রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ১৮

0
826

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

১৮
ভিষণ অস্তিত্বে মায়া। রিদ হঠাৎ করে সামনে চলে আসাতে অনেকটা হতভম্ব। মায়া ঘুনাক্ষরেও ধারণাতে ছিল না রিদ আজ দেশে ফিরবে দেশে সেটা নিয়ে। মায়া যদি জানতো রিদ আজ হঠাৎ করেই দেশে চলে আসবে তাহলে ইহজন্মেও মায়া মুক্তা শশুর বাড়িতে আসত না। ফ্যাসাদে পরে মায়া স্তব্ধ নেয় হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইল জায়গায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিকে সেদিক ঘুরাতেই রিদের কপালের ভাজ শিথিল হলো হঠাৎ। নিজ বাড়িতে মায়ার উপস্থিতিটা রিদের ধারণাতেও ছিল না। অনাকাঙ্ক্ষিত মায়ার উপস্থিতিতে রিদ নিজেও খানিকটা চমকিত হলেও গম্ভীর মুখ অতলে তা প্রকাশ করলো। বরং মায়াকে কয়েক পলক দেখে খুব স্বাভাবিক নেয় এগিয়ে গেল সিঁড়ি দিকে। গম্ভীর মুখোর রিদ ধুপধাপ পা ফেলে চলল নিজে ঘরে। তখনই রিদকে দেখে জুইয়ের পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো ফাহাদের বোন সেজুতি। তাড়াহুড়ো রিদকে পিছন ডেকে বলল…

‘ আরে রিদ ভাই! তুমি কখন এসেছ দেশে? তুমি কি আজকে এই বাড়িতেই থাকবে আমাদের সাথে?

সেঁজতি কথায় রিদ পিছন ঘুরলো না আর না উত্তর করলো কোনো কিছু। যেমন হাঁটছিল ঠিক তেমনই হাঁটা গতি বহাল রাখতেই ফের রিদের কানে আসল সেঁজুতি উৎফুল্লতা ডাক। সে তাড়াহুড়োয় হেনা খান ডাকছে রিদের ফিরে আসার খবর দিয়ে। রিদকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মায়া। এতক্ষণ জানটা গলায় আটকে ছিল যেন। মায়া স্বস্তির হলেও সেঁজুতি কথায় রিদকে উত্তর করতে না দেখে ফের মুখ বেঁকে আসল মায়ার। লোকটা আসলেই বজ্জাত! দেমাগি আর অহংকারী টাইপ। কতো সুন্দর করে সেঁজুতি ডাকলো অথচ লোকটা ঘুরেও তাকাল না? এমনিতে মায়াকে অপমান করতে সবসময় মুখ চালিয়ে এগিয়ে আসে অথচ আজকে চুপ। মায়াকে নিজের বাড়িতে দেখে প্রতিক্রিয়াও করলো না? এতো ভালো মানুষ তো এই রিদ খান নয়। নিশ্চয়ই মায়াকে অপমান করতে খিচুরি পাকাচ্ছে মনে মনে। সুযোগ পেলেই যে খোঁটা মারবে নিজের বাড়িতে আসা নিয়ে সেটাও মায়া বেশ বুঝতে পারছে। মায়াকে এবার সাবধানে থাকতে হবে। ভুলেও এই লোকের সামনে পরা যাবে না। নয়তো মায়াকে অপমান করতে কতক্ষন লাগবে এই বজ্জাত লোকের? দেখা গেল বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে মায়াকে ‘আউট ‘ বলে অপমান করে বসল। তখন মায়া এতো রাতে কোথায় আউট হয়ে যাবে এই বাড়ি থেকে? জায়গায় আছে কোথাও যাওয়ার? এতো রাতে একা একা মায়ার তো আশুগঞ্জ যাওয়া সম্ভব নয়। তবে যেটা সম্ভব সেটা হলো আপাতত এই লোকের চোখের সামনে না পরা। মায়া বিগত দুইদিন লুকিয়ে চুকিয়েই বেড়াতে হবে এই বাড়িতে রিদ খানের সামনে পরতে না চেয়ে। একবার নিজের বাড়ি অবধি পৌছাতে পারলে ভুলেও বোনের শশুর বাড়িতে পা রাখবে না আর মায়া। ভাবুন মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিদের চলে যাওয়ার দিকে। চলন্ত রিদ চলে যেতে যেতে কি মনে করে সেও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়ার দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনের। অনাকাঙ্ক্ষিত চোখ মিলনের আতংকে উঠল মায়া। আতঙ্কের নেয় ধড়ফড়িয়ে সামনে ঘুরে যেতেই রিদও ঘাড় ঘুরাল সামনে। রিদের মুখ ভঙ্গিমা তখনো গম্ভীর। বুঝার রা নেই তার মনে আসলে কি চলছে মায়ার উপস্থিতে। সেঁজুতি ডাকে প্রায় সাথে সাথে হেনা খানকেও রান্না ঘর থেকে বেরুতে দেখলো মায়া। রিদের চলে যাওয়ার দিকে উৎফুল্লর মুখ করে তিনিও সেদিকে ছুটলো রিদের পিছন পিছন। হেনা খান খান বেশ সচ্ছ আর নরম মনে মানুষ। এই বয়সে এসেও নিজের পরিবারের তদারকি তিনি নিজের হাতেই করছেন সবটা। ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীদের বিয়ে মেহমানদারি সবকিছু উনার হাতে। অথচ এতোবড় বাড়িতে মায়া রিদের বাবা-মাকে কোথাও দেখলো না। আর না কেউ তাদের কথা কিছু বলছে। মায়া রিদের বাবাকে বেশ কয়েকবার দেখেছিল চট্টগ্রামে কিন্তু রিদের মাকে আজ পযন্ত দেখেনি। মায়া বুঝতেও পারছে না আসলে রিদের মা জীবিত আছেন নাকি মৃত? যদি জীবিত থাকে তাহলে কোথায়?? উনি উপস্থিত নেই কেন পারিবারিক অনুষ্ঠানে? তাছাড়া রিদের বাবাও বা কেন আসলো না নিজের পারিবারিক বিয়েতে? ভাবুক মায়া ভাবনার মাঝেই হেনা খানকে দেখলো রিদের রুম থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে তাও প্রায় বিশ মিনিট পর। হেনা খানের উজ্জ্বল চেহেরায় হাসিটা যেন চোখে পরার মতোন। হয়তো রিদের উপস্থিতিতে এতোটা খুশি তিনি তার প্রমাণ উনার হাস্যজ্বল মুখে। মায়া বুঝতে পারে না এমন গুমরো মুখের রিদ খানের উপস্থিতিতে কেউ এতোটা খুশিও হতে পারে। নয়তো রিদের মতোন মানুষকে তো সোজা ভাষায় কারও সাথে কথা বলতেও দেখা যায় না। মায়ার ভাবনার মাঝে ফের সেঁজুতি ডাকলো পরলো কিচেনে। হেনা খান ডেকেছে। সেঁজুতি হাতে ফোনটা নিয়েই দৌড়াল সেদিকে। মায়া সেঁজুতি চলে যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল জুইয়ের দিকে। সেই কখন থেকে জুই ফোনে মন্ত। মিটমিট হাসছে আর চ্যাট করছে। মায়া যে কিছু জিগ্যেসা করবে সেই সুযোগটাই পাচ্ছিল এতক্ষণ যাবত সেঁজুতির উপস্থিতিতে। সেজুতি চলে যাওয়ায় এবার সুযোগ বুঝেই মায়া উঠে দাঁড়াল। জুইয়ের বরাবর দাঁড়িয়ে কিছু বলবে তখনই সেঁজুতিকে দেখলো কিচেন থেকে কফির মগ হাতে নিয়ে বেরুতে তাড়াহুড়োয়। সেঁজুতিকে দেখেই মায়া চুপ করে গেল। মুখে আসা কথা গুলো ঢুক গিলে নিয়ে জুইয়ের দিকে তাকাল। দেখলো বেখেয়ালি জুই তখনো মিটমিট হেঁসে চ্যাট করছে ফোনে। মায়া যে সেই কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই খেয়াল পযন্ত নেই। রাগান্বিত মায়া জুইকে মুখে কিছু বলতে না পারলেও সেঁজুতির অগোচরে ধুপ কিল বসাল জুইয়ের বাহুতে। মায়ার হঠাৎ কিলে জুই খৈই হারিয়ে হাত ফসকে ফোন পরলো ফ্লোরে। চমকিত জুই নিজের ফোনটা ধরতে চেয়ে তাকাল মায়ার দিকে। রাগান্বিত মায়া তখনো রাগে কটমট করে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে। জুই ঝুঁকে ফোনটা ফ্লোর থেকে উঠিয়ে বিরক্তি গলায় ঝাড়লো মায়ার উপর। বলল…

‘ কি সমস্যা তোর? মারলি কেন হ্যাঁ? ভালো লাগে না? পছন্দের বিয়াইর বাড়িতে আছিস, কই আনন্দ প্রকাশ করবি, তা না করে মারামারি করছিস বোনের সাথে। গায়ে বেশি জোর থাকলে গিয়ে রিদ বিয়াইকে দেখা যাহ! ব্যাটা তোর জন্য বিদেশ থেকে চলে এসেছে। কতো দরদ দেখেছিস? নিশ্চিত তোর জন্য চানাচুর আর আমার জন্য রসমালাই এনেছে। যাহ সেগুলো গিয়ে নিয়ে আয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে। যাহ সর!

রাগান্বিত মায়া আরও চেতে উঠল জুইয়ের খোঁচা মারা কথায়। এমনই জুইয়ের জন্য মায়াকে এই বাড়িতে আসতে হয়েছে এখন আবার জুই-ই মায়াকে খোঁচা মারছে রিদ খানকে জড়িয়ে। রাগান্বিত মায়া জুইকে কিছু বলবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো সেঁজুতি। দুজনের উদ্দেশ্য বলল…

‘ তোমরা কেউ উপরে যেতে চাও আমার সাথে? যেতে চাইলে আসো!!

‘ যাব আপু!

মায়া তৎক্ষনাৎ উত্তর করলো সম্মতি দিয়ে। পরক্ষণেই জুই জানালো সে যাবে না, বলে আবারও ফোনে মন্ত হলো। মায়া হাতে ফোন না থাকায় ঘুরাঘুরি জন্য সেঁজুতি সঙ্গ নিতে চাইল। বিগত কয়েক ঘন্টা ধরে
একজায়গায় বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি লাগছিল মায়া। সেজন্য সেজুতির পিছন পিছন যেতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে উপরে। কয়েক সিঁড়ি যেতেই আচানক ফোন বেজে উঠল সেঁজুতি। কল রিসিভ করে ফোনটা কানে তুলে কথা মগ্ন হয়ে হাঁটতে লাগলে মায়া সহানুভূতি দেখাতে চাইল সেঁজুতি উপর। যেহেতু সেঁজুতি ফোনে কথায় ব্যস্ত সেজন্য কফির মগটা নিজের হাতে নিতে চাইল মায়া। হলো তাই। মায়া হাত বাড়িয়ে সেঁজুতি থেকে কফির মগটা নিতে চাইলে সেঁজুতি প্রথমে দিতে না চাইলেও পরে দিতে বাধ্য হয়, কফির মগ হাতে নিয়ে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছিল বিদায়। মায়াকে ছোট করে ধন্যবাদ জানালো সেঁজুতি। উত্তরে ভদ্রতা দেখিয়ে হাসলো মায়া। কফির মগ হাতে মায়াও সেঁজুতি পিছন পিছন এসে থামল এক বন্ধ দরজার সম্মুখে। কিন্তু তখনো সেজুতির ফোন আলাপ শেষ না হওয়ায় সে কান থেকে অল্প ফোন উঠিয়ে বিনয়ের সহিত মায়াকে বলল…

‘ একটু কষ্ট করে কফির মগটা ভাইয়াকে দিয়ে আসতে পারবে তুমি? আসলে আমার কলটা খুবই আর্জেন্ট। ভাইয়া রুমেই আছেন হয়তো। তুমি কফির মগটা দিয়ে চলে আসবে। পারবে?

সরল মায়া ভদ্রতা দেখিয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা কাত করে সম্মতি দিল সেঁজুতি কথায়…
‘ আচ্ছা আপু।

মায়া সুন্দর সাবলীল সম্মতি দিয়েই চাপানো দরজাটায় নক করল। ভিতর থেকে কোনো উত্তর না আসায় মায়া আবারও নক করলো। পরপর কয়েকবার নক করতেই সাইডে দাড়িয়ে থাকা সেঁজুতি অল্প কান থেকে ফোন উঠিয়ে মায়াকে বলল…

‘ ভাইয়া মনে হয় ওয়াশরুম আছে মায়া। তুমি কফির মগটা রুমে রেখে চলে আসো!

মায়া তাই করলো। দ্বিতীয়বার আর নক না করেই চাপানোর দরজার আস্তে করে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। খুব পরিচয় একটা ঘ্রান নাকে ভাজলো তখনই। আবছায়া আলোয় মায়া রুমটাকে দেখলো। বেশ সুন্দর আর বড়। ভিতরকার পরিপাটি গুছালো আয়োজন দেখে মায়া বুঝলো এই রুমের মালিক বেশ রুচিশীল। মায়া ভাবলো রুমটা হয়তো ফাহাদের হবে। যেহেতু সেঁজুতির মুখে মায়া ভাইয়া শব্দটাই শুনেছে বেশ কয়েক বার সেহেতু এই রুমের মালিক ফাহাদেরই হওয়ার কথা। কারণ সেঁজুতি ভাই তো ফাহাদ তাই না। সেই হিসাবে এই রুমটাও মুক্তার ভবিষ্যত রুম। মায়া গোল গোল চোখে রুমেটা দেখতে দেখতে একটু সামনে এগোল। কোমর বেঁকে টি-টেবিলে উপর কফির মগটা রাখতে গিয়ে চোখ গেল আবছায়া আলোয় সামনের বিছানার উপর। মূহুর্তে আকাশ ভেঙে পরার নেয় চমকে উঠে পুনরায় কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল হতবুদ্ধি রুপে। হতবাক মায়া থমকে জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল বিছানায় রিদকে বসে থাকতে দেখে। রুমের লাইট অফ থাকায় মায়া প্রথমে রিদের উপস্থিতি ঠাহর করতে না পারলে রিদ মায়াকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেছিল। তখন থেকেই রিদ শান্ত দৃষ্টিতে মায়া দিকে চেয়ে। মায়ার হাবভাব সবকিছুই খেয়াল করছিল সে। মূলত রিদ বাহির থেকে রুমে এসেছে ত্রিশ মিনিটেরও উপরে তারপরও ফ্রেশ হতে পারেনি প্রথমে হেনা খানের জন্য পরে তার ফোন কলের জন্য। হেনা খানের কাছে সেই কফি চেয়েছিল তখন। হেনা খান চলে যেতেই ভেবেছিল ফ্রেশ হবে কিন্তু জুরুরি ফোন কল আসায় কথা বলতে বলতে বিছানা পাশে এসে বসেছিল সেজন্য তখন মায়ার দরজা নক করাটা হেয়াল করেনি রিদ। কিন্তু মায়াকে তার রুমে প্রবেশ করতে দেখেই ফোন কানে থাকা অবস্থায় খানিকটা কপাল কুঁচকে আসল রিদের। নিঃশব্দে মায়াকে লক্ষ করে কল কেটে ফোনটা রাখল বেড সাইডের টেবিলের উপর। তারপর আস্তে ধীরে হাতে ঘুড়িটা খুলেও সেখানে রাখার সময় মায়া দৃষ্টিতে পরলো রিদকে। এতে রিদ বিন্দুমাত্র আবাক হলো না মায়া উপস্থিতিতে। আর না চমকালো। বরং স্বাভাবিক নেয় মায়ার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোমর বেঁকে সুইচ বোর্ডের সুইচ চেপে রুমের আলো জ্বালিয়ে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল থমথমে খেয়ে থাকা মায়া দিকে। কোমরে গুঁজে রাখা শার্টটা টেনে প্যান্টের উপর ফেলতে ফেলতে শান্ত দৃষ্টি ঘুরাল মায়া পা থেকে মাথা অবধি। দু’হাতে পকেটে গুঁজাতে গুজাতে মায়া উদ্দেশ্য তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ কি চাই?

থমথমে মায়া ধ্যান ভাঙ্গল রিদের গম্ভীর কথায়। জড়তায় আষ্টশ হয়ে মিইয়ে গেল তখনই। মায়া ফাহাদের রুম মনে করে ভুল ক্রমে রিদের রুমে ঢুকে পরেছে। এমনি এই লোকের সাথে মায়ার সখ্যতার সম্পর্ক নেই। তার উপর আবারও ভুল করে এই লোকের রুমেই এসেছে মায়া। আগের বার মায়ার রিদের দাদা বাড়িতে যাওয়াটায় পছন্দ করেনি রিদ সেজন্য অপমান করে করেছিল ছায়াকে ‘আউট’ বলে। এবার নিশ্চয়ই আরও বেশি অপমানজনক কথা শুনাবে মায়াকে নিজের রুমে দেখে? দুঃখী মায়ার দুঃখে কেদেকুটে বুক ভাসাতে ইচ্ছা করলো। ঘুরে ফিরে কেন রিদের মুখোমুখি হয় মায়াকে সেটাই বুঝে না সে। দুঃখী মায়া দুঃখ কষ্টে নিজের ভাগ্যে দোষী বানাল। আজকাল মায়ার ভাগ্যে রিদ দোষ পরে গেছে। সেজন্য মায়া প্রতিবার ঘুরেফিরে শুধু রিদ খানের চক্রেই ফেসে যায় এজন্য? দুঃখে কষ্টে জর্জরিত মায়া ছোট গলায় মিইয়ে গিয়ে বলল রিদকে…

‘ কিছু চায় না।

রিদের তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে চাইল…

‘ তাহলে…

রিদের কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো মায়া। রিদকে শেষ করতে না দিয়ে বেশ সাহসী গলায় রিদকে শাসিয়ে বলল…

‘ তাহলে কি হ্যাঁ? কি করবেন আপনি হুম? আমাকে ভয় দেখান? আমি আপনাকে ভয় পায় মনে করছেন? ভুলেও না। আপনি হবেন কোথাকার নেতা-সেতা। আমি আপনাকে মোটেও ভয় পায়না বুঝেছেন। উল্টো আপনি আমাকে ভয় পাবেন যদি আমার আসল পরিচয় জানন তো। আপনি জানেন আমি কে? চিনেন আমাকে? আমি হলাম জাতির ভাবি। আমার পিছনে কার হাতে আছে জানেন? এই জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত আছে আমার পিছনে। তাই আমার সাথে বেশি তেরিং বিরিং করলে সোজা সেই হাত দিয়েই টুস করে আপনাকে গায়েব করে দিব হুহ। শুধু ফাহাদ জিজুর ভাই বলে ছেড়ে দিলাম আপনাকে, নয়তো আমি কিন্তু অনেক ক্ষমতাসীন ভাবি হয় মনে রাখবেন। নিন আপনার কফি নিন।

মায়া লম্বা চওড়া হুমকিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল রিদ। মায়া রিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তক্ষুনি হাতের কফির মগটা পুনরায় টি-টেবিলে উপর রেখে এক প্রকার দৌড়ে পালাল রুম থেকে। মায়া চলে যেতেই রিদ এগিয়ে এসে কফির মগটা হাতে নিল। সেটাতে চুমুক দিতে দিতে মৃদুস্বরে আওড়াল…

‘ জাতির ভাবি! ইন্টারেস্টিং!
~
খান বাড়ির মেহমানদারিতে অতিষ্ঠ মায়া। একের পর এক রাস্তার পরিবেষণ করেই যাচ্ছে মায়াকে তাও কিছুক্ষণ পর পর। এমনিতে মায়া বেশি খায়। সারাদিন ঘুরঘুর করে খাওয়ার বদ অসভ্য আছে। কিন্তু এই মূহুর্তে খেতে পারছে না জড়তায়। বোনের শশুর বাড়িতে আছে মায়া। প্রথম দিনই যদি এতো বেশি খায় তাহলে মায়ার ভদ্রতা চলে যাবে না? তখন মানুষ কি বলবে মায়াকে? মায়া পেটুক রাক্ষসের মতোন খায় এটা বললে তখন মায়ার আর ভদ্রতা থাকবে চলে যাবে না? মূলত এজন্যই তো মায়া লোক দেখানো ভদ্রতার খাতিরে কিছুক্ষণ পর পর আসা সকল রাস্তা গুলো ফেরত পাঠাচ্ছে অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু খান বাড়ির মানুষজনও জানি কেমন, দেখছে মায়া খেতে পারছে না, ভদ্রতা রক্ষা করছে, তারপরও কিছুক্ষণ পরপর গাদা গাদা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে মায়াকে। আর এজন্যই মায়ার ভালো লাগছে না। অতিষ্ঠ লাগছে খান বাড়ির অতিরিক্ত মেহমানদারিতে। আর লাগবেই বা না কেন? চোখের সামনে প্রিয় খাবার গুলো বারবার ফিরত পাঠাতে কার ভালো লাগে? মায়ার কষ্ট হয় না বুঝি? দুঃখী মায়া নিজের সামনে রাখা ট্রে ভরতি খাবার দিকে তাকাল। হতাশা দৃষ্টিতে বিরক্তি ঠেলে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল জুইকে খোঁজতে। এই জুইটাকেও আশেপাশে কোথায় দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ফাহাদের বোন সেঁজুতি সাথে কোথাও গিয়েছে। মায়াও যেতে চেয়েছিল ওদের সাথে কিন্তু জুই বলল ওহ নাকি ওয়াশরুমে যাবে। আবার এক্ষুনি চলে আসবে বলে মায়াকে অপেক্ষা করতে বলেছে। মায়াও সেই সন্ধ্যা থেকে এই খান বাড়ির ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে থাকতে থাকতে মায়ার কোমর লেগে আসছে ব্যথায়৷ অতিষ্ঠ মায়া বিরক্তিতে উঠতেও পারছে না ভদ্রতা দেখিয়ে। কোথায়, কোন দিকে যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না। যাও একটু ওঠেছিল সেঁজুতি পিছন পিছন কিন্তু রিদের ভয়ে ফের এখানে এসে বসেছে পুনরায়। তাছাড়া মায়া এখানকার কোনো কিছুই চিনে না। তারপর আবার মায়ার বোন মুক্তাকে উপরের কোন রুমে নিয়ে গিয়েছে তখন সেটাও মায়া দেখেনি। শুছেনে মুক্তাকে ফাহাদের বাবার রুমে নিয়ে গেছে। ছেলেরা সব বাহিরে! মায়াকে সারাক্ষণ ভাবি ভাবি ডাকা ছেলেগুলো খান বাড়ির বাগানের দিকটায় দেখেছিল মায়া। হেনা খানের সাথে ফাহাদের মাকে দেখেছিল কিচেনে সার্ভেন্ডদেরকে রান্নায় সাহায্য করতে। বাকি রইল মায়া সে একাই আপাতত খান বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে। আশেপাশে মানুষের উপস্থিতির শব্দ মায়া পাচ্ছে কিন্তু মায়ার পাশে কেউ নেই। নিঃসঙ্গ মায়া অতিষ্ঠ হয়েই একটা সময় সোফায় বসে মুচড়া মুচড়ি শুরু করলো বিরক্তিতে। কি করবে ভেবে না পেয়ে খাবার দিকে তাকাল। খাবে কি খাবে না তা নিয়েও দ্বিধায় ভোগলো। মায়া নিজের বাসায় থাকলে এতক্ষণে সবগুলো নাস্তাই মায়ার পেটে চালান হয়ে যেত কিন্তু বোনের শশুর বাড়িতে ভদ্রতা দেখাবে নাকি খাবে তাই নিয়েও ভাবলো। খুব জোর করে মনকে বুঝালো না থাক, মায়া এই মূহুর্তে ভদ্রতা দেখাবে না খেয়ে। মায়ার চিন্তা ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ধুপ করে মায়ার গা ঘেঁষে বসল চেপে। হঠাৎ বসার দারুণ মায়ার বাহুর সঙ্গে বাহু আর উরুর সঙ্গে উরুর ঘষা লাগতেই চমকে উঠে মায়া পাশে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মায়ার নাক, মুখ ভারি খেল রিদের বাহুতে। সিগ্ধ মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে ভাজতেই শরীর শীতল হয়ে আসল মায়ার। রিদের হঠাৎ উপস্থিতে থমকে যাওয়ার মতোন কয়েক সেকেন্ড থ মেরে রইলো। একটা সময় হুশে ফিরতে ধড়ফড়িয়ে রিদের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইলে তৎক্ষনাৎ গায়ের কাপড়ে টান খেয়ে আবারও জায়গায় বসে পড়লো মায়া। অস্তিত্বের মায়া তৎক্ষনাৎ নিচে তাকিয়ে লক্ষ করতে বুঝতে পারল মায়ার ওড়নাসহ চুরিদার ফ্লকের কিছু অংশে রিদ বসে আছে গা এলিয়ে সোফায়।

আতঙ্কিত মায়া রিদের এতো কাছে বসে থাকতে অস্থির নেয় ছটফট করে টানাটানি শুরু করলো নিজের কাপড় রিদের নিচ হতে ছাড়াতে। রিদ মায়া দিকে তাকাল না। আর না মায়া কাপড় ছাড়ল বসা থেকে। বরং গা এলিয়ে সোফায় বসল। ভাবখানা এমন রিদের পাশে আপাতত কেউ নেই। আর না রিদ কাউকে দেখতে পারছে। তখনই রিদ গলা ছেড়ে হেনা খানকে ডেকে বলল ‘রিদকে পুনরায় কফি দিতে! রিদ হেনা খানকে ডাকায় অধৈর্য্যের নেয় অস্থির হলো মায়া। হেনা খান ওদের দুজনকে খোলামেলা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকতে দেখলে নিশ্চয়ই খারাপ ভাববে মায়াকে। অস্থির মায়া নিজের কাপড় দু’হাতে টেনে রিদের উদ্দেশ্যে ছোট গলা বলল….

‘ ছাড়ুন!!

মায়ার ছোট গলায় রিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মায়ার দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখাচোখি হলো অস্তিত্বে মিইয়ে যাওয়ার মায়ার দুচোখের সাথে। জড়তার মায়া প্রথমবারের মতোন রিদকে এতো কাছ থেকে লক্ষ করলো। রিদ খান আসলেই সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়, বলতে গেলে বাড়াবাড়ি রকমের আর্কষণে সুন্দর লোক এই রিদ খান। সবচেয়ে সুন্দর এই লোকের চোখ। গুরুগম্ভীর আর মারাত্মক নেশালো। জবান নয় যেন চোখ কথা বলে তাঁর। এই যে সদ্য গোসল করে আধ ভেজা চুলে আর গায়ে, চলে এসেছে এতে রিদকে আরও সচ্ছ আর সিগ্ধ সুন্দর লাগলো মায়ার চোখে। এই যে রিদের ঘাড় বেয়ে নামা ফোঁটা পানিতেও মায়ার চোখ গেল। বুকের পাশের হাল্কা ভেজা কালো টি-শার্টেও তো প্রথম নজর পরেছিল মায়ার। লোকটা আসলেই সুন্দর শুধু একটু বদমেজাজির রাগটা আছে। সেটা ছেড়ে দিলেই একদম পারফেক্ট লাগতো। রিদ মায়াকে মনোমুগ্ধের নেয় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার কপালে ভাজ শিথিল হলো তখনই। মায়ার ধ্যান ভাঙ্গতে তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ নজর দিয়ে লাভ নেই। আমি অলরেডি বুকড বিয়াইন!

রিদের কথায় থতমত খেয়ে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি লুকাতে আশেপাশে তাকাল মায়া। চুরি ধরা পরার মতোন অস্তিত্বে মিইয়ে আবারও নিজের কাপড় টেনে রিদকে বলল…

‘ ছাড়ুন প্লিজ!!

রিদ ভ্রুর উঁচিয়ে তাকাল প্রশ্নোত্তর দৃষ্টিতে। মায়া রিদকে নড়তে না দেখে ফের নিজের কাপড় টেনে তাকাল রিদের দিকে। চোখাচোখি হয়ে যেতেই মায়া নিজের দৃষ্টি নিচে করে ফের কাপড় টেনে বলল…

‘ কি হলো ছাড়ুন প্লিজ!!

‘ এখনো তো ধরতেই পারেনি। ছাড়ব কখন? তাছাড়া আপনি আমার বাড়িতে কি করেন? শুনলাম আপনি নাকি আমার নতুন বিয়াইন হয়েছেন? কথাটা কি সত্য???

‘ হুমমম!

‘ তাহলে শুনেন সলিড একটা কথা বলি। আপনি দরদ দেখিয়ে দুলাভাইয়ের ভাই মনে করে আমাকে ছেড়ে দিলেও আমি ফাহাদের শালী মনে করে আপনাকে কখনোই ছাড়ব না। এর জন্য আপনার জাতির ভাইকেও আমি দেখে নিব সমস্যা নেই। আর রইল আপনার কথা! তাহলে প্রথমে বলি রাখি, বোনের শশুর বাড়ির মনে না করে নিজের শশুর বাড়ির মনে করেও চলতে পারেন এতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার অতিরিক্ত টইটই নিয়ে সমস্যা আছে। দুলাভাই বা আদাস পাবলিক যাদেরকে আপনি নতুন নতুন বিয়াই বলে চিনেন আপাতত তাদের সাথেও ঘুরাঘুরি নিষেধ। মানে হেলদি দূরত্ব বজায় রাখবেন তাদের সাথে। নয়তো ঐ যে বললাম সবাইকে দেখে নিব। সে-দলে আপনি থাকবেন কিন্তু। আরেকটা কথা নাইস কালার! কালো রংটা বেশ মানিয়েছে আপনার সাথে। আই লাইক ইট! তবে নেক্সট টাইম লালের সাথে লাল পরবেন। তাহলে আরও সুন্দর দেখাবে।

লাস্ট কথাটা দুষ্টুমির ছলে বলেই সামনে ঘুরে গেল রিদ। হতবাক মায়া হতবুদ্ধি হয়ে থ মেরে বসে রইল। প্রথম রিদের হুমকি ধামকি গুলা মাথায় আসল না। সে কেন নিজের দুলাভাই বা বিয়াইদের কাছ থেকে দূরে থাকবে তাও এই লোকের কথায়? বোনের শশুর বাড়িতে এসেছে বিয়াইদের সাথে আড্ডা দিবে এটাই স্বাভাবিক তাই না? সে কেন রিদ খানের কথা শুনতে যাবে আশ্চর্য? তাছাড়া এই লোকের চোখেও সমস্যা আছে। মায়া এই মূহুর্তে টকটকা লাল রঙ্গা ড্রেস পরে আছে অথচ এই লোক বলছে মায়াকে কালো রঙ্গে মানিয়ে বেশ? আজব পাবলিক ঠিকঠাক কালার চেনে না হুহ। হেনা খান এগিয়ে আসতে দেখে মায়া আস্তে করে সরে বসল। কারণ ততক্ষণে রিদ মায়া কাপড় ছেড়ে দিয়েছিল। হেনা খানের আসার প্রায় সাথে সাথে জুই আর সেঁজুতিও উপস্থিত হলো সেখানে। মায়ার পাশে জুইকে বসতে দেখে রাগে মুখ বাঁকাল মায়া। জুই মায়া মাথায় টুকা দিতেই চোখ গরম করে তাকাতেই জুই আবারও মায়ার মাথা গাট্টু মেরে বলল…

‘ বলদি তোর কালো ফিতা দেখা যাচ্ছে কাঁধে। সেটা ভিতরে ঢুকা নয়তো কারও চোখে পরবে।

জুইয়ের কথা আকাশসম চমকিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকাল রিদের দিকে। তারমানে এই লোক তখন মায়াকে এই কালো ফিতার জন্য বলেছিল মায়াকে কালো রঙ্গে সুন্দর লাগছে? গাঢ় লজ্জায় তখনই মিইয়ে গেল মায়া। অথচ রিদ খান মায়াকে এতোবড় কথা বলেও দিব্যি সে তার কফির মগ চুমুক দিতে ব্যস্ত। পাশেই হেনা খান অনেক কিছু বলছে তাঁকে। সে হ্যাঁ না উত্তর করছে না। শুধু গম্ভীর চিত্তে শুনে যাচ্ছে।

#চলিত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here