রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া ০৪

0
728

#রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা
লেখিকাঃ রিক্তা ইসলাম মায়া

০৪
হাতে প্রেম চিঠি নিয়ে হাঁটছি। সাথে ফ্রিতে দু’টো লাল গোলাপও আছে। এই গুলা কিছুক্ষণ আগে আমাদের কোচিংয়ের এক সিনিয়র ভাই দিয়েছে। সে বরাবরই আমাকে প্রেম নিবেদন করে যাচ্ছিল বিগত একমাস ধরে, আমিই তার ডাকে সারা দেয়নি কখনো। সারা না দেওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারও ছিল। আমি বিবাহিত মেয়ে। আর বিবাহিত মেয়েদের যেমন প্রেম ভালোবাসা মানায় না ঠিক তেমনই মানায় না তাদের হাতে প্রেমপত্র সেটাও। কিন্তু এই কথাটা কথা কিভাবে বুঝাবো গর্দভ ছেলেদের? বিগত একমাস ধরেই কোচিংয়ের ভাইয়াটি আমাকে এটা সেটা বলে জ্বালাত করতো এতোদিন। কিন্তু আজতো সরাসরি ফুল আর চিঠি দিয়ে বসল এক সিনিয়র আপুকে দিয়ে। আমি প্রথমে নেয়নি। পরে আমার অনুপস্থিতে এসব আমার ব্যাগে রেখে গেছে সেটা আমি মাত্রই ব্যাগ খোলে বুঝতে পারলাম। সকালে কোচিং ক্লাস শেষ করে কলেজে যাওয়ার পথে আইসক্রিম খেতে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে চিঠি আর ফুল গুলো পেলাম। সেই থেকেই এই গুলো আমার হাতে। আর জুই? সেতো এক ঝুলি প্রশ্ন খোলে বসে আছে আমার সম্মুখে দু’হাতে আইসক্রিম নিয়ে। হাতের চিঠি আর ফুলের দিকে তাকিয়ে হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কাঁধে কলেজ ব্যাগটা চাপালাম। অন্য খালি হাতটা দিয়ে দোকানের বিল পরিশোধ করে চট করে জুই থেকে কোণ আইসক্রিমটা নিয়ে নিলাম। বিনা বাক বয়ে সামনের দিকে ঘুরে যেতেই জুইও দ্রুততার পা চালায় আমার সাথে। আমি একহাতে ফুল আর চিঠি নিয়েই আইসক্রিমের প্যাকট ছিঁড়ে মুখে আইসক্রিম তুলতে পাশ থেকে ক্ষেপ্ত হলো জুই নিজের করার প্রশ্ন উত্তর না পেয়ে। চেতন গলায় বলল…

‘ অসভ্য মাইয়া বলবি কিছু, তোরে এসব কে দিছে? তুই কি লুকিয়ে প্রেম করছিস??

জুইয়ের কথায় রাগ হলো না। বরং হতাশায় বুক ভার হলো আরও। অনেক ইচ্ছা ছিল কলেজে উঠে লুকিয়ে একটা প্রেম করবো। কিন্তু আমার স্বপ্নে মাটি চাপা পরে গেল আধার রাতের হঠাৎ বিয়েতে। হয়তো আমার বিয়ে না হলে আজ এই চিঠি আর গোলাপ ফুল পেয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম সিনিয়র ভাইয়ের সাথে প্রেমটা করবো কিনা! কিন্তু হায় আমার অসহায়ত্ব! নাম-দাম কিচ্ছু জানি না এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার বিয়ে হলো। তার জন্য আমার কাছে দুনিয়ার সকল পুরুষই হারাম হয়ে আছে। অথচ হালাল পুরুষের চেহারাটা অবধি মনে নেই। গায়ে কলেজের সাদা ড্রেস। রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাতের ফুল আর চিঠির দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় জুইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললাম…

‘ প্রেম করার ভাগ্য আমার নেই। আমার জন্য প্রেমটা হারাম হয়ে আছে এক অচেনা হালাল পুরুষের জন্য।

আমার ভারি কথা গুলো হয়তো জুইয়ের মস্তিষ্ক ক্যাচ করতে পারলো না। কি বলেছি সেটা নিয়ে। বুঝার কথাও না। আমার হঠাৎ বিয়েটা তো আজও লুকায়িত জুইয়ের কাছ থেকে। তাই ওহ বুঝবে কি আমি কি বলেছি।

‘ কি বলছিস আবোল-তাবোল? ঠিক করে বল, এসব কে দিয়েছে? সত্যি করে বলবি রিতু, তুই কি প্রেম করছিস কারও সাথে?

‘ না।
‘ তাহলে?

আর কথা ঘুরালাম না। সোজাসাপ্টা উত্তরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম…

‘ রিফাত ভাইয়া দিয়েছে এসব। আমি নিতে চায়নি তাই তার এক মেয়ে ফ্রেন্ডকে দিয়ে আমার ব্যাগে রাখিয়েছে। এখন টাকা বের করতে গিয়ে মাত্রই দেখলাম।

আমার কথায় খানিকটা চমকে উঠা মতো করে অধৈর্য গলায় জুই বলল…

‘ রিফাত ভাই দিয়েছে মানে? কাশেম স্যারের ছেলে সুন্দরী রিফাত ভাই কথা বলছিস তুই?

জুইয়ের হাল্কা পাতলা উত্তেজনা সম্মতি দিয়ে বললাম…

‘ হুমম!
‘ ও মাই গড! সিরিয়ালি রিতু? কোচিংয়ের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম রিফাত ভাই তোকে পছন্দ করে? রিয়েলি! রিতু তুই কি উনার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবি?

দায়সারা উত্তরে বললাম…
‘ নাহ!
‘ কেন?
‘ এমনই! উনাকে আমার পছন্দ না তাই।
‘ কি বলিস? এতো সুন্দর ছেলেকে তুই না করছিস কেন?
‘ সুন্দর ছেলে বলেই না করছি। বেশি সুন্দর ছেলেপেলে আমার হজম হয়না। সুন্দর ছেলে মানেই সে নিজেকে আমার থেকে বেশি দাম দিবে সুন্দর বলে। তাই আমি আমার থেকে অসুন্দর ছেলেদের বিয়ে করবো। তারা যেন নিজেকে নিয়ে অহংকার করতে না পারে। বরং সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ভাবে এবং বউ বউ করে শুধু আমাকে ভালোবেসে যাবে ব্যাস।

‘ ওহ আচ্ছা! এতো গভীরে তোর চিন্তা ভাবনা। ওকে! নাইস চিন্তা ভাবনা। তার মানে তুই কালো, বেঁটে, আর বয়স্ক বুড়িওয়ালা লোক বিয়ে করবি এইতো? সুন্দরী বউ বলে যে তোকে সারাক্ষণ আদর করবে এমনটাই তো তোর চাওয়া তাই না? যাহ অতি শীঘ্রই পেয়ে যাবি তোর বয়স্ক বুড়িওয়ালা, কালো বেটে করে জামাইটারে দোয়া দিলাম।

জুইয়ের কথায় নাক মুখ কুঁচকে তাকায় আমি। মেয়েটা সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝে কথা বলে। এই মাইয়া আমারে দোয়া দিসে নাকি বদদোয়া? রাগে ওর দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলি…

‘ তোরে বলছি আমি বেঁটে বয়স্ক বুড়িওয়ালা লোক বিয়ে করবো? তুই জানস? আমার জামাই কতো লম্বা? আমি তার কাঁধের সময় হয় এতো লম্বা সে। (দু-হাত ছড়িয়ে দেখিয়ে বললাম) আর তার ইয়া প্রশস্ত বর্ডি। আসছে আমার জামাইরে বুড়িওয়ালা বলতে। আমার জামাইর বুড়ি বলতে কিচ্ছু নাই। সো নিজের চিন্তা কর। তোর বদদোয়া আবার তোর উপরই না পরে যায় হুবিশ মাইয়া। আমার এতোবড় জামাইরে বেঁটে বলতে আসছে তার ফাজিল শালী। যাহ তুই…

কথা গুলো বলতে বলতে থেমে যায়। মুখ ফস্কে কোথায় ভুলটা করে ফেললাম বুঝতেই হাতের ফুল, চিঠি আর আইসক্রিম নিয়েই চমকে উঠে, উদ্বিগ্নতায় ‘ আল্লাহ! আমি এবার শেষ। বলে মৃদু স্বরে চিৎকার করে দু’হাতে মুখ চেপে ধরলাম ভয়ে। জুই যে মানুষ? আমাকে আস্ত রাখবে না আর। আমার পেট থেকে একটা একটা করে কথা বের করে ছাড়বে। আমি ভয়ের তাড়নায় উত্তেজিত ভঙ্গিতে হতবাক জুইকে ফেলে হঠাৎই থেকে দৌড় লাগালাম জুইয়ের থেকে পালিয়ে বাঁচতে। কয়েক সেকেন্ড দৌড়াতেই কানে আসল জুইয়ের রাগান্বিতের স্বর আমার পিছন পিছন। রেগেমেগে ফায়ার হয়ে আমাকে ডাকছে আর বলছে, আমার জামাই কোত্থেকে আসল সেটা বলে যেতে। নয়তো আজ আমাকে আস্ত ছাড়বে না। দৌড়ানি থামেনি। ভয়ে তাড়নায় দৌড়াতে থাকলাম শুধু। মুখ ফস্কে এতোবড় ভুলটা কিভাবে করলাম আমি? এবার যদি জুই সবাইকে বলে দেয় তো? নিশ্চিত আমাকে সবাই মেরে ফেলবে। আব্বুর কানে গেলেতো আমি শেষ। রক্ষা নেই! আল্লাহ তুমি সহায় হও। মনে মনে আল্লাহ নাম নিয়েই দৌড়চ্ছিলাম আগামীতে কি হবে সেই ভেবে ভয়ে। টানটান উত্তেজনায় বর্তমানের অবস্থানটাও ভুলে গেছিলাম এক মূহুর্তের জন্য। ভুলে গিয়েছিলাম আমি কলেজ ড্রেসে রাস্তায় দৌড়াচ্ছি। আসলে মানুষের মনে যখন ভয় বাসা বাঁধে তখন তার মস্তিষ্ক নাকি অচল হয়ে যায় আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ভয় এতোটাই ছিল যে বর্তমান অবস্থানের কথাটা ভুলে হুমড়ি খেয়ে পরলাম কারও গায়ে। আমার হঠাৎ ধাক্কায় লোকটাও খৈ হারায় গড়াগড়ি করে দুজনই চটপটাং রাস্তায় পরলাম। বলতে গেলে ফ্রীতে ছোট খাটো বাংলা সিনামার সিন হয়ে গেল। আমি নিচে সে উপরে। আহা কি দৃশ্য! তবে আমার কাছে বেশ রোমান্টিক না হলেও সামনের মানুষটার রেগে যাওয়ার মতো যথেষ্ট মজাদার ছিল সিনটা। হয়েছিল তাই। লোকটা আমার উপর রেগেমেগে ফায়ার হয়ে গেছিল। হুমকি-ধামকি সবকিছু দিয়ে বসেছিল তবে সেটা চাপা স্বরে। পাবলিক প্লেসে বলে সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম আর কি হা হা হা। আমার স্টুপিড কান্ড গুলা। আচ্ছা যায় হোক! এবার আসি মূল কথায়। জুইয়ের ভয়ে তখন উত্তেজিত ভঙ্গিতে দৌড়াতে দৌড়াতে গুটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ করে সেই লোকের সাথে ধাক্কা খেয়ে বসি। আসলে ধাক্কা বললে ভুল হবে। আমিই দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটার পিঠের উপর পরে যায়। যার জন্য লোকটার গায়ে তৎক্ষনাৎ ল্যাপ্টে যায় আমার অর্ধ খাওয়া আইসক্রিমটা। এতটুকুতে আমার সিন শেষ হয়নি। তারপর যেটা হয়েছিল সেটা আরও করুণ দশা। লোকটার পিঠে ধাক্কা লেগে পরতে গিয়ে নিজেকে বাঁচতে তৎক্ষনাৎ শক্ত মুঠোয় পিছন থেকে লোকটার কলার আঁকড়ে ধরতে চাইলে ঘটে হিতের বিপরীত। লোকটার পিছনে কাপড়টা ছিঁড়েফুড়ে লোকটাকে সহ ‘ঠাস’ রাস্তায় গড়াগড়ি করে পরে গেলাম তখনই। নিচে পরে কুইনে আর কমড়ে ব্যাথা পেয়ে মাগো’ বলে মৃদু চিৎকারে পাশে তাকাতেই দেখালম একটা দামি আইফোন আমার হাতের কাছে রাস্তায় পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মোবাইলের ডিসপ্লের যা অবস্থা এই ফোন ইহকাল ঠিক হবে বলে আর মনে হচ্ছে না। ছোট মাথায় তখনই প্রশ্ন আসল এতো দামি ফোন কে এইভাবে ভেঙ্গে রাস্তায় ফেলে গেল? ইশ ফোনটা দেখতে কি নতুন। এতো ভালো ফোন কেউ ভাঙ্গে? এই ফোনের মালিক নিশ্চিত উগ্রবাদী পাষাণ বড়লোক হবে। টাকা গরমে রাস্তায় এতো দামি ফোন ভেঙ্গে চলে গেছে ছেহ। এই জাতি সভ্য হবার নয়। এক মূহুর্তে জন্য নিজের ব্যাথা ভুলে ফোন দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলে উঠলাম…

‘ আহারে এতো দামি আইফোনটা কোন পাষাণে ভাঙছে আল্লাহ জানে। মানুষ বড়লোক হলে যা হয় আরকি। টাকা দাম নাই এদের কাছে। এসব জাতির টাকা পয়সা দখল করে সরকার কেন যে, বাংলাদেশ বর্ডার পার করে দেয় না আল্লাহ জানে। রোহিঙ্গা হয়ে পরের দেশে ঘুরলে বুঝবে টাকার মায়া।

কথাটা বলে হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলতে গেলে বুঝালাম আমার হাত কোথাও আটকে আছে। হাত নাড়াতে গিয়ে রাস্তা সাথে ঘষা লাগতেই ব্যথা ‘আহ করে উপর দিকে তাকাতেই আতংকে উঠলাম মূহুর্তে। আল্লাহ আমি শেষ! এতক্ষণ যাবত ভুলে যাওয়া ঘটনা গুলো একে একে মনে পরল। মনে পরল আমি কাউকে নিয়ে রাস্তায় পরেছিলাম। ভয়ে আতংকে সিঁটিয়ে গিয়ে লোকটার শক্ত মুখপান এক পলক দেখে মূহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ভাঙ্গা ফোনটার দিকে। আহ! যা বুঝার তখনই বুঝে গেলাম। এই ফোন ভাঙ্গার আসামি অন্য কেউ না আমি নিজেই। তখন আমার হঠাৎ ধাক্কা লাগায় লোকটার ফোন কান থেকে নিচে পরে ভেঙ্গে গেছে। নিজের ভুলে এবার বেশ জোরেসোরে কান্না পেল আমার ভয়ে। এতো দামী আইফোন ভেঙে কি যে করবো ভেবে না পেয়ে এক মূহুর্তের জন্য ইচ্ছা হলো হাত পা ছড়িয়ে রাস্তা বসে কান্না করি। বহুত কষ্ট নিজের কান্না আটকে রেখে আইফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারও মাথা তুলে অপরাধী চোখে লোকটার দিকে তাকাতেই আতঙ্কে চমকে উঠলাম ক্রুদিত ঐ রক্তিম চোখ জোড়া দেখে। তখনই আমার খেয়াল হলো আরে লোকটা তো আমার পরিচিত। সর্বনাশ! ফোন ভাঙ্গার জন্য আর কোনো মানুষ পেলাম না। সোজা কলেজের ভিপির ছেলে রিদ খানের ফোনটাই ভাঙ্গতে হলো আমায়? শেষ আমি শেষ! আতংকে যখন বুক ঠকঠক করছিল ভয়ে তখনই আমার ভয়টা বাড়িয়ে দিল রিদ খানের চাপা গর্জনে…

‘ হোয়াট দ্যা হ্যাল?

আমার উপর থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে যখন উনার পাঞ্জাবিতে টান খেল তখনই চাপা গর্জনে এই কথাটা বলে। উনি তখনো আমার দিকে ঝুঁকে রয়েছে কারণ উনার পাঞ্জাবির একাংশ ছিঁড়ে আমার হাতের মুঠোয়। আমি আতঙ্কিত চোখে উনার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার হাতের দিকে তাকাতেই বুঝালাম উনার গর্জন ছাড়ার কারণটা। অসহায়ত্ব আর বুক ধড়ফড়ে, এবার সত্যি সত্যি আমার হাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে ইচ্ছা করল। অবশেষে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। রাস্তায় ঐ অবস্থায় শুয়ে থেকেই দু’হাতে মুখ ঢেকে অতিরিক্ত ভয়ে কেঁদে উঠলাম এতো। লোকটার ফোনটা ভেঙ্গে কান্না আটকাতে পারলেও যখন দেখলাম লোকটার পিঠের কর্লার থেকে কমড় অবধি সাদা পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে আমার হাতে ধরে আছি তখন কি আর কান্না থামানো যায়? এতো বড় ভুল। উহুম ভুল নয় ঘোর অপরাধ। এতো বড় অপরাধ করেও কি স্বাভাবিক থাকা যায়? না যায় না। আমার তো এই মূহুর্তে ইচ্ছা করছে কাঁদতে কাঁদতে একটা সাগর বানিয়ে ফেলি। সেই সাগরের পানিতে রিদ নামক লোকটা ভাসিয়ে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেয় যাতে আমি বেঁচে যায়।

আমার কান্না মধ্যে লোকটা উঠে দাঁড়াল। আমি তখনো কেঁদে যাচ্ছিলাম তবে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে লোকটাকে দেখছিলাম কি করে? লোকটা গায়ে সাদা পাঞ্জাবিটা ঝেড়ে উঠে রাগের কটকট করে ঘাড় বাঁকিয়ে নিজের পিঠ দেখতে চায়। অল্প একটু দেখেই বুঝতে পারলো উনার পাঞ্জাবি শেষ। তাই চাপা রাগে কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল…

‘ নাটক শেষ হলে উঠে দাঁড়ান। নয়তো গাড়ীর চাকার সাথে বেঁধে সোজা থানায় নিয়ে যাব। এখানকার থানাও আমার! পুলিশ আমার। শুধু আসামি হয়ে সারাজীবন পঁচে মরতে হবে আপনাকে।

হাঁড় হিম করা হুমকিতে কেঁপে উঠলাম আমি। সর্বনাশ থানা পুলিশ করলে আমি শেষ। আমার আব্বু আস্ত রাখবে না আমাকে ভেবে তৎক্ষনাৎ উঠে বসলাম ভেজা চোখে। আস্ত ধীরে উঠে দাঁড়ালাম অপরাধীর মতো মাথা নত করে। কান্না ভাঙ্গা গলায় মিনমিন করে বললাম…

‘ সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন।

উনার(রিদ) উত্তর না পেয়ে অপরাধীর চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। উনি কেমন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দৃষ্টিতে শীতলতা নেই। খানিকটা রাগ আছে তবে বেশটা বিরক্তির প্রকাশ। আমি ভয়ে কাচুমাচু করে এদিক সেদিক তাকিয়ে আবারও পালাবার রাস্তা খুজছিলাম তখনই আমার পায়ের কাছে কিছুর আভাস পেয়ে নিচে তাকাতে দেখলাম উনি(রিদ) ঝুঁকে রাস্তা থেকে কিছু তুলছে। প্রথমে ভাবলাম হয়তো আমার বইয়ের ব্যাগ তুলে দিবে আমায় কিন্তু না, উনি আমার ধারণা মিথ্যা করে যখন আমার পায়ের কাছ থেকে রিফাত ভাইয়ে দেওয়া প্রেম চিঠি আর গোলাপ ফুল তুলে নিজের হাতে নিলেন, তখনই ভয়ে চমকে উঠলাম। আল্লাহ উনি আমার চিঠি হাতে নিচ্ছেন কেন? লজ্জায় অস্তিত্ব বোধ করতেই উনি উঠে দাঁড়ায় চিঠি আর ফুল নিয়ে। উল্টে পাল্টে চিঠির খামটা আর গোলাপ দুটো দেখে আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে বলল…

‘ লাভ লেটার?

আমি অস্তিত্বে আছড়ে পরছিলাম বারবার। কিছু বলার মতোন গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। গলা ভিষণ কাঁপছিল। হঠাৎ করে বড্ড পানির তৃষ্ণা অনুভব করলাম। বুঝলাম আমি উনাকে ভয় থেকে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছি। তাই হুট করে হাত বাড়িয়ে ছু’ মেরে উনার হাত থেকে চিঠিটা নিতে চাইলেও নিতে পারলাম না। কারণ উনি আমার থেকে আরও একধাপ এগিয়ে তৎক্ষনাৎ চিঠিটা মাথার উপরের তুলে ফেললেন। আমি অস্তিত্ব বোধ করে জড়ানো গলায় হাসফাস করে বললাম…

‘ এটা দিন আমাকে।

‘ কেন?

‘ ওটা আমার ছিল।

‘ আমার ছিল বলতে এখন নেই। ছিল শব্দটা অতীতে চলে গেছে। বর্তমানের এটার আমার। আমি যেহেতু রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি তাই এটা আমার।

লোকটার অদ্ভুত কথায় বোকার মতোন তাকিয়ে রইলাম। কি বলে এসব? আমার চিঠি, উনার কি করে হয় আবার? রিফাত ভাইয়ের সাথে কি উনি প্রেম করবে? ছেলে হয়ে ছেলের সাথে প্রেম? তখনই উনি গম্ভীর গলায় বলে উঠে…

‘ আউট।

বিষন্নে বলে উঠলাম..

‘ মানে??

আমার কথায় হেলদোল হলো না উনার। গোলাপ দুটো ডিল মেরে ফুটপাতের ড্রেনে ফেলে হাতের চিঠিটাও মুষ্টিতে দলা মুচড়া করে ড্রেনে ফেলে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হাতের ঘুড়িটা এক পলক দেখে দায়সারা উত্তরে বললেন…

‘ এই-ই শেষ! নেক্সট টাইম আমার চোখের সামনে পরা
নিষেধ। কথা অমান্য হলে জীবনও শেষ।

মানে এটা কোনো কথা? কেউ কি কারও সামনে ইচ্ছা করে যায় নাকি? আমি কি এখন ইচ্ছাকৃত কিছু ঘটিয়েছি উনার সাথে? সবকিছুই অনাকাঙ্ক্ষিত। এর জন্য উনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। আমার মতো অপরিচিত মেয়ের সাথে উনার কি শত্রুতামি? প্রথম দিন থেকেই কেন বাজে আচরণ করছে? এখন আবার মারার হুমকি দিচ্ছে। আচ্ছা লোকটা সন্ত্রাসী -টন্ত্রাসী নয় তো। হতে পারে। হু নোস?

‘ যদি দেখা হয় তো?

আমার হঠাৎ প্রশ্নে উনার মধ্যে হাল্কা পরিবর্তন ঘটল। এক কদম এগিয়ে এসে আমার দিকে হালকা ঝুঁকে উনার(রিদ) দুই আঙ্গুল বন্দুকের মতোন করে তাক করলো আমার গলার উপর ও থুঁতির নিচে। বেশ সিরিয়াস গলায় বলল…

‘ কথার অবাধ্য হলে গুলি যে কোথায় করব নিজেও জানি না।

অপরিচিত কাউকে যে এমন ভাবে হুমকি দেওয়া যায় আমার জানা ছিল না। আমি অপরিচিত হয়েও যদি আমার সাথে এমন ব্যবহার করে তাহলে পরিচিত মানুষের সাথে কি করেন উনি আল্লাহ জানেন। এমন উগ্রবাদী ত্যাড়া মানুষটার গালফ্রেন্ড গুলা ঠিকে তো? বড্ড জানতে ইচ্ছা করল আমার ছোট মনে। তবু মুখ বাকিয়ে প্রশ্নটা করার সাহসটা হলো না। আবার চুপও রইলাম না। ভয়ার্ত মুখে নিভে যাওয়া গলায় আস্তে করে বলল…

‘ আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন? আমিতো ইচ্ছা করে আপনার ফোন ভাঙ্গেনি। ভুল…

‘ আউট!

লোকটার গম্ভীর গলার কেঁপে উঠলাম আমি। আবারও অপমান। এবার তো আমি উনার রুমে নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা থেকে আউট হয়ে কোথায় যাব? আকাশে? অপমানিত সহ্য করতে না পেরে বলে ফেললাম…

‘ অপরিচিত মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হয়।

আমার কথায় যেন চটে গেলান উনি। তিরতির মেজাজে চিবিয়ে বলল…

‘ জ্ঞান দিতে বলছি। আপনার শুকরিয়া আদায় করা দরকার আপনি আমার পরিচিত কেউ নন। নয়তো যে ডানা মেলে রাস্তায় উড়ে বেড়াচ্ছেন! সেই ডানার পাখনা গুলো কবেই ছাঁটায় হয়ে যেত আমার হাতে। নাউ আউট!

লোকটার রাগান্বিত মেজাজ ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম আমি। কি সাংঘাতিক লাগে লোকটা রেগে গেলে। আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। ব্যাগ নিয়ে যে বেগে দৌড়ে এসেছিলাম সেই বেগে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। জীবনের বেচে থাকলে সজ্ঞানে কখনো লোকটার সম্মুখীন হবো না হ। অসভ্য নেতা।
~~

মায়া যেতেই রিদ বিরক্তির চোখ তুলে নিজের ভাঙ্গা ফোনটার দিকে তাকাল। জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রামে এসেছিল দাদাবাড়ীতে। কিন্তু মাঝে গাড়ির ড্রায়ার পাঞ্চার হওয়ায় বডিগার্ড পাঠিয়েছে গাড়ির ড্রায়ার চেঞ্জ করতে। এরমধ্যেই ফোনআলাপ করছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে মায়ার আগমনে ফোনটাও ভাঙ্গল। এমন না সে ফোন ভাঙ্গায় রিয়েক্ট করতো না। অবশ্যই রিয়েক্ট করতো। কিন্তু চোখের সামনে মায়াকে দেখে তার রিয়াকশনটা উল্টো দিকে চলে যায়। মেয়েটার দেখলে কেন যে তার বড্ড পরিচিত লাগে হারিয়ে যাওয়া বউটার কথাও মনে পরে। আজ বিগত দেড় বছরের উপর হয়েছে তার হঠাৎ বিয়েটার সময়কাল। এতোদিন তার তেমন একটা বিয়েটা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু সেদিনকার কলেজ ফাংশনে মেয়েটিকে দেখেই তার হারিয়ে যাওয়া বউটার কথা মনে পরলো ভিষণ করে। বিশেষ করে মেয়েটার গলার স্বরটা তার বেশ পরিচিত লাগল। হ্যাঁ সেদিন ঝড়ের রাতে এক্সিডেন্টে তার হুশ তেমন ছিল না যার জন্য সাহায্যকারী মেয়েটার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায়নি সে। ঝাপসা ছিল মুখটা। কিন্তু মেয়েটার কন্ঠটা আজও তার কাছে স্পষ্ট। তারপর কাজী সাহেবের দেওয়া কাবিননামায় দেখেছিল সে তার বউয়ের নামটা ‘ রিক্তা ইসলাম মায়া ‘ বাড়ির ব্রাক্ষণবাড়িয়া। ব্যাস এতটাই দেখেছিল। তার বউয়ের সম্পর্কে আর কিছু জানে না সে। জানার ইচ্ছাও নেই। কিন্তু সেদিন ফাংশনে এই ইসরাত নামক মেয়েটার মুখে ব্রাক্ষণবাড়িয়া শব্দটা শুনেই চোখ তুলে তাকিয়েছিল সে। দেখেছিল মেয়েটাকে। বেশ পরিচিত মনে হয়েছিল মুখটা। সে প্রথমে সন্দেহ করেছিল মেয়েটা তার বউ হতে পারে ভেবে, এজন্য মূলত ফাংশন শেষে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎতে সে মেয়েটার নাম জিজ্ঞেসা করেছিল কিন্তু মেয়েটার নাম ‘ইসরাত জাহান, বলায় তার সন্দেহ দূর হয়ে যায়। বুঝতে পারে এই মেয়েটি তার হারিয়ে যাওয়া বউ নয়। কিন্তু তারপরও কেন যেন মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ হয় তাও জানে না। সেকি আশায় ছিল এই মেয়েটা তার পালিয়ে যাওয়াটা বউটা হতে পারে এজন্য? হয়তো! যদিও মেয়েটা তার পালিয়ে যাওয়া বউ হতো তাহলেই বা কি? বউকে দিয়ে তার কি দরকার? কোনো দরকার নেই। বিয়েটা সে মানে না। এমন হঠাৎ বিয়ের ভিত্তি নেই তার কাছে। সেখানে এই বেয়াদব মেয়েকে(মায়া) তো বউ হিসাবে আরও দরকার নেই। নিজের চিন্তা ভাবনাটায় রিদ নিজেই ফোড়ন কাটলো তৎক্ষনাৎ। নিজের ভাবনায় নিজেই বিরুদ্ধতা করল। না এই বেয়াদব মেয়েটাকে(মায়া) তার বউ হিসাবে নিজের জন্য দরকার না হলেও অন্তত আজকে একটা থাপ্পড় মারার জন্য হলেও মেয়েটার তার বউ হওয়ার দরকার ছিল। রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে প্রেমচিঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বের করতো। মাথা তুলে আছড়ি আছড়ি যদি দম না বের করতো তাহলে তার রাগটা কিছুতে কমতো না। বেয়াদব নারী।

রিদের চিন্তা ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে থামল। আসিফ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পিছনে দরজা খুলে দিতেই রিদ গম্ভীর মুখে উঠে বসল গাড়িতে। ডাইভারের সাথে আসিফ সামনে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল আরাফ খানের বাড়ির উদ্দেশ্য। রিদ গা এলিয়ে সিটে বসতেই সামনে থেকে আসিফ প্রশ্ন করে বলল…

‘ ভাই আপনার পাঞ্জাবি ছিঁড়লো কিভাবে? কিছুক্ষণ আগেও তো ভালো ছিল।

রিদ আসিফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসল। আসিফের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে নিজ বাক্যে বলল…

‘ তোর আমার এক্সিডেন্টের কথা মনে আছে? ২০১৭তে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরার পথে নরসিংদী জেলায় হয়েছিল সেটা?

রিদের কথায় আসিফ তৎক্ষনাৎ সম্মতি দিয়ে বলে উঠে…

‘ জ্বিই ভাই মনে আছে।

আসিফের সম্মতিতে রিদ পুনরায় সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ বুঝেছিস আসিফ আমার একটা বিয়ে হয়েছিল সেদিন রাতে। বলতে গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে। আমাকে সাহায্য করা মেয়েটাই আমার বউ। অসুস্থতার জন্য বউটার ফেসটাও দেখা হয়নি। নাম-পরিচয়ও কিচ্ছু জানি না। শুধু বউটার কন্ঠটা একটু করে মনে আছে। এখন মনে হচ্ছে তোর ভাবিকে একটু দেখার জন্য হলেও তার খোঁজ করার দরকার। যা-ত তোর পলাতক ভাবির খোঁজ করতো। অনেক তো হলো তার লুকিয়ে চুকিয়ে বেড়ানো এবার নাহয় স্বামীর মুখ দর্শন করবে।

হতবাক আসিফ চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল রিদের দিকে। রিদ ভাই বিয়ে করেছে, কই সেতো জানত না। তাকে বলেনি এতোদিন। এতো বড় সত্যি কথাটা যদি কোনো কারণে খান পরিবারে কানে যায় তাহলে তোলপাড় হয়ে যাবে। সর্বনাশের কান্ড ঘটিয়ে বসবে একেক জন। তাছাড়া রিদ খানের মতো মানুষ শুধু বউয়ের মুখ দেখার জন্য এতোদিন পর খোঁজ করবে এমনটাও নয়। নিশ্চিত কি কিছুতো একটা মনে আছে। আসিফ ‘ জ্বিই ভাই বলে সম্মতি দিয়ে সামনে ঘুরে গেল। রিদকে আর কিছু বলার মতো সাহস পেল না কারণ রিদের পারসোনাল বিষয়ে প্রশ্ন করা একদমই পছন্দ করে না। রিদ নিজ থেকে যতটুকু বলবে ততটুকুই সবাই শুনতে পারবে এর বেশি প্রশ্ন করা নিষেধ।

#চলিত…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here