বলে। লোকটার ধমকে আরও সিঁটিয়ে গেলাম আমি। বুকের ভিতর ভয় নামক হৃৎপিণ্ডটা কেমন ধুপধাপ করে সারা শরীরে লাফালাফি করে জানান দিচ্ছিল সে যেকোনো সময় কাঁপতে কাঁপতে আমাকে অজ্ঞান করে দিবে সেটা। অতিরিক্ত ভয়ে যেমন মানুষের দিশাহারা হয়ে যায় আমার অবস্থাটাও ঠিক তেমনই ছিল। অতিরিক্ত ভয়ে কারণে মুখ দিয়ে তেমন কোনো কথা বের হচ্ছিল না। হাত-পা ঠান্ডা অনুভব করছিলাম। গলা দিয়ে তেমন কথা বলার জোর পাচ্ছিলাম না নার্ভাসনেসের জন্য। তারপরও নিভে যাওয়া গলায় একটু করে পিছন ঘুরে বলেছিলাম…

‘ জ্বিই আমাকে?.

তৎক্ষনাৎ শক্ত গলার উত্তর আসলো উনার…

‘ ইয়েস ইউ! কাম হেয়ার! এদিকে আসো।

ছেড়ে রাখা শাড়ী আঁচলটা একটু চেপে ধরে নত মস্তিষ্কের দুই কদম এগিয়ে উনার(রিদ) সম্মুখে দাঁড়াতেই উনি বললেন…

‘ পিছনে সারিতে বসার মতো কি পড়াশোনাতেও পিছিয়ে আছেন নাকি আপনি?

চমকে উঠে লোকটার দিকে তাকালাম ভাসা ভাসা চোখে। শুধু চমকিয়েছি বললে ভুল হবে ভিষণ ভাবে হতবাক হয়ে ছিলাম যে, এতো মানুষের ভিড়ে কি লোকটা আমাকে লক্ষ করেছিল, যে আমি কোথায় বসেছিলাম? দেখতে পেয়েছিল আমি পিছনে সারিতে বসেছিলাম সেটা? অবশ্যই দেখতে পেয়েছেন। না দেখতে পেলে এই মূহুর্তে কি করে আমাকে খুঁচা দিতো আমার পিছনে বসা নিয়ে। আমার হতবাক চেহারা দিকে তাকিয়ে উনি ফের প্রশ্ন করেন আমাকে…

‘ মিস অর মিসেস??

উনার কথা মানে প্রথমে বুঝতে না পেরে অবুঝ গলায় বললাম…

‘ হুমমম???

‘ ম্যারিড অর আনম্যারিড?

‘ জ্বিই আনম্যারিড!

‘ মানে সিঙ্গেল?

উনার কুঁচকানো কপালের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমার কথাটা উনার মন মতো হয়নি। হয়তো অন্য কোনে উত্তরের প্রত্যাশা করছিল এমন টাইপ হবে। আমি উনার দৃষ্টিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জানায়

‘ হুমমম।

আমার কথায় উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাশের লোকটাকে ডিঙ্গিয়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন টেবিলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে। আক্রোশে হেয়ালি গলায় বলে…

‘ আজকাল বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েদের চেনার উপায় নেই। সবাইকে দেখতে কেমন একি রকম লাগে, এজন্য আজ-কালকার মেয়ে গুলা সহজেই মিথ্যা বলে নিজেদের সিঙ্গেল দাবি করতে পারে তাই না! আচ্ছা যায় হোক সেই সব কথা! আপনি নিশ্চয়ই অবিবাহিত সিঙ্গেল নারী হবেন। আর আমাকেও সত্যি বলছেন এটাও আমি বিশ্বাস করি। তবে আমার মিঙ্গেল, প্রতারক, একজন বিবাহিতা মহিলাকে চায়। আপনি সে নন। তাই আমার আপনার প্রয়োজন নেই। আপনি আসুন!

লোকটার পরপর কথায় হা হয়ে গেলাম আমি। সবগুলো কথায় কেমন মাথা উপর দিয়ে গেল। ছেলেরা অবিবাহিত সিঙ্গেল মেয়ে খুঁজে নিজের জন্য। আর এই লোক বিবাহিত মিঙ্গেল মহিলা খুঁজছে নিজের জন্য পরকীয়া করতে? ছিহঃ কি খারাপ এই লোক! পরকীয়া করার জন্য শেষে কিনা বিবাহিত মহিলাদের খুঁজ করছে ছিঃ! এতো রুচি খারাপ নেতাদের হয়। প্রচন্ড ঘৃণায় গা শিরশির করে উঠে আমার। যাও লোকটার উপর চোখের দেখায় ভালো লেগেছিল কিন্তু লোকটার রুচি সম্পর্কে জেনে ততটাই গা ঘিন ঘিন করে উঠে অরুচিতে। লোকটার চরিত্রের খারাপ এই কথাটি সর্বপ্রথম আমার মস্তিষ্কে সেদিন ঢুকেছিল রিদ খানের বিরুদ্বে। হওয়ার কথা ছিল। আমার জীবনটা কোনো নাটক বা সিনামার কাহিনি ছিলনা যে, নায়িকাদের মতো নাটক করে ভনিতা করে সবকিছু উড়িয়ে দিব। বরং আমি উনার কথা গুলো বাস্তব ভিত্তিতে নিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখা হওয়া রিদ খানের পরপর কথা গুলো আমার কাছে বেশ অন্য রকম লেগেছিল। বাস্তবে আমাদের সাথে কোনো পুরুষ যদি হঠাৎ দেখায় এমন ভাবে কথা বলে তাহলে আমরা তার সম্পর্কে ঠিক দুটো ধারণা করি। এক, হয়তো সামনে লোকটা পাগল, নয়তো তার ক্যারেক্টারে সমস্যা আছে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। রিদ খানকে পাগল বলার প্রশ্ন উঠে না। কারণ রিদ খানকে অন্তত ঠান্ডা মাথায় সবকিছু হ্যান্ডেল করতে দেখেছিলাম আমি, তাই দ্বিতীয় কারণটায় আমার মস্তিষ্কে গেঁতে গিয়েছিল রিদ খানকে নিয়ে। আমি যখন রিদ খানের ক্যারেক্টার নিয়ে চিন্তা ভাবনায় বিভোর ছিলাম ঠিক তখনই আমার ধ্যান ভাঙ্গে আবারও উনার প্রশ্ন…

‘ নাম কি??

লোকটার হঠাৎ প্রশ্নে আবারও অবাক হয়েছিলাম। কারণ উনার সামনেই তো সকালে উনার দাদাভাইকে আমি আমার নামটা বলেছিলাম। তখন কি উনি শুনতে পায় নি আমার নামটা? নাকি শুনেও এখন নাটক করছে আমার সাথে?

‘ জ্বিই আমার?

‘ আপনার কি মনে হয় আমার নাম আপনার কাছে জানতে চায়বো??

লোকটার ত্যাড়ামি কথায় বুঝলাম রিদ খান মোটেও সহজ মানুষ নয়। আমার মতোন অপরিচিত মানুষের সাথে যদি তার এতো ত্যাড়ামি হয় তাহলে পরিচিত মানুষদের সাথে এই লোক কতোটা ত্যাড়ামি করে আল্লাহ জানে। এতো ত্যাড়ামি করার জন্য এই লোকের একটাও গার্লফ্রেন্ড ঠিকেছে কিনা কে জানে! তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে লোকটা আমার নামটা জেনেও ত্যাড়ামি করে আমার কাছে পুনরায় জিজ্ঞেসা করছে। এজন্য আমিও রিদ খানকে পরীক্ষা করার জন্য মিথ্যা একটা নাম বলে ফেলি চট করেই…

‘ ইসরাত জাহান!

নামটা বলেই ভয় ভয় নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। যদি মিথ্যা নাম বলার অপরাধ আবারও ধমক দেয় আমাকে সেই ভয়ে। কিন্তু না লোকটা তেমন কিছুই করলো না। বরং স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। যেন উনি কোনো কারণে হতাশ হলেন আমার এই উত্তরে। উনার হতাশ হওয়া ফেসটা দেখে বুঝলাম, উনি সত্যি সত্যি আমার সকালে বলা নামটা উনি শুনেন নি। হয়তো কাজে মাঝে ছিল বলে আমার নামটা লক্ষ করেননি তখন। এজন্যই হয়তো পুনরায় আমার কাছে নামটা শুনে শিওর হতে চেয়েছিল কোনো কিছু নিয়ে। কিন্তু আমি উনাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে ভুল নাম বলে ফেললাম। এখন সত্যিকারের নামটা বললে নিশ্চয়ই উনি আমাকে মিথ্যাবাদী বলে মনে করবেন এজন্য চুপ করে গেলাম নিজের নামটা উনাকে না বলে।

‘ নামটা সুন্দর তবে আমার পছন্দ নয়। আউট!

আবারও অপমান। লোকটার কি আর কোনো কাজ নেই নাকি যখন তখন আউট, আউট’ বলে অপমান করে আমাকে। আমি কি ইচ্ছা করে এখানে ছিলাম নাকি যে, বরং উনিই তো আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করে এখানে আটকাচ্ছেন বারবার। মনে মনে অনেকটা চেতে গেলেও মুখে প্রকাশ করলাম না কিছু। বরং নম্রভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে রুম থেকে বের হতে চাইলে ফের শুনলাম রিদ খানের প্রশ্ন সিক্ত গলার স্বর। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন…

‘ আচ্ছা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সব মেয়েরাই কি বেয়াদব, প্রতারক, পালাতক, আর ঝগড়াটে হয়? নাকি ভালো মেয়েও পাওয়া যায় ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে?

ধৈর্য সীমা অতিক্রম করেছিল সেদিন রিদ খান। তারপরই জোর গলায় লোকটাকে কিছু বলতে পারিনি। এমনই লোকটা বারবার ব্রাক্ষণবাড়িয়া সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে আমাদের বদনাম রটাচ্ছে। এখন আমি যদি পাল্টা উত্তর করতাম তাহলে লোকটা নিশ্চিত আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলতো, এইতো তুমিই ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বেয়াদব ঝগড়াটে মেয়ে। শুধু নিজের মাতৃভূমি বদনাম হবে বলে রাগ চেপে হনহন করে বেড়িয়ে পরেছিলাম লোকটার সামনে থেকে। নয়তো লোকটা যা-তা বলে আমাকে আরও অপমান করতো সেখানে থাকলে।

( এই গল্পে #দেওয়ানার মতো এতো ক্রেজিনেস থাকবে না। সম্পূর্ণ লাভ স্টোরি হবে গল্পটা। তবে অবশ্যই বাস্তব সম্মত হবে)

#চলিত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here