রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া
১৭
ব্যাগপত্র গুছিয়ে সিএনজি করে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন নামলো আরিফ। পিছন দুইবোন বসা, মায়া আর জুই। সঙ্গে আছে বৃদ্ধ ফুলবানু। আরিফ ভাড়া মিটিয়ে পিছনে আসতে সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়াল দুইবোন। একটু পিছনে দাঁড়িয়ে জায়গায় দিল আরিফকে। নম্রতার সহিত আরিফ নানুমার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দাঁড়াল করাল সাইডে। তারপর নিজের বাকি জিনিসপত্র নামানোর জন্য মাথা নুয়ালো সিএনজি ভিতরে। আরিফ যখন একে একে নিজেদের ব্যাগপত্র টানছিল তখনই কোথায় থেকে তিনি-চারজন ছেলে এসে হাজির হলো তাদের সম্মুখে। ভদ্রতা দেখিয়ে ফুলবানুকে সালাম জানিয়ে দৃষ্টি আর্কষণ করলো আরিফের। গলার সুর পেয়ে লাগেজ রেখে আরিফ পিছনে ফিরতেই চোখে দৃশ্যমান হলো স্বল্প পরিচিত লোকদের। আরিফ চিনে তাদের। প্রায় দেখা স্বাক্ষত হয় তাদের সাথে রাস্তাঘাটে বা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে। এমনকি মায়ার কোচিং সেন্টারেও যাতায়াত আছে তাদের। তবে ছেলে গুলো বখাটে নয়। ভদ্র মার্জিত পরিবারের ছেলে এরা। রাজনৈতিক করে। কিন্তু ভালো ছেলে কাতারে পরে। আরিফ সে এলাকায় থাকে সেই এলাকারই ছোট ভাই এরা।
‘ আসসালামু আলাইকুম আরিফ ভাই। কোথায় যাচ্ছেন আপনি??
‘ ওয়ালাইকুম সালাম! এই তো বাড়িতে যাচ্ছিলাম আরকি। তা তোমাদের কি খবর। হঠাৎ এখানে কেন তোমরা???
সামনের ছেলেটির নাম তপু। মূলত সেই সালাম দিল আরিফকে। তপু নামক ছেলেটি সরল হেঁসে ভদ্রা দেখিয়ে আরিফের হাত থেকে ব্যাগটা নিতে চেয়ে হাত বাড়িয়ে বলল…
‘ এইতো ভাই ঢাকা যাচ্ছিলাম। রিদ ভাইয়ের পরিবার ঢাকায় আছেন। উনাদের পরিবারিক বিয়ে বলে আমাদেরকেও যেতে দাওয়াত করেছেন। সেখানেই যাব ট্রেনে করে আমরা। তবে যাওয়ার পথে দেখলাম আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে, তাই এগিয়ে আসলাম আরকি। দিন ব্যাগ গুলা আমাদেরকে দিন আরিফ ভাই। আমরা নিয়ে যাচ্ছি। এই শফিক বাকি ব্যাগ গুলা বের কর তো গাড়ি থেকে তোরা।
তপু নামক ছেলেটির আদেশে বাকি ছেলে গুলাও তাই করলো। আরিফকে হঠাৎ আগত ছেলে গুলার সঙ্গে বেশ সখ্যতা দেখিয়ে কথা বলতে দেখে কপাল কুঁচকে আসে মায়ার। আরিফ সচারাচর বাহিরের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেয় না যখন সঙ্গে মায়া বা জুই থাকে। বোনদের সেফটি কথা ভাবে তাই। তাহলে এখন কেন এই অপরিচিত ছেলে গুলা থেকে সাহায্য নিচ্ছে সেটা মাথায় আসছে না মায়ার। আরিফ সবাইকে তাড়া দিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে হাঁটল। অনলাইনে কাটা টিকেট গুলো মোবাইল দেখিয়ে কাউন্টার থেকে কাগজের টিকেট নিতে হবে বলে। ততক্ষণে জুই ফুলবানু বেগমকে ধরে এগিয়ে গেল স্টেশনের প্লাটফর্মে রাখা চেয়ার গুলোতে বসতে। মায়া তাদের পিছনে। হাতে ছোট খাটো কাপড়ে ব্যাগ। কাঁধের একপাশে ঝুলছে মেয়েলী ছোট ব্যাগ। সেথায় ফোনের শব্দ আসলে বেখেয়ালি মায়া হাটা থামিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন নিতে চাইলে বাঁধা দেয় তপু নামক ছেলেটি। সে আগের নেয় ভদ্রতা দেখিয়ে ছোট গলায় মায়াকে শুধিয়ে বলে….
‘ ভাবি আগে কোথাও বসেন। তারপর ফোন রিসিভ করবেন। এটা পাবলিক প্লেস আপনার সমস্যা হবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে।
তপুর ভদ্র ভাষায় ছোট করে ভাবি ডাকায় বিস্ফোরণের ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়া। মায়ার সাথে সাথে সামনে থেকে জুইও তাকাল ফুলবানু বেগমের হাত ধরে চেয়ারে বসাতে বসাতে। তপুকে ছোট গলায় মায়াকে ভাবি ডাকতে শুনেছে জুই। মূলত এজন্য জুইও চমকিত। কিন্তু ফুলবানু বেগমের সামনে কিছু বলতে নারাজ জুই। বিস্ফোরণের মায়া কিছু বলবে তখনই শফিক নামক ছেলেটি প্লাটফর্মের চেয়ারের পাশে ব্যাগগুলো রাখতে রাখতে মায়াকে বসার জায়গা দেখিয়ে তপু নেয় সেইম ভদ্রতা দেখিয়ে ছোট গলায় বলল…
‘ ভাবি আপনি এই চেয়ারটাতে বসুন। এখানে কোনো ছেলেরা আসবে না আমরা আছি আশেপাশে। আপনি বসুন প্লিজ।
বিস্ফোরণের মায়া হতবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। আজকাল প্রায়ই মায়ার সাথে এমন হয়। চেনা নেই, জানা নেই, ইয়া দামড়া বড় বড় ছেলেপেলে মায়াকে ভাবি বলে সম্মোধন করে যেখানে সেখানে। একেক জনের আবার কি ভদ্রতা? আহা! দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায় মায়ার। অথচ কে কার বউ সেটাই জানে না মায়া। আজকাল মায়াকে ছোট, বড় সবাই ভাবি বলে সম্মোধন করে। যেন মায়া এই জাতির, জাতিগত ভাবি হয়। কিন্তু এই জাতির জাতিগত ভাইটা কে আজও মায়ার জানতে পারে না। মায়াতো বিবাহিত। মায়ার একটা হারিয়ে যাওয়া স্বামীও আছে। সে আজও নিখোঁজ। মায়া তাঁকে খোঁজে পেলে নাহয় একটা কথা ছিল। বলতে পারতো না সেও কারও ভাবি হয়। কিন্তু যেখানে মায়ার গোটা স্বামীটাই খোঁজ খবর নেই, সেখানে মায়া এই জাতির ভাবির হয়ে বসে আছে। এখন মায়া যদি কাউকে প্রশ্ন করে, এই জাতির ভাইকে নিয়ে, কে সে? কাকে জড়িয়ে মায়াকে এতো এতো ভাবি ডাকা হয়? কে সে? তাহলে সবাই একটাই উত্তর আসে…
‘ আমাদের ভাই। ভাবি!
উৎসুক মায়া ফের প্রশ্ন করে…
‘ আপনার ভাইটা কে?
তাদের উত্তর…
‘ আপনার স্বামী। ভাবি!
থমথমে খেয়ে মায়া এর বেশি প্রশ্ন কাউকে করতে পারে না। কারণ বাকি প্রশ্ন করার আগেই বাকিরা ঘায়েব হয়ে যায়। মানে এক কথায় মায়াকে এরিয়ে চলে যায় মায়ার সম্মুখ থেকে। হতশায় মায়া আজকাল ডিপ্রেশনে ভুগছে। একদিকে নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজে পাচ্ছে না। অন্যদিকে জাতির ভাই নামক নতুন বিপদ সংকেত মায়ার কপালে জুটেছে। এর জন্য শান্তিতে ফ্রেন্ডের সাথে কোচিংয়ের পরে কোথাও আড্ডাও দিতে পারে না জ্বালায়। মায়া আজকাল রাস্তায় পাশের দাঁড়িয়ে ফুসকা ওয়ালা মামার ফুসকা খেতে পারে না। যদি মায়া খাওয়ার জন্য যায়, তাহলে দেখা যাবে কোথাও থেকে কেউ না কেউ সেখানে চলেই আসবে। একদম অপরিচিত মুখ মায়ার কাছে তাঁরা। অথচ মায়ার সাথে তাঁরা এতো নম্রতা ভদ্রতার সহিত বিনয়ী কথা বলবে যেন মায়া খুব বড় ধরণে সম্মানিত ব্যক্তি হয় তাদের। প্রথম দেখায় মায়াকে বাধ্যতা মূলক সালাম দিবে। তারপর বিনয়ী সহিত মায়াকে রাস্তায় দাঁড়াতে নিষেধ করে বলবে…
‘ ভাবি এই রাস্তাঘাট ভালো না। ভাইয়ের নিষেধ আছে আপনি যাতে রাস্তাঘাটে খোলামেলা চলাফেরা না করেন তাতে। দুষ্টু ছেলেদের উৎপাত বেশি থাকে। আপনি বাসায় চলে যান ভাবি। আমরা আপনার ফুসকা প্যাক করে বাসায় দিয়ে আসবো। আপনি বাসায় চলে যান ভাবি।
তারপর? তারপর সত্যি দেখা যায় মায়ার বাসায় সেদিন সন্ধ্যায় ফুসকার বড় প্যাক দিয়ে যায় কেউ না কেউ দারোয়ান চাচাকে দিয়ে তাঁরা। মায়া যতক্ষণ পযন্ত ফুসকা ওয়ালা মামা থেকে চলে আসবে ততক্ষণ পযন্ত ছেলেগুলো ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকবে আর বারবার মায়াকে বিনয়ী করে বলবে, মায়া যাতে বাসায় চলে আসে সেটা নিয়ে। এতো বড় বড় দামড়া ছেলেদের ভাবি ভাবি অনুরোধ করাটা দৃষ্টি কুঠোর লাগে বলে মায়া বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয় সেখান থেকে। আর এই সবকিছুর প্রত্যেক স্বাক্ষী হচ্ছে জুই। আজকাল মায়ার সাথে সাথে জুইও অতিষ্ঠ এই অচেনা জাতির ভাইকে নিয়ে। তবে এতোদিন মায়া এই বিষয়টি নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগলেও আজ মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল এই ভেবে যে, মায়া আজ বাড়ি চলে গেলে আর আসবে না এই চট্টগ্রামে। তখন এই জাতির ভাইয়েরও বিষয়টা দামাচাপা পরে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে এই রেলস্টেশনে যখন মায়াকে অল্প পরিচিত ছেলেগুলো ভাবি বলে সম্মোধন করলো তখনই মায়া তাক লাগলো এই ভেবে যে, এই জাতিরগত ভাই নিশ্চয়ই মায়ার বাসার খোঁজ খবর রাখবে? আরিফকে পূর্ব থেকে চিনে এমনটা মনে হচ্ছে মায়ার৷ এবার মায়ার নিজ বাড়িতে চলে গেলেও যদি জাতির ভাই লোকটা মায়ার জন্য সেখানেও যায় তখন কি হবে? চমকিত মায়ার ধ্যান ভাঙ্গে ফের তপু নামক ছেলটির মৃদু ঢেকে। মায়া এক পলক তপু দিকে তাকিয়ে বসল শফিক নামক ছেলেটির দেখানো চেয়ারে। জুই তখনো মায়ার দিকে আবাক করা নজরে চেয়ে। মায়া ভীতিকর দৃষ্টি তুলতে চোখ মিলল দুজনের। মায়ার চোখের ভয়টা যেন মূহুর্তে পড়ে ফেললো জুই। মায়ার সাথে সাথে জুইয়ের মনেও ভয়ের আশঙ্কা দেখা দিল এই ভেবে, ছেলেগুলোর মায়াকে ভাবি ডাকা শব্দ যদি কোনো কারণে আরিফ বা ফুলবানু বেগমের কানে যায় তাহলে বিপদে পরে যাবে দুজন। জড়সড় বসা মায়ার সাথে সাথে জুইও চুপসে গেল ভয়ে। মনে মনে আল্লাহ কাছে দোয়া করলো যাতে আরিফ বা ফুলবানুর কানে না যায় ছেলেগুলোর ভাবি ডাকটা।
দেখতে দেখতে জুইয়ের দোয়াই কবুল হলো। পুরো ট্রেন জার্নিতে ছেলেগুলোর কেউ মায়াকে আর ভাবি ডাকলো না আরিফ বা ফুলবানু বেগমকে সামনে। তবে পুরো রাস্তায় ছেলেগুলো দায়িত্ব নিয়ে মায়াদের খেয়াল রেখেছে। ট্রেন আশুগঞ্জ থামায় তাড়াহুড়ো দুই মিনিটে সবগুলো লাগেজে নামিয়ে দিল ছেলেগুলো। সবাই একে একে আরিফ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠতে উঠতে তপু আরিফের চোখের আড়ালে যেতে যেতে মায়াকে বলল…
‘ আসি ভাবি! আমরা কিন্তু আমাদের ভাইয়ের হয়ে বিয়েতে থাকব ভাবি ইনশাআল্লাহ।
বিয়ে? কোন বিয়ে! কার বিয়েতে থাকবে বলে গেল? মায়ার বোনের বিয়েতে তো ওদের দাওয়াত করেনি আরিফ। তাহলে কোন ভাইয়ের পক্ষ হতে কার বিয়েতে থাকবে ওরা? উফফ! অস্তিত্বে মায়া ফের ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় পারছে না হাত পা ছড়িয়ে স্টেশনে কাঁদতে। যাকে পাওয়ার তার সন্ধান খোঁজে পাচ্ছে না মায়া। অথচ মায়ার জীবনে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই যাচ্ছে। থামা থামি নামই নিচ্ছে না। প্রথমে রিদ খান আর এখন অচেনা জাতির ভাই। রিদ খান তো দেশে বাহিরে চলে গেল আজ প্রায় একমাস। এই ফাঁকে মায়াও বাড়িতে চলে এসেছে জীবনে কখনো রিদ খানের সঙ্গে দেখা হবে এটাও নিশ্চিত। রিদ খানকে নিয়ে ঝামেলা মুক্ত। কিন্তু এই জাতির ভাইকে কি করবে মায়া? এই লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। সব জায়গায় মানুষ লাগিয়ে মায়ার বাড়ি অবধি যদি চলে আসে তখন কি করবে মায়া? মায়ার রাগী বাবা এসব শুনলে নিশ্চয়ই মায়াকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিবে? ডিপ্রেশনে মায়ার এলোমেলো চিন্তায় হঠাৎই ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসলো। কি করবে উপায় না পেয়ে ভয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সেখানেই। মায়া হঠাৎ কান্নায় ব্যস্ত প্লাটফর্মে মানুষের অনেকের দৃষ্টি কুঠোর হলো সে। জুই, আরিফ, ফুলবানু, লাগেজে ছেড়ে মায়াকে ধরলো। চিন্তিত গলায় তিনজনই মায়াকে শুধালো, কি হয়েছে জানতে চেয়ে। মায়া কিছুই বললো না। শুধু অজানা ভয়ে ফুপাল। চিন্তিত আরিফ মায়ার কাঁধ চেপে নিজের কাছে টানলো। বোনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলে একটা সময় শান্ত হয় মায়া।
~~
তীব্র কোলাহলে গুঞ্জনে সকালের কাঁচা ঘুমটা ছুটে যায় মায়ার। বিরক্তি সূক্ষ্ম ভাজ ললাট বটে আসলে চোখ মেলা তাকাতে চেয়ে পকল ঝাপটালো মায়া। ঘুমের রেশ পুরপুরি কাটাতে না পেরে চোখ জ্বলে উঠল তখনই। বিরক্তি মায়া উপুড় হয়ে বালিশের মুখ গুঁজে দিল। পাশেই হয়তো জুই ঘুমের আছে ভাবল মায়া। তাই হাতড়ে জুইয়ের পাশটা চেক করতেই খালি জায়গায় পেয়ে মুখ তুলে তখনই চাইল পিটপিট করে। আশ্চর্য জুই বিছানাতে নেই। তারমানে জুইও উঠে গেছে এতক্ষণে। শুধু কি মায়াই এতো বেলা অবধি পরে পরে ঘুমাচ্ছিল? এমনটা তো হওয়ার কথা না। মায়া বাড়িতে আসলে সবার আগে মায়ার রাগী বাবা ডেকে ঘুম থেকে তুলে সবাইকে নামাজ জন্য। অথচ আজ কেউ ডাকলো না মায়াকে? ঘুমানোর জন্য মায়াকে এতো বেলা অবধি ছেড়ে দিল? মায়া মন সন্তুষ্টি হলো না। বাহিরে গুঞ্জনে মনে হচ্ছে বাসায় ঝামেলা চলছে বড়সড়। কি নিয়ে সবার এতো কথা কাটাকাটি হচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না মায়ার। বিরক্তি মায়া বিছানা উঠে বসল। রাতে চট্টগ্রাম থেকে বাসায় ফিরতে রাত প্রায় নয়টার নাগাদ হয়ে গিয়েছিল। তারপর গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে সবার সাথে একটু কথা বলে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত বারোটার ঊর্ধ্বে চলে যায়। মায়ার রুমে জুই, আর ফুলবানু বেগম ঘুমিয়ে ছিল রাতে। ক্লান্তিময় ঘুমটা এখনো পুরা হয়নি মায়ার। আরও একটু ঘুমাতে পারলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু বাসার সবাই উঠে গেছে তাহলে নিশ্চয়ই অনেক বেলা হয়ে গেছে। মায়াকে বিছানা ছাড়ার দরকার। বিছানায় ঝিম ধরে বসে থাকা মায়া হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিল সময় দেখতে। মোবাইলের সাইড বাটন চেপে স্ক্রিনে আলো জ্বালাতে মায়ার চোখ কপালে উঠলো ভোর ৪ঃ৪৫ সময় দেখে। মায়া ভাবলো ফোনের টাইম ঠিক নেই হয়তো। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা ধরে বাহিরের পরিবেশটা দেখতে চাইল কিন্তু মোটা পর্দার আড়ালে নজরটা বাহির অবধি যাওয়া সম্ভব হলো না। বিরক্তি মায়া গায়ে ওড়না চাপিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। বাহিরে ঘর থেকে ভেসে আসার গুঞ্জনের শব্দ ধরে সেদিকে হাঁটল। পা থামল পরিবারের চিন্তিত চেহেরা আর বড় বোনের হিচকি তুলা কান্দন মুখটা দেখে। চোখে ঘুম পলক ঝাপটাতে ঘায়েব হলো মায়ার। বসার ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলো জুই আর নিজের মা-চাচাকে বড় বোন মুক্তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে। হয়তো সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে মুক্তাকে তাও বুঝল না মায়া। পরিবারের প্রত্যেকের চেহারায় আমাবর্ষার ঘোর অন্ধকার লেপ্টে। থমথমে পরিবেশে বাবা-চাচা দুজনই সোফায় বসে মন্ত হয়ে। বিষন্নতা প্রত্যেকের চেহারায় দৃশ্যমান।৷ পরিবারের হঠাৎ কি হয়েছে তার কিছুই জানে না মায়া। কাউকে প্রশ্ন করবে সেই সাহসটাও পাচ্ছে না একেক জনের চিন্তিত মুখটা দেখে। জড়সড় মায়া শুধু দরজা আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল অসহায় মুখ করে। তখনই আরিফকে দেখলো সকলের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বাসার ঘরে ফিরতে বাহির থেকে। আরিফ বসার ঘরে পা রাখতেই চিন্তিতে মুখ খুললো মায়া মা রেহেনা বেগম।
‘ উনারা চলে গেছে আরিফ?
সোফায় বসতে বসতে শান্ত গলায় উত্তর করলো আরিফ…
‘ হুমমম
অধৈর্য্যের নেয় ফের শুধালো রেহেনা বেগম আরিফকে…
‘ আর কিছু বলেছিল উনারা? কোনো আবদার?
‘ উহুম! আর কিছু বলেনি মা!৷ উনাদের আগের কথায় রইল। তবে ফাহাদের নানা-নানুমাকে আমি আগে থেকেই চিনি। চট্টগ্রামে উনাদের বাসায় আমি গিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার। বেশ ভালো মানুষ উনারা। ফাহাদ আর মুক্তার আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের ডেটটা হঠাৎ পিছিয়ে যাওয়াতে বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিল। বেশ অনুতপ্ত উনারা মা। আর এজন্য মূলত ফাহাদকে নিয়ে এই মধ্যেরাতে আমাদের বাসায় ছুটে আসেন উনারা ক্ষমা চাইতে।
আরিফের কথা শেষ হওয়ার মাঝে তপ্ত গলাশ ফোড়ন কাটে জুইয়ের বাবা জামাল সাহেব। তিনি খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলল…
‘ উনাদের দুঃখ প্রকাশ দিয়ে আমরা কি করবো? একবারে জায়গায় দুই দুইবার বিয়েটা পিছানো হচ্ছে তাও উনাদের জন্য। আমরা কি সমাজ নিয়ে চলি না? সমাজের মানুষকে কি জবাব দিব? দুইবার করে বিয়ের কার্ড চাপানো হয়েছে, সমাজের মানুষকে, আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করা হয়েছে। এখন আবার সবার বাসায় গিয়ে বলি যে আপনারা কেউ আমাদের বিয়েতে আসবেন না। আমাদের মেয়ের বিয়ে আবারও পিছানো হয়েছে। দাওয়াত ক্যান্সেল। এসব গিয়ে বললে মানসম্মত থাকবে আমাদের? সমাজের মানুষের কাছে আমরা হাসির পাত্র হয়ে উঠবো। উনাদের যদি এতোই সমস্যা থাকে তাহলে না করার উনাদের ছেলেকে বিয়ে। আমরা কি উনাদের পায়ে পরে আছি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য? দিব না এমন বাড়িতে মেয়ে বিয়ে। আমরা আমাদের মেয়ের জন্য এর থেকে ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দিব। তুই ফোন করে উনাদের না করে দেয়। আমরা মেয়ে বিয়ে দিব না। বড় ভাই আপনি কিছু বলছেন না কেন?
চাচার কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলো মুক্তা। জামাল সাহেব তখনো রেগে। জুই, মুক্তাকে জড়িয়ে ধরে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বাবার দিকে। শফিকুল ইসলাম চিন্তিত মুখে বসে। পরিস্থিতি ফ্যাসাদে তিনি। একদিকে মেয়ে, অন্যদিকে সমাজ। তাছাড়া ভাইয়ের কথাও ফেলের নয়। বিয়ের কার্ড দিয়ে দ্বিতীয় বারের মতোন সমাজের মানুষ ও আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করা হয়েছে। এখন যদি সবাইকে নিষেধ করা হয় তাহলে অবশ্য মানুষ হাসাহাসি করবে উনাদের মেয়ের ভাগ্য নিয়ে। পরিস্থিতিতে জটিলতা বুঝেতেই চমকে উঠে মায়া। বুঝতে পারে বোনের বিয়েটা আবারও পিছিয়ে গেছে কিন্তু কেন তা এখনো জানতে পারেনি মায়া। হয়তো ফাহাদের সঙ্গে তার পরিবারের লোকও এসেছিল মায়াদের বাসায়। খুব সম্ভবত ফাহাদের বৃদ্ধ নানা-নানি এসেছিল। আরিফের কথায় তো তাই বুঝল মায়া। সারারাত না ঘুমিয়ে হয়তো এই মিটিং করেছিল সবাই কিভাবে কি করবে? মায়া ঘুম থেকে লেট উঠায় ফাহাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু মুক্তা বিয়েটা আবারও কেন পিছানো হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছে না মায়া। অসহায় আর কৌতূহল মায়া দ্বিধা কাটাল আরিফ। ছোট বোন মুক্তাকে এক পলক দেখল। পরিস্থিতির চাপে পরে সেই তখন থেকে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। না নিজের পরিবারকে কিছু বলতে পারছে আর না ফাহাদকে দোষ দিতে পারছে। সবদোষ মুক্তা নিজের ভাগ্য দিল। আজ ভাগ্যের জোরে এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে মুক্তা। মুক্তা টেনশন বাড়িয়ে দিয়ে বাবা সম্মতি জানালো ছোট চাচার কথায়। তিনি বললেন….
‘ জামালের কথাটা ফেলে নয় আরিফ। একবারে জায়গায় দুইবার করে বিয়েটা পিছানোতে সমাজের মানুষ হাসাহাসি করবে আমাদের মেয়ের উপর। পরিস্থিতি যায় হোক। এতে আমাদের মেয়ের কোনো দোষ নেই। আমরা আমাদের মেয়েকে হাসির পাত্র বানাতে চায় না সমাজে সামনে। বিয়ের কার্ডে চাপানো তারিখেই বিয়ে হবে মুক্তার তবে অন্য কারও সাথে। আমরা মেয়ে বিয়ে দিব না। তুমি ফাহাদের পরিবারকে এই কথাটা জানিয়ে দাও আরিফ।
বাবার গম্ভীর মুখের কথায় আতংকে হয়ে উপস্থিত সদস্যরা। মায়া ভীতু দৃষ্টিতে বোনের দিকে চেয়ে অপরাধী নেয়। মুক্তার কান্না বেগ আরও বাড়ে। এবার ফুপানো থেকে মৃদু শব্দ কানে বাজছে সবার। আরিফ পরিস্থিতির জটিলতা বুঝে গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করলো। বাবা-চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল…
‘ সমাজের কথা চিন্তা করার দরকার নেই কাকা। আপনি ভালো করলে ও সমাজ আপনার পিছনে কথা বলবে, খারাপ করলেও বলবে। আমাদের আপাতত নিজের পরিবারের কথা ভাবা উচিত। তাছাড়া ফাহাদ পরিবার অন্যায় কোনো আবদার করেনি চাচা। আল্লাহ না করুক আজকে যদি আমার পরিবারের কেউ ফাহাদের বাবার পরিস্থিতিতে থাকতো মৃত্যু লড়াইয়ে, তাহলে আমি ছেলে হয়ে কখনোই আমার বোনকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতাম না। আগে আমার পরিবারের সদস্যকে সুস্থ করে তুলতাম তারপর বিয়ে দিতাম। আচ্ছা আপনিই বলুন আজকে যদি আমার আব্বা অসুস্থ হতো তাহলে আপনি আমার বিয়ের কথা চিন্তা করতেন কাকা? করতেন না নিশ্চয়ই। ঠিক তেমনই ফাহাদের পরিবারের হঠাৎ এক্সিডেন্ট ফাহাদের মা সুস্থ হলেও আঙ্কেল এখনো অসুস্থ। আমি নিজে দেখেছি আঙ্কেলের অসুস্থতা কতোটা। তাছাড়া উনারা বিয়েটা ভাঙ্গতে চাচ্ছে না। শুধু বলেছে আজকের মধ্যে ঘরোয়া ভাবে দুই পরিবারের সম্মতিতে মুক্তা ফাহাদের বিয়ে দিয়ে রাখতে। কারণ পরশু আঙ্কেলকে নিয়ে ফাহাদ ও তার পরিবার সিঙ্গাপুর যাবে আঙ্কেলের ভালো চিকিৎসা জন্য। সুস্থ হয়ে আঙ্কেল সিঙ্গাপুর থেকে ফিরলে তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করে বউ ঘরে তুলবে ব্যস এতটুকু আবদার তাদের। আর এখানে আমি খারাপ কিছু দেখছি না কাকা। আমরা সবাই জানি এক্সিডেন্টে আঙ্কেলের বুক পাঁজরের চারটে হাড় ভেঙ্গে গেছে। সেইগুলা রিং বসাতে হবে। এতোদিন বাংলাদেশের ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েছিল হয়তো ভালো হয়ে যাবে ভেবে। কিন্তু হঠাৎ আঙ্কেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সিঙ্গাপুর নিয়ে যাচ্ছে ইমার্জেন্সিতে। এমনত অবস্থায় কারও পক্ষেই আনুষ্ঠানিক বিয়ের আয়োজন করা সম্ভব নয়। সেজন্য বিয়ের ডেট পিছানো অনুরোধ করেছেন খান পরিবার সদস্যরা এই মধ্যরাতে নিজে আমাদের বাসায় ছুটে এসে। এতে খারাপ কিছুই নেই কাকা। জম্ম -মৃত্যু আল্লাহ হাতে। আঙ্কেল বাহিরে যাওয়ার পূর্বে ছেলের বউকে দেখে যেতে চান বলে এখন আপাতত ঘরোয়ালো ভাবে বিয়েটা দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আমার সাথে ফোনেও কথা হয়েছে আঙ্কেলের। আমি বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি। দায়িত্ব নিয়েছি। এখন যদি আপনারা কোনো কারণে বিয়েটা ভাঙ্গতে চান তাহলে আমি মুক্তার বড় ভাই হয়ে বলছি। বাবা-কাকা কাউকেই মানবো না। আমি নিজে দাঁড়িয়ে বোনকে বিয়ে দিব ফাহাদের সঙ্গে। তাও আজরাতে। দায়িত্ব যখন নিয়েছি আজকের মধ্যেই সব আয়োজনেট ব্যবস্থা করবো আমি। এরপরও যদি আপনাদের কারও আপত্তি থাকে তাহলে আমাকে বলুন, আমি মুক্তাকে নিয়ে বের হয়ে যাব বাসায় থেকে তারপরও এই বিয়েটা বন্ধ হচ্ছে না। কারণ মানুষের বিবেক তার সর্বোচ্চ আদালত। আর আমার বিবেক আমাকে এতো বড় অন্যায় করতে সমর্থন করছে না। বাকিটা আপনাদের হাতে। আমি আয়োজন করতে বের হলাম।
কথা গুলো বলেই পরপর দাঁড়িয়ে যায় আরিফ। উজ্জ্বল চোখে সবাই আরিফের দিকে তাকিয়ে। বড় ভাই বাবার ছায়া হয়। সেটাই যেন প্রকাশ করলো আরিফ। চলে যেতে গিয়ে আরিফ কান্দনরত মুক্তার সম্মুখে দাঁড়াল। দীর্ঘ নিশ্বাস গোপন করে আশ্বস্তের হাত বুলিয়ে দিল বোনের মাথায়। ইশারায় মুক্তাকে বুঝার আরিফ আছে ওর পাশে। কিছু হবে না মুক্তার। আরিফ বাহিরের দিকে হাঁটল। হাতে অনেক কাজ। আপাতত বাজার করতে হবে বিয়ের জন্য। রাতে মুক্তার বিয়ে। দুই পরিবারের সদস্য উপস্থিত থাকবে বাড়িতে। বরযাত্রী খাবারের আয়োজনের লিস্ট বড়। আরিফ যেতে যেতে গলা ছেড়ে ডাকল মায়া আর জুইকে।
‘ এই রিতু! জুই নিয়ে আয়তো ভাইয়ে সাথে। কাজ আছে!
ব্যস আরিফের এক ডাকই যথেষ্ট ছিল মায়া আর জুইয়ের জন্য। হ্যন হয়ে ছুটে তক্ষুনি আরিফের পিছন পিছন। পরিবারের বড়রা কে বা কারা কি বলবে তার অপেক্ষা করলো না কেউ। আরিফ ডেকেছে ব্যস তাতেই হলো। এক দৌড়ে দরজার আড়াল হতে উৎলাসে ছুটে গেল মায়া আরিফের পিছন পিছন। পরিবারের বাকি মহিলা সদস্যদের মাঝেও আনন্দে উজ্জ্বল চেহারা দেখা গেল। রেহেনা বেগম তক্ষুনি নিজের ছোট জা রেনু বেগমকে তাড়া দিতে দিতে বলল…
‘ এই রেনু আয়তো! রান্না ঘরে আয়। কত্তো কাজ বাকি।হঠাৎ বিয়ে আয়োজন করা কি চারটে খানিকটা কথা নাকি। এই মুক্তা যাতো তোর নানুমাকে নিয়ে ঘরে যা তুই। আর শুন! তোর ফুপিদের ফোন লাগিয়ে বল সকাল সাতটার ভিতরের যেন সবাই এই বাড়িতে থাকে। এই রেনু যা তোর ভাই-ভাবিদেরও দাওয়াত করে আয় তাড়াতাড়ি। বলবি সকাল দশটার ভিতরে যেন সবাই এই বাড়িতে থাকে। যা! যা! সবাই গিয়ে যার যার কাজ কর। আমি নাস্তা রেডি করছি।
রেহেনা বেগমের সবাইকে তাড়া দিয়ে ছুটলো রান্না ঘরে উদ্দেশ্যে। আজ উনার কত্তো কাজ। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা শ্বাস ফেলার সময় কই উনার? রেহেনা বেগমের কথায় তৎক্ষনাৎ ছুটলো রেনু বেগম। স্বামী যে গোমরা মুখে বসে আছে তার খবর নেওয়ার সময় কই উনার? বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে হাতে হাতে কত্তো কাজ বাকি। তাছাড়া বড় ভাবি বলেছে আগে রেনু বেগমের ভাই-ভাবিদের দাওয়াত করতে। তাই তিনি আগে নিজের ভাই-ভাবীদের দাওয়াত করবে তারপর বড় জা-কে রান্না কাজে সাহায্য করবে। কে মন খারাপ করে বসে থাকল, তা আপাতত উনার দেখার দরকার নেই। দেখতে গেলেই ঝামেলা হবে। তাছাড়া আরিফের কথা একটাও মিছে নয়। অস্বীকার করা দায়। থাকুক দুই ভাই নিজের রাগ নিয়ে বসে। তিনি তো বাড়ির বড় ছেলের কথায় শুনবে হু। বাড়ির গৃহকর্মীদের তাড়াহুড়ো দেখে দুইভাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। দুজনকে যে কেউ পাত্তা দেয়নি বেশ বুঝলো। তবে যদি আরও রাগ নিয়ে বসে থাকে তাহলে সারাদিনও যে কেউ তাদের রাগ ভাঙ্গাতে আসবে না সেটাও বুঝলো দুইভাই। এজন্য বিনা বাক্য বয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়াল দু’জন। নিজেদের রাগ ছেড়ে একে একে ফোন করলো নিকটতম আত্মীয়দের। যাদের দাওয়াত না করলেই নয়।
~~
যদিও বিয়েটা ঘরোয়া পরিবেশে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু মায়ার পরিবারের নিকটতম আত্মীয় স্বজনরা মিলে ভরপুর হয়ে আছে সমগ্র বাড়ি। কমপক্ষে পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে শুধু মায়াদের নিকটতম আত্মীয় স্বজনরায় হলো। বাকি বিশ থেকে পঁচিশ জনের মতোন হবে ফাহাদের পরিবার থেকে আসা বরযাত্রী। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বিয়ের আয়োজন। বউ সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। দুইদিন পর আবার মুক্তাকে নিয়ে আসবে সবাই। মুক্তা শশুরকে সিঙ্গাপুরে বিদায় জানিয়ে। ফাহাদও যাবে বাবা মার সাথে। শুধু ফাহাদের ছোট বোন থাকবে বাংলাদেশে নানাবাড়ীতে খান পরিবারের সঙ্গে। বিয়ে বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ করছে পরিবেশ। মায়া এতক্ষণ দিব্যি টইটই করে বেড়িয়ে সারা বাড়িতে। বোনের বিয়ে বলে কথা পা দুটো মাটিতে পরছে না চঞ্চলতায়। সুন্দর দেখতে একটা চুরিদার জামাও পরেছে। হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়ার মায়ার শপিং করাও হয়নি। সকালে জুই আর মায়া আরিফের সঙ্গে বেড়িয়েছিল না? তখনই আরিফ এই সুন্দর দেখতে জামাটা কিনে দিয়েছে মায়াকে। সেইম দেখতে একটা জামা জুইও পড়ে আছে আজ। মূলত আরিফ দুজনকে এক রকম দেখতে দুটো জামা কিনে দিয়েছিল সকালে। সেই জামা পরেই সারা বাড়িতে টইটই করছে মায়ার। আবার ব্যস্ততা দেখিয়ে মেহমানদারিও করছে মাঝেমধ্যে শরবত এগিয়ে দিয়ে। মায়া উৎফুল্লতা শুধু বরযাত্রী আসার আগ মূহুর্ত পযন্ত দেখা গেল। ফাহাদের সঙ্গে মায়ার আগে কখনো দেখা হয়নি। মুক্তা বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ছবিতে মায়া বেশ কয়েকবার দেখেছিল। সরাসরি আজই প্রথম শালী দুলাভাইয়ের পরিচয়। কিন্তু সেই পরিচয়ে বিস্ফোরণ ঘটলো রিদের দাদা-দাদির উপস্থিতি দেখে। দিন দুনিয়া ভুলে সর্বনাশ ঘটিত দৃষ্টি ফেলে তব্দা খেয়ে চেয়ে থাকল শুধু আরাফ খানের দিকে মায়া। আরাফ খান তখনো বরে পিছনে মানে ফাহাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। মূলত শালীবৃন্দ দুলাভাইকে স্বাগত জানাতে এসেছিল বাড়ির মুল গেইটের ফটকে। যেহেতু আনুষ্ঠানিক বিয়ে আয়োজন ছিল না তাই গেইট ধরার মাধ্যমও ছিল না। কিন্তু মায়া আরাফ খানকে দেখেই তব্দা খেয়ে যায়। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে যখন শুনলো ফাহাদের নানাভাই হয় আরাফ খান। মায়ার মোটের চিন্তে ভুল হলো না আরাফ খানকে। এই নিয়ে দুবার দেখা হয়েছে মায়ার সাথে আরাফ খানের। প্রথমদিন কলেজে। দ্বিতীয়দিন উনাদের বাড়ির মেজবানের দাওয়াতে গিয়েছিল মায়া তখন। মায়ার সর্বনাশ হলো তখন যখন মায়ার ছোট মাথায় আসলো রিদ খানের ফুফাতো ভাই হয় ফাহাদ। এর মানে রিদের খান মায়ার আত্মী হয়ে গেল। সম্পর্কে পাতানো বিয়াই- বিয়াইন? ছিঃ আর কোনো সম্পর্ক খোঁজে পেল না? সোজা বিয়াই এই পান্তা মুখের রিদ খানকেই হতে হলো। মায়ার জীবনটায় বেদনার। ফাহাদের মামাতো ভাই যেহেতু রিদ খান এরমানে রিদ খান অবশ্যই এই বিয়েতেও আসবেন? নতুন আত্মীয় বলে কথা আসবে তো অবশ্যই। মায়ারও মুখোমুখি হবে আবার? উৎফুল্লর মায়া মুখটা তৎক্ষনাৎ রিদের ভয়ে চুপসে গেল। জড়সড় অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি ঘুরাল আশেপাশে। না রিদকে মায়ার চোখে কোথাও পরেনি। মনে হয় বিয়েতে আসেনি। মায়া শান্ত হতে হতে চমকে উঠল স্টেশনে দেখা হওয়া সেই চারটে ছেলেকে দেখে। এই ছেলে গুলোই তো কাল মায়াকে ভাবি, ভাবি ডাকছিল না স্টেশনে? আজ মায়ার বোনের বিয়েতে চলে আসলো কি করে? কার সাথে এসেছে এরা? নিশ্চয়ই ফাহাদ ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে এসেছে? আচ্ছা এর মানে কি এই ছেলে গুলোও ফাহাদ দুলাভাইয়ের চেনা মানুষ হয়। তার মানে সব সর্বনাশ মায়ার কাঁধে নাচছে। আল্লাহ এই অচেনা জাতির ভাই যদি ফাহাদের পরিচিত কেউ হয় তাহলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে মায়ার বোনের সঙ্গে যে ফাহাদের বিয়ে হচ্ছে সেটা। এবার আরও সহজে মায়ার অবধি পৌছে যাবে বিনা বাধায়। একদিকে রিদ খান তো অন্যদিকে এই অচেনা জাতির ভাই লোকটা দাড়িয়ে। কোনদিকে পালাবে মায়া? পালাবার পথ তো সবই বন্ধ। অসহায় মায়া তক্ষুনি বুক ফেটে কান্না আসলো। এতো ঝামেলা মাঝে ভেবেছিল এবার বুঝি মায়া নিস্তার পাবে সবকিছু হতে। কিন্তু তার কিছুই হলো না। উল্টো সব ঝামেলাকে আত্মীয় বানিয়ে বসে আছে সে। অসহায় মায়া সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেললো। চোখে পানি, নাকে পানি যখন এক হচ্ছিল কাঁদতে কাঁদতে তখনই কানে আসলো রিদ খান এখনো দেশে ফিরেনি। কবে ফিরবে কেউ জানে না। আর এই সংবাদটা স্বয়ং আরাফ খান দিল আরিফকে। মূলত আরিফ জানতে চেয়েছিল রিদ কোথায়। বিয়েতে কেন নেই সে। উত্তরে আরাফ খান এটাই বলল। কষ্ট জর্জরিত মায়া অসহায়ত্ব কমে আসলো রিদ দেশে নেই বলে। মায়া ভাবলো রিদ হয়তো এখনো জানে না মায়া সাথে তার নতুন আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়েছে সেটা। জানলে হয়তো মায়াকে অপমান করবে এই নিয়েও? মায়াও কম যায় না আর একবার অপমান করে দেখুক না মায়াকে? মায়া সোজা গিয়ে নিজের স্বামী কাছে বিচার দিবে হু। আচ্ছা ভালো কথা মায়ার স্বামীর খোঁজটায় তো নেওয়া হয়নি। সুমনের সাথে মায়ার কথা হয়েছিল সকালে। সুমন বলেছে বাবা হাফেজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে মায়ার স্বামীর নাম- ঠিকানা যোগাড় করে দিবে আজ রাতে মধ্যে। সেই থেকে মায়া ফোনটা হাতে হাতে নিয়ে ঘুরছে এতো ব্যস্ততা মাঝেও। যদি সুমন ফোন দেয় সেই আশায়। মায়ার নিখোঁজ স্বামী খোঁজে পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন এবার যায় কিছু হোকনা কেন? মায়া হাফেজ সাহেব থেকে নিজের নিখোঁজ স্বামীর ঠিকানা নিবেই নিবে। হাফেজ সাহেব লোকটা কেমন ইচ্ছাকৃত ভাবে মায়াকে ওর স্বামী খোঁজ দিতে চাইছে না। মায়ার ফোন ধরে না। রাতে সুমন ফোন করুক। সঠিক তথ্য দিতে না পারলে দরকার পরলে কালই একবার নরসিংদী চলে যাবে মায়া। তারপর এবার হারিয়ে যাওয়া স্বামীর ঠিকানা চাই-ই চাই। অন্তত ঐ গম্ভীর মুখ্যর পাষাণ রিদ খানকে টক্কর দেওয়া জন্য হলেও মায়ার গুন্ডা স্বামীকে চায় হু।
সুন্দর ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হয় ফাহাদ আর মুক্তার। বড়বোনের বিদায় বেলা মা-চাচীদের সেকি কান্না। মায়াও একটু করে কাঁদতে চেয়েছিল কিন্তু তা করার আর সুযোগ পেলে কোথায়? মুক্তার সাথে বরযাত্রীদের সঙ্গে মায়া আর জুইকেও যেতে বলল মায়ার গম্ভীর বাবা। মায়া অবশ্য প্রথমে যেতে চায়নি এজন্য ভাইয়ের পিছন পিছন ঘুরঘুর করছে কতক্ষণ। কিন্তু লাভ হয়নি জুইয়ের জন্য। জুইয়ের এক কথা মায়া না গেলে সেও যাবে না কোথাও। অসহায় মায়া রাগী দুঃখে জুইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। বাবা-চাচাদের আদেশে সুন্দর করে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল মুক্তার পাশে। যেহেতু বউ দুইদিন থাকবে শশুর বাড়িতে সেহেতু মায়া আর জুইকেও দুইদিন থাকতে হবে মুক্তার সাথে। কথা তো তাই হলো। মায়াও তাই জানে। কিন্তু মায়া মুক্তার সঙ্গে না যাওয়ার প্রদান কারণ ছিল মায়া কাল নরসিংদী যেতে চেয়েছিল সুমনদের বাড়ি, যেটা জুইয়ের জন্য সফল হয়নি। তাছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না মায়ার। কারণ রিদ খানতো আর দেশে নেই তাহলে মায়ার সাথেও মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্ন আসে না। গাড়ির মুক্তা পাশাপাশি বসতে বসতে মায়া ভাবলো বোনের শশুর বাড়ি থেকে ফিরে নরসিংদী যাবে সে। আপাতত এই দুটোদিন এভাবেই যাক। মায়া গাড়িতে বসতেই জুইও তক্ষুনি মায়ার শরীরের সঙ্গে চেপে বসল গাড়িতে। মায়া রাগী চোখ দেখাতেই দুষ্টু হাসলো জুই। মায়া শরীরের সঙ্গে চেপে বসতে বসতে বলল…
‘ জানিস রিতু! আমি না রাতে একটা দোষ স্বপ্ন দেখাছিলাম। যে সকালে উঠে দেখি রিদ খান আমাদের নতুন বিয়াই রুপে হাজির দুইহাতে পুটলি নিয়ে। জানিস পুটলিতে কি ছিল? তোর জন্য চানাচুর। আর আমার জন্য রসমালাই। আচ্ছা বলতো বিয়াইন তো আমরা দুজনই রিদ খানের একই হয়, তারপরও তোর বেলায় এতোবড় কিপ্টামি কেমনে করতে পারলো বুঝাতো তুই আমারে?
জুইয়ের খুঁচানো কথায় মায়া গাল ফুলিয়ে বসে। মনে মনে শপথ করে ফেলেছে এমন বেয়াদব বোনের সাথে আর জীবনেও কথা বলবে না। জুই যে ইচ্ছা করেই মায়ার মজা নিচ্ছে রিদ খানকে জড়িয়ে সেটা বেশ বুঝতে পারছে মায়া। নয়তো এমন হালাল স্বপ্ন কেউ দেখে? রাতে স্বপ্ন দেখলো রিদ খান ওদের বিয়াই রুপে আর সকাল হতে হতে সেটা সত্যি হয়ে গেল? তাছাড়া জুইতো রাতে ঘুমাইনি। সারারাত পারিবারিক মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল। ঘুমে তো মায়া ছিল। স্বপ্ন দেখার হলে মায়া দেখতো। সব আজাইরা ফাউ কথা জুইয়ের মায়াকে রাগানোর জন্য। যাতে মায়া জুইয়ের সঙ্গে কথা বলে ফেলে সেজন্য। মায়া সব বুঝে। বলবে না আর এমন পুলটিবাজ বোনের সাথে কথা হু।
~~
বড় বোনের শরীর ঘেঁষে খান বাড়ির সোফায় বসে মায়া। সঙ্গে অবশ্য জুইও রয়েছে তবে ফাহাদের ছোট বোনের সাথে বসে। মায়া ভদ্র মেয়ের মতোন গুছিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে এদিকসেদিক তাকিয়ে বাড়ির পরিবেশটা অবলোকন করছে। মায়ার জানা মতো এটা ফাহাদের বাড়ি নয়। ফাহাদের নানাবাড়ি এটা। এর মানে রিদ খানের দাদা বাড়ি হবে এটা। বাড়িতেও তেমন মেহমানের আনাগোনা নেই। যারা আছে সকলেই হয়তো উনাদের নিকটতম আত্মীয় স্বজন হবে ফাহাদে। সবমিলিয়ে ত্রিশ চল্লিশের মতোন মানুষজন উপস্থিত এতোবড় বিয়ে বাড়িতে। এতক্ষণ যাবত বউ দেখানো পূর্ব চলেছে সকলের। এখন তেমন কিছুই করছে না। তবে মেহমানদের খাবার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আবার মুক্তাকেও মাত্র নিয়ে গেল ফাহাদের বাবার কাছে। তিনি দেখতে চেয়েছেন ছেলের বউকে। তাই মায়া সঙ্গে গেল না। জায়গায় বসে রইল। তবে মায়া দৃষ্টি সুন্দর দেখতে বাড়িটি অবলোকন করতে ব্যস্ত। চারপাশে বিলাসিতায় ভরপুর। এতো বিলাসিতা দেখে আন্দাজ করায় যায় খান পরিবারের রুচি কতোটা ঊর্ধ্বে হবে। মায়া সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে দৃষ্টি যায় ড্রয়িংরুমে মেইন দরজা পটকের দিকে। বেখেয়ালি দৃষ্টি সেদিকে খেয়াল হতেই আতঙ্কে নেয় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল ভয়ে। বরাবর সম্মুখের রিদ দাঁড়িয়ে। গায়ের কোট হাতে ভাজ করে নেওয়া রিদের। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কোথা থেকে মাত্র বাসায় ফিরেছে। রিদতো দেশে ছিল না তারমানে আজকে নিশ্চয়ই বাহির থেকে ফিরেছে। মায়া লক্ষ করলো রিদের ডানহাতটা পকেটে গুঁজে মায়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে। হয়তো দেশে ফিরেই মায়াকে এই ভাবে নিজের বাড়িতে দেখবে রিদও আশা করেনি এমনটা। কাকতালীয় ভাবে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত দেখা দুজনের।
#চলিত…..