#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ২০
নির্বাক মাহানুর আরহামকে দেখে ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। আরহামের চোখ মুখে দুষ্ট হাসির ছড়াছড়ি। মাথা থেকে ক্যাপ খুলে মুখের ম্যাক্স পুনরায় পরে নেয়। মাহানুর আগাগোড়া পরোক্ষ করে চাপা কণ্ঠে বলল,
-আপনি! এখানে কী করছেন?
-তুমি যা করছো আমিও তাই করছি।
-আপনি না আজ চলে যাবেন? তাছাড়াও আপনি জানলেন বা কী করে আমি এখানে?
-কুল। ধীরে ধীরে সবটা বলছি।
-আপনার এই হেয়ালি আমার পছন্দ হচ্ছে না। কে বলেছে আপনাকে? অহনা?
উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মাহানুর। আরহাম আরাম করে বসে বলল,
-আমার শশুরআব্বা আর শালারা একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে এখানে।
-মানে?
-গতরাতেই আয়াস আমাকে তোমার কথা বলেছে। তারপর শশুরআব্বাও এলো। আয়াস চিন্তিত হয়ে বলল আরহাম ভাইয়া আপনিও ওর সাথে চলে যান। ওকে এতদূর আমরা একা ছাড়তে চাই না। আসীন মিয়া বলল এই সুযোগে আপনাদের ঘুরাও হয়ে যাবে। একজন আরেকজনকে ভালোভাবে চিনতে পারবেন। শেষে শশুরআব্বা বললেন আমার মেয়েকে দেখে রাখার দায়িত্ব এখন থেকে তোমার ভুলে যেও না। তারপর আয়াস তার বন্ধুকে কল দিলো। উইযে সাদাফ। উনি বললেন একটা সিট খালি আছে। আমি তৎক্ষণাৎ ঐ সিট নিজের জন্য বুক করে ফেলি। অতঃপর আমি এখন তোমার সামনে।
বিস্মিতবিমূঢ় মাহানুর। একরাতের মধ্যে এতো কাহিনী হয়ে গেলো তাও আবার তার অগোচরে! মাহানুর চমকিত হয়ে জিগ্যেস করলো,
-তার মানে আপনি আজ চট্টগ্রাম যাচ্ছেন না?
-এক সপ্তাহের ছুটি আমার। তাই ভাবলাম ওয়াইফের সাথে কাটানো যাক।
-মেহমানরা কী ভাববে! সুনহেরা কী ভাববে?
-অন্যের কথা চিন্তা করলে তুমি আর আজ এখানে থাকতে না! সুনহেরাও সবটা জানে। আমি মেনেজ করেই এসেছি।
মাহানুর তপ্ত নিঃশাস ত্যাগ করলো। চোখ, মুখে অন্ধকার ছেয়ে গেলো তার। আরহাম মুখ ভঙ্গি গম্ভীর করে বলল,
-এটাই লাস্ট বার আমি তোমার বেয়াদবি মাফ করছি। নেক্সট আমাকে না বলে রুমের বাহিরেও যেতে পারবে না। দূরে থাকলেও কল দিয়ে বলতে হবে।
-আপনি যেরকম ওয়াইফ চান আমি সেরকম না। আর হতেও পারবো না।
শক্ত গলায় বলল মাহানুর। আরহাম কপালে আঙুল ঠেকালো। মাহানুরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল,
-আমি বানিয়ে নেবো নে কোনো প্রবলেম নেই। আপাদত তোমার সো কলড ট্যুর ওরফে হাল্কাপাতলা হানিমুন এনজয় করো।
মাহানুর মুখ বাকিয়ে কিছু বলতে নিলে সাদাফ এগিয়ে আসলো। আরহামের সাথে হ্যান্ডশেক করলো সে। হাসি মুখে মাহানুরকে বলল,
-সারপ্রাইস কেমন লাগলো মাহানুর?
মাহানুর ভোঁতা মুখে বলল,
-এতো সুন্দর সারপ্রাইস আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে দেয়নি সাদাফ ভাইয়া।
-তোমার বিয়ের কথা তো কাল আয়াস বলল আমাকে। বাই দা ওয়ে কংগ্রাচুলেশন।
-থ্যাংক ইউ।
-ওয়েলকাম। তোমার হাসব্যান্ড কিন্তু দেখতে সেই! দুইজনকে মানিয়েছে।
মাহানুর হাসতে চেয়েও পারলো না। আরহাম স্মিত হাসলো। পাশের সিটে বসা তনুশী মাহানুরকে বলল,
-উনি তোমার হাসব্যান্ড? আগে তো বললে না!
-ভুলে গিয়েছিলাম আপু।
-তোমাকে দেখতে এতো ছোট লাগে আমরা ভাবতেই পারিনি তুমি ম্যারিড!
রাকা নামের একজন তরুণী বলল কথাটা। এই দুইজনের সাথে বেশ ভাব হয়েছে মাহানুরের। এখানে যে কয়টা কাপল আছে সবাই বেশ মিশুক। সবাই ছেলেমেয়েদের ফামিলির কাছে রেখে এসেছে পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করতে। শুধু রাকাই মাহানুরের সমবয়সী। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তার। হাসব্যান্ডের বন্ধু আর বন্ধুর বউদের সাথে ঘুরতে এসেছে সে।
আরহাম ঘাড় বাকিয়ে মাহানুরের দিকে তাকায়। সত্যি আজ মাহানুরকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কেউ বলবেই না এই মেয়ে অনার্স এ পড়ে। আরহামের রাগ হলো মাহানুরের সাজগোজ দেখে। এখন তো সবাই তাকেই বুড়ো মনে করবে! আর ভাববে সে মাহানুরকে বাল্যবিবাহ করেছে! মুখ কঠিন হয়ে এলো আরহামের। রাগের মধ্যে মাহানুরের নাকের নাকফুলটা দেখে তার চাতক মন একটু হলেও শান্ত হলো। এই নাকফুল যে তার চিহ্ন বহন করে। চিত্তের এক দমকা শীতল হাওয়া ছেয়ে গেলো আরহামের।
মাহানুর আর একবারও আরহামের সাথে কথা বলল না। কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে রইলো সে। আরহামের কানেও ব্লুটুথ। কারো সাথে কথা বলছে সে। সহসা মাহানুরের মাথায় একটা আইডিয়া আসে। একদম গ্রেট আইডিয়া!কান থেকে ইয়ারফোন খুলে আরহামের হাতের শার্ট ধরে টান দেয়। আরহাম বিরক্ত হয়ে পাশে তাকায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-মুখে ডাকলেও পারো।
-আপনি কী এই পাঁচদিনই আমার সাথে থাকবেন?
-না। সেখানে আমার আরেকটা সংসার আছে ঐ বউয়ের কাছে যেয়ে থাকবো।
বিরক্তিকর কণ্ঠে উচ্চারণ করলো আরহাম। মাহানুর কপাল কুঁচকে বলল,
-আপনি কী ভালোভাবে উত্তর দিতে পারেন না? আজব লোক!
-এখন যে কথা বলার জন্য শার্ট ধরে টানাটানি করছিলে সেটা বলে আমাকে উদ্ধার করো।
-ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনার জন্য আমার মুড তো খারাপ হলোই কিন্তু আমি ভ্রমণের এনজয় নষ্ট করতে চাচ্ছি না! তাই আমি ভেবেছি আমরা একদম স্ট্রেঞ্জ এর মতো ব্যবহার করবো। সেখানে গিয়ে আমরা আর দুইজন দুইজনকে চেনবো না। এক রুমে থাকলেও। আপনিও সিঙ্গেল আমিও সিঙ্গেল।
-ভেবেচিন্তে বলছো তো?
-হ্যাঁ। কথা বললেও অচেনা হিসেবে।
-ওকে ডান।
মাহানুরের গোমড়া মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। হাত বাড়িয়ে বলল,
-ডিল ফাইনাল?
আরহামের ভীষণ হাসি পেলো মাহানুরের বাচ্চামো দেখে। কোনোরকম নিজের হাসি দমিয়ে রেখে হাত মিলিয়ে বলল,
-ফাইনাল।
-ইয়েস। এখন আমি ইচ্ছেমতো এনজয় করবো। থ্যাংক ইউ মিস্টার জিরাফ।
আরহাম কিছু বলল না। মাহানুর আবারও কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে রইলো। মেয়েরা ওপর দিয়ে যতই ডোন্ট কেয়ার দেখাক স্বামীর বেলায় তারা অনেক জেলাসি হয়। স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলেই তাঁদের কলিজা ধক করে উঠে। আরহাম মনে মনে পরিকল্পনা করলো মাহানুরকে এই পাঁচদিনে সে সোজা করে ছাড়বে। এমন সব কান্ড করবে যাতে মাহানুর নিজে এসেই বলে “আমি আমাদের ডিল ভাঙছি। আপনাকে আমি অন্যকারো সঙ্গে দেখতে পারবো না!” আনমনে বাঁকা হাসলো আরহাম।
____________________
সকাল আটটায় ঘুম ভাঙে আয়াসের। জানালার পর্দার আড়াল দিয়ে আলো ভিতরে আসছে। চোখ মেলে তাকাতেই সুনহেরার ঘুমন্ত মুখশ্রী ভেসে উঠে তার নয়নে। ছোটমোটো হয়ে ঘুমিয়ে আছে সুনহেরা। আয়াস গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো সুনহেরার দিকে। কাল রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছে দুইজন। তাঁদের কথার মেইন টপিকই ছিল স্টাডি, ক্যারিয়ার। ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েকটা চুল সামনে এসে ভীষণ বিরক্ত করছে সুনহেরাকে। আয়াস প্রগাঢ় নজরে সেটা পরোক্ষ করলো। হাত বাড়িয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতে উদ্যত হতেই আচমকা সুনহেরা পিটপিট করে চোখ খুলে ফেললো। আয়াসকে এতো কাছে দেখে কিছুটা সরে গেলো সে। আয়াস থমথমে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
-আপনার চুল মুখে এসে আপনাকে বিরক্ত করছিলো সেটা সরানোর জন্যই হাত বাড়িয়েছিলাম।
-এতো কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমার আপনার ওপর বিশ্বাস আছে আয়াস।
-ধন্যবাদ।
-ফ্রেশ হয়ে নিচে যাই?
-হুম।
আয়াস চশমা ঠিক করে পরছিলো সুনহেরা মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। লাল রঙের সেলোয়াড় কামিজ পরনে সে। একদম নতুন বউ বউ লাগছে তাকে। দুইজন একসাথে রুম থেকে বের হয়। কিছুক্ষন পর সবাই চলে যাবে। বাস এসে পরেছে।
রিদ আর অহনা বাগানের দিকে হাঁটছে। অহনার মন খারাপ। রিদ এটাসেটা বলে হাসানোর চেষ্টা করছে তবুও কাজ হচ্ছে না। রিদ এবার অধয্য হয়ে বলল,
-এখন কী সার্কাসের জোকার সাজতে হবে আপনাকে হাসাতে?
-কিছুই সাজতে হবে না। এখন মাহানুর কী করছে! কে জানে আবার রাগারাগি করছে নাকি!
-উফফ জানেমান তুমি ওদের দুইজনকে সাইডে রাখো তো। ওরা হাসব্যান্ড ওয়াইফ ঝগড়া করুক, মারামারি করুক আবার মিল হবেই। তুমি এখন আমাদের কথা ভাবো।
-আমাদের কথা আর কী ভাববো! আজকে বাসায় চলে যাবো তারপর আর ভালোভাবে দেখা হবে না।
দুঃখী কণ্ঠে বলল অহনা। রিদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-আমি বিয়ের কথা বলি আব্বাকে? আমারও তোমার থেকে দূরত্ব ভালো লাগে না।
অহনা কিছু বলতে মুখ খুলবে তার আগেই চোখ, মুখ শক্ত করে অতি সিরিয়াস ভঙ্গিতে রিদ বলে,
-আবার দেখা যাবে আমার আগেই আরহাম এক হালি বাচ্চা প’য়’দা করে ফেলেছে তখন তো আমি ওর কাছে হেরে যাবো! জানোই তো জানেমান রিদ কখনই পিছিয়ে থাকে না।
-ছি! অসভ্যের মতো কথা বলা ছাড়া আর কিছু পারেননা আপনি?
-এটাকে অসভ্য বলে না জান। আমার স্বপ্ন আমি আরহামের আগে বাপ হবো। আমার ছেলের সাথে ওর মেয়ে বিয়ে দেবো।
-বাহ্! জনাবের স্বপ্নের শেষ নেই!
-তোমার সাথে আমার স্বপ্নের আসলেই শেষ নেই।
অহনা মলিন চোখে রিদের দিকে তাকালো। রিদ অহনার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল,
-আমি কালই আব্বাকে বলছি। কাজকাম বিয়ের পরও করা যাবে আমার আগে তোমাকে চাই।
-যদি আপনার আব্বা আমাকে ছেলের বউ হিসেবে না মানে?
-না মানলে নাই সেটা তার বিষয়। ছেলে হিসেবে আমি আগে তাকে বলবো যদি সে রাজি না হয় তাহলে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবো।
-সত্যি বলছেন? পরে কথার বেখেলাপ করবেন নাতো?
-প্রমিস করছি। একমাত্র মৃত্যুই পারবে আমার প্রমিসকে ভাঙতে আর কেউ না।
-অশুভ কথা বলে আমার মন খারাপ করবেন না একদম।
-আচ্ছা বইন করবো না।
-চলুন কিছুক্ষন পর চলে যেতে হবে।
-হুম। তবে খুব শিগ্রই আমরা সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাবো।
-আপনার কথা কবুল হোক।
_________
দুপুরের খাবারের জন্য হোটেলের সামনে বাস থামানো হলো। ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে খাওয়া দাওয়া হলে সবাই আবারও বাসে উঠে বসে। এখন মাহানুর বসেছে রাকার সাথে। রাকার স্বামী আরহামের পাশে যেয়ে বসেছে। আরহামও তাঁদের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। বেশিরভাগ পুরুষই তার সমবয়সী। কয়েকজন আবার তার থেকে বড়। মাহানুর আর রাকা গল্পে মেতেছে। তাঁদের সাথে যোগ দিয়েছে তনুশী আর শ্রেয়াও। মাহানুরের বয়স শুনে তারা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি। তনুশী পঁচিশ বছরের অথচ তার এক মেয়ে পাঁচ বছরের। আর শ্রেয়ার আট বছরের এক ছেলে। মাহানুর তাঁদের সংসারিক আলাপ শুনে বিব্ৰতবোধ করলো। রাকা বলল,
-তা মাহানুর কাল বিয়ে করে আজই ঘুরতে এসেছো! হানিমুন নাকি?
-আসলে ঐরকম না।
-হয়েছে হয়েছে আমরা বুঝতে পেরেছি তুমি সরম পাচ্ছ। নতুন নতুন বিয়ে হলে এইরকমই হয়। (তনুশী)
-তোমার হাসব্যান্ড কী কাজ করে মাহানুর? (শ্রেয়া)
মাহানুর হকচকিয়ে গেলো। আরহাম তো তার কাজ সিক্রেট রাখতে পছন্দ করে তাহলে এখন বলা কী উচিত হবে। অনেক ভেবেচিন্তে মাহানুর উত্তর দিলো,
-সে জব করে।
-ওওও! তোমাদের কী এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে?(রাকা)
-হ্যাঁ।
-ওহ। তোমরা দুই জামাই বউই বেশ লম্বা! মানিয়েছে তোমাদের।(তনুশী)
-ঠিক বলেছেন তনুশী আপু। দেই মেড ফর ইচ আদার। (রাকা)
মাহানুর কোনোরকম হাসলো। গলা ঝেরে জিগ্যেস করলো,
-এবার আপনাদের বিষয়ও কিছু বলুন। বাচ্চাদের ছাড়া থাকতে খারাপ লাগবে না?
-আমার তো এখনই খারাপ লাগছে। আমার বাচ্চা তার দাদুর কাছে বেশ ভালো থাকে তারপর কেমন যেনো খালি খালি লাগছে। (তনুশী)
-আমারও সেম অবস্থা। তবে এভাবে একটু নিজেদের মধ্যেও সময় কাটানো দরকার। (শ্রেয়া)
-আমাদেরই ভালো। শান্তি!(রাকা)
মাহানুর মাথা নাড়ালো। শ্রেয়া মুখ ভঙ্গি গম্ভীর করে বলল,
-শুনো তোমাদের একটা অ্যাডভাইস দেই। ফ্যামিলির কথায় ভুলেও জলদি জলদি বাচ্চাকাচ্চা নেবে না। নিজেদের মতো ঘুরবে, সব স্বপ্ন পূরণ করবে তারপর ধীরেসুস্থে বাচ্চা নেবে।
মাহানুর সরম পেলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। রাকা সরমে লাল হয়ে গেলো। এভাবেই তারা গল্প করছে আর বাস তার নিজ গতিতে চলছে।
বিকাল যেয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্য ঢলে পরে চারপাশে অন্ধকার করে দিয়েছে। তাঁদের বিকেলে সিলেটে পৌঁছানোর কথা থাকলেও অত্যাধিক জ্যামের কারণে সন্ধ্যা সাতটায় তারা সিলেটে পৌঁছায়। এখান থেকে মেঘালয়ের শহর শিলংয়ে যেতে যেতে বেশ কয়েক ঘন্টার মতো লাগবে। আবার সেখানকার রাস্তাঘাট সূর্যাস্তের পর সেফ নয়। তাই সবাই আজ রাত সিলেটের কোনো হোটেলে থাকার পরিকল্পনা করলো। সাদাফের সাথে বেশ কয়েকটা নামিদামি হোটেলের মালিকের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় খুব দ্রুত হোটেল পেয়ে যায় তারা। আট জোড়া কাপলের জন্য আটটি রুম, সাদাফ আর গাইডদের জন্য একটি রুম মোট নয়টি রুম বুক করা হলো। আজ রাত্রি এখানে যাপন করে আগামীকাল সকাল ভোরে তারা রওনা হবে তামাবিল চেকপোষ্টে। মেনেজার সবাইকে যার যার রুমের চাবি দিয়ে দেয়। উন্নত মানের হোটেল হওয়ায় প্রত্যেক বেলার খাবার সার্ভেন্টরা রুমে যেয়েই দিয়ে আসে। মাহানুর আরহামের পিছন পিছন হাঁটছে। কোথায় ভাবলো এই বুঝি জিরাফের থেকে পিছা ছুটলো এখন আরো একই রুমে, একই সাথে থাকতে হবে! আরহাম সেই সকালের পর থেকে মাহানুরের সাথে কথা বলেনি। সম্পূর্ণ ইগনোর করছে তাকে। এতে মাহানুরেরও কোনো আসে যায় না।
রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে আরহাম দরজা লাগিয়ে দিলো। মাহানুর কাঁধের ব্যাগ বিছানায় রেখে নিজেও ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। আরহাম তেড়ে এসে বলল,
-এই নোংরা শরীর নিয়ে বিছানায় বসেছেন কেনো আপনি? এখানে আমিও ঘুমাবো। শাওয়ার নিয়ে এসে বসুন।
-উরে বাবা! তুমি থেকে আপনিতে চলে গেলেন! গুড গুড! এভাবেই আমাকে সম্মান করে চলবেন।
আরহাম টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বলল,
-আমি স্ট্রেঞ্জারদের সাথে এভাবেই কথা বলি।
মাহানুর ভুলেই গিয়েছিলো সকালের কথা। জিবে আলতো কামড় দেয় সে। আরহামের ব্যাগ দেখে সরু নজরে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
-এই ব্যাগ, আর ট্যুরের জিনিসপত্র কিভাবে পেয়েছেন আরহাম ভাইয়া?
মুচকি হেসে আরহামকে জব্দ করতে বলল মাহানুর। মাহানুরের সাথে লাগতে এসেছো না চান্দু এবার শুধু বুঝবা মজা! আরহাম স্বাভাবিক। ভিতরে অগ্নিগোলা ভম্ব হলেও বাহ্যিক দিয়ে এমন রূপ যেনো সে ভাইয়া শব্দটি শুনতেই পায়নি।
-রিদের সবকিছু।
-ওউওওও!
মাহানুর নিজের ব্যাগ থেকে তোয়ালে আর ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুম চলে যায়। মাহানুর চলে যেতেই আরহাম আছাড় মেরে ব্যাগটা বিছানায় ফেললো। শার্টয়ের ওপরের কয়েকটা বোতাম খুলে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে এসে পরলো মাহানুর। আরহাম সেদিকে না তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢোকে। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে শার্ট না খুলেই ঝর্ণা ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বড় বড় নিঃশাস নিতেই সুন্দর বেলিফুলের একটি সুঘ্রাণ তার নাকে এসে ঠেকলো। এই ঘ্রাণ সে মাহানুরের শরীরের থেকেও পেয়েছে। হয়তো বেলিফুলের কোনো স্মেল যুক্ত বডিওয়াশ জেল ব্যবহার করে মাহানুর। আরহাম মুখ থেকে পানি ঝেরে আরো কয়েকবার ঘ্রাণ নিলো।
মাহানুর বাসার সবার সাথে কথা বলতে আয়াসকে কল দিলো। ইচ্ছেমতো বকে আয়াসকে। কিছুক্ষন কিছুক্ষন করে সবার সাথে কথা বলতে থাকে। আরহাম ওয়াশরুম থেকে বের হলো। মাহানুরকে ফোনে কথা বলতে দেখে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। মাহানুর বাঁকা চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
-ল্যাপটপ এনেছেন আপনি?
-হ্যাঁ।
আরহাম নিজের ল্যাপটপ বের করে দিলো মাহানুরকে। মাহানুর উৎফুল্ল হয়ে এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো। আরহাম সবসময় ভাবতো মানুষ রুপী বাঁদর শুধুই রিদ। তবে আজ মাহানুরকে দেখে তার ধারণা পাল্টে গেলো। হয়তো দুইজন আগের জনমে ভাইবোন ছিল! ল্যাপটপ দিয়ে আয়াসকে ভিডিও কল করলো মাহানুর। সবাই একত্রে ড্রইংরুমে বসা। আয়াস, মেহরাব খান, হামজা খানের কথা শেষ হলে সুনহেরা আসে।
-ভাবি আমার ভাইয়া কোথায়?
-তোমার জিরাফ মুখো ভাই পটল তুলতে গিয়েছে!
দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বিড়বিড় করে বলল মাহানুর। সুনহেরা মাহানুরের কথা শুনতে না পেয়ে বলল,
-মানে? কী বললেন ভাবি?
-তোমার ভাই পাশেই বসা ভাবি।
-এখন আর আপনি আমাকে প্লিস ভাবি বলবেন না। নাম ধরে ডাকলে আমি বেশি খুশি হবো।
-ঠিক আছে ডাকবো।
-ভাইয়া কোথায় তুমি?
সুনহেরার ডাকে আরহাম ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে আসে। মাহানুর একটু দূরে সরে বসলো। সুনহেরা আরহামকে দেখে বলল,
-আমার জন্য সেখানকার আঁচার আর চকলেট নিয়ে আইসো।
-ঠিক আছে নিয়ে আসবো।
-তোমরা অনেক বেশি এনজয় করিও আর হ্যাঁ কাপল পিক তুলে সেন্ড করবে আমাকে।
-হুম।
কথা শেষ হলে আরহাম তার ল্যাপটপ নিয়ে নেয়। আবারও দুইজন মৌন হয়ে যায়। রাতে খাবার আসলে দুইজন একসাথে খেয়ে নেয়। আরহামের কিছু জরুরি কল আসায় রুমের বেলকনিতে চলে যায় সে। মাহানুর কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে। সারাদিন জার্নি করায় ক্লান্ত চোখে ঘুম এসে বাসা বাঁধছে। কিন্তু আরহামের সাথে ঘুমোতে হবে ভেবে চোখ বন্ধ করতে পারছে না সে। রুমে তেমন বড় কোনো সোফাও নেই। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর রুমে আসে আরহাম। ফোন চার্জে দিয়ে বিছানায় বসতেই মাহানুর ইতস্তত করতে করতে বলল,
-আপনি বিছানায়ই ঘুমাবেন?
-হ্যাঁ। আপনার অসুবিধা থাকলে আপনি নিচে বিছানা পেতে ঘুমোতে পারেন। বাই দা ওয়ে আমি কিছুক্ষন আগেই খাটের নিচে ইঁদুর দৌড়াতে দেখেছি।
-আমার সমস্যা নেই। তাছাড়াও আপনি তো আমার ভাইয়ের মতোই! শুয়ে পরুন।
ভীত কণ্ঠে জবাব মাহানুরের। আরহামের চোয়াল কঠিন থেকে কঠিনত্বর হয়ে উঠলো। ছি! নিজের হাসব্যান্ডকে কেউ ভাই বলে! এই মেয়ের মাথায় ঘিলু বলতে কিছুই নেই। কয়েকমাস পর এই ভাইয়ার সন্তান পেটে নিয়ে ঘুরবে এই তারছেড়া মেয়ে! ছি! মনে মনে বলল আরহাম। বিছানার একপাশে বসে মধ্যে সুন্দর করে কোলবালিশ দিয়ে ঘেরা দিয়ে দিলো আরহাম। রুমের বাতি নিভিয়ে আরাম করে শুয়ে পরলো সে। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো মাহানুর। ভারী নিঃশাস ত্যাগ করছে আর আরহামের ঘুম হা’রাম করছে সে।
______________
মেঘালয় অর্থাৎ মেঘের আবাসস্থল। রাজ্যজুরেই যেনো মেঘের অপূর্ব খেলা। উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্ঠিত রাজ্য মেঘালয়। এই রাজ্যের উত্তর পূর্ব দিকে আসাম এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ অবস্থিত। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। ভারতের সবচেয়ে আদ্র অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত মেঘালয়। রাজ্যের প্রায় অর্ধেকের বেশি শতাংশ বনভূমি। সবসময়েই বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে টুরিস্টরা এখানে ভ্রমণ করতে আসতেই থাকে।
সকাল ভোরে তন্দ্রা ভেঙে যায় আরহামের। ছোট ছোট চোখে পাশে তাকায়। মাহানুর বিছানায় নেই। আরহাম আরমোড়া দিয়ে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে ফোন হাতে নেয়। সময় ছয়টা পনেরো বাজে। আরহাম টি-শার্ট টেনে ঠিক করে নিচে নামে। ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুম চলে যায়। মাহানুর বেলকনিতে এক্সারসাইজ করছে। লং শার্ট আর পেন্ট পরা সে। ওড়না খুলে পাশে রেখেছে। বেলকনির দরজা খুলে ভিতরে তাকায়। বিছানা খালি দেখে দ্রুত ওড়না নিয়ে পরে নিলো। ঘামাক্ত শরীরে রুমের ভিতরে ঢুকে মাহানুর। আরহাম তখনই ফ্রেশ হয়ে বের হয়। আড়চোখে মাহানুরের দিকে তাকাতেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় তার। খনিকের জন্য নিঃশাস আটকে গেলো। কপাল থেকে গলা বেয়ে বেয়ে ঘাম ঝরছে মাহানুর। মুক্তোদানার মতো চকচক করছে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোটা। আরহাম ঢোল গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো। দৃষ্টি সংযম করে সরিয়ে ফেললো। মাহানুর তোয়ালে দিয়ে গলা, মুখ মুছতে মুছতে বলল,
-সাদাফ ভাইয়া ফোন দিয়ে বলল সাতটায় নাস্তা করে বের হবো আমরা।
-ঠিক আছে।
যথাসময়ে রেডি হয়ে বের হয় আরহাম আর মাহানুর। সকলে একসাথে নাস্তা করে। তামাবিল চেকপোষ্টে যাওয়ার জন্য পুনরায় বাসে উঠে বসে। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে তারা সেখানে পৌঁছায়। আরহাম একজন গাইডের সাথে কথা বলছে। মাহানুর আড়চোখে তাকে দেখে সাদাফের পিছু পিছু হাঁটতে থাকলো। সকাল সকাল তাই কমই মানুষ এখানে। একে একে সবার কাস্টমস ইমিগ্রেশনের সব ফরমাল কাজ শেষ হয়। আরহাম মাহানুর থেকে বেশ দূরে দূরে হাঁটছে। মাহানুর মাথা ঘুরিয়ে আরহামের হাবভাব দেখে আবার সামনে তাকায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা বর্ডার ক্রস করে ডাউকি চলে আসলো। বেশি দূরত্ব না হওয়ায় কথায় কথায় হেঁটেই চলে আসলো তারা।
এখান থেকে গাড়িতে করে তাঁদের শিলং যেতে হবে। কার,মাইকেবাস, জিপ সবই আছে। সকলের কথা মতো কয়েকটা জিপ গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া হলো। তারা এখানে যে কয়দিন থাকবে এই জিপ দিয়েই যাতায়াত করবে। মাহানুর আগেও অনেকবার জিপে উঠেছে তবে এবার সে ভীষণ এক্সসাইটেড। সাদাফ সবাইকে জায়গার বর্ণনা দিচ্ছে।
-হেই সাদাফ!
মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে সকলে সামনে তাকায়। দুইজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো দেখতে পাহাড়ীদের মতো একটু চাকমা চাকমা। মেয়ে দুইজন শার্ট আর টাইট পেন্ট পরা। চোখে সানগ্লাস। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। সাদাফ বড় একটি হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলো।
-তোমাদের অপেক্ষায়ই ছিলাম। ভালো আছো?
-ইয়েস ব্রো।
-এসো।
সাদাফ তাঁদের দুইজনকে সকলের সামনে নিয়ে আসে। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
-ওরা হচ্ছে আমাদের এবার যাত্রার পথপ্রদর্শক। আমাদের সাথে আসা গাইড আমাদের সুবিধা অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটা দেখবে। আর উনারা আপনাদের এখানকার সব ঘুরার জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে।
সবাই চুপচাপ শুনলো সাদাফের কথা। অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েটি হাত নাড়িয়ে বলল,
-হ্যালো গাইস। আই এম হেবা।
-এন্ড আই এম মৌমিতা। আশা করি আমাদের সাথে আপনাদের যাত্রা আরো আনন্দনীয় হবে।
সকলে মুচকি হাসলো। রাকা আর মাহানুর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। রাকা হেবাকে দেখে বলল,
-হেবা নামের মেয়েটা একটু কেমন যেনো! তাই না মাহানুর?
-হয়তো অনেক বেশি স্টাইলিশ সে। দেখতে কিন্তু ভালোই।
-হ্যাঁ মোটামোটি। তোমার হাসব্যান্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি? দুইজন দূরে দূরে হাঁটছো?
-তেমন কিছু না। আসলে এরেঞ্জ ম্যারেজ তো তাই আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং কম।
-একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে জন্য এটা ক্ষতিকর। তোমরা এখন আরো বেশি বেশি একসাথে থাকবা। নিজেদের মধ্যে কথা বলবা তাহলেই তো তোমাদের নরমাল সম্পর্ক হবে।
-জি।
আমতা আমতা করে বলল মাহানুর। একে একে সবাই জিপে উঠে বসছে। শিলং যেতে কয়েক ঘন্টার মতো লাগবে। যাওয়ার পথে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে তারা সেখানে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখবে। একটা জিপের ড্রাইভার একটু অসুস্থ তাই আরহাম নিজেই ড্রাইভ করবে বলে মনস্থির করলো। সবাই ভীষণ অবাক হয়েছিল আরহাম জিপ চালাতে পারে শুনে। আরহাম ড্রাইভার সিটে বসে পরলো। রাকা জোর করে মাহানুরকে পাশে বসাতে নিলে আচমকা হেবা এসে বসে পরলো। মাহানুর মনে মনে স্বস্তির নিঃশাস ছাড়লো। যেহেতু জিপগুলো যথেষ্ট বড় তাই একটায় ছয়জনের জায়গা হয়ে যাবে।পিছনে মাহানুর, রাকা তার হাসব্যান্ড আর সাদাফ বসলো। মাহানুরের পাশেই বসেছে রাকা। আরহাম মিরর মাহানুরের দিকে সেট করে জিপ স্টার্ট দেয়। হেবা বাঁকা চোখে বারে বারে আরহামের দিকে তাকাচ্ছে। প্রথম দেখায় এই সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পরে গিয়েছে সে। আরহাম মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আর মাহানুরের হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখছে। হেবা নিজ থেকেই বলল,
-হাই। আই এম হেবা।
-হ্যালো।
ছোট উত্তর আরহামের। হেবার মন ক্ষুন্ন হয়। তবুও স্মিত হেসে বলে,
-আপনার নাম বলবেন না মিস্টার?
-আরহাম, আরহাম চৌধুরী।
খানিকটা সময় নিয়েই বলল আরহাম। সে হেবার সাথে কথা বলতে একদমই অমনোযোগী। এই মেয়ের হাবভাব তার কাছে ভালো ঠেকছে না। হেবা আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। কণ্ঠস্বর খাঁদে ফেলে বলল,
-জিম ট্রাইনার নাকি?
-নাহ। একজন সাধারণ এমপ্লয়ী।
-ওওও!
হেবা আর কিছু বলল না। রাকা আর তার হাসব্যান্ড গান গাইছে মাহানুর মুচকি হেসে তালি দিচ্ছে। এই কাপল একদম লাভবার্ড! দেখতেও তাঁদের সুন্দর লাগে। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে আগে বাড়ছে তাঁদের গাড়ি। আশেপাশে তাকিয়ে সামনের মিররের দিকে তাকাতেই সহসা দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। মাহানুর অগোছালো দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। পুনরায় তাকাতে দেখতে পায় আরহাম সেই একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। দ্বিতীয়বার দৃষ্টিপাত হওয়াতে সরম পেয়ে যায় মাহানুর। ভুল করেও আর সামনে তাকালো না। ঐ রুক্ষ দৃষ্টি দেখার ইচ্ছে নেই তার।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মেঘালয় রাজ্যের বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে পৌঁছায় তারা। বড় বড় পাহাড়ের গা বেয়ে ভয়ংকর সব পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে তাঁদের জিপ। বাতাসে মাহানুর কেশ উড়ছে। হাত দিয়ে সামনের কেশগুলো সরিয়ে আশেপাশে তাকায়। গাড়ি থেকে নিচের দিকে তাকাতেই গা শিউরে উঠলো তার। যদি কোনো কারণে এখন গাড়ির ব্রেক ফেইল করে তাহলে কয়েকহাজার ফুট নিচে পরে যাবে তারা। খুঁজেও পাওয়া যাবে না তাঁদের ম’রাদেহ। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো মাহানুর।
অরণ্য আচ্ছাদিত সবুজ পাহাড় আর মেঘের খেলা দেখতে দেখতে গভীর খাদের ভীতি দূর হয়ে গেলো তার। সামনের জিপ থামিয়ে কিছু মানুষ নিচে নেমেছে। এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। মাহানুরের মনে পরলো সে নিজের সাথে ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। দ্রুত কাঁধের থেকে ব্যাগ নামিয়ে ক্যামেরা বের করে। ফটাফট কয়েকটা প্রাকৃতিক চিত্র বদ্ধ করে ফেললো ক্যামেরায়।
তাঁদের কেউ আর জিপ থেকে নামলো না। কিছুটা দূর যেতেই আকাশের মেঘগুলো উড়ে যেতে দেখা গেল। ঠিক তাঁদের মাথার ওপর এসেই ভীড় জমালো যেনো! যত শিলংয়ের দিকে যাচ্ছে ততই বাতাসের তেজ বাড়ছে। মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। ভারী বাতাসে বড় বড় দানব আকৃতির গাছগুলো নড়ছে। এ যেনো বর্ষণের পূর্বভাস।
__________________
ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে রিদদের পরিবারের সবাই। রিদের বড় দুই ভাই। একজন কলেজের প্রফেসর আরেকজন বিজনেসম্যান। বড় জনের এগারো বছরের একটি ছেলে আর ছোট জনের নয়মাসের এক মেয়ে। রিদের বড় ভাবি একটু অহংকারী। গরিবদের মানুষ হিসেবে গণ্যই করে না সে। ছোট ভাবি আবার মোটামুটি ভালোই। রিদের বাবা, বড় ভাই আর ভাবি এক স্বভাবের। তার পরিবারের এই অহংকার, দেমাগের জন্যই রিদ যত পারে তাঁদের থেকে দূরে থাকে। শার্টয়ের বোতাম লাগাতে লাগাতে তাড়াহুড়ো করে আসে রিদ। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
-গুডমর্নিং। তোমরা সবাই এতো জলদি কিভাবে যে উঠো!
-সবাই তো আর তোর মতো ছন্নছাড়া না যে এগারোটায় ঘুম থেকে উঠবে! আমাদের অনেক কাজকর্ম থাকে তোর মতো বাপের হোটেলে বসে খাই না আমরা।
খোঁচা মেরে বলল রিদের বড় ভাই। রিদ স্মিত হাসলো। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সে। রিদের আম্মা বলল,
-এভাবে নাড়ছিস কেনো আব্বা? খাবার ভালো লাগছে না?
-আব্বা তোমাকে কিছু বলতে চাই আমি।
রিদের কথায় সকলে তার দিকে তাকালো। রিদের আব্বা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,
-দরকারের তো কিছু বলবে না অদরকারি কথাই নাহয় শুনি?
-আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি।
রিদের আব্বা ধীরে ধীরে শব্দ করে হেসে উঠলো। বাকি সবাই বিষয়টা আহামরি নিলো না। রিদ শান্ত ভাবেই বসে আছে। রিদের বাবা উপহাস স্বরে বলেন,
-ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলো না এখনই বিয়ে করবে! তোমার ছোটকালের বন্ধু আরহাম সে এখন বড় একজন আর্মি। নিউসপেপার খুললেই তার ছবি দেখে মন ভরে যায়। আর আমাদের নয়াবজাদা! টকাইদের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে!
-তুমি বলতে চাচ্ছ আমি তোমার পায়ে দাঁড়িয়ে আছি? তোমার পাও দিয়ে হাঁটছি?
রিদের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো রিদের ছোট ভাবি। স্বামীর চোখ রাঙ্গানি দেখে হাসি নিভে যায় তার। রিদের আব্বা কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললেন,
-আচ্ছা যাও মানলাম তুমি বিয়ে করতে চাচ্ছ। আগে অফিসে বসো তারপর আমি মেয়ে খুঁজছি।
-মেয়ে আমার খোঁজা আছে তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।
সকলে আশ্চর্য হয়ে রিদের দিকে তাকালো। রিদ স্বাভাবিক ভাবেই বেড চিবুচ্ছে। রিদের বাবা ক্ষেপে উঠলো। তার একটা ছেলেও নিজের পছন্দে বিয়ে করেনি আর রিদ কিনা বলছে মেয়ে খোঁজা আছে! শক্ত কণ্ঠে বললেন,
-তুমি কী জানো না এই বাড়ির ছেলেরা আমার পছন্দে বিয়ে করে? যে মেয়েকে আমার পছন্দ হয় না সে এই বাড়ির বউ হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না।
-তোমার আগের নিয়ম বাঘে খেয়েছে।
-আচ্ছা মেয়ে কী করে? বাসা কোথায়? তার বাবা মা কী করে?
-মেয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। বাসা চট্টগ্রামে এখানে একটা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। তার বাবা একজন সাধারণ চাকরিজীবী আর মা গৃহিনী।
-বাড়ি কয়তলা?
-টিনসিটের বাড়ি তাঁদের।
রিদের আব্বা হাসলো। বিকৃত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে জিগ্যেস করলো,
-ছোটবউ তোমাদের কয়তলা বাড়ি?
-আম্মুর পাঁচতলার একটি বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছে। আব্বুরও দুইটি বাড়ি ভাড়া দেওয়া। বর্তমান যেটায় থাকছে সেটা ছয়তলা।
-আর বড়বউ তোমাদের?
-আমার মা বাবা এখন যে বাসায় থাকছে সেটা নয়তলা শশুরআব্বা।
-দেখলে আর বুঝলে কিছু? ঐ মেয়ে তোমার যোগ্য না তাই তাকে ভুলে যাও। অফিসে জয়েন হও আমার ভালো মেয়ে খোঁজা আছে।
রিদ ক্রোধে হাত মুঠিবদ্ধ করে ফেললো। ধপ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। এক লাথিতে চেয়ার দূরে ছিটকে ফেলে দেয়। তিক্ত কণ্ঠে বলে,
-চাঙ্গে যাক তোমার অফিস, চাঙ্গে যাক তোমার মেয়ে দেখা! তোমার এই বিলাসবহুল বাড়ি তুমি কব’রে নিয়ে যেও। আমি ঐ মেয়েকেই বিয়ে করবো। তুমি রাজি থাকো বা না থাকো আমার কোনো যায় আসে না।
গট গট পা ফেলে সদর দরজা দিয়ে চলে গেলো রিদ। রিদের আব্বা কঠিন মুখে বসে রইলো। রিদের মা কান্না করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো।
<<<<চলবে। (গল্পের দরকারে কিছু কিছু জায়গার বর্ণনা দিতে হবে। আশা করি আপনাদের বোরিং লাগবে না। কেমন হয়েছে বলবেন। আসসালামু ওলাইকুম।)