রিদ-মায়ার প্রেমকাঁথা
লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া
০৬
‘ আমি আর পারছি না জুই। আমাকে রেস্ট নিতে দে, নয়তো মাথা ঘুরিয়ে পরে যাব রাস্তা।
কথাটা বলেই কারও অপেক্ষা না করে ধুপ করে বসে পরলাম রাস্তায় ঘাসের উপর। বড্ড ক্লান্তিতে শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে আমার। এতক্ষণ যাবত মাথার উপর প্রহর সূর্যের তাপ নিয়ে হাঁটছিলাম নিরুদ্দেশ গন্তব্যের উদ্দেশে। এই মূহুর্তে আমরা নরসিংদী জেলা বাগিচা এলাকায় অবস্থান করছি। এখানে কেন এসেছি এটা অবশ্য সবার জানা। তাই নতুন করে আর নাই বা বললাম কিছু। তবে এই মূহুর্তে আমার সঙ্গে রয়েছে আমার চার বান্ধবী জুইকেসহ মাহি, মাইশা, সুমি, আর আমি। সবার চোখেমুখে ক্লান্তির চেয়ে হতাশা বেশি, সেই সাথে কাঠফাটা রোদের অতিষ্ঠ বিরক্তি। আমাকে পা ছড়িয়ে রাস্তার ঘাসের উপর বসে যেতে দেখে সামনের থেকে দ্রুত এগিয়ে আসল জুই। সুমিকে সাইন্ড কেটে আমার সামনে বসে খানিকটা উদ্বিগ্নতায় বলল…
‘ তোর বেশি খারাপ লাগছে রিক্তা? মাথা ঘুরছে তোর? পানি খাবি?
ক্লান্তিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম যার অর্থ হ্যা বেশি খারাপ লাগছে। লাগবে নাই-ই বা কেন? অসুস্থ শরীর নিয়ে নরসিংদী এসেছি অচেনা জামাইর চেনা ঠিকানা খুঁজতে। বিষয়টা আজব না? সত্যিই আজব! কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেন এসব আজব কারবার একটু বেশিই হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে বাসায় এসেছি আজ আটদিন গিয়ে নয়দিন হলো। ১০৪° ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বাসায় এসেছিলাম সেদিন। আরিফ ভাইয়া আমাকে আর জুইকে নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে একদিন হসপিটালের রেখে। তারপর থেকে আমি আশুগঞ্জ নিজের বাসায় আছি। আজ বিগত আটদিন লাগলো আমার সুস্থ হতে। এখনো পুরপুরি সুস্থ নয় আমি। তারপরও বান্ধবীদের হাত ধরে চলে আসলাম নরসিংদী জেলায় আমার অচেনা জামাইকে খুঁজতে। কোথায় তার খোঁজ পাব জানি না। তবে হাল ছাড়িনি, এখনো খুঁজে চলছি। কারণ তার সাথে আমার এখানেই দেখা হয়েছিল তাই আমার বিশ্বাস তার ঠিকানা এখানেই পেয়ে যাব। তাছাড়া এখানে এসেই স্হানীয় লোকদের জিগ্যেসা করতে করতে একটা কাজী অফিসে গিয়ে পৌঁছে ছিলাম। সেখানে আমাকে বিয়ে পড়ানো ঐ বৃদ্ধা লোকটা ছিল না। উনাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তাঁরা আমাকে দেড় বছর আগে সেদিন রাতে ঐ অপরিচিত লোকটার সাথে বিয়ে দেয়নি। নিরাশ হয়েছিলাম আমরা সবাই। তবে লোকটা আমাদের আরও একটা কাজি অফিসে ঠিকানা দিয়েছে আর বলেছে সেখানে খোঁজ করতে। এখন সেই ঠিকানা অনুযায়ী হাঁটছিলাম আমরা। কিন্তু পথে মধ্যে ক্লান্তিতে বসে পড়লাম রাস্তায়। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে মুখের নেকাব মাথার উপর তুলতে তুলতে দূর্বল গলায় বললাম…
‘দে! পানি দে খাব!
আমার অসুস্থতা দেখে মাইশা, মাহি, সুমি তিনজনই আমাকে গোল করে দাঁড়াল চারপাশে। গায়ে সবার বোরখা পরিহিত। মাইশা, সুমি নিজেদের বোরখা পরলেও আমি, জুই, মাহি পরেছি যার যার ‘মার’ বোরখা। বয়স্ক মায়ের বোরখা ছোট মেয়েরা পরলে কেমন হবে বুঝতেই পারছেন। আমাকে আর বলে বুঝাতে হবে না। আর্ধ পাগল বুড়ীর মতোন লাগছিল একেক জনকে। তারপরও নিজেদের সেফটির জন্য এই বোরখা পরে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম সকাল সাতটার বাসে। আমাদের সবার পরিবার জানে আমরা সবাই সুমিদের বাসায় যাচ্ছি, আর সুমি বাসায় জানে ওহ আমার বাসায় এসেছে, আমাকে দেখতে। আমি অসুস্থ এজন্য। মূল কথা হলো আমরা সবাই যার যার বাসায় মিথ্যা বলে বের হয়েছি নরসিংদীর উদ্দেশ্য। সকাল সাতটার বের হয়েছিলাম আর এগারোটা মধ্যে নরসিংদী বাগিচা এলাকার বাজারে পৌছে গেলাম। এখান থেকে কাজীর সন্ধান করে একটা কাজী অফিসে পৌঁছে ছিলাম সেখান থেকে নিরাশ হয়ে অন্য কাজীর ঠিকানা যেতে গিয়ে পথে মধ্যে আঁটকে বসলাম। কারণ সত্যিই আমার অসুস্থ লাগছে তাই। মনে হচ্ছে গায়ের জ্বর আবারও উঠবে। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি গায়ের জ্বর থেকে মনের অসুস্থতা একটু বেশি অনুভব করছি। আর তার কারণ হলো আমার ঐ অচেনা স্বামীকে নিয়ে। লোকটাকে যত খুঁজতে যাচ্ছি ততই যেন তাঁকে হারিয়ে ফেলছি। কোনো মতেই যেন লোকটার নাগাল আমি পাচ্ছি না হাত বাড়িয়েও। এতে যেন আমার মনে অস্থিরতা কাজ করছে আরও বেশি লোকটার সন্ধান পাওয়ার জন্য। জানি না এই ঠিকানার গিয়েও যদি লোকটার খোঁজ না পায় তাহলে কি হবে? আমার মনের অস্থিরতাটাও কাউকে বলতে পারছিলাম না। কারণ আমি যাদের বলবো ওরা সবাই আমার উপর ক্ষেপে যাবে স্বামী নামক লোকটার জন্য অস্থিরতার কথা শুনলে। কিন্তু আমি কি করবো? ওদের আমার সামনে বারবার রিক্তার জামাই! রিক্তার জামাই! নিয়ে আলোচনা করতে করতে এখন ঐ লোকটাকে আমি সত্যিই মিস করছি। আমার মনে হচ্ছে আমি বড় ভুল করে ফেলেছি। আমার উচিত হয়নি সেদিন অচেতন স্বামীকে বিছানায় ফেলে পালিয়ে আসাটা। একটু অপেক্ষা করতাম লোকটার জাগ্রত হওয়ার জন্য, তাহলে হয়তো আজকে এই দিনটা দেখতে হতো না আমায়। আমার মন বিচলিতের দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতেই জুই হাফ লিটার পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি বোতলটা উপরে তুলে ঢগঢগ করে অনেকটা পানিই খেয়ে নিলাম। মাইশা নিজের হাতে দ্বিতীয় কাজী অফিসের ঠিকানাটায় চোখ বুলিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,…
‘ বাল! এই মধ্য দুপুরে কই যামু অচেনা এলাকায়
শালার কাজী বাড়ি খুঁজতে? ধুর সন্ধ্যার আগে আগে যদি বাসায় না পৌঁছায় তাহলে সবাই ধরা খেয়ে যাব। উঁহুম ধরা খাওয়া যাবে না। দুলাভাই খোঁজার মিশন এখনো অল্পও হয় নাই। তাই এতো তাড়াতাড়ি গল্প শেষ হলে চলবে না৷ এই রিতু শরীরে একটু জোর লাগাত বইন। এইতো একটু সামনে বাজার দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে কারও কাছে এই এড্রেসটা জিজ্ঞেসা করে রিক্সা নিয়ে যাব সোজা তোকে বিয়ে দেওয়া সেই কাজি বাড়িতে। বেশি লেট হবে না। জাস্ট একটু কষ্ট করা লাগবে। যেতে পারবি?
মাইশার যুক্তিতে কেউ বাঁধা দিল না। কারণ মাইশার কথা গুলো আসলেও সত্যি। এখানে বসে থাকা মানেই নিজেদের কাজে দেরি করা। আমি ‘হুম’ বলে অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে দাড়াতেই জুই আর মাহি দুজন আমাকে দুই দিক থেকে ধরলো। তারপর যতটা পারি দ্রুত হেটে একটা অটোরিকশা নিয়ে চললাম পাঁচজন কাজি অফিসের উদ্দেশ্য। ভাগ্য ভালো থাকায় সেই অটোরিকশা ওয়ালা মামা চিনত আমাদের দেওয়া কাজী অফিসে ঠিকানাটা। প্রায় বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে পৌছালাম ছোট খাটো একটা কাজী অফিসে সামনে। দেখতে মোটামুটি ভালোই ছিল। আমরা সবাই অটোরিকশার ভাড়া মিটিয়ে কাজী অফিসের সামনে দাঁড়াতেই অতি উৎসাহের সহিত মাহি পাশ থেকে আমার হাত চেপে ধরে বলল…
‘ রিতু দেখতো এটাই কি সেই কাজী অফিস যেখানে তোর বিয়ে হয়েছিল?
আমি গোল গোল চোখে আশপাশটা ভালো করে দেখেও কিছুই চিনতে পারলাম না। চিনব কিভাবে? দেড় বছর আগে রাতে এসেছিলাম এইখানে। তাই দিনের আলোয় সবকিছু বুঝা মুশকিল। তাই আমি ধীর গলায় বললাম…
‘ কিছু বুঝতে পারছি নাতো এই অফিসটায় কিনা!
আমার কথায় জুই বলল…
‘ আচ্ছা চল ভিতরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।
তৎক্ষনাৎ উত্তর করলো মাহি..
‘ হুম চল! চল!
পরপর পাঁচ বান্ধবী মিলে কাজী অফিসে ঢুকতে দেখলাম একটা হালকা পাতলা গঠনের লোক সাদা কাবলি পরে টেবিলে উপরে মোবাইল রেখে চেয়ারে বসে মনোরোগ সহকারে ওয়াজ শুনছে। একত্রে আমাদের পাঁচ বান্ধবীকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠে থতমত খেয়ে যান তিনি। ছোট খাটো রুমের কাজী অফিসটা পুরো খালি। বুঝায় যাচ্ছে আজ তাদের কোনো কাজ নেই। হয়তো আজ কোনো বিয়ের ফাংশন হাতে ছিল না তাই অফিসে অবসর সময় পার করছে ফোন চালিয়ে তিনি। আমাদের পাঁচ বান্ধবীকে দেখে অভিনবে দ্রুত ফোন বন্ধ করে পাশে রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে প্রথমে জিজ্ঞেসা করলেন…
‘ আসসালামু আলাইকুম! জ্বিই আপনার কি বিয়ে করানোর কাজে এসেছেন নাকি তালাকের পরামর্শে?
জড়তায় আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কিন্তু মাইশা আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করে সাহসীকতা সঙ্গে এগিয়ে গেল লোকটার সম্মুখে। এবং বলল…
‘ জ্বি আসলে, আমরা আপাতত আপনার কাছে তালাকের পরামর্শের জন্যই এসেছিলাম। আসলে আপনাদের এখান থেকে দেড় বছর আগে ২০১৭ সালে নভেম্বরের তিন তারিখে আমার এক কাজিন বোনের বিয়ে হয়েছিল। এখন ওরা ছাড়াছাড়ি চায়, কিন্তু আমার বোনের কাছে কাবিননামার কোনো কপি নেই। সেজন্য আপনাদের কাছে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছে আমাদের কাবিননামার একটা কপির নেওয়ার জন্য। আপনি প্লিজ একটু কষ্ট করে ২০১৭ সালের নভেম্বরের তিন তারিখের বিয়ের তালিকাটা চেক করে আমাদের সেই কাবিননামাটা একটু দিবেন প্লিজ?
কাজী লোকটা বাকা চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। হয়তো মাইশার কথা একটু বিশ্বাস করেছে এজন্য। লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমাদের বসতে বলে পাশে রুমে গেল আর পাঁচ মিনিট পর ফিরে এলো মোটাতাজা একটা রেজিস্ট্রার বিয়ে খাতা নিয়ে। আমাদের সবার চোখে মুখে তখন আশার আলো মতো ঝলঝল করছিল খাতাটা দেখে। লোকটা আমাদের সামনে খাতা খোলে বসতে বসতে বলল…
‘ যার কাবিননামা লাগবে সেই কন্যার নাম কি?
ঝটপট উত্তর করল মাহি..
‘ জ্বি! রিক্তা ইসলাম মায়া।
কাজি আর কোনো প্রশ্নই করলেন না৷ শুধু মনোযোগ সহকারে ২০১৭ সালে নভেম্বরের তিন তারিখ ধরে রিক্তা ইসলাম মায়া নামের, আমার কাবিননামাটা খোঁজতে লাগলেন। এর ফাঁকে মাহি কাজি সাহেবকে আমার নামটা বলে আমাকে খুঁচিয়ে বলল…
‘ রিতু আমি নামটা ঠিকঠাক বলেছি তো? না মানে তুই এই নামেই বিয়েটা করেছিস নাকি অন্য কোনো নামে??
‘ নাহ এই নামেই করেছি।
‘ তারমানে আমি তোর নামটা ঠিকঠাক বলেছি তাইতো?
‘ হুম!
‘ আরে বাহ! দারুণ তো! আন্দাজে বকা মেরে ফেললাম।
মাহির কথার অর্থ না বুঝে কপাল কুঁচকে তাকাতেই মাহি ফের বলল…
‘ ওহ আচ্ছা ভালো কথা! রিতু দেখতো এই লোকটাই কি ছিল সেদিন রাতে তোকে বিয়ে দেওয়া কাজীটা?
মাহির কথায় চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম আমার সম্মুখে বসা কাজীর দিকে। দেড় বছর আগে স্বামীর চেহারাটায় মনে রাখতে পারিনি সেখানে বিয়ে পড়ানোর কাজীর চেহারাটা কিভাবে মনে রাখব? তারপরও আমার যতটুকু স্মরণ আছে সেদিন রাতে আমাদের বিয়েটা দিয়েছিল একটা মোটাতাজা বেশ বয়স্ক, লাল দাঁড়ি ওয়া বৃদ্ধা লোক উনার নিজের বাড়িতে, কোথায় কাজী অফিসে নয়। আমি অসম্মতি দিয়ে বলল…
‘ না এনি সেই কাজী নন। আমাকে যে বিয়ে দিয়েছিল সেই লোকটা অনেক বয়স্ক বৃদ্ধা লোক ছিল।
আমার কথায় মূহুর্তে চুপ করে যায় মাহি। খানিকটা ভেবে বলল…
‘ আমার মনে হয় এই লোকটা ঐ বৃদ্ধা কাজীর ছেলে হবে।
আমি এবারও অসম্মতি দিয়ে বললাম…
‘ নাহ এই লোকটা বৃদ্ধা কাজীর ছেলে নয়। কারণ আমাকে বিয়ে দেওয়া বৃদ্ধা কাজীর একটাই ছেলে ছিল। যে সেদিন আমাদের উপকার করেছিল নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়ে। সেই লোকটা, এই লোক নয়।
মাহি এবার নড়েচড়ে বসল। চোখেমুখে হতাশা দেখা গেল ওর। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল…
‘ তাহলে আমার মনে হয় এই লোকটা এই অফিসের স্টাফ হবে।
মাহির কথায় ভরসা পাচ্ছিলাম না আমি। তারপরও ছোট করে উত্তরে বললাম…
‘ হবে হয়তো!
থমথমে পরিবেশে আমরা সবাই কাজী লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি যে কিনা একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমার কাবিননামা খোঁজে চলছে। উনার পৃষ্ঠা উল্টানো দেখে বুঝলাম উনি ইতিমধ্যে কয়েকবার করে রেজিষ্ট্রি খাতা ঘাঁটিয়ে ফেলেছে আমার কাবিননামাটা খুঁজতে। অবশেষে তিনি রেজিস্ট্রার খাতা বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ দুঃখীত জনাবারা, ২০১৭ সালের নভেম্বরের তিন তারিখের কোনো কাবিননামা নেই এখানে। কারণ এই তারিখের আমাদের কাজী অফিস খোলায় হয়নি। আমি এখানে নতুন স্টাফ তাই একটু খাতাটা চেক করে নিলাম। কারণ আমাদের এই কাজী অফিসটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজ থেকে বিগত এক বছর পাঁচ মাস আগে। মানে বরাবর ২০১৮ জানুয়ারি মাসে খোলা। আপনারা ২০১৭ সালের নভেম্বরের তিন তারিখের কাবিননামা খুঁজছেন। তারমানে এই অফিস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আরও দুই মাস আগে আপনার বোনের বিয়ে হয়েছিল। এরমানে আপনারা ভুল ঠিকানায় এসেছেন। আপনার বোনের হয়তো অন্য কোনো কাজী অফিস থেকে বিয়ে হয়েছিল এখান থেকে নয়।
এক আকাশ ভেঙ্গে পরল এমন একটা থমথমে অবস্থায় বসে আছি আমরা সবাই। হতাশায় হতবাক সবাই। কারও মুখে কোনো কথা আসছে না। এই নিয়ে পরপর দুই দুইটা কাজী অফিসে চক্র কেটে ফেললাম কাঙ্ক্ষিত কাজীর আশায় কিন্তু সেই কাজীর বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল না এখনো। সবার থমথমে ভাবের রেশ কাটিয়ে জুই আগ্রহ গলায় বলল…
‘ আচ্ছা এর আগে কি আপনারা নিজেদের বাসায় বিয়ে পড়াতেন? আপনাদের বাসার কি কোনো রেজিস্ট্রার খাতাপত্র আছে কিনা একটু দেখবেন প্লিজ?
জুইয়ের অধৈর্য গলায় চোখ ঘুরাল কাজী দিকে। তিনি জুইয়ের ব্যাকুলতা বুঝে বলল…
‘ আমাদের এর আগে মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও বিয়ে দেওয়া হয়নি জনাবা। আর এটাই আমাদের একমাত্র পুরাতন রেজিস্ট্রার খাতা এর বাহিরে আমাদের অন্য কোনো নোট খাতা নেই।
‘ ওহ! তাহলে মনে হয় আমরাই ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি।
‘ হুমম।
এক গুমোট হতাশা চেয়ে গেল সবার মাঝে, আমাদের নিরাশা যেন চারপাশ থেকে ঘিরা। জুই চুপ হয়ে যেতেই মাইশা বলল…
‘ আচ্ছা এই কাজী অফিসের বাহিরে কি আর কোনো কাজী অফিস আছে আশেপাশে?
‘ হুম আছে। এই এলাকার পশ্চিম দিগন্তে সৈয়দ কাজীর অফিস আছে। আপনারা সেখানে খোঁজ করে দেখতে পারেন।
‘ আমরা সেখান থেকেই এসেছি মাত্র। ওরাই আমাদের এখানের অফিসের ঠিকানা দিয়েছে। ওদের কাছেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত কাবিননামা পায়নি।
‘ তাহলে দুঃখীত জনাবা, আর কোনো কাজী অফিস নেই এই এলাকায়। আপাতত এই দুটোই আছে। আপনারা হয়তো ভুল এলাকায় এসেছেন মনে হয়।
একরাশ হতশা নিয়ে উঠতে চাইল সবাই। কিন্তু আমি উঠলাম না। কারণ আমাকে যে ঐদিন রাতে বিয়ে দিয়েছিল ঐ কাজীর নামটা না জানলেও উনার ছেলে হাফেজ সাহেবের নামটা ঠিকই মনে আছে আমার। উনি আমাদের সেদিন রাতে সাহায্য করেছিল। হয়তো এখন উনার নামটা বললে বাকি পরিচয়টা পেয়ে যাব। তাই আমি প্রশ্ন করে বললাম।
‘ আচ্ছা আপনি হাফেজ সাহেব নামে কাউকে চিনেন এই এলাকার?
আমরা কথায় সবাই উঠতে গিয়েও উঠল না। বরং কৌতূহল চোখ ঘুরাল আমার দিকে। কাজী সাহেব আমার প্রশ্নে তিনিও একটা প্রশ্ন করল আমাকে…
‘ কোন হাফেজ সাহেবে কথা বলছেন আপনি? কোন পাড়ার হাফেজ?
‘ কোন পাড়ার উনি আপাতত সেটা বলতে পারব না। তবে উনার বাবাও মানুষের বিয়ে পড়ান। কাজীর টাইপের মানুষ ছিল উনার বাবা।
আমার কথায় উনি দ্রুত সম্মতি দিয়ে বলল…
‘ আচ্ছা! আচ্ছা! আপনি কাজী মোল্লা হুজুরে কথা বলছেন? মসজিদের ইমামতি করতেন যে উনার কথা বলছেন না?
সঠিক জানি না এই লোকটাই কিনা। তারপরও শেষ আশা মনে করে সম্মতি দিয়ে বললাম…
‘ জ্বিই উনিই। উনার বাসার এড্রেসটা দেওয়া যাবে?
‘ জ্বিই অবশ্য। আমি এক্ষুনি এড্রেসটা লিখে দিচ্ছি। তবে এখান থেকে বেশ দূরে নয় হুজুরের বাড়ি। পাঁচ মিনিটের পথ গেলেই সামনে পেয়ে যাবেন হুজুরের বাড়ি।
‘ জ্বি আচ্ছা! ধন্যবাদ!
লোকটা থেকে কাগজের টুকরাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার সাথে সাথে বাকিরাও উঠে দাঁড়াল। সবার চোখেমুখে কৌতূহলের তীক্ষ্ণতা। হয়তো জানতে চাচ্ছে আমি কাজীর নামটা এতক্ষণ যাবত ওদেরকে কেন বললাম না? আসলে নামটা আমার নিজেরও স্মরণে ছিল না। আন্দাজে ডিল মারলাম আরকি। এবার আন্দাজ করাটা সত্যি কিনা সেটা লোকটার বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারবো।
~~
অনেক চেষ্টায় অবশেষে সফল হলাম আমরা,আমাকে বিয়ে দেওয়া সেই কাজি বাড়িতে পৌছাতে সক্ষম হলাম। এই মূহুর্তে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি সেই হাফিজ সাহেবের বাড়িতে। এই বাড়ি থেকেই আমার বিয়ে হয়েছিল দেড় বছর আগে সেই অপরিচিত লোকটার সাথে। অবশেষে স্বামী নামক লোকটার পরিচয় পেতে যাচ্ছি বলে বুকের ভিতর অজানা একটা অস্থিরতা কাজ করছে। বুকটা ধুকধুক করছে ক্ষণে ক্ষণে। আমরা হাফিজ সাহেবের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমন নামক হাফেজ সাহেব বড় ছেলে। এই ছেলেকে আমি আমার বিয়ের রাতে একটু করে দেখেছিলাম হাফেজ সাহেব আর দাদা কাজী মোল্লার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে। ছেলেটার চেহারাটা মনে ছিল না তবে এখানে এসে ছেলের কথায় একটু আর্ধটু মনে করতে পারছি। এই মূহুর্তে শুরু যে আমার মনে টানটান উত্তেজনা কাজ করছে এমনটা নয়। বর্তমান সবার মাঝেই আমার মতো উত্তেজনা কাজ করছে। আর সেই উত্তেজনা থেকেই সুমন নামক ছেলেটি আমাদের কাছে আসতেই প্রথম প্রশ্নটা করলো মাহি…
‘ আমরা অনেক দূর থেকে হাফেজ সাহেবের কাছে এসেছি ভাইয়া। উনি কি বাসায় আছে?
বোখরা পরিহিত আমাদের পাঁচ কন্যাকে এক পলক চোখ বুলাল ছেলেটি। এতো গুলো মেয়ের সাথে একত্রে কথা বলতে বেশ ইতস্তত ও দেখাল তাঁকে। এজন্য আমাদের থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল মাহির দিকে। বিনীত সহিত বলল…
‘ জ্বি না। আব্বু নরসিংদীতে নেই। উনি রাজশাহীতে আছে আজ বিগত দুই মাস ধরে।
সুমি ছট করে প্রশ্ন করে বলল..
‘ উনি ঐখানে কি করেন? কবে আসবেন?
‘ জ্বিই, ঐখানে আমাদের আম বাগানের দেখাশোনা করেন আব্বা। তবে কবে আসবে বলতে পারছি না।
ছেলেটির কথায় জুই বলল…
‘ আসলে আমরা অনেক বিপদে পরে আপনার বাবার কাছে এসেছিলাম সাহায্যের জন্য। আপনার বাবা আমার ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছিল দেড় বছর আগে আপনাদের বাড়িতে, এজন্য উনার সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চায়। আমরা
জুইয়ের কথায় হাল্কা কপাল কুঁচকাল ছেলেটি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের সবাইকে এক পলক দেখে বলল…
‘ বিয়ে পড়ানোর কাজ তো আমার আব্বা করতো না দাদা করতো। আপনার বোনের বিয়ে যদি আমাদের বাড়ি থেকে হয়ে থাকে, তাহলে সেটা আমার দাদাভাই-ই দিয়েছিলেন হয়তো আমার আব্বা না।
ছেলেটির কথায় তৎক্ষনাৎ আমার স্বর্ণাভে আসল সেই বৃদ্ধা কাজী সাহেবের কথা। হ্যাঁ উনিই আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন উনার ছেলে নয়। তাই আমি ঝটপট উত্তরে বললাম…
‘ হ্যাঁ আপনার আব্বা নয় আপনার দাদাই ছিলেন আমাদের বিয়ে দেওয়া কাজী সাহেব। উনি কোথায় উনাকে ডাকুন একটু প্লিজ।
বিষন্নয়ে ছেলেটি আমার দিকে চমকে তাকাল। আমার হুটহাট কথায় যেন ছেলেটি চমকে গেল। আমার বান্ধবীরাও চমকিয়েছে একটু। আমি এমন ভাবে নিজের বিয়ের বিষয়টা ফাস করে দিব ওরা হয়তো ভাবিনি। কারণ এখানে আসার আগে আমাদের কথায় ছিল কেউ যেন ভুলেও না বলে আমি সেই পাত্রী যার কাবিননামা তোড়জোড় করে খোঁজে চলছি আমরা। এই ওয়াদা কেউ ভঙ্গ করেনি বরং আমি উত্তেজনায় মুখ ফশকে বলে ফেললাম। আমার হুটহাট এই মুখ স্লিভ করার বিষয়টির জন্য না জানি কোনদিন বড় ধরণে বিপদে সম্মোহনী হয় আমি, আল্লাহ জানে। আমার বান্ধবীদের কর্ড়া দৃষ্টি এড়াতে আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম। ছেলেটি বিষন্ন কাটিয়ে বলল…
‘ আমার দাদা বেঁচে নেই। উনি আগুনে পুড়ে মারা গেছে আজ বিগত এক বছর চার মাস হয়েছে। সেই থেকেই দাদার কাজী অফিসটা বন্ধ।
সুমন নামক ছেলেটির কথায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠল সবার। তৎক্ষনাৎ হতাশা ঘোর চোখে মুখে ফুটে উঠল। এতো কষ্ট করেও কি অবশেষে অচেনা লোকটার পরিচয় পাবো না? এই কাজী সাহেবই তো চিনতেন আমার স্বামী নামক লোকটাকে। এখন তিনি মারা গেছেন এবার কিভাবে পৌছাব ঐ লোকটা অবধি? হতাশ যখন আমার গলা ধরে আসছিল কষ্টে তখন মাইশা আশার আলো জ্বালিয়ে দ্রুত প্রশ্ন করলো ছেলেটাকে, বলল…
‘ আপনার দাদা বেঁচে নেই কিন্তু উনার কাজী অফিসের কাগজ পত্র তো এখনো রয়েছে তাই না? ওখানে নিশ্চয়ই বিয়ের পুরাতন রেজিস্ট্রার খাতা গুলো আছে? আসলে আমাদের ২০১৭ সালের নভেম্বরের তিন তারিখের বিয়ে পড়ানো সকল লিস্টা গুলো লাগবে। এই তারিখে আপনাদের বাড়িতে রিক্তা ইসলাম মায়া নামক একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল আপনার দাদা। এই মেয়েটিই আমার বান্ধবী ওহ(আমাকে দেখিয়ে)। ওর কাবিননামাটা আমাদের চায়। আপনি কি একটু কষ্ট করে আপনার দাদার অফিসের পুরাতন রেজিস্ট্রার খাতা ঘেঁটে আমাদের সেই কাবিননামার একটা ছবি দিতে পারবেন? আসলে আমরা অনেক আশায় এসেছিলাম এখানে। প্লিজ আমাদের আশা ভাঙ্গবেন না। কষ্ট করে আমাদের একটু সাহায্য করুন না, রিক্তা ইসলাম মায়া নামক কাবিননামার খোঁজে দিয়ে। প্লিজ!!
মাইশার সহজ কথায় যেন এক আকাশ সমান চমকে উঠল ছেলেটি। মাইশার কথা শেষ হতে না হতেই তুমুল গতিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আপনিই সেই মেয়ে? যার উদ্দেশ্য কিছুদিন আগে কিছু লোক এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তারাও আপনাদের মতো করে একই তারিখের কাবিননামার কাগজটার খোঁজ করছিল। উনি সম্ভব আপনার স্বামী হবেন আবার নাও হতে পারে, কারণ লোকটার সাথে আরও দুজন মানুষ ছিল একই কালো পোষাক পরিহিত তাই ঠিকঠাক বলতে পারছিলাম না কোন লোকটা আপনার স্বামী হবে।
ছেলেটির কথায় এবার আমাদের মাথায় আকাশ ভাঙ্গল। সবর্নাশ সেই অচেনা লোকটা আমার খোঁজ করছে? কিন্তু কেন? আমাকে দিয়ে তার কি প্রয়োজন? নিশ্চয়ই খারাপ কোনো মতলব হতে পারে। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে কাট। সেই সাথে তুমুল উত্তেজনা দেখাল আমার এক একেকজন বান্ধবীদের ফেসে। ওরা একে একে ছেলেটির প্রশ্ন করতে লাগল। প্রথমে মাহি বলল..
‘ আপনি কি উনাদের কাবিননামা কাগজটা দিয়ে দিয়েছেন?
‘ নাহ দেয়নি! কারণ…
ছেলেটিকে বলতে না দিয়ে তাড়াহুড়ো সুমি বলল…
‘ ভেরি গুড দেননি! যান কাবিননামা কাগজটি আমাদের জন্য নিয়ে আসুন। যান! যান!
আমাকে দেখিয়ে ছেলেটি বলল…
‘ উনার কাবিননামার কাগজটি আমার কাছে নেই। সেটা তো…
আবারও ছেলেটিকে বলতে না দিয়ে মাইশা বলল…
‘ নেই মানে? কাবিননামা কাগজ দিয়ে আপনার কি করেছেন? কাজী অফিসে না বিয়ের কাবিননামার একটা কাগজ থাকে তাহলে আপনাদের কাছে থাকবে না কেন বলুন?
সবার এতো এতো প্রশ্নে ছেলেটি এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বললো…
‘ প্লিজ আমাকে বলতে তো দিন। আপনারা সবাই এতো প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিব কিভাবে?
জুই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল…
‘ আপনি বলুন ভাইয়া, আমরা আপনার কথা শুনছি।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছেলেটি বলতে লাগল…
‘ আসলে দাদার অফিসের ইলেক্ট্রক শর্টসার্কিটে হঠাৎ করে একদিন আগুন লেগে যায়। সেই আগুনে আমার দাদাভাই সহ অফিসের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিছুই বাঁচাতে পারিনি। এজন্য মূলত আপনাদের এই মূহুর্তে সাহায্য করতে পারছিনা। কারণ আমাদের কাছে কিছুই নেই। এই একিই কথা আমি সেদিন ঐ লোক গুলোকেও বলেছিলাম। তিনটা লোক এসেছিল। আর আমাকে আপনার বিয়ের কাবিননামাটা দিতে বলেছিল। আমি কাবিননামাটা দিতে না পারায় আপনার তথ্য চাচ্ছিল আমার কাছে। আপনি আমাদের পরিচিত কেউ হন কিনা বা আপনি কখনো কাবিননামা খোঁজে এখানে এসেছেন কিনা কাউকে নিয়ে এসব। আমি না করেছিলাম সেদিন কারণ আপনি কখনই আসেননি এতোদিন। কিন্তু আজ আপনি আসবেন আমি ভাবতেও পারিনি। এমনটা জানলে আমি তাদের নাম্বার রেখে দিতাম। কল করে বলতাম আপনারা এখানে এসেছেন। আসলে আমি যতদূর বুঝলাম ওরাও আপনায় খোঁজছে। আপনারাও তাদের খোঁজছে কিন্তু কেউ কারও খোঁজ পাচ্ছেন না।
ছেলেটির কথায় জুই বলল…
‘ আপনার কাছে উনাদের কোনো তথ্য আছে? উনারা কোথাকার মানুষ? নাম কি তাদের? এমন কোনো তথ্য আছে আপনার কাছে? দিতে পারবেন?
‘ জ্বি না পারব না। আসলে তখন বিষয়টি এতো গুরুত্ব দেয়নি। লোক গুলো আমাকে যা প্রশ্ন করেছিল আমি সেই প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর করেছিলাম শুধু। তাছাড়া সবার মুখে মাক্স পরা ছিল তাই কাউকে চেনার উপায় ছিল না আমার। তবে উনাদের কথায় বুঝলাম ওরা ঢাকার মানুষ হবে। হয়তো কারও পাঠানো লোক হবেন। পোষাকে তেমনই মনে হয়েছিল আমার কাছে।
হতাশার উপর হতাশা হচ্ছিলাম আমরা সবাই। সেই হতাশা নিয়েই জুই আবারও বলল…
‘ আচ্ছা ওর(আমাকে দেখিয়ে) যেদিন বিয়ে হয়েছিল সেদিন রাতে ওর স্বামীকে নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন? নামটাও শুনেছেন? আমাদের নামটা বলতে পারবেন একটু?
সবার কৌতূহলী চোখ ছেলেটির দিকে তাক করা। কিন্তু ছেলেটি ইতস্তত চোখে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল…
‘ আসলে সেদিন ঘুমের ঘোর ছিলাম আমি, এজন্য ঠিকঠাক বর-বউ কাউকেই দেখিনি। বরের নামটা সেদিন রাতে শুনলেও এখন আমার মনে নেই, অনেক আগের কথা তো তাই। আর সেদিন রাতে ঘুমের রেশের মধ্যে বর-বউকে দেখেছিলাম তাই কারও চেহারাটাও মনে নেই। সকালে উঠে আমি কাউকে দেখতে পায়নি। মেয়ে নাকি রাতেই স্বামীকে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল এমনটা শুনেছিলাম আব্বা মুখে। বাকিটা আমার আব্বা বলতে পারবে ভালো। তিনিই আপনার বোনকে আমাদের বাসায় এনেছিল।
জুই আবার প্রশ্ন করে বলল…
‘ আপনার বাবা নিশ্চয়ই ঐ ছেলেকে চিনবে রাইট?
‘ জ্বিই আব্বা চিনে উনার স্বামীকে। আব্বা মুখে শুনেছিলাম উনার(আমাকে দেখিয়ে) স্বামী নাকি অনেক বড় মাপের একজন লোক। উনাকে নাকি সবাই একনামে চিনে। আবার সবাই ভয়ও পায় নাকি।
তাড়াহুড়োয় সুমি প্রশ্ন করে বলল…
‘ কেন ভয় পায় কেন? উনি কি সন্ত্রাস টাইপের লোক নাকি?
সুমির প্রশ্নে ছেলেটি আমার দিকে তাকাল। ইতস্ততায় বলল…
‘ হবে হয়তো! আমি সঠিক জানি না। আব্বা জানে।
জুই বলল…
‘ আচ্ছা আপনার আব্বা আসবে কবে বলতে পারেন?
‘ জ্বিই আমার আব্বা এখন আসবে না। এখন আমের সিজন। এই সিজনের আম বিক্রি করে আব্বা রাজশাহী থেকে বাড়িতে আসবেন এর আগে না। আরও মাস দুই একের ব্যাপার।
~~
দরজা ঠেলে রিদের অফিসে প্রবেশ করলো আসিফ। হাতে এক টুকরো কাগজে নাম্বার লেখা। রিদ অফিসিয়াল গ্যাটাপে ল্যাপটপের সামনে বসা। আসিফকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেও চোখ উঁচিয়ে তাকাল না পযন্ত। মনোযোগ সব ল্যাপটপে টাইপিং করা নিয়ে। আসিফ রিদের মনোযোগ বুঝে খানিকটা দ্বিধা করল কিছু বলতে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে রিদের দৃষ্টি আর্কষণ করতে হাতের এক টুকরো কাগজটা টেবিলের উপর রেখে রিদের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে ইতস্তত গলায় বলল…
‘ ভাই কোনো কাজ হয়নি। নরসিংদীতে আমাদের লোক পাঠিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। তাঁরা খোঁজ চালিয়েও ভাবির কোনো তথ্য যোগাড় করতে পারেনি। কারণ কাজিসহ উনার অফিসের সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আরও দেড় বছর আগেই। তাই আপনাদের বিয়ের কাবিননামাটাও পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় কথা হলো, ভাবিকে সেই বাড়ির কেউ চিনে না। একদম অপরিচিত মানুষ ভাবি তাদের। কেউ জানে না মেয়েটি কে ছিল যার সাথে আপনার সেরাতে বিয়ে হয়েছিল।
আসিফের দীর্ঘ কথায় রিদের হাত থেমে যায় ল্যাপটপের কি-বোর্ডে। চোখ উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আসিফের দিকে। ল্যাপটপের কাজ রেখে আসিফের বাড়িয়ে দেওয়া কাগজটার দিকে একটা ভ্রুর উঁচিয়ে তাকাতেই আসিফ রিদের মনোভাব বুঝে বলল..
‘ ভাই এখানে কাজী সাহেব ছেলে, হাফেজ সাহেবের নাম্বার আছে। এই লোকটার সাথে কথা বলে হয়তো ভাবির সম্পর্কে কিছু জানা গেলেও যেতে পারে। এজন্য মূলত লোকটার নাম্বার আনতে বলেছিলাম আমাদের লোকদের।
রিদ আসিফের কথার কোনো উত্তর করলো না। বরং হাত বাড়িয়ে এক টুকরো কাগজের পিসটা নিজের হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাম্বার উপর চোখ বুলিয়ে চেয়ারে গা ছেড়ে বসল। নাম্বার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আসিফের উদ্দেশ্য বলল..
‘ তোর ভাবির লুকোচুরি খেলাটা আমার আর ভালো লাগছে না আসিফ। কি করি বলতো? তোর ভাবিকে যত খুঁজতে যায় ততই সে আমার হাতে বাহিরে যাচ্ছে। এতে আমার ইন্টারেস্ট আরও বাড়ছে। তুই তো জানিস, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার কতোটা আর্কষণ। নাহ! তোর ভাবিকে দুটো থাপ্পড় মারার জন্য হলেও আমার তাঁকে দরকার। যাতো এই নাম্বারে লোকটাকে তুলে নিয়ে আয়তো। শালার, যতদিন বউকে দুটো থাপ্পড় না মারবো ততদিন শান্তি নাই। যাহ লোক পাঠা।
রিদের গা ছাড়া কথায় আসিফ চোখ ছোট ছোট করে তাকায় রিদের দিকে। বউকে দুটো থাপ্পড় মারার জন্য রিদ খান এতো তোড়জোড়ের অনুসন্ধান করে বউকে খুঁজছে বিষয়টি ভাবতেই সে আবাক। মূল কথা আসিফের যুক্তিতে আসল না রিদের বউকে থাপ্পড় মারার জন্য খুঁজা বিষয়টি। মেয়েটিকে থাপ্পড় গুলোই বা মারবে কেন? মেয়েটির বা কি দোষ? এমনতো না যে রিদ খান ভালোবাসে বউকে খুঁজছে পাওয়ার জন্য। বা তার ভালোবাসার বিয়ে করা বউ হঠাৎ পালিয়ে গেছে, কোনোটাই না। আবার এমনটাও না যে মেয়েটিকে পেলে রিদ খান তাঁকে নিয়ে খুশি খুশি সংসার করবে। তেমনকিছু করবে না তাহলে শুধু শুধু মেয়েটাকে থাপ্পড় মারবে কেন? কি অপরাধ মেয়েটির? তাছাড়া হাফেজ সাহেবও বা মেয়েটির খোঁজ দিবে কিভাবে? আসিফ যতটুকু বুঝতে পারছে অচেনা মেয়েটিকে খোঁজ হাফেজ সাহেব কেন কেউ বলতে পারবে না, অচেনা মেয়েটি আসলে কে ছিল? যতদিন না মেয়েটি নিজ থেকে ধরা দিচ্ছে রিদের কাছে ততদিন পযন্ত হয়তো রিদ খানও নিজের বউকে সনাক্ত করতে পারবে না এতোটা নিশ্চিত আসিফ। কিন্তু মুখ বাড়িয়ে কিছুই বলতে পারলো না রিদকে সে ভয়ে। তাই শুধু হাত বাড়িয়ে রিদ থেকে হাফেজ সাহেবের নাম্বারটা নিতে নিতে সম্মতি দিয়ে বলল…
‘ জ্বিই ভাই কাজ হয়ে যাবে!
#চলিত…