রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ১২

0
775

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

১২
বিয়ের হৈচৈ মেতে থাকা পরিবেশটা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো নিদারুণ ভয়ংকর সংবাদে। মায়ার পরিবারের কাছে খবর আসলো মুক্তার শশুর বাড়ি থেকে। ফাহাদের বাবা-মা এক্সিডেন্ট করেছে কার সংঘর্ষে। আহত হয়েছে মুক্তার শশুর শাশুড়ীও ননদ- ননাসের সঙ্গে ডাইভারও। খবর পেয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে পরলো মায়ার পুরো পরিবার। সঙ্গে গেল মুক্তাসহ! আর বাসায় রেখ গেল শুধু জুই, মায়া,আর জুইয়ের মা জুহেরা বেগমকে। মায়ার মা-বাবা, চাচাসহ মুক্তাকে নিয়ে গেল আরিফ। নতুন আত্মীয়! তারপর আবার মুক্তার নিজের শশুর শাশুড়ী বলে কথা, এই মূহুর্তে তাদের পাশে থাকাটা জরুরি মনে হলো মুক্তার। সচ্ছ আলো নেয় প্রেমময় স্বপ্ন গুলো হঠাৎই অন্ধকারে গুটিয়ে গেল আপনজনদের অনাকাঙ্ক্ষিত এক্সিডেন্টে মুক্তা আর ফাহাদের জীবনে। দুজনের লুকায়িত প্রেমের সম্পর্ক ছিল ভার্সিটির জীবনে সিনিয়র জুনিয়র হয়ে। ফাহাদের ভার্সিটির লাইফ শেষ করা থেকে স্টাবলিশ হয়ে পারিবারিক ব্যবসায় জয়েন করা পযন্ত প্রায় চার বছর গড়ায় দুজনের প্রেমের সম্পর্কের। ততদিন সম্পর্কটা সবার কাছ থেকেই লুকায়িতই ছিল। দুই পরিবারের জানাজানি হলো মাস দুইয়েক আগে। মায়ার পরিবারের বড় মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি থাকলেও ছেলে হিসাবে ফাহাদকে বেশ মনে ধরায় কেউ আর বাঁধা দিল না তাদের। আপোষেই মেনে নিয়েছিল দুজনের প্রেম। দীর্ঘ অপেক্ষার ভালোবাসা পূর্ণতা পেত যাচ্ছিল আর পাঁচ পরেই কিন্তু হঠাৎ করেই যেন দুজনের গুছানো স্বপে ভাঁটা পরলো। এলোমেলো অগোছালো হলো সবটা। পূর্ণতা পাওয়া সম্পর্কটা আবারও মিইয়ে গেল। ফাহাদের পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য আবারও সবকিছু পিছালো। পাঁচ পর হওয়া বিয়েটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবারও দেড়মাস পরে ঠিক করলো পরিবার লোকজন। এমন পরিস্থিতিতে কারও কাছেই বিয়েটা ঠিক মনে হলো না তাই। মুক্তা বা ফাহাদ দুজনই নিরবে মেনে নিল বড়দের সিদ্ধান্ত। কারও কোনো আপত্তি রইলো না কোনো কিছুতে। দুজনের একই কথা! পরিবার আর ভালোবাসার মানুষ গুলো পাশে থাকলেই হলো তাদের বাকি যেকোনো পরিস্থিতি সামলে নিবে দুজন। কিন্তু মায়ার খুশি খুশি ফেসটা যেন হঠাৎই মুচড়ে গেল মুক্তার বিয়েটা পিছিয়ে যাওয়াতে। দুঃখে বেশ করে হায়-হতাশ হলো ফাহাদের পরিবারের জন্য। তারপর নিজের অবুঝ মনকে বুঝালো বিপদে শক্ত থাকতে হবে বলে। মায়া দুঃখ আর হতাশ ঘোটা একদিন চললো। তারপর দিনই সব ঠিক হয়ে গেল যখন শুনলো ফাহাদের বাবা-মা এখন ঠিক আছে, সুস্থ আছে। তাদের দুইদিন পরই হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দিবে বাসায়। এজন্য মায়ার মা,বাবা, আর চাচাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় আরিফ। মুক্তাকে নিয়ে সে হসপিটালের থেকে যায় ফাহাদের পরিবারের পাশে। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালনের জন্য। তবে মায়া পরিবার বাড়িতে আসলো আরও একদিন পর। মায়া তখনো বাড়ির চত্বরে। যেহেতু মুক্তা বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সেজন্য তাদের কালই চট্টগ্রামে চলে যেতে হবে বলে জানালো বাবা শফিকুল ইসলাম। মায়ার স্বস্তির থাকা ফেইসটা মূহুর্তে চুপসে যায় আবারও অপ্রিয় শহরে চলে যেতে হবে শুনে। মায়ার ইচ্ছে ছিল বাবাকে বলবে সে আর জীবনেও চট্টগ্রামের পড়তে যাবে না। চট্টগ্রামের মানুষ ভালো না। মায়ার একদম পছন্দ না চট্টগ্রামের মানুষজন। বিশেষ করে সাদা পাঞ্জাবি পড়া গম্ভীর মুখোর লোকজন। এরা সাদা পাঞ্জাবি পরলেও তাদের ভিতরটা একদমই কালো কালো। সেজন্য মায়া আর চট্টগ্রামে পড়তে যাবে না। মায়াকে পড়াতে হলে সে নিজ এলাকায় আশুগঞ্জে কোথাও পড়বে নয়তো লেখাপড়ায় করবে না। তাছাড়া মায়া এতো পড়াশোনা করেও বা কি করবে? জীবনে একটা সরকারি চাকরি তো পাবেই না। উল্টো জীবনের এতো বছর পড়াশোনা করে লসে যাবে। এর থেকে ভালো মায়ার হারিয়ে যাওয়া জামাইকে খোঁজে ওকে বিয়ে দিয়ে দিক। মায়া কি না করবে নাকি? এমনই তো রাজি হয়ে যেতো! শুধু শুধু টেনেটুনে মায়াকে এতো পড়াশোনা করানোর কি দরকার? তাছাড়া মায়া চট্টগ্রামে পড়তে যাবে না বলে, ঘোর অনশন করার ইচ্ছে ছিল পরিবারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা আর হলো কই? পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি দেখেই চুপ করে গেল। এই দুঃখের সময়ে মায়া আর নতুন করে ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না বলেই চুপ করে গেল। এমনই মুক্তার বিয়ের নিয়ে টেনশনের মধ্যে আছে সবাই। মায়া আর টেনশন দিতে চায়নি বলেই আপোষে রাজি হয়ে গেল চট্টগ্রামে চলে যাবে বলে। কিন্তু যাওয়ার আগে মায়া একবার নিজের অজানা স্বামীর খোঁজ করতে চায় বলেই পরদিন নিজের বান্ধবী সুমিদের বাড়ি যাওয়ার নাম করে, আবারও পাঁচ বান্ধবী একত্রে পাড়ি জমালো নরসিংদী জেলায়, সুমনদের বাড়ি হাফেজ সাহেবের খোঁজ করতে। কিন্তু সেই যাত্রায় গিয়েও কেউ হাফেজ সাহেবের দেখা না। তবে সুমন ছিল বাসায়, আবারও সুমনের সাথে দেখা হলো সবার। মায়াদের বাসায় বসতে দিল। সেখানেই জুঁই সুমনের কাছে জানতে চাইল’ হাফেজ সাহেবের নাম্বার বন্ধ কেন? তিনি কোথায় আছেন? সুমন বিনীত সহিত জানাল। বাবা হাফেজ সাহেবের ফোন চুরি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। সবটা শুনে হতাশ বুক ভারী হলো মায়ার। ভাগ্য মায়ার সহায় নয়। আজ পযন্ত যতবার মায়া নিজের অজানা স্বামীর খোঁজ করতে গিয়েছে ঠিক ততবারই খালিহাতে ফিরেছে শূন্য হয়ে। আজও অজানা স্বামী অবধি পৌছাবার কোনো রাস্তায় খোঁজে পাচ্ছে না মায়া। আর কিভাবে স্বামীর খোঁজ করবে তাও বুঝতে পারছে না। শেষ আশা ছিল হাফেজ সাহেব। কিন্তু উনার সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আবারও যেন নতুন করে অন্ধকার চেয়ে গেল মায়া আশা জুড়ে। হতাশার মায়া শেষ ভরসা হিসাবে সুমনের নাম্বারটায় সঙ্গে করে নিয়ে আসলো, যেহেতু হাফেজ সাহেবের নাম্বারের আর ফোন করা যাবে না তাই সুমনের নাম্বারটা নিয়ে আসলো এই ভেবে হয়তো সুমনের মাধ্যমেই হাফেজ সাহেবের সঙ্গে মায়া যোগাযোগ করতে পারবে। বুক ভরা হতাশা নিয়ে যখন মায়ার পঞ্চ বান্ধবী সুমনদের বাড়ি ছাড়লো, রাস্তায় আসলো! তখনই জুইয়ের মার বাটন ফোনে কল আসলো আরিফের। জুই ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই ছোট স্কিনে চোখে পরলো আরিফের নাম্বারটি। হাল্কা ঘাবড়ে যাওয়ার মতোন করে জুই তৎক্ষনাৎ চোখ ঘুরালো মায়ার দিকে। আরিফ হঠাৎ এই নাম্বারে কল করেছে তারমানে আরিফ জানে জুই, মায়া বাসায় নেই। এবং জুইয়ের আম্মুর ফোনটা যে ওদের কাছেই আছে এটাও বাসায় ফোন করে হয়তো শিওর হয়েছে। কিন্তু ওরা যে বান্ধবীর বাড়ির নাম করে নরসিংদী এসে বসে আছে সেটা তো আর কেউ জানে না। তারমানে আরিফও জানবে না। জুই অনেকটা ভয়ে ভয়ে মাটির রাস্তা একপাশে দাঁড়িয়ে রিসিভের বাটন চেপে ফোনটা কানে তুলতেই ফোনের ওপাশ থেকে আরিফের শাসিত গলা শুনা গেল তখনই। আরিফ কর্ড়া গলায় বললো…

‘ এই তোরা কোথায় আছিস?

ঘাবড়ে যাওয়ার মতো করে জুই তাকাল মায়ার ভয়ার্ত মুখের দিকে। ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে আস্তে বলল…

‘ এইতো ভাই আছি! সুমিদের বাসায়! কেন কিছু বলবে??

ফোনের ওপাশ থেকে অনেকটা ধমক স্বরে শুধালো আরিফ!!

‘ ওখানে কেন গিয়েছিস? রাতে তোদের চট্টগ্রামে ফিরার কথা জানিস না? ব্যাগ প্যাক করেছিস??

মিনি করে বলল জুই…
‘ না ভাই করেনি! একটু পর বাসায় গিয়ে করে নিব। আজকে তো চলে যাব, এজন্য একটু বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম আরকি আমরা দুজন।

জুইয়ের ধীর গলায় নরম হয়ে আসলো আরিফ। বিগত দুইদিনের হসপিটালের দৌড়াদৌড়িতে অনেকটায় ক্লান্ত সে। তারপর আবার মায়ার নামে খোঁজদারী আসলো, তাও আবার আরিফের কাছে। নিশ্চিয়ই মায়া কোনো কান্ড ঘটিয়েছে নয়তো রিদ খানের বডিগার্ড আসিফ মুশাররফ কেন খোঁজবে মায়াকে আরিফের কাছে? আরিফ জুইয়ের কাছে মায়ার সন্ধান খোঁজল। সে বলল..

‘ কিছুক্ষণের মধ্যে যেন তোদের বাসায় পায় আমি মনে রাখিস। আমি ফোন করবো ছোটমাকে। এখন মায়ার কাছে ফোনটা দে। ওহ কোথায়?

আরিফের শক্ত গলায় জুই অসহায় চোখ তুলে তাকাল মায়ার দিকে। মায়া তখনো কালো নেকাবের আড়ালে ভয়ার্ত ডাগর ডাগর চোখে জুইয়ের দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। জুইয়ের তাকানোতে চোখাচোখি হলো দুজনের। মায়া ইশারায় কি হয়েছে জানতে চাইলে জুই আরিফের কথার উত্তর দিয়ে বললো…

‘ এইতো ভাই, ওহ আমার কাছেই আছে! কথা বলবে?

‘ হুম দে ওকে!

কান থেকে ফোন উঠিয়ে মায়ার দিকে এগিয়ে দিলো জুই। ইশারায় বুঝাল কথা বলতে। মায়া স্বাভাবিক ভাবেই আরিফের ফোনটা কানে তুললো। ‘ হ্যালো! বলতে না বলতেই ফোনের ওপাশ থেকে অবৈধ গলায় ধমকে উঠলো আরিফ। মায়াকে শাসানো গলায় জিগ্যেসা করলো……

‘ এই তোকে রিদ খানের লোক খোঁজছে কেন? তোকে ওদের কি দরকার? কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস তুই ওদের সাথে? সত্যি করে বল!

আরিফের মুখে রিদ খানের নাম শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাট হলো মায়ার। চমকে উঠার মতো করে মায়া জুইয়ের দিকে তাকাল। আরিফের কথার পিষ্টে কি বলবে তাও বুঝতে পারলো না। মায়ার জানা মতে সে কোনো ঝামেলা পাকায়নি রিদ খানের সাথে। এমনকি রিদ খান সামনেও পরে না বেশকিছু দিন ধরে। দূর থেকে পালিয়ে যায় রিদ খানকে কোথাও দেখলে। মুখোমুখি হওয়া তো দূর। এবার কেন রিদ খানের লোক মায়াকে খোঁজছে আরিফের কাছে সেটা মায়া কিভাবে জানবে? মায়া তো কিছু করেনি। সে নিষ্পাপ না? নিশ্চয়ই রিদ খান মায়াকে আবারও অপমান করতে আরিফের কাছে মিথ্যা নালিশ করতে চায় বলেই মায়ার খোজ করছে এই লোক। মায়া রিদ খানকে চিনবে না? এক নাম্বারে অভদ্র আর বদমেজাজী অহংকারী লোক। মায়া চিন্তা ভাবনার মাঝেই ফোনে ওপাশ থেকে আবারও অধৈর্য্যের ধমকে উঠলো আরিফ। ধ্যান ভাঙ্গলো মায়ার। আরিফ বললো…

‘ কি হলো বল? আসিফ ভাই আমাকে ফোন করে তোর নামে জিগ্যেসা করছিল কেন? তুই আমার কেমন বোন হুস? তোর নাম আসলেই রিক্তা ইসলাম মায়া কিনা? আমি ঠিকঠাক চিনি কিনা তোকে? তুই কোথায় পড়িস? হঠাৎ এতোসব প্রশ্ন কেন করছিল আমাকে? তুই কি কলেজে কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস ওদের সাথে সত্যি করে বল রিতু?

আরিফকে বিশ্বাস করাতে অধৈর্য্যের নেয় তৎক্ষনাৎ বামহাতটা মাথায় রাখল মায়া। বাচ্চা সুলভ তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগলো…

‘ না ভাই! মাথা ছুঁয়ে বলছি আমি কিছু করিনি। আমি নিষ্পাপ! বিশ্বাস না হলে জুইকে জিগ্যেসা করো। জুই সাক্ষী।

‘ তোরা দুইটায় তো বাঁধর! একটার কথা আরেকটাকে কি জিগ্যেসা করবো? তুই কিছু করে থাকলেও তো ঐটা জীবনে বলবে না আমাকে? তোর বোন না?

আরিফের কথা মায়ার যুক্তিযুক্ত মনে হলো। সত্যিই জুই কখনো মায়ার নামে নালিশ করে না কাউকে। মায়া দোষ করলেও জুই সেটা সামলে নেয় তারপরও বড়দের কানে দেয় না কখনো। কিন্তু এখন তো মায়া সত্যিই কিছু করেনি। তাহলে এটার সাক্ষী কিভাবে দিবে সে? মায়া যে নিষ্পাপ এটা তো বিশ্বাস করাতে হবে আরিফকে তাই না? মায়া ফের তাড়াহুড়ো বললো…

‘ ভাই তুমি বিশ্বাস করো! জুই এবার সত্যি সাক্ষী দিবে! এই জুই তুই ভাইকে বল আমি কিছু করিনি। আমি নিষ্পাপ! বল!

মায়া জুইকে ডেকে কথা গুলো বললো। আরিফ ফোনের ওপাশ থেকে কটাক্ষ গলায় বললো…

‘ হুম! তুই যে নিষ্পাপ সেটা আমি চট্টগ্রামে গেলেই বুঝবো। এই নিয়ে সকাল থেকে আসিফ ভাই আমাকে পাঁচবার ফোন করছে। তাও তোর তথ্য জানার জন্য। প্রতিবার ফোন করেই তোর কথা জিগ্যেসা করে। সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করে বলে ‘ আমি কনফার্ম কিনা ‘ রিক্তা ইসলাম মায়া আমার নিজের বোন হয়? আচ্ছা তুই বল আমার বোনের নাম আমি জানবো না? হ্যাঁ? তাছাড়া রিদ খানের লোক আসিফ ভাই, তাঁর সাথে একটু কথা বলার জন্য আমার মতোন সাধারণ মানুষ অনেকটা অপেক্ষা করতে হয়, সেই আসিফ ভাই সকাল থেকে আমাকে বারবার ফোন করে শুধু তোর কথায় জিগ্যেসা করছে। তুই নাকি কলেজে বলেছিস তোর নাম ইসরাত জাহান? এজন্য আসিফ ভাই বারবার কল করে আমার কাছে কনফার্ম হতে চাচ্ছে তোর নাম সত্যিই রিক্তা ইসলাম মায়া কিনা? আমি জানি না কেন এতো জরুরি তলবে তোর খোঁজ করছে আসিফ ভাই। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোকে নিয়ে। দেখ রিতুু, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক তাই রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে ঝামেলা করার কোনো প্রশ্ন উঠে না। সবচেয়ে বড় কথা আমরা রিদ খানের এলাকায় থাকি। আর আসিফ ভাই কিন্তু এমনই এমনই আমাকে ফোন দেয়নি তোর খোঁজে। নিশ্চয়ই রিদ খান বা তার পরিবার বলেছে ফোন করতে তাই করেছেন উনি। আমি যতদুর জানি আসিফ ভাই রিদ খানের পার্সোনাল বডিগার্ড, তাই রিদ খান যা বলবে আসিফ ভাই তাই করে। এবার যদি রিদ খান তোর তথ্য চায় তাহলে৷ তিনি এমনি এমনি চায়নি। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। দেখ রিতু? যদি রিদ খানের সাথে বেয়াদবি করেও থাকিস তাহলে ভাইকে বল! আমি সামলে নিব বিষয়টা। আসিফ ভাইকে বুঝিয়ে বলবো তোর হয়ে। দরকার পরলে রিদ খানের সঙ্গে দেখা করে উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব তোর হয়ে, তারপরও আমি চায় না রিদ খানের মতোন রাজনৈতিক লোকের দৃষ্টি তোর উপর পড়ুক! তুই কলঙ্কিত হ!

আরিফের কথা শেষ হতে হতে মায়া অসহায় গলায় মিনমিন স্বরে বলল…

‘ আমি সত্যিই কিছু করিনি ভাই। বিশ্বাস করো!

মায়ার কথায় হতাশার ভারি নিশ্বাস ফেলে আরিফ। তার কাছে কিছুই ঠিক মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মায়া বড় কোনো ঝামেলায় ফেঁসে যাচ্ছে। রিদ খানকে চিনে সে। এমনিতে তো কারও খোঁজ করার মতোন মানুষ না। আরিফ নিজেকে শান্ত করে নরম গলায় বললো…

‘ আচ্ছা ঠিক আছে! ভাই আছি চিন্তা করিস না। যাহ হবার তা দেখে নিব। যাহ এখন বাসায় যাহ! আমি আসিফ ভাইকে ফোন করে জেনে নিবনে আসলে কি হয়েছে। তোকে কেন ওরা খোঁজছে।

‘ আচ্ছা ভাই!
মায়া ফোন রাখতে গেলে আরিফ ফের থামিয়ে দিয়ে বলে।

‘ আচ্ছা শুন আরেকটা কথা! ছোট চাচা তোদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। আর মামা এসে তোদের স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে। খবরদার একা একা স্টেশনের বাহিরে বের হবি না। মামা আসলে তারপর যাবি। আমি আরও কয়েকদিন পরে আসব চট্টগ্রামে। ততদিন তোদের সাথে নানুমা এসে থাকবে শহরে। আর শুক্রবার নানুবাড়িতে চলে যাবি মামার সাথে কেমন?

‘ আচ্ছা!
~~

বিকাল প্রায় পাঁচটার ঘরে! সচ্ছ কাঁচে দরজা ঠেলে রিদের অফিসে ঢুকল আসিফ। বিষন্নতায় আড়ষ্ট হয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা গেল আসিফের শ্যামবর্ণের লম্বাটে মুখে। বিষন্নতা চাপিয়ে রিদের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াল তীব্র হাসফাস করতে করতে। খানিকটা দ্বিধা জড়িয়ে ভয়ও পাচ্ছে সে এই ভেবে যে, তার দেওয়া খবর দুটো কিভাবে নিবে রিদ। খবরটা জানার পর কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা ভেবেও এই মূহুর্তে বেশ চিন্তিত আসিফ। ইতস্তত আসিফ হাসফাস করে জড়ানো চোখে এক পলক চাইল রিদের গম্ভীর চোখ মুখের দিকে। কি সুন্দর সাবলীল ভাবে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কিছু একটা টাইপ করছে ব্যস্ত হাতে। রিদের ব্যস্ত হাত আর স্ক্রিনে উপর কুঁচকানো দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে এই মূহুর্তে কতোটা মনোযোগী টাইপিংয়ে হাত চালাতে। আসিফ আবারও হাসফাস করলো রিদকে তার কাছে থাকা নিউজ গুলো দিতে। কিন্তু এই মূহুর্তে খবর গুলো দেওয়া ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়েও কয়েক সেকেন্ড ভাবলো সে। তারপরও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে ধীর স্বরে ডাকল রিদকে…

‘ ভাই একটা কথা ছিল।

রিদ তৎক্ষনাৎ উত্তর করলো না! আর না আসিফের দিকে চোখ তুলে তাকাল। বরং তখনো ব্যস্ত হাত চলছে কিবোর্ডে। আসিফ আরও একটু ইতস্তত বোধ করে জড়ানো গলায় ফের রিদের উদ্দেশ্য ডেকে বলল…

‘ ভাই কথা গুলো খুব জরুরি ছিল। যদি একটু শুনতেন!

রিদের মনোযোগী নষ্ট হলো না বরং ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকেই গম্ভীর স্বরে আওড়াল।

‘ বল, শুনছি!

ইতস্তত আসিফ রিদকে এক পলক দেখে খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল…

‘ আসলে ভাই দুটো নিউজ আছে। একটা ভালো, অন্যটা খারাপ হবে। এজন্য বলছিলাম আপনি কোনটা আগে শুনতে চায়বেন।

আগের নেয় রিদ বলল…

‘ আপাতত কোনোটাই না শুনতে চাচ্ছি না। বেশ জরুরি হলে বল নয়তো বেড়িয়ে যাহ কাজ করছি আমি।

আসিফ চুপ করে গেল দ্বিধা নিয়ে। খবরটা বেশ জরুরিই তাই রিদকে জানানো দরকার। এজন্য আসিফ আগের নেয় জড়ানো গলায় বলল…

‘ ভাই খবরটা মনে হয় আপনার জন্য খুব জরুরিই হবে। ভাবিকে নিয়ে আপ…
আসিফকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখ আওড়াল আসিফ।

‘ বল শুনছি!

আসিফ দ্বিধা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ধীর গলায় বলতে থাকল…

‘ আসলে ভাই ভাবির খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা। আপনার কথা অনুযায়ী সিম অফিস থেকে নাম্বারে তথ্য যোগাড় করেছিলাম নাম্বারদাতার। আপনার ধারণায় ঠিক ছিল। সেদিন রাতে ভাবি কল করা মানুষটা উনার বড় ভাই ছিল। কলদাতার রেজিস্ট্রার সিম থেকে জাতীয় পরিচয় পত্রের মাধ্যমে ভাবির ভাইয়ের ছবিসহ সকল তথ্য যোগাড় করেছিলাম। ছেলেটির আমাদের পরিচিত এক ছোট ভাই আপনিও চিনবেন ওকে। ওর নাম আরিফ! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে মাত্র বের হয়েছে। ওর ছোট বোনের নামই রিক্তা ইসলাম মায়া, মানে আমাদের ভাবি! এই নিয়ে আমি সকাল থেকে বেশ কয়েক বার আরিফের সঙ্গে ফোনে করা বলে শিওর হয়েছি ভাই। আপনি যাকে ইসরাত জাহান নামে চিনেন উনিই আমাদের ভাবি হয় ভাই। ভাবি আপনাকে নিজের নাম মিথ্যা বলেছিল সেদিন। এবার কেন বলেছিল সেটা ভাবিই ভালো বলতে পারবে ভাই। তবে আমি আরও খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ভাবি আজ সকালে আপনার খোঁজে নরসিংদী গিয়েছিল উনার তিন বান্ধবীসহ চাচাতোকে নিয়ে। হাফেজ সাহেবের ছেলে সুমন আমাদের লোকদের জানিয়েছে সেটা। এর আগেও নাকি আপনার খোঁজে কিছুদিন আগে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু প্রথমবার আপনার খোঁজ না পাওয়ার ব্যর্থ হয়ে নাকি আজ দ্বিতীয়বারের মতোন গিয়েছিল কিন্তু পথিমধ্যে নাকি ভাবিদের আজ সকালেই এক্সিডেন্ট হয়। হাফেজ সাহেবের ছেলে সুমন নাকি সেখানেই ছিল। ওহ আমাদের লোকদের একটু আগে জানাল ভাবিসহ নাকি উনার দুটো ফ্রেন্ড মারা যায় অন দা স্পট, আর বাকি দুজনের অবস্থাও নাকি বেশ ভালো না হসপিটালের ভর্তি আছে আহত অবস্থায়। ভাবির পরিবারের এটা নিয়েই তোলপাড় চলছে। আমি আরিফকে একটু আগে ফোন করেছিলাম ফোন ধরেনি। হয়তো ফোন তুলার পরিস্থিতিতে নেই। আমাদের ছেলেরা কিছুক্ষণ আগেই খবরটা দিল আমায়। এজন্য আমি আপনাকে বলতে…

আসিফ বলতে বলতে থেমে যায় রিদের নিশ্চিুপ ভঙ্গি দেখে। রিদের চোখে মুখে আগের মতো গম্ভীর্য নেই তবে বেশ শিথিল দেখাল তাঁর চেহারা। রিদের মুখ দেখে ভিতরকার অবস্হাটা বুঝল না আসিফ। কারণ রিদের নিশ্চিুপ দৃষ্টি তখনো ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তবে রিদের কিবোর্ডের ব্যস্ত হাত দুটো থেমে আছে টাইপিং করা থেকে। আসিফ সেদিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই বুঝল রিদের হাত দুটো শুধু থেমে নেই ভূমিকম্প নেয় তরতর করে কম্পনরত হচ্ছে সেগুলো। আসিফের পূর্ণ দৃষ্টির মধ্যেই রিদের সেই হাতের কম্পন আরও দৃঢ় হলো ক্রমাগত। আসিফের স্পষ্ট চোখে পরলো রিদের কানির্শ বেয়ে ঝড়া চিকন ঘামের ফোঁটা গুলোকে। আসিফ খানিকটা চমকালো। শুকনো গলায় দ্রুত চোখ বুলাল রিদের মুখে। রিদের শক্ত থাকা মুখের আদল পরিবর্তন দেখা না গেলেও তবে আসিফের কানে আসল রিদের ভাঙ্গা গলার একটু স্বর…

‘ কবে হয়েছে এসব??

আসিফ বিন্দুমাত্র সময় নিল না উত্তর করতে। ব্যস্ত গলায় বলল…

‘ ভাই সকালের ঘটনা এটা। ভাবিকে উনাদের পারিবারিক কবর স্থানই কবর দেওয়া কথা চলছে কিন্তু পুলিশ কেইস হওয়ায় লাশ এখনো দাফন করা হয়নি। তদন্ত চলছে। ভাই আপনি কি যাবেন ভাবিকে শেষ দেখা দেখতে?

আসিফ বলতে বলতে আবারও থেমে যায় রিদের নিশ্চিল অবস্থা দেখে। কারণ ততক্ষণে রিদ ল্যাপটপের কিবোর্ডের উপর কপালে ঠেকিয়ে গা ছেড়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রশ্ন করার থেকে। আসিফ ধরফরিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসল রিদের দিকে। আতঙ্কিত হাতের ভাই, ভাই করে ডাকতে লাগলো রিদকে। আসিফ উত্তেজিত ভঙ্গিতে রিদের কাঁধ চেপে ধরতেই বুঝল রিদের বেগতিক শরীর তীব্র কম্পন হওয়ার বিষয়টা। হতভম্ব আসিফ তখনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রিদের সাড়াশব্দ পাচ্ছে না বলে। আতঙ্কিত মুখে শুকনো ঢুক গিলতে গিলতে চাইল রিদের দিকে। নিশ্চিল রিদকে দেখে আসিফ তখনো ঠাহর করতে পারছে না আসলে হয়েছে কি? রিদ কি বেহুশ হয়ে গেল নাকি অতিরিক্ত উত্তেজনায় হার্ট অ্যাটাক করলো? কোনটা?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here