তবে_ভালোবাসো_কী ২ #Mehek_Enayya(লেখিকা) পর্ব ২১

2
590

#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ২১

প্রচন্ড বৃষ্টি এবং বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে শিলংয়ে পৌঁছালো মাহানুররা। সময় বিকেল চারটা বাজে। অথচ আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আসার পথে তারা এলিফ্যান্ট ফলস ও বোরহিল ঝর্ণা থেকে ঘুরে এসেছে। মেঘালয়ের অন্যতম অপূর্ব জলপ্রপাত হলো এলিফ্যান্ট ফলস। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পরা পানির দৃশ্য দেখে যে কারো মন মুগ্ধতায় ভরে যায়। আকাশ তখন কালো মেঘে ঢাকা ছিল তাই ভীতগ্রস্ত হয়ে কেউই আর নিচে নামেনি। দূর থেকেই জলোচ্ছসের শব্দ ও শীতল বায়ু তাঁদের হৃদয়কে প্রফুল্ল করে তোলে। সেখানে আর বেশি সময় কাটালো না। একটু আরেকটা ছবি তুলে ফের রওনা হয় শিলংয়ের উদ্দেশ্যে। জিপ চলন্ত অবস্থায়ই ভারী বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টিতে এখানের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যেভাবে উপভোগ করা যায় সেভাবেই মনে অন্যরকম একটা ভয়ও কাজ করে। পাহাড়ি রাস্তা। যদি একটু উচনিচ হয়ে যায় তাহলে একদম গভীর খাঁদে পরে যাবে। মৃত্যু নিশ্চিত। এইরকম নানান ভয়,ভীতি কাটিয়ে অবশেষে তারা এসে পরে নিদিষ্ট গন্তব্যে।
চমৎকার সাজানো শহর। মেঘালয়ের শিলংয়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে পাঁচ হাজার ছয় ফুট। তাই এখানে বাতাস একটু বেশি। পাহাড়, ঝর্ণা মিলে শিলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেও মানুষদের আনাগোন। ছাতা কিংবা রেইনকোট পরে মানুষ কেনাকাটা করছে আবার কেউ কেউ ঘুরছে। এখানকার মানুষদের কথার ধরণ, মুখের আকৃতি অনেকটাই ভিন্ন।

মুখ ভার করে লাফ দিয়ে জিপ থেকে নেমে পরলো মাহানুর। চোখ, মুখে রাগের আভাস তার। এই রাগেরও যুক্তিসহ কারণ আছে। বৃষ্টি চলাকালীন সবাই রেইনকোট পরে নেয়। কেউ কেউ আবার ছাতা তুলে নিয়েছিল মাথার ওপর। আরহাম মনের ভুলে কিছুই আনেনি। বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে যাচ্ছিলো সে। মাহানুরের আবার একটু মায়া হয় তার জিরাফের ওপর। তার ব্যাগে এক্সট্রা রেইনকোট ছিল একটু বড় সাইজের। সেটা আরহামের ফিট হবে। মাহানুর ব্যাগ থেকে বের করে এগিয়ে দিলে হেবা নামের মেয়েটিও সেই সময়ই আরহামকে রেইনকোট এগিয়ে দেয়। আরহাম পিছনে ফিরে মাহানুরকে দেখলোও না। তাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে হেবার দেওয়া রেইনকোট নিয়ে নেয়। এতেই মাহানুরের ইগো হার্ট হয়। ভালো ভেবে দিয়েছিলো অথচ আরহাম ঐ মেয়েরটা নিলো তাকে দুই টাকারও দাম দিলো না! সেইসময় শান্ত ভাবে বসলেও মনে মনে আরহামকে ইচ্ছে মতো গা’লি দেয়। অন্য মেয়ের রেইনকোট নিয়েছে এতে তার প্রবলেম নেই তবে অন্য মেয়ের জন্য তাকে ইগনোর করেছে, এটিটিউড দেখিয়েছে এটাই আরহামের দোষ।

একে একে সবাই নেমে পাশেই দাঁড়ালো। হোটেল আগের থেকে অনলাইন বুক করে রাখা ছিল। সাদাফ ভিতরে গিয়েছে কিছু ফরমাল কাজ সম্পূর্ণ করতে। স্ট্রিডফুডের ঘ্রাণ নাকে আসতেই ক্ষুদার্থ পেট মোচড় দিয়ে উঠলো মাহানুরের।দুপুরে তারা দোকান থেকে হালকা পাতলা খাবার খেয়েছিলো তবে সেটায় পেট ভরেনি তার। আরহাম কিছু বলতে মাহানুরের কাছে আসছিলো তৎক্ষণাৎ হেবা তাকে ডেকে উঠলো। না চাওয়ার সত্ত্বেও আরহাম পিছনে ফিরলো।
-আপনি একটা জ্বরের মেডিসিন খেয়ে নিয়েন আরহাম। নাহলে অসুস্থের কারণে আগামীকাল ঘুরতে যেতে পারবেন না।
-ঠিক বলেছেন। আপনি এখানকার?
-হ্যাঁ।
-এখানকার মানুষরা নাকি বাংলা ভাষায় পারদর্শী নয়?
হেবা খিলখিলে হেসে উঠলো। মাহানুর হাসির আওয়াজ শুনে মাথা বাকিয়ে চোরা চোখে তাকালো। আরহামকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখলো মাহানুর। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সাদাফ তার হাতে চাবি দিতেই আরহামকে রেখেই ভিতরে চলে গেলো সে।
-আমি একজন ট্রাভেল এজেন্ট। তাই আমাদের মোটামোটি কয়েক দেশের ভাষাই শিখে রাখতে হয়।
-ওহ!
-আপনি কী গাইড হিসেবে এসেছেন?
-না। টুরিস্ট হিসেবে।
-সিরিয়াসলি! বাট এখানে সবাই তো কাপল।
অবাক কণ্ঠস্বর হেবার। আরহাম স্বচ্ছ হাসলো। ভরাট কণ্ঠে বলল,
-আমিও ম্যারিড। আমার ওয়াইফের সাথেই এসেছি।
-মজা করছেন?
-মোটেও না। এখন যে মেয়েটি ভিতরে গেলো সে আমার ওয়াইফ।
হেবা স্তব্ধ। কথা গুলিয়ে ফেললো সে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-ইউ মিন মাহানুর নামের মেয়েটি আপনার ওয়াইফ?
-ইয়েস।
-ওহ শিট! আমি বুঝতেই পারিনি।
আরহাম আর কিছু বলল না। মাহানুর তাকে রেখেই চলে গিয়েছে। আরহামও বড় বড় পা ফেলে ভিতরে চললো। মাহানুর শক্ত হাতে রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। ক্ষিপ্ত মেজাজে সামনের দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। অকেজো হয়ে যায় তার শরীরের সর্বাঙ্গ। বিছানা থেকে শুরু করে পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজানো। রুমের সবই সাদা। মোম দিয়ে ডেকোরেশন করা। পূর্বের হোটেলের রুম সাধারণ মানুষদের জন্য হলেও এই রুম যে সম্পূর্ণ কাপলদের সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। আরহাম হাঁচি দিতে দিতে রুমে ঢোকে। একবার মাহানুরের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরতেই সেও চমকে যায়। মাহানুরের ভাবভঙ্গি দেখে তার হাসিও পেলো ভীষণ। গলা ঝেরে বলল,
-এভাবে দাঁড়িয়েই রাত করবেন?
মাহানুরের ঘোর ভেঙে যায়। আবারও চোখ, মুখে রাগ উপচে পরছে তার। আরহামকে উপেক্ষা করে ধুপধাপ পা ফেলে সোফায় ব্যাগ রাখে। রেইনকোট থাকার সত্ত্বেও তার পরিহিত জামা ভিজে গিয়েছে। আরহাম নিজের ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে। বারবার হাঁচি দিচ্ছে সে। দাঁড়াতে শরীর কাঁপছে তার। আলগোছে সোফায় বসে পরে। মাথা চেপে ধরে। পাশেই মাহানুর দাঁড়িয়ে ছিল। আরহামকে দেখে তেজি কণ্ঠে বলল,
-ভেজা শরীর নিয়ে বসলেন কেনো? যান ড্রেস পরিবর্তন করে আসুন।
-এতো চেঁচামেচি করতে হবে না। একটু রেস্ট করে যাচ্ছি।
-আপনার রেস্ট এর চক্করে সোফা ভিজে যাবে। দ্রুত যান।
-মাথা সোজা করাও কঠিন হয়ে পরেছে বৃষ্টিতে ভিজে!
মাহানুর মুখ বাঁকালো। নিজের কাজ করতে করতে বলল,
-আর্মিরা এতো কমজোর হয় আমার জানা ছিল না! যান হেবার কাছে। যেভাবে রেইনকোট দিয়েছিলো সেভাবেই আপনার মাথার ব্যাথাও দূর করে দিবে।
-আর ইউ জেলাস?
কপাল চেপে ধরে বাঁকা হেসে বলল আরহাম। মাহানুর হকচকিয়ে গেলো। তাড়া দেখিয়ে বলল,
-নোহ। নট আই এম।
জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো মাহানুর। ওয়াশরুমের দরজা খুলতে আরেক দফা অবাক হয় সে। ওয়াশরুমেও ফুল দিয়ে সাজানো। বাথটাবে গোলাপের পাঁপড়ি ছিটানো। মাহানুর দরজা লাগিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-হো রে ভাই তোদের জন্য মানুষ ওয়াশরুমেও রোমান্স করবে! রোমান্স করতে না চাইলেও যে হারে ডেকোরেশন করেছিস দুই থেকে তিন হয়েই সবাই বাড়ি ফিরবে!
বেশ সময় লাগিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয় মাহানুর। সে বের হতেই আরহাম যায়। মাহানুর রুমের বেলকনিতে আসে। একমাত্র বেলকনিটাই তার পছন্দ হলো। তাঁদের রুম সাততলায়। এখান থেকে বৃষ্টি অনেক সুন্দর উপভোগ করা যাবে। এখন বৃষ্টির জোর বেড়েছে। মাহানুরকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি। মন খারাপ করে রুমে আসে মাহানুর। এভাবে চললে তারা ঘুরবে কিভাবে! আর এখানে এসে ঘুরতে না পারলে এখানে আসাটাই লস।
মাহানুর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাঁড়ছে। আরহাম কাশতে কাশতে বের হলো। আয়নায় চোখ পরতেই মাহানুরের স্নিগ্ধ, শ্রী মুখ তার নজরে আটকে যায়। একদম বউয়ের মতো মাহানুর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল ঝাঁড়ছে। আরহাম সম্মোহিত হয়ে কয়েক পা এগিয়ে যায়। মাহানুরের একদম পিছনে যেয়ে দাঁড়ায় সে। মাহানুর নিজের মতো বকবক করে পিছনে ফিরতেই আরহামের পুরুষালি বক্ষের সাথে বারি খেলো। আরহামের দুইহাত আপনা আপনিই মাহানুরের কোমরে চলে গেলো। মাহানুর মাথা তুলে আরহামের নজরে নজর রাখলো। আরহামের অন্যরকম চাহনি দেখে মাহানুরের ষষ্ঠইন্দ্রিয় চঞ্চল হয়ে উঠলো। সরে যেতে চাইলে আরহামের হাতবন্ধন থেকে ছুটতে পারে না। আরহামকে ঠেলে দূরে সরাতে চাইলে তার ধাক্কায় একচুলও নড়লো না আরহাম। মাহানুর আবারও আরহামের দিকে তাকালো। প্রগাঢ় দৃষ্টি তার। মাহানুর এবার জড়তা নিয়ে বলল,
-ছাড়ুন। আর সামনের থেকে সরে দাঁড়ান।
আরহামের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। মাহানুর কিছুটা চেঁচিয়ে বলল,
-কী বলছি ছাড়ুন? বদ্ধ রুমে একজন মেয়েকে একা পেতেই প্রবৃত্তি, পুরুষত্ব জেগে উঠলো নাকি?
আরহাম ধপ করে মাহানুরের কাঁধ থেকে ওড়না টেনে নিচে ফেলে দিলো। আরহামের কাজে বিস্মিত মাহানুর জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। দুইহাত দিয়ে বক্ষস্থল ঢাকার প্রয়াস করে। রাগ মিশ্রিত চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-আপনি এতটা লেইম পারসন আমি ভাবতেও পারিনি! ছি! এমন চরিত্রহীন, নিলজ্জ আমার হাসব্যান্ড ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে আমার।
-শাটআপ ইউ স্টুপিড। নিচে তাকাও।
মাহানুর ছোট ছোট চোখে নিচে তাকায়। মাহানুরের ওড়না থেকে একটি চেলা গড়গড় করে চলে গেলো। মাহানুর ভয় পেয়ে আরহামের বুকের সাথে লেগে যায়। আরহাম এই সুযোগে প্রাণ ভরে মাহানুরের কায়ার ঘ্রাণ শুকলো। তারপর কিছুটা রাগ দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো মাহানুর। মাহানুর পরতে পরতে বেঁচে যায়। আরহাম শক্ত, রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-লিসেন্ট তুমি কোনো আহামরি সুন্দরী নও যে তোমাকে দেখে আমার প্রবৃত্তি জেগে উঠবে! একটু ভালোভাবে কী কথা বলছি একদম মাথায় চড়ে নাচছো!যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছ!
মাহানুর নত মুখে তাকিয়ে রইলো। আরহাম আবারও বলল,
-ভুলে যেও না আমি তোমার হাসব্যান্ড। তোমার সো কলড রুপ, যৌবন আমার জন্য সম্পূর্ণ হালাল ও বৈধ। নেক্সট টাইম বুঝেশুনে কথাবার্তা বলবে। আমার কোনোরূপ শখ নেই তোমার
কাছে আসার বা তোমাকে ছোঁয়ার। মাইন্ড ইট।

আরহাম কথা শেষ করে সরে যায় মাহানুরের সামনে থেকে। মাহানুর থমথমে মুখে ব্যাগ থেকে আরেকটি ওড়না বের করতে থাকে। এতো আলিশান রুমে চেলা পোকা কিভাবে আসলো সেটা ভাবতে থাকে সে। আরহাম ফোন হাতে নিয়ে সরু নজরে তাকিয়ে বলল,
-আমার সামনে ওড়না ছাড়া থাকতে তোমার ইজ্জত লুটে যায় অথচ সাদা ড্রেস পরা ভেজা অবস্থায় সারারাস্তা ঘুরেছো! আমি কিন্তু বারবার তোমাকে সাবধান করবো না মাহানুর। ঐদিন ড্রেসের জন্য বলেছি আর আজ লাস্টবার বলছি। নেক্সট ড্রেসের প্রতি অসচেতন হলে এর পরিনাম ভয়ংকর হবে তোমার জন্য।
মাহানুরের রাগ হলেও কোনো উত্তর দিলো না সে। গোমড়া মুখে বেলকনিতে চলে যায়।
_______________
সাতটা বাজে। সুনহেরা হাজেরা আর লুৎফার থেকে রান্না শিখছে। সে বলতে গেলে ডিম ভাজি আর নুডুলস ছাড়া কিছুই রান্না করতে পারে না। মা দরকার ছাড়া কিচেনে কখনই তাকে ঢুকতে দিতো না। সুনহেরা একসময় এটা নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সে রান্না পারে না তার শাশুড়ি না জানে এই দোষের কারণে কত বকে তাকে! তবে আজকে তার চিন্তা শেষ হয়ে গেলো। হাজেরা যখন জানতে পারলো সুনহেরা রান্না পারে না তখন সে বললেন,
-সমস্যা নেই। একমাস আমাদের রান্না দেখো, একটুআরেকটু শিখো তারপর নাহয় তুমি রান্না করিও। তোমার শাশুড়ি এখনও সুস্থ আছে তাই তার হাতের রান্নাই উপভোগ করো। আর যেহেতু রান্না পারো না তাই রান্নাঘরেও আসবে না। কোনোভাবে যদি হাত পুড়ে বা কেটে যায় তখন আমরা তোমার আম্মুকে কী জবাব দেবো!
সুনহেরার ছোট মন খুশিতে ভরে যায় তখন। আনন্দে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হাজেরাকে। প্রসন্ন হেসে বলে,
-আপনার মতো একজন শাশুড়ি পেয়ে আমি তো ভাগ্যবতী মা।
-পাগল মেয়ে! আমিও তো ভাগ্যবতী ছেলের বউ রুপী দুইজন মেয়ে পেয়ে।
হাজেরা তাকে বিরিয়ানি রান্না শেখাচ্ছে। কত কেজি চালে কতটুকু মাংস দিয়ে হয় মুখস্ত করছে সুনহেরা। সায়রিন আবার রান্নাবান্নায় নেই। সে আছে তার স্টাইল আর ফ্যাশন নিয়ে। সুনহেরা রান্না দেখতে দেখতে বলল,
-মা বাসার সবার প্রিয় খাবার কী?
-তোমার শশুর আর চাচাশশুরদের প্রিয় খাবার সবজির খিচুড়ি আর আয়াস সহ বাকি সবার পছন্দের খাবার কাচ্চি। তাও আবার মাহানুরের হাতের তৈরি।
-ভাবি রান্না করতে পারে?
-হ্যাঁ। মোটামুটি সবই পারে। সেই পিচ্চিকালে তোমার মতো এসে এসে আমার রান্না করা দেখতো। দেখতে দেখতেই শিখে গিয়েছে।
-তাহলে আমাকেও কাচ্চি রান্না শিখিয়ে দিয়েন মা।
হাজেরা মুচকি হাসলো। বিরিয়ানি নাড়তে নাড়তে বলল,
-সেটা তোমার ভাবিই শিখাবে নে। এখন আমাদের থেকে বেশি ভালো কাচ্চি সেই রান্না করে।
-ঠিক আছে।
-আয়াস আর মাহানুরের নুডুলস অনেক ফেভারিট। যদি রামেনের মতো করে রান্না করে দেওয়া হয় তাহলে আর কথাই নেই!
পাশ থেকে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল লুৎফা। সুনহেরা আয়াসের নাম শুনে একটু সরম পায়। মনে মনে ডিসাইড করলো যেভাবেই হোক ঐরকম নুডুলস রান্না শিখবে সে। তারপর একদিন বানিয়ে আয়াসকে চমকে দেবে।

রান্না দেখা শেষ হলে ফিহা আর ফায়াজকে নিয়ে নিজের রুমে আসে সুনহেরা। একা একা তার বোরিং লাগে তাই তাঁদের সাথে বসে কার্টুন দেখবে। আয়াস সেই বিকেলে বের হয়েছে এখনও তার খবর নেই। ছোট ফিহা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তাকে। সুনহেরা হাসি মুখে উত্তর দিচ্ছে। তিনজন একসাথে বিছানায় বসে টিভিতে ডোরেমন চালু করে লাইট অফ করে দেখতে থাকে। সুনহেরা দুইজনকে চকলেট বের করে দেয়।
-ফিহা তোমার আয়াস ভাইয়া রাতে বাসায় কখন আসে?
আমতা আমতা করে জিগ্যেস করলো সুনহেরা। ফিহা চকলেট খেতে খেতে বলল,
-ভাইয়া তো রাতে বাসায়ই থাকে।
-ওহ!
সুনহেরা আর কিছু জিগ্যেস করলো না। তার মানে তার জন্যই আয়াস এখনও বাহিরে। কেনো আয়াসের কাছে অনেক বিরক্তকর সে! আয়াস কী সত্যি তাকে অনেক অপছন্দ করেন! এইরকম নানান ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সুনহেরার। কী আজব! সে প্রথমে বিয়েই করতে চায়নি অথচ এখন আয়াস তাকে উপেক্ষা করছে বলে তার মন খারাপ লাগছে!
____________
একনাগাড়ে বেশ অনেকক্ষণ বৃষ্টি হয়ে থেমে যায়। যেহেতু বৃষ্টি নেই তাই কিছুক্ষন বিশ্রাম করে সবাই বের হয় রাতের শিলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কয়েকজন আবার ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া পেয়ে ঘুম দিয়েছে নয়তো পার্টনারদের সাথে সময় কাটাচ্ছে। আরহাম প্রথমে আসতে চায়নি। বৃষ্টিতে ভেজার ফলে একটুআধটু জ্বর বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। মাথা ভীষণ ব্যাথা করছিলো। কিন্তু যখন দেখলো মাহানুর ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখন টনক নড়ে গেলো আরহামের। সেখানে কতগুলো ছেলে থাকবে তার মধ্যে ঐ গায়ে পরা সাদাফও থাকবে। অন্য মেয়েরা গেলেও তারা তাঁদের হাসব্যান্ডের সাথে থাকবে যদি মাহানুরের সাথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়। না আরহাম আর ভাবতে পারলো না। সে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই পকেটে ফোন ভরে মাহানুরের পিছু পিছু বের হয়। সব কিছু একদিকে আর স্ত্রী আরেকদিকে। আর যদি স্ত্রী মাহানুরের মতো উড়নচন্ডী হয় তাহলে টেনশন একটু বেশিই!

সাদা রঙের থ্রি পিস পরেছে মাহানুর। ওড়না চাদরের মতো শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে। বাহিরে অনেক বেশি ঠান্ডা। তার ছাড়া চুলগুলোকে কিছুক্ষন পর পর ধমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাঁকা চোখে আরহামের দিকে তাকায় সে। শ্যামবর্ণ মুখমন্ডল কিছুটা লালচে হয়ে আছে। নাক একটু বেশিই লাল। কিছুক্ষন পর পর হাঁচি দিচ্ছে। সবসময় পরিপাটি থাকা কেশ অগোছালো হয়ে আছে। দাঁড়ি কিছুটা বড় হয়েছে। সেই প্রথমদিন যখন সে আরহামকে দেখেছিলো তখন আরহামের চুল একদম ছোট ছোট ছিল আর দাঁড়ির বিন্দুমাত্রও ছিল না। কেমন একটা গুন্ডা গুন্ডা ভাব ছিল মুখে! আর আজ দেখতে অনেকটা মলিন আর নম্র লাগছে। সবকিছুই ঠিক ছিল তবে এখনও আরহাম হেবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কই কখন তো তার সাথে এভাবে হেসে কথা বলল না! আর কী বা এতো কথা তাঁদের! ওহ বুঝতে পেরেছি ঐ মেয়ের সাথে কথা বলতেই তো জিরাফের বাচ্চা এসেছে! বলুক গা কথা আমার কী যতসব। দূরে যেয়ে মরুক শা’লায়! মনে মনে নিজের সত্ত্বাকে নিজেই বলল মাহানুর। তার যে একটু একটু হিংসা হচ্ছে এটা সে মানতে নারাজ।
নয়টা বাজার পূর্বেই রাস্তাঘাট কেমন নীরব হতে শুরু করলো। বাতাসের তেজ আবারও বাড়ছে। দূরেই তারা একটি রেস্তোরা দেখতে পেলো। যেহেতু বের হয়েছে তাই রাতের খাবার খেয়েই হোটেলে ফিরবে সবাই। মাহানুর বাতাসে কেঁপে কেঁপে হাঁটছে। কিছুটা দুরের কয়েকজন ছেলেলোক নিকৃষ্ট চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাহানুরের সেদিকে তাকিয়ে রাগও হয় আবার একটু ভয়ও হয়। ভীত নজরে ডানপাশে তাকাতেই আরহামকে তার একদম নিকটে দেখতে পায়। আরহাম স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটছে। আচমকা আরহাম একহাত দিয়ে মাহানুরকে আগলে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মাহানুর এমনেই তো শীতে কাঁপছিলো আরহামের ছোঁয়া পেয়ে জমে গেলো তার শরীর। আরহামের হাত এখন তার পিঠে অবস্থিত। আশেপাশে মানুষ থাকায় মাহানুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-সমস্যা কী আপনের? আমার কাছে ঘেঁষতে এসেছেন কেনো? দূরে সরে হাঁটুন।
-আমার আর কোনো বউ নেই যে তাঁদের সাথে ঘেঁষতে যাবো।
-থাকতেও পারে! এখন আমাকে ছাড়ুন। তাছাড়াও কারো না শখ নেই আমার কাছে আসার তাহলে এখন সে বেহায়ার মতো আমাকে ছুঁইছে কেনো?
-আমার শশুরআব্বা তার মেয়েকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছে সেটাই আমি পালন করছি। তাছাড়াও আমি চাইনা মানুষজন তোমাকে সিঙ্গেল ভেবে তাকিয়ে থাকুক। তাই চুপচাপ যেভাবে আছো সেভাবেই হেঁটে চলো।
-তাকিয়ে থাকুক, যা মন চায় করুক আপনার তাতে কী? এতো পিরিত উতলে পরছে কেনো?
-তোমার ভাষা শুনলে মাঝে মাঝে আমার মাথা হেং হয়ে যায়। মন চায় তোমাকে তুলে আছাড় মারি।
-যতসব! আপনি আপনাকে মানুষদের সামনে লজ্জায় ফেলছেন।
-এখন চুপচাপ না হাঁটলে আরো ভয়ংকর কাজ করে বসবো আমি। হোপ ইউ নো হোয়াট আই মিন ওয়াইফি! তাই ভদ্র মেয়ের মতো চুপ থাকো আমাকে রাগীও না।
-আপনাকে আমি পরে দেখে ছাড়বো।
-শুধু দেখবে কেনো আরো কিছু করিও আমার কোনো প্রবলেম নেই।
নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল আরহাম। মাহানুর মুখ বন্ধ রেখেই হাঁটতে থাকে। আরহাম হালকা ভাবে ধরলেও মাহানুর কেমন যেনো অনুভূতি হচ্ছে। এই ছোঁয়াতে সে খারাপ কিছু অনুভব করলো না বরং তারও মনের ভয় দূর হয়ে গেলো। নাম না জানা এক অদ্ভুত অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো সে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে সকলে আবার হোটেলে এসে পরলো। আরহাম ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে। মাহানুর সোফায় বসে ক্যামেরার ছবি দেখছে। এতো সুন্দর সুন্দর প্রকৃতির ছবি দেখলেও মন ভরে যায়। সহসা একটি ছবিতে নজর আটকে গেলো মাহানুরের। ক্যামেরা সামনে নিয়ে ভালোভাবে ছবিটায় চোখ বুলালো। ভুল ক্রমে আরহাম এসে পরেছে ছবিতে। একহাত দিয়ে ড্রাইভ করছে আরেক হাত মাথার চুলে। মাহানুর ঐ ছবিটা দ্রুত নিজের ফোনে নিয়ে নেয়। অনেকটা জুম করে দেখতে থাকে আরহামকে। শান্ত মুখ ভঙ্গি তার। নজর জিপের মিররে। মাহানুর মিররের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই চমকে যায়। এতোটাই চমকিত হয় তার ওষ্ঠজোড়া কিছুটা ফাঁক হয়ে যায়। মিররে তার মুখ। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে সে। তার মানে আরহাম সারারাস্তা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল! কিন্তু কী দেখছিলো তার মুখে? সে তো আরহামের দুই চোখের বিষ তাহলে এতো নিখুঁত ভাবে কেনো তার দিকে দিকে তাকিয়ে ছিল!

নির্জন, নীরব রজনী। ঝুম বৃষ্টির সাথে বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো মাহানুর। বিকট শব্দ তুলছে একেকটা বজ্রপাত। পশ্চিমের জানালা খোলা পর্দা দেওয়া। বিজলি চমকানোর আলোয় কিছুক্ষন পর পর রুম আলোকিত হয়ে উঠছে। মাহানুর গায়ের কাঁথাটা ভালোভাবে জড়িয়ে ধরলো। মাথা সহ সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে নিলো সে। পাশ থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠে আওয়াজ শুনতে পেলো মাহানুর। কাঁথা মুখ থেকে নামায়। মাথা ঘুরিয়ে পিছনে আরহামের দিকে তাকায়। অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে খুক খুক করে কাশছে আরহাম। মাহানুরের কেনো জানি একটু মায়া হলো বেচারার ওপর। যতই হোক সেও একজন মানুষ। এতো পাষান হওয়া যায় না! ওড়না সুন্দর ভাবে গায়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করে। আরহামের কাছে এসে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
-আপনার কী শরীর অসুস্থ লাগছে?
-না। নাটকে অভিনয় করবো সেটারই প্রাকটিস করছি!
-বাহ্ বাহ্ মাহানুর তোর হাসব্যান্ডের গুনের অভাব নেই! আর্মি এখন আবার অভিনেতা! তা কোনো ষাট বছরের বুড়োর রোল করছেন নাকি!

>>>চলবে।

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here