রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া
১৯
সকাল আটটা! দিনটা মুক্তার বিয়ের পরদিন। নতুন বউকে নিয়ে রান্না ঘরেই পারভীন শেখ। আশেপাশে সার্ভেন্ট আছে আরও দুজন। একজন তরকারি কুটছে তো অন্যজন রুটি বানাচ্ছে। মুক্তা ঘোমটা মাথায় শাশুড়ী পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির মানুষের জন্য চা বানাচ্ছে। পারভিন শেখ রুটি তেলে ভেজে সেটা আবার শেকে দিচ্ছে আগুনে পুরে। বিয়ে বাড়িতে মেহমান আছে সবাইকে নাস্তা দিবে বলেই তোড়জোড় করে সবাই ব্যস্ত হাত চালাচ্ছে কাজে। তবে মুক্তাকে কেউ বলেনি রান্না ঘরে আসতে বরং না আসতে নিষেধ করেছিল পারভিন শেখ। মুক্তা নিজ থেকেই সেধে এসেছে শাশুড়ীকে কাজে সাহায্য করতে। নতুন বউ হয়ে কিভাবে অসুস্থ শাশুড়ীকে কাজ করতে দেখেও বসে থাকবে সে? বড্ড বেমানান হয়ে যায় না? তাছাড়া বাড়ির মানুষজন বিশেষ করে মুক্তা মা পইপই করে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে শশুর বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠার আগেই যেন মুক্তা রান্না ঘরে উপস্থিত থাকে। অসুস্থ শাশুড়ীকেও যেন হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে। মুক্তা বরাবরই নরম ও বুঝদার মেয়ে। বড়রা যাহ বলবে তাই করে। এজন্য পারভিন শেখের বারবার নিষেধ করা শর্তেও রান্না ঘর থেকে যায়নি মুক্তা। শাশুড়ী প্রথমে বলেছিল উনার ছেলেকে সময় দিতে। ফাহাদ কাল বাদে পরশু সিঙ্গাপুর চলে যাবে বাবাকে নিয়ে, ফিরবে কখন? তার ঠিক নেই। তাই ছেলের আশেপাশে থাকতে বলছে। কিন্তু মুক্তা নরম গলায় পারভিন শেখ জানায়, ফাহাদ এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতে আরও ঘন্টা দুয়েক সময় নিবে। ছেলের ঘুমের কথা শুনেই চুপ করে যান পারভিন শেখ। মুক্তাকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করেই থমথমে খেয়ে চুপচাপ ফের হাতের খুন্তিতে পুরোটা ভাজেন। মৃদু স্বরে আদেশ করেন তিনি ‘ তাহলে তুমিও গিয়ে ঘুমাও। আমি সার্ভেন্ড দিয়ে খাবার রুমে পাঠিয়ে দিব যাও।
শাশুড়ীর কথায় বেশ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা ঘুমটা টেনে জড়তা চোখে এদিকসেদিক তাকাল মুক্তা। তখনই চোখাচোখি হলো তরকারি কুটতে থাকা কাজের মহিলা ফুলমতি সঙ্গে। অর্ধবয়স্ক ফুলমতি ওকে দেখেই মিটমিট হাসছিল। সেজন্য ইতস্ততায় জড়িয়ে মুক্তা শাশুড়ী দিকে ঘুরে গিয়ে মিনমিন গলায় বলল ‘
‘ আমি আপনার পাশে থাকি আম্মু। আমার সকালে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।
আর কিছুই বলল না পারভিন শেখ। চুপচাপ নিজের কাজে হাত চালাল। শাশুড়ীর নিরব সম্মতি দেখে মুক্তা চায়ে কিটলিতে হাত বাড়াল। সত্তরে ঊর্ধ্বে বয়স্ক হেনা খানও বসে নেই। তিনি মূলত ডাইনিংয়ে খাবার রাখছে একে পর এক। পাশেই সার্ভেন্ট রুপি অল্প সময়ী মালা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে উনাকে সাহায্য করতে। তক্ষুনি দেখল রিদকে ফরমান ড্রেসআপে সিড়ি বেয়ে নামতে। হেনা খানের চোখ সেদিকে পরতেই রিদকে ডাকল নাস্তা করতে। রিদ হাত ঘড়িতে সময়টা এক পলক দেখে নিয়ে ড্রয়িংরুমে মেইন দরজা দিকে যেতে যেতে বলল…
‘ এখন না দাদী! একটু পর! আয়ন আসছে জরুরি কাজে। সেটা শেষ করেই করব।
হেনা থেমে যায়। শুধু বলল…
‘ তাহলে কফি করে দিব তোকে? খাবি? পাঠাবো?
রিদ চলে যেতে যেতে বলল..
‘ পাঠাও।
~~
সকাল সকাল খান বাড়ির বাগানে বিচরণ মায়ার। নতুন বাড়ি! নতুন পরিবেশ দেখে রাতেও তেমন ঘুম হয়নি। এজন্য সকল সকাল ঘুম থেকে উঠেই খান বাড়ির বাগানে হাটাহাটি করতে চলে এসেছে। খান বাড়ির বাগানটা বেশ মনে ধরেছে মায়ার। বেশ সুন্দর আর পরিপাটি। বাগানে মাঝে একটা ছোটখাটো বাংলোও দেখেছে মায়া। খোলা বাংলোতে আবার আধুনিকা সোফাও ফেলে বসার মতোন সুন্দর পরিবেশ করে রেখেছে খান বাড়ির মানুষ। মায়া আর সেদিকটায় যায়নি। বরং উল্টো পথে হাঁটল। বাগানের মালিদের বাগান চর্চার কাজ করতে দেখা গেল সেদিকটায় এগোতে চাইল মায়া। অল্প এগোতে দেখল আরাফ খানকে। তিনি সাদা ফতুয়া গায়ে জড়িয়ে হাতে লাঠিভর করে দাঁড়িয়ে বাড়ির মালিদের এটা সেটা আদেশ করছে বাগানে পরিচর্যায়। উনাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ বিরক্ত মালিদের উপর তিনি। মায়া আরাফ খানকে এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছিল। কথাও হয়েছে দুজনের টুকটাক। তবে বেশিভাগ সময়ই মায়াকে মজার ছলে হেনস্ত করেছেন তিনি। এই যেমন কাল যখন জানতে পারলো মায়াই মুক্তার বোন হয়, তক্ষুনি বেশ রসিয়ে মজা করেছিল মায়া সঙ্গে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিখ্যাত ঝগড়ার খেতাব নিয়ে। মায়া অবশ্য হুম হ্যাঁ তেমন কিছুই বলেনি বিয়ে বাড়ির মানুষজন দেখে। কিন্তু আজ মায়া নিজ থেকেই আরাফ খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। আরাফ খানকে অনুসরণ করে সেদিকে পা বাড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে পরলো পায়ের নিচে ইট বেজে। বাগানের ইটের সরু রাস্তায় পরে যাওয়ায়, দু’হাতের কুইন আর দু’পায়ের হাঁটু জ্বিমজ্বিম করে উঠল তক্ষুনি ব্যথা দিয়ে। কেউ দেখা আগে তাড়াহুড়ো উঠে বসল মায়া। লং হাতার চুরিদার জামার উপর দিয়ে একহাতে অন্যহাতের কুইন চাপলো ব্যথায়। মুখ কুঁচকে, ইস, ইস করে বুলি আওড়িয়ে হাতের তালুতে কুইন ঘষতেই, তক্ষুনি মুখের সামনে বাড়াল কারও পুরুবেষ্টি শক্তপোক্ত হাত। মায়া চমকে মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পরলো কুঁচকানো দুটো চোখে শীতল দৃষ্টি। অসময়ে হুটহাট অপরিচিত মানুষের সামনে মুখ থুবড়ে পরে যাওয়ায় মায়ার ইজ্জত লাগল বেশ। কিন্তু তারপরও তব্দা খেয়ে যাওয়ার মতোন করে থমথমে মুখে চেয়ে রইল শ্যামবর্ণের পুরুষটির দিকে। অপরিচিত লোকটিকে মায়ার বেশ পরিচিত মনে হলো। কিন্তু কোথায় দেখেছে লোকটাকে, সেটা মনে করতে চেয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে সে। তক্ষুনি গম্ভীর মুখ খুলল শ্যামবর্ণে লোকটা। নিজের হাত হাল্কা নাড়িয়ে মায়াকে বলল…
‘ কি হলো মিস? ওঠে আসুন। এইভাবে বসে থাকলে অবশ্যই আশেপাশের সবাই জেনে যাবে আপনি নিজের পায়ে সঙ্গে বেজে পরে গেছেন৷ তখন সেটা শুনতে ভালো দেখাবে না। বিষয়টা লজ্জা জনক হতে পারে আপনার জন্য। তাই কেউ দেখার আগেই আপনার আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ানো উচিত।
আমতাআমতা করে অপরিচিত লোকটার হাত চেপে উঠে দাঁড়াল সে। লজ্জায় জড়িয়ে আমতাআমতা করে ধন্যবাদ জানাল ছোট করে। লোকটা মায়া দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে হাতের ঘড়ির সময়টা দেখে নিল। তারপর পকেটে দুটো হাত গুজে দিতে দিতে বলল…
‘ আমি যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি ফাহাদে শালী হবেন রাইট?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। তবে পর মূহুর্তে প্রশ্ন করে বলল…
‘ আপনি কিভাবে বুঝলেন?
‘ আন্দাজে ডিল মেরেছিল। তবে সঠিক হয়ে গেল। সম্পর্কে আপনি আমার বিয়াইন হোন৷ সেই সুবাদে আপনাকে একটা ভালো পরামর্শ দেয় ফ্রীতে। এইভাবে হুটহাট পাবলিক প্লেসের পরে যাবেন না কেমন। হাঁটতে না জানলে রোজ সকালে নিময় করে হাঁটাহাটি করবেন, দেখবেন একদিন ঠিকঠাক হাঁটতে শেখে গেছেন। তারপরও এইভাবে হুটহাট পাবলিক প্লেসের সুন্দরী মেয়েদের পরে যাওয়া নিষেধ মনে থাকবে??
মায়া কি হলো কি জানি। লোকটির কথায় সুন্দর করে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। সুন্দর মুখের লোকটার এদিকসেদিক তাকাল। তারপর আবার মায়ার দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো ফের সময় দেখে বলল…
‘ সম্পর্কে যেহেতু বিয়াইন হয়েছেন তাই আমাদের আবারও দেখা হবে। আবার বলতে বারবার দেখা হওয়ারও চান্স আছে। এখন আসি। তবে আমার কথা গুলো মনে রাখবেন কেমন?
মায়া সুন্দর করে সম্মতি স্বরুপ ঘাড় কাত করতেই লোকটা তাড়াহুড়ো মায়াকে পাশ কাটিয়ে সামনে দিকে পা বাড়াল। কি মনে করে লোকটা ফের পিছন ফিরে তাকাতেই মায়ার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মায়া লজ্জা মিইয়ে যেতেই লোকটা তাড়াহুড়ো মায়াকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল…
‘ আর হ্যাঁ! ঐ যে বললাম সুন্দরী মেয়েদের হুটহাট রাস্তায় পরে যেতে নেই সেটাও কিন্তু মনে রাখবেন বুঝেছেন?
মায়া এবারও লজ্জিত মুখে সম্মতি স্বরুপ ঘাড় কাত করল মৃদুস্বরে আওড়াল..
‘ জ্বি আচ্ছা!
তাড়াহুড়োই আয়ন কয়েক কদম এগোতেই হঠাৎ সম্মুখে পরলো জুই। অল্পের জন্যে দুজনের শরীর স্পর্শ লাগেনি এর আগেই সর্তক সহিত ছিটকে সরলো জুই। পথে বিঘ্ন ঘটায় বিরক্তি সহিত তাকাল আয়ন। চোখে বাজল জুইয়ের সহ্য ঘুম থেকে উঠা সিগ্ধ মুখটা। কপাল কুঁচকে জুইকে এক পলক দেখেই তৎক্ষনাৎ পিছনে তাকাল আয়ন মায়ার উদ্দেশ্য। ততক্ষণে মায়াকে দেখা গেল আরাফ দিকে হেঁটে যেতে। জুই অনুতপ্ত গলায় শুধালো…
‘ সরি ভাইয়া। আমি আসলে আপনাকে…
জুইয়ের কথার মাঝেই আয়ন ঘুরে তাকাল ওর দিকে। জুইকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল আয়ন…
‘ দুজন কি টুইনস?
আয়নের প্রশ্ন বুঝতে না পেরে অবুঝ গলায় শুধালো জুই…
‘ জ্বি??
আয়ন কি মনে করে আবারও পিছন ঘুরে তাকাল মায়ার দিকে। মায়াকে দেখা গেল আরাফ খানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলতে। খুব স্বাভাবিক নেয় আয়ন সেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল জুইয়ের কৌতুহল ভরা মুখটার দিকে। আয়ন আবারও শিওর হওয়ার জন্য বলল…
‘ আমি যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি ফাহাদের দ্বিতীয় শালী আর মায়ার বোন রাইট?
কৌতুহলী জুই হতবাক স্বরুপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। অপরিচিত একটা ছেলেকে নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে পেরে বিস্মিত হলো। আবাক স্বরে প্রশ্ন করল জুই..
‘ আপনি মায়াকেও চিনেন? কিভাবে?
দারুণ হাসল আয়ন। রিদকে দেখলো খান বাড়ির ভিতর থেকে বের হতে। সেদিকে পা বাড়াতে চেয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় আদেশ জাড়ি করলো জুইয়ের উদ্দেশ্য। বলল…
‘ যানতো বিয়াইন সাহেবা আমার জন্য এক গ্লাস পানি আর একটা হট কফি নিয়ে আসেন। আজ সকাল সকাল কাজের তাড়াহুড়ো বের হয়ে পরেছিলাম তাই কিছুই খাওয়া হয়নি আমার। তবে হ্যাঁ! পানিটা অবশ্যই কুসুম গরম পানি নিয়ে আসবেন কেমন। আমার গলায় সমস্যা হচ্ছে এজন্য গরম পানি পান করতে হচ্ছে। যানতো দ্রুত নিয়ে আসেন।
গমগমে আদেশ করেই আয়ন রিদের দিকে আগালো। হতভম্ব জুই হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইল আয়নের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। চিনা নেই, জানা নেই, একদম অপরিচিত একটা লোক এসে এমন ভাবে জুইকে কাজের আদেশ করল যেন শত যুগ ধরে জেনা মানুষটি জুইয়ের। অথচ জুই যে এই বাড়িতে নতুন মেহমান সেদিকেও খেয়াল করলো না লোকটা। এখন জুই গিয়ে কাকে বলবে গরম পানি আর হট কফি দিতে? যদি কেউ জিগ্যেসা করে, কার জন্য এসব, তাহলে কি নাম বলবে জুই? লোকটার নামটাও তো জানে না জুই। খান বাড়ির সাথে লোকটার কি সম্পর্ক সেটাও বুঝতে পারছে না। তবে লোকটা যে ফাহাদের ভাই টাইপের কিছু একটা হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছে কিছুক্ষণ আগের জুইকে বিয়াইন সাহেবা বলে সম্মোধন করা কথায়। জুইকে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ন ফের চলে যেতে যেতে তাড়া দিয়ে বলল…
‘ কি হলো জুই দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমাকে নিয়ে পরে ভাববেন এখন দ্রুত যান। আমার মাথা পেইন দিচ্ছে আপনার কফির জন্য।
হতবাক জুইয়ের বিস্মিতা আকাশ ছুলো আয়নের কথায়। লোকটা জুইয়ের নামও জানে? সর্বনাশ!
হতবুদ্ধি জুই তৎক্ষনাৎ ছুটল বাড়ির ভিতর দিকে। ফিরে এলো ট্রেতে করে কুসুম গরম পানি আর হট কফি নিয়ে। ততক্ষণে আয়ন রিদের সাথে কথায় ব্যস্ত। জুই ইতস্ততা বোধ করে সেদিকে আর আগালো না। বরং রিদের ছেলেদের একজনকে ডেকে ট্রে তুলে দিল তাদের হাতে আয়নকে দিতে। ছেলেটির কফির ট্রে হাতে নিতেই তৎক্ষনাৎ বাড়ির দিকে দৌড়াল জুই। আপাতত সেঁজুতি রুমটা জুইয়ের স্বস্থির মনো হলো।
~
মোটর পাইব হাতে চেপে দাঁড়িয়ে মায়া। উদ্দেশ্য বাগানের চারাগাছে পানি দিবে। কিন্তু হঠাৎ করে মোটর পুড়ে যাওয়ায় হতাশ মায়া। সেজন্য লাল ছোট বালতি হাতে বাগানের একপাশের মোটরকল থেকে পানি সংগ্রহ করতে সেদিকে গেল। দু’জন মালির দেখাদেখি সেও টিউবল চেপে বালতি ভরলো পানিতে। দু’হাতে বালতি আগলিয়ে টেনে কিছুপথ যেতেই কোথাও থেকে দৌড়ে এগিয়ে আসল সেই তপু নামক দামড়া ছেলেটি। ভাবি, ভাবি বলে মায়াকে সম্মান দেখিয়ে জোরপূর্বক বিনিত সহিত মায়ার হাত থেকে বালতিটা নিজের হাতে নিলো। থমথমে মুখের মায়া চুপ করে গেল তপুর মুখে ভাবি ডাকটা শুনে। সর্তক চোখে আশেপাশে তাকাল কেউ শুনে নিয়েছে কিনা দেখতে। মায়ার ভয়, পাছে যদি কেউ শুনে নেয় মায়াকে এতো বড় দামড়া ছেলে ভাবি ভাবি ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে তাহলে নিশ্চয়ই বিষয়টা দৃষ্টিকুটু দেখাবে নতুন আত্মীয়দের মাঝে। মুক্তার কানে যেতে পারে সেই ভয়ও করলো মায়া। তাছাড়া এখনকার সবাই জানে মায়ার এখনো বিয়ে হয়নি। এখন কোন জাতীর ভাইকে জড়িয়ে এই দামড়া ছেলেগুলো মায়াকে এতো এতো সম্মান দেখায় সেটাও তো মায়া জানে না। সেজন্য মায়া কথা না বাড়িয়ে সর্তক সহিত এদিকসেদিক তাকাতেই চোখে পড়লো কিছুদূর বসা রিদকে। মায়ার দিকেই কপাল কুঁচকে তাকিয়ে। নিশ্চিত শুনেছে তপু নামক ছেলেটিকে মায়াকে ভাবি ডাকতে। মায়া খানিকটা থমথমে খেয়ে যায় রিদের সাথে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যেতে। আবার কি মনে করে মায়া বেশ সাহসী হয়ে বুক ফুলিয়ে রিদের দিকে গর্বিত চোখে তাকাল। নাক ফুলিয়ে রিদকে ভাব দেখিয়ে বুঝাতে চাইল মায়া এখন জাতির ভাবি। ওর পিছনে জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত আছে সেটা। মায়া রাতেই যে রিদকে ছোটখাটো হুমকি দিয়েছিল জাতির ভাইয়ের লম্বা হাত দিয়ে রিদকে ঘায়েব করে দিবে, সেটা সকালেই সত্যি হলো তপুর ছেলেটার এতো সম্মান দেখিয়ে ভাবি ডাকায়। এখন নিশ্চয়ই এই রিদ খান মায়ার পিছনে আর লাগবে না? ভয় পাবে ওকে? নয়তো এই লোকটা যে সবসময় মুখ বাঁকিয়ে থাকে মায়াকে অপমান করার সেটা আজ বুঝবে মায়ার কতো সম্মান আছে সকলের সমানে। আর যায় হোক জাতির ভাই অন্তত একটা উপকার করেছে মায়ার জীবন এসে। এই যে মায়া এখন রিদ খানকে নিভয়ে নাক দেখিয়ে চলবে সেটাতো একমাত্র এই জাতির ভাইয়ের জন্যই হলো তাই না? এজন্য তো অন্তত মায়ার উচিত এই জাতির ভাইকে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার। ক্ষমতাসীন মায়া নিজের ভাবনা ছেড়ে রিদকে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল তপুকে অনুসরণ করে। মনে মনে শপথ করলো আজ থেকে সে এই রিদ খানকে ভুলেও ভয় পাবে না। কারণ রিদ খান থেকে মায়ার ক্ষমতা অনেক বেশি। মায়া কতো সম্মান এই দামড়া দামড়া ছেলেগুলোর সামনে। সেটা বুঝাতে হবে না এই রিদ খানকে? এখন মায়াকে অকারণে ভয় পেলে চলবে? ভুলেও চলবে না। হু! মায়া কি মনে করে চলে যেতে যেতে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিদের দিকে তৎক্ষনাৎ চোখ মিলল দুজনের। রিদ তখনো আগের নেয় কপাল কুঁচকে তাকিয়ে মায়ার দিকে। রিদের সাথে ফের চোখ মিলতেই মায়া আবারও মুখ বাঁকাল রিদকে। তক্ষুনি শুনা গেল কারও ঝনঝনে মুক্ত হাসির শব্দ। মায়া চমকে উঠে পাশের তাকাতেই দেখল সকালের সেই শ্যামবর্ণের ছেলেটি রিদের পাশে বসে আছে মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লজ্জায় মায়া তৎক্ষনাৎ ছুটে পালাল আরাফ খানের কাছে। তক্ষুনি আয়ন বলল…
‘ বাহ! বিয়াইন সাহেবা তো ভালোই মুখ ভেঙ্গাতে পারে। তা তোর প্রতি এতো মেহেরবানির কারণ কি?
‘ আপাতত আমি তার শত্রু পক্ষের আছি তাই।
‘ আচ্ছা এই ব্যাপার? পরিচয়টা দিয়ে দে তাহলেই তো হয়।
রিদের মুখটা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে উঠল। অল্প কথায় বলল…
‘ নো নিড!
কথাটা শেষ করে ফের রিদ চোখ তুলে তাকাল মায়ার দিকে। দূর পথে দেখা গেল মায়াকে বালতি থেকে মগে করে বাগানের চারাগাছে পানি দিতে আরাফ খানের সঙ্গে। ইতিমধ্যে যে আরাফ খানের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে মায়ার সেটা বেশ চোখে পরলো রিদের। মেয়েটার সবার সাথেই সহজে মিশতে পারে অথচ রিদের বেলায় এলেই যতো মিথ্যা থাকে রিদকে বলে বেড়ায়। তাহলে সেখানে রিদ কেন যেচে নিজের পরিচয় দিতে যাবে? রিদকে কি দিয়েছিল এই মেয়ে নিজের পরিচয়? নাকি বিয়ের রাতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বলে পালিয়ে ছিল? হয়তো আজও দুজন দুজনের পরিচয় মিলতো না যদি না রিদের মন শ্রায় দিতো এই মেয়েকে নিয়ে। দেখা যেত আজীবন স্বামী স্ত্রী হয়েও কখনো নিজেদের পরিচয় মিলতো না। বরং সামনে থেকেও দূর হয়ে যেত একে অপরের। না ডিভোর্স হতো আর না সংসার। এই মেয়ে যখন ঝুলন্ত অবস্থায় নিজেকে রাখতে পছন্দ করে, তাহলে রিদ কেন আগ বাড়িয়ে যাবে নিজের পরিচয় দিতে? থাকুক আজীবন ঝুলন্ত অবস্থায়! রিদ কখনো বলবে না সে কে? কি তার পরিচয়? যদি এই মেয়ে তাঁকে খোঁজে বের করতে পারে তখন দেখা যাবে কি করার যায় এই সম্পর্কটা নিয়ে। ততদিন থাকুক যেমনটা চলছে তেমন।
রিদ নিজের চিন্তা ভাবনায় আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। মায়া আরাফ খানের সঙ্গে চারাগাছে পানি দিয়ে বসল বড় ছাতার নিচে। চেয়ারে পা বুঝিয়ে বসতেই সেখানে আগমন ঘটল মালার। হাতে মায়া আর আরাফ খানের জন্য নাস্তার ট্রে। টেবিলের উপর রেখে মালা আরাফ খানের উদ্দেশ্য জানায়, সকালের চা নতুন বউ মানে মুক্তা বানিয়েছে সবার জন্য। মালা চলে যেতে আরাফ খান গলা ছেড়ে রিদকে নিজের কাছে ডাকল। রিদ ততক্ষণে আয়নের সাথে বাড়ির ভিতরের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু আরাফ খানের ডাকে পিছন ঘুরে তাকাল। সেদিকে যেতে না চেয়েও রিদ কি মনে করে পা বাড়াল আরাফ খানের উদ্দেশ্য। আয়ন রিদের পিছনে না গিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে হাঁটল হেনা খানের সঙ্গে দেখা করতে। রিদকে আসতে দেখেই ভারি নিশ্বাস ফেলল আরাফ খান। নাস্তার ট্রের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় মায়াকে বলল…
‘ বুঝলে মায়া, দিন দিন আমার রিদটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে তারপরও বিয়ে করতে চাচ্ছে না। এজন্য না পেরে ছোট ভাই ফাহাদকে বিয়ে করালাম আমরা, তাও তোমার বোনের সঙ্গে। এই রিদটা যদি বুঝতো! তাহলে আজকে নাস্তার টেবিলে চা সাথে গরম গরম পিঠাও খেতে পারতাম ওর বউয়ের হাতের। কতো সুবিধা হতো আমাদের বলো।
আবারও হতাশার ভারি নিশ্বাস ফেলল আরাফ খান। যেন এই মূহুর্তে উনার মতো দুঃখী মানুষ দুটো আর এই ধরণীতে নেই। মায়ার ও বেশ মায়া হলো আরাফ খানের কথায়। বুড়ো মানুষের এতো দুঃখ থাকতে নেই। এতে মায়ার কষ্ট হয়। ততক্ষণে রিদও মায়ার পাশের চেয়ারটা টেনে আরাফ খানের মুখোমুখি হয়ে বসল। আরাফ খানের নাটকীয় কথা সবই তার কানে এসেছে। সেজন্য বসতে বসতে বলল…
‘ সব ফালতু কথা!
রিদের অল্প কথায় যেন আহাজারি করে উঠল আরাফ খান। মায়ার কাছে ফের ভারি দুঃখ প্রকাশ করে বলল…
‘ দেখেছ নাতনী? ওর বিয়ের কথা বললে সব ফালতু হয়ে যায়। আর ওহ যে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে বিয়ে না করায় সেটা ওর চোখ পরে না। আচ্ছা তুমিই বলো ওকে দেখতে শুকনো শুকনো লাগছে না তোমার কাছে?
আরাফ খানের কথায় তক্ষুনি মায়া কৌতুহল ভরা দৃষ্টিতে তাকাল রিদের দিকে। রিদ কিছু বলবে তার আগেই এক অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল মায়া। হাত বাড়িয়ে রিদের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। এদিকসেদিক ঘুরিয়ে রিদের মুখে জহরী দৃষ্টিতে পরখ করে মায়া আরাফ খানকে বলল…
‘ হ্যা একটু একটু শুকনা লাগছে দেখতে নানাভাই।
মায়া রিদের থুতনি ছেড়ে দিতে থমথমে খেয়ে বসল রিদ। মায়া হঠাৎ এমনটা করবে তার ধারণাতেও ছিল না। তবে আরাফ খান দারুণ মজা পেল। তিনি একগাল হেঁসে উঠতেই রিদ চাপা স্বরে মায়া ধমকে শুধালো…
‘ স্টুপিড! ওটা রোদে শুকিয়েছে।
মায়া কিছু বলবে তার আগেই আরাফ খান মায়ার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে উৎসাহে বলল…
‘ আরেহ বাহ! তোমার সাথে দারুণ জমবে আমার। তবে তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি ভিতর থেকে আমার মেডিসিন গুলো খেয়ে আসছি। নয়তো গিন্নি আমার এক্ষুনি হাঙ্গামা শুরু করে দিবে।
মায়া ঘাড় কাত করে আরাফ খানকে সম্মতি দিতেই তিনি হাতের লাঠি ভর করে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে গেল। উনাকে যেতে দেখেই ভিতরে চেপে রাখা কথা গুলো রিদের উদ্দেশ্য বলল মায়া…
‘ আপনি আমাকে একদম ধমক দিবেন না। আমি কিভাবে বলবো কোনটা রোদে শুকিয়েছে আর কোনটা আপনার বিয়ে না করায় শুকিয়েছে? আমি কি আগে বিয়ে করেছি নাকি যে জানবো? আমার তো পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা নেই বুঝলেন?
মায়া ত্যাড়া কথায় রাগে দাঁত পিষল রিদ। বলল…
‘ আর আমিতো শত অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ব্যক্তি। এর আগে চার পাঁচটা বিয়ে করে অভিজ্ঞ হয়ে বসেছি।
রিদের কথায় মায়া সহমত প্রকাশ করে খোঁচা মেরে বলল…
‘ চার পাঁচটা বিয়ে তো করবেনই। এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? আপনার যে রাগ বউ ঠিকবে এই জীবনে আপনার? সবগুলা বউ তো এমনই চলে যাবে আপনাকে ছেড়ে। আমি আগেই ভেবেছিলাম আপনি এমন কিছুই করবেন। এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যান, তা নাহলে শুধু চার পাঁচটা বিয়ে কেন? এর পরে দশ-বারোটা বিয়েও করতে হবে যদি না শুধরান। তারপরও একটা বউ থাকবে না দেখবেন।
মায়ার কথায় রিদ চুপ হয়ে গেল। এই মেয়ে তার কথা কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে গেল। এখন রিদ কিছু বললে আরও উল্টো তাঁকেই পাগল বানাবে এই মেয়ে। তাই রিদ মায়ার কথায় মায়াকেই ফাঁসিয়ে দিয়ে বলল…
‘ যাক অবশেষে কেউ আমার দুঃখ বুঝলো। বুঝলেন বিয়াইন সাহেবা আমি সত্যিই অনেক দুঃখে আছি। আমার বউ থাকছে না আমার কাছে। বিয়ে করেও রাতে বউ ছাড়া ঘুমাতে হচ্ছে। এদিকে ছোট ভাই বিয়ে করে নিল। অথচ আমার বউ আমাকে এখনো স্বীকারই করতে চাচ্ছে না। উল্টো আমাকে তার শত্রু ভাবে। এদিকে শীতও চলে এসেছে। রাতে যে বউকে জড়াজড়ি করে ঘুমাব তারও কোনো উপায় নাই। আমি ভিষণ দুঃখে আছি বুঝলেন বিয়াইন। আপনি আমার জন্য একটা সঠিক বউ খোঁজেন তো। যে বউ মেন্টালি আধপাগল হবে। গেলুও কম থাকবে। বোকা চেহারা আর সরল হাসি থাকবে তার। আমিতো লম্বা মানুষ তাই বউটা খোঁজবেন ঠিক আপনার মতোন নাটু মেয়ে। আসলে ছোট বউকে কোলে তুলে কিস করার ফিলিংস আলাদা। আহা! আর এজন্য আমার ছোট বউই লাগবে কনফার্ম। তারপর এই যে আমার গায়ের রংটা হলো ফর্সা, এজন্য বউয়ের গায়ের রঙ মিলিয়ে হতে হবে হলুদ, একদম আপনার মতোন। তারপর এই যে আপনি আমার দিকে তাকান।
মায়ার থুতনি ধরে রিদ নিজের দিকে ঘুরিয়ে মায়ার নাক মুখ দেখিয়ে আবার বলল রিদ….
‘ এই যে আপনার মতোন নাক, ঠোঁট, মুখ, গাল, চোখের ভিতরের কালো তিল, একদম সবকিছু এই রকমের হলেই চলবে। তারপর এই যে ধরেন আমি যা বুঝাতে চাইবো বউকে সে ঠিক তার উল্টো বুঝবে একদম আপনার মতোন করে। আমার এই রকম গুণের বউই পছন্দ। যদি আপনার অনুসন্ধানে এমন মেয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন কেমন? আমি অপেক্ষায় রইলাম। আসলে শীত চলে এসেছে তো তাই বউটা খুব জরুরি। শীতের রাতের উমের একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না? আচ্ছা আমি এখন আসি তাহলে বিয়াইন! আপনি একটু খোজাখুজি করে দেখেন কোথাও আছে কিনা এমন মেয়ে, ততদিন না-হয় আমি আর একটু অপেক্ষা করলাম।
কথা গুলো বলেই রিদ জায়গায় ছাড়ল। মায়া রিদের চলে যাওয়ার দিকে কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইল। আসলে রিদের জন্য বউ খোঁজা নিয়ে একটু কনফিউজড সে। রিদ খান কি মায়াকে বউ খোঁজতে বলে গেল নাকি মায়ার পিছনে সরাসরি লাইন মারল? কোনো ভাবে কি রিদ খান মায়াকে নিজের পাত্রী হিসাবে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে গেল? কনফিউজডের মায়া ঠোঁট উল্টালো।
.
#চলিত…