প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-০৩ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
644

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রুদ্র ইরফান। তটিণী-র দ্যা গ্রেট রুদ্র ভাই। যিনি সবে অনার্স ফাস্ট ইয়ারের গন্ডি পেরিয়েছেন। পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুরা মিলে প্লান করেছে ট্যুর দিবে। রুদ্রদের বন্ধু মহল মোট ছয়জন নিয়ে। ইশা, ফয়সাল, প্রমি, জোনাকি, রাফসান ও রুদ্র। এইতো বন্ধুমহল।

ছয় বন্ধুর দল ঠিক করেছে আগামীকাল মানে শুক্রবার দ্বার’চিনি দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সেজন্য আজ থেকেই সবাই সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। রুদ্র নিজের পড়ার মতো জামাকাপড় নিয়ে নিলো ব্যাগে। সাথে টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

বেলা তখন সাড়ে বারোটা। এই সময়ে স্কুল ছুটি হয় তটিণী-র। যদি স্কুল ফাঁকি না দেয় তো বাসায় আসবে একটার দিকে। সেজন্য রুদ্র নিশ্চিত মনে নিজের ব্যাগ বিছানার উপরে রেখে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো শাওয়ার নিতে। কিন্তু বেচারা রুদ্রের ভাবনাতে পানি ঢেলে দিয়ে বারোটা পাঁচ মিনিটে টিপটিপ করে পা ফেলে তটিনী বাড়িতে প্রবেশ করলো।

রোবা নাহার টেবিলে খাবার এনে রাখতে রাখতে বললেন, ‘গোসল করে ঝটপট চলে আয়।’

তটিনী বাক্যব্যয় না করে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠলো। রুদ্রের রুম পেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ পড়ে গেলো তার। বিছানায় ব্যাগপত্র দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো আপনাআপনি। পা টিপে টিপে প্রবেশ করলো সে। ব্যাগের ভিতর কাপড় দেখে তটিণী-র মাথায় যেনো সম্পূর্ণ আকাশ ভেঙে পড়লো। রুদ্র তাকে লুকিয়ে তাহলে এই কাজ করছে!মানা যাচ্ছে না। একদমই না। যেভাবেই হোক এই ব্যাগের মধ্যে যেভাবে কাপড় জায়গা করে নিয়েছে সেভাবে তাকেও রুদ্রের পাশের সিটে জায়গা করে নিতে হবে। আর তা পারবে একমাত্র তার বড়ো বাবা।

তটিনী নিঃশব্দে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো রুদ্র। সুক্ষ নজরে বিছানা পর্যবেক্ষণ করে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে খাবার টেবিলে চলে গেলো।

*
টিশার্ট ও প্লাজু পড়োনে ষোলো বছরের কিশোরী। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। হেলেদুলে খাবার টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো সে। কোনো দিকে না তাকিয়ে বসে পড়লো রুদ্রের সামনাসামনি একটি চেয়ারে। রোবা নাহার যত্ন করে মুরগির মাংস প্লেটে তুলে দিলেন। তটিনীর সবচেয়ে প্রিয় হলো মুরগির রোস্ট। মাংসতে কামড় দিয়ে যেই না হাড্ডি আলাদা করবে অমনই সেটা হাত থেকে ছুটে গেলো। পড়লো তো পড়লো সোজা রুদ্রের প্লেটে। রুদ্র হতভম্ব চোখে তাকালো। তটিনী হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘স্যরি।’

রোবা নাহার হাড্ডিটা সরিয়ে নিলেন। বুঝ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ছোট মানুষ ও রুদু, এভাবে তাকাস না ভয় পাবে।

তটিণী-র দুই পাশে বসেছে আরও দুটো বিচ্ছু। নাম তুরফান ও রাজ। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কি করবে ঠিক করে ফেললো। তটিনী তখন সবে আরেকটা হাড্ডি সহ মাংস মুখে নিচ্ছে তখনই রাজ কনুই দিয়ে গুঁতো মা*রলো। যার ফল স্বরুপ এবার মাংসসহ হাড্ডি রুদ্রের কপালে বারি খেয়ে প্লেটে আওয়াজ তুলে পড়ে গেলো।

রুদ্র নিজের কপালে হাত দিয়ে তটিণী-র দিকে তাকালো। রুদ্রের চাহনি দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না।কেমন নির্লিপ্ত চাহনি তার। তটিনী ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি ইচ্ছে করে করিনি রুদ্র ভাই।’

রাজ ও তুরফান একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় চেয়ারআপ করলো। তটিনী কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল, ‘আমি সত্যিই এবার ইচ্ছে করে করিনি রুদ্র ভাই।’

রুদ্র ঠাস করে নিজের প্লেট নিয়ে উঠে সোফাতে চলে গেলো। ঈশানী মেয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর জন্য ছেলেটা একদণ্ডও শান্তি পায় না। সবসময় বাঁদরামি করতে হবে কেন তোর? একটু শান্ত থাকতে পারিস না তুই?’

রোবা নাহার বললেন, ‘আরে ছাড়ো ওকে, বুঝেনি বাচ্চা মানুষ।’

‘হ্যাঁ ও তো বাচ্চা, আর রাজ তুরফান তো বুড়ো হয়ে গেছে। ওদের দুজনকে দেখেছেন ওর মতো কখনো এমন করতে? বাচ্চা বাচ্চা বলে ছাড় দিয়ে দেই বলেই ও দিনদিন এরকম হচ্ছে আপা।’

ঈশানী তরকারির বাটি নিয়ে রুদ্রের পাশে গেলেন। প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘কিছু মনে করো না রুদ্র, এই মেয়েটা শুধরবে না। তোমার সাথে বেয়াদবি করলে থাপ্পড় মে*রে দিবে। তাহলে বড়দের সম্মান করতে শিখবে ও।

রুদ্র হেসে বলল, ‘ব্যাপার না চাচি আম্মা। আরেকটু বড়ো হোক, এমনই বুঝ আসবে।’

তটিনী রাজের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুই গুঁতো দিলি কেন তখন? দুটোয় প্লেন করেছিলি তাই না?

রাজ অসহায় বাচ্চার মতো তাকিয়ে বলল, ‘এসব কি বলিস? আমার মতো ভদ্র বাচ্চা আবার প্লেন করতে পারে নাকি?’

তটিনী রোবা নাহারের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘তোমার ছেলে ইচ্ছে করে আমাকে গুঁতো দিয়েছে বড়ো মা। সেজন্য মাংস রুদ্র ভাইয়ের দিকে চলে গেছিল।’

রোবা নাহার ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তটিনী যা বলছে তা সত্যি?’

রাজ অবুঝ বাচ্চাদের মতো করে বলল, ‘একদমই না মা, তুমি তুরফানকে জিজ্ঞেস করো।’

তটিনী নাক টেনে বলল, ‘ওরা দুজন মিলে করেছে বড়ো মা।’

রোবা নাহার কিছু বলার আগে হুংকার দিলেন ঈশানী। তেড়ে এসে বললেন, ‘শেষ হয়েছে তোর বিচার দেওয়া? ছেলেগুলো তোর জন্য শান্তিই পায় না। সারাদিন তো বাহিরে থাকে, বাসাতে কয়েক ঘন্টা থাকে সেটাও তোর সহ্য হয়না। ওরা কি এখন তোর জন্য রাস্তায় থাকবে?’

রোবা নাহার গলা উঁচু করে বললেন, ‘থামো তো, ওকে বকছো কেন? নিশ্চয়ই ওরা করেছে সেজন্য ও বিচার দিয়েছে। সবসময়ই কি ইচ্ছে করে সব করবে নাকি?

‘আপনি ওকে চিনেন না আপা। বাপের মতো বজ্জাত হয়েছে।’

তটিনী চোখের জল মুছে বলল, ‘আজ থেকে আমি তাহলে একাই খেতে বসবো। তোমাদের সাথে আর কখনো খেতে বসবো না।

বলেই তটিনী সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রোবা নাহার সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হয়েছে তোদের? শান্তি পাচ্ছিস তোরা? মেয়েটা খেতেও পারলো না তোদের জন্য। সবমসময় ওর পেছনে না লাগলে চলেনা তোমাদের? চলে গেছে তো এবার চারজনে শান্তিতে বসে খাও।’

রোবা নাহার গটগট করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। ঈশানী মন খারাপ করে বললেন, দেখেছো রুদ্র? দোষ করলো কে দোষী হলো কে?

রুদ্র হাত মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি দেখছি।’

*
বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে তটিনী। বিষন্ন মনে ভেবে বলেছে নিজের বাবাকে। তার এ-ই মুহুর্তে মনে হচ্ছে তার বাবা ছাড়া কেউ তাকে ভালোবেসে না। নিজ মনে স্বগোতক্তি করল, ‘বাবা ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না, থাকবো না আর এই বাড়িতে।

সেটা শুনে ফেললো রুদ্র। দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বলল, ‘তাই?’

তটিনী নাক টেনে বলল, ‘হ্যাঁ।’

রুদ্র ধীর পায়ে এসে তটিণী-র পাশে বসলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে বলল, ‘চোখ মুছে নে।’

‘না।’

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চোখ মুছে খেতে চল, তোর নাটক দেখতে পারবো না আর।’

তটিনী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কে বলেছে আপনাকে নাটক দেখতে? এসেছেন কেন এখানে আপনি?’

রুদ্র নিজের চুল টেনে সোজা হয়ে বসলো। এক হাত ঘুরিয়ে নিয়ে রাখলো তটিণী-র কাঁধে। তটিনী এবার মৃদু শব্দ করে কেঁদে উঠলো। রুদ্র হেসে বলল, ‘এতো কান্না কই পাস তুই? ক্লান্ত হোস না?’

তটিনী উত্তর দিলো না। রুদ্র মুচকি হেসে বলল, ‘দ্বার’চিনি দ্বীপ যাবি?’

তটিনী চোখ তুলে তাকালো। রুদ্র চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘যাবি?’

তটিনী রুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সত্যি নিবেন আমায়?’

রুদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। তটিনী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘আগে আপনি স্যরি বলুন।’

রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘আপনার ভাই ইচ্ছে করে আমাকে গুঁতো মে*রে আপনার দিকে মাংস ফেলে দিয়েছে। আপনি সেটা দেখেও চুপ করে ছিলেন। আমাকে বকা খেতে দেখে আনন্দ পাচ্ছিলেন।’

রুদ্র মিনমিন করে বলল, ‘স্যরি।’

তটিনী দাঁত বের হাসলো। রুদ্র হাত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘খেতে চল, তুই খাস নি বলে আমার মা জননী না খেয়ে বসে আছেন।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here