স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৩৮

1
617

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পূর্বাশা কি বুঝলো জানা নেই। তবে সে হাত রাখলো মিসেস শীওর কাঁধে। শান্ত কন্ঠে বলল – আমার মেঝ মামা জাফর চৌধুরী।

মিসেস শীওর ধ্যান ভাঙলো যেন, নিজের হুঁশ ফিরে পেল কিছুটা। তবে কোনো দিকে তাকালো না সে। নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে শুরু করলো তার সম্মুখে মানব সমাজে দাঁড়ানো উন্মাদ কিংবা পা’গ’ল হিসেবে পরিচিত মানবের নিকট। তবে তাকে বাঁধা দিলেন তৃষামের মা অর্থাৎ পূর্বাশার বড় মামী কাকন বেগম। মিসেস শীওকে সাবধান করতে তিনি বললেন – ওর দিকে যাবেন না। ও নিজের আশেপাশে সহ্য করতে পারে না কাউকে। কেউ কাছে গেলেও আঘাত করে তাকে।

মিসেস শীও যেন শুনলেন না কিছু। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন জাফর চৌধুরীর সম্মুখে। ধরা গলায় ডাকলেন – জাফর!

তীব্র আলোর ঝলকানি সহ্য করতে না পেরে বন্ধ করে রাখা চক্ষুদ্বয় পিটপিট করে খুললেন জাফর চৌধুরী। তবে আজ কাউকে আঘাত করলেন না তিনি। বরং দৃষ্টি শীতল হলো তার। এত বছর পর বুঝি লোকটা চিনতে পরলো কাউকে। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন মিসেস শীওর পানে। অতঃপর অস্ফুট কন্ঠে বললেন – শীও!

মিসেস শীও হু হু করে কেঁদে উঠলেন। এতদিন পর প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্যে এসে ধরে রাখতে পারলেন না আর নিজেকে। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে জড়িয়ে ধরলেন জাফর চৌধুরীকে। কান্নারত কন্ঠেই বললেন – তুমি কেন ফিরে গেলে না জাফর? আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।

মিসেস শীওর আর্তনাদ বোধহয় একটু খানি আঘাত করলো জাফর চৌধুরীর হৃদয়ে। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টালেন তিনি। অভিযোগের সুরে বললেন – আমি, আমি যেতে চেয়েছিলাম তো। কিন্তু দেখো ওরা যেতে দেয়নি আমাকে। এখানে জোর করে বেঁধে রেখেছে। আমাকে তোমার কাছে ওরা যেতে দেয়নি শীও।

বাবা মায়ের এমন আবেগঘন মুহূর্তে কোনো সন্তানেরই বিরক্ত করা উচিৎ নয় কিন্তু জায়ান যে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারছে না। তার বাবা তার সম্মুখে। তাকে সে ছোট বেলা থেকে শুধুমাত্র স্বপ্নেই দেখেছে আজ সে বাস্তবে ধরা দিয়েছে তার কাছে। যেই বাবাকে একটা বার দেখার জন্য ছটফট করে ম’রে’ছে সে আজ সেই বাবার দেখা মিলেছে যে। বাবাকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য হাতটা যেন নিশপিশ করছে। বাবার কাছে থেকেও তার থেকে এই দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না যে ছেলেটার। জায়ান ভুলে গেল তার পিতা মাতার আবেগঘন মুহুর্তের কথা। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল বাবার নিকটে। কিন্তু তার বাবা বুঝলো না তাকে। ছেলের হৃদয়ের আকুলতা বুঝি উন্মাদ পিতার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো না। জায়ানকে নিজের দিকে এগুতে দেখেই ফুঁসে উঠলেন তিনি। ক্রোধে যেন হিংস্র হয়ে উঠলো তার মুখমন্ডল। মিসেস শীওকে ছাড়িয়ে নিলের নিজের থেকে। তেড়ে গেলেন জায়ানের দিকে। তবে ছেলেটার কাছ অব্দি পৌঁছাতে আর পারলেন না তিনি, তার আগেই হাতে পায়ে বাঁধা লোহার মরিচা ধরা শিকলগুলো দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হলেন তিনি। তবে এই টুকুতেই দমে গেলেন না জাফর চৌধুরী। চোখে মুখে আগুন ঢালা ক্রোধ নিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজলেন তিনি। পায়ের কাছে পড়ে থাকা স্টিলের একটা খাবার প্লেট হাতে তুলে নিলেন। চড়ম হিংস্রতার সহীত সে প্লেটখানা ছুঁড়ে দিতে চাইলেন জায়ানের পানে। ঠিক তখনই তার হাত খানা ধরে ফেললেন মিসেস শীও। শীতল কন্ঠে বললেন – তোমার ছেলে জায়ান, জায়ান ইবনে জাফর চৌধুরী।

জাফর চৌধুরী দমে গেলেন সাথে সাথেই। শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন মিসেস শীওর পানে। বার কয়েক পলক ঝাপটে প্রশ্ন করলেন – আমার ছেলে?

মিসেস শীও মাথা ঝাঁকালেন, বললেন – তোমার ছেলে।

জাফর চৌধুরী হাতে ধরে রাখা স্টিলের প্লেট খানা ফেলে দিলেন নিচে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন যেন। নিজের হাতে পায়ে বাঁধা থাকা শিকল গুলো খুলে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভীষনভাবে। এক শিকল দিয়ে অন্য শিকলে আঘাত করে ঝনঝন শব্দ তুললেন পুরো কক্ষে। ব্যাকুল কন্ঠে বললেন – আমি আমার ছেলের কাছে যাব। আমার ছেলে, আমার অংশ। আমার ছেলের কাছে যাব।

বাবার এমন ব্যাকুলতা ভরা আবদার ফেলতে পারলো না জায়ান। ছুটে গেল সে বাবার পানে। জীর্নশীর্ন দেহী, নোংরা পোশাক পরিহিত বাবাকে বুকে জড়িয়ে নিল সে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক শক্তপোক্ত পুরুষ মানুষ হয়েও ডুকরে কেঁদে উঠলো ছেলেটা। বাবার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল – আমার বাবা, আমি আমার বাবাকে পেয়েছি। তিনি আছেন, তিনি আছেন।

এত বছর পর জাফর চৌধুরীকে একটু স্বাভাবিক আচরন করতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির সবাই। তারপরে এই আবেগ জড়িত ঘটনাগুলো সকলের চোখেই পানি এনে দিয়েছিল। তাদের আর সাহস হয়ে ওঠেনি এমন আবেগঘন মুহূর্তগুলোকে ভাঙার। তাই দরজার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সবাই। তবে এবার হয়তো তাদের একটু বিরক্ত করতে ভিতরে প্রবেশ করলো পূর্বাশা। মেয়েটার চোখ দুটোও পরিপূর্ণ অশ্রু দ্বারা। পূর্বশা এগিয়ে গেল সে মিসেস শীওর পানে। তার পশে দাঁড়িয়ে বলল – আমার মামা আপনাকে ঠকায়নি ম্যাম, পলিয়েও আসেনি আপনাদের ছেড়ে। সে ফিরতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভাগ্যের কাছে প্রচন্ড বাজেভাবে হেরে গিয়েছিলেন।

মিসেস শীও পাশ ফিরে তাকালেন পূর্বাশার পানে। মেয়েটা একটু সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো – মায়ের মুখে শুনেছি, আমাদের সব মামা খালাদের মধ্যে মেঝ মামা মেধাবী ছিলেন খুব। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল বাহিরে পড়তে যাওয়ার। নানাজান প্রথমে ছেলেকে দূরে পাঠাতে রাজি না হলেও মেঝ মামার জেদের কাছে হার মেনেছিলেন পরবর্তীতে। একটা নির্দিষ্ট সময় নিয়ে বাংলাদেশের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সে পাড়ি জমান চীনে। কিছু বছর পর পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসে জানান সে নাকি চীন দেশীয় কোনো এক নারীর প্রণয়ে গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, ইতমধ্যে তাকে বিয়েও করে ফেলেছেন। নানাজান কিছুতেই মানতে পারেননি মেঝ মামার কথা। সে ভেবেছিলেন চীন দেশীয় নারী কখনও বাংলাদেশে এসে সংসার করবে না বরং তার ছেলেকে নিয়ে আবার পাড়ি জমাবে চীনে। তখন ছেলেকে সারাজীবনের জন্য হারাতে হবে তাকে। নানাজান দেশেই মামাকে বিয়ে করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু মামা! তার হৃদয়ে তো শুধুমাত্র আপনি ছিলেন। সে আপনাকে ব্যতীত অন্য কোনো নারীকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসবে নির্বাচন করতে পারেনি। তখন নানাজান জোর জবরদস্তি শুরু করেন। কিন্তু জোর করলেই কি সব হয় বলুন? আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই একটা কথা শুনি পরিবারের চাপে পড়ে করেছি, বাবা মা জোর করে দিয়েছে, আমার কোনো উপায় ছিল না। আসলেই কি বিষয়গুলো এমন? আমি জানি না তবে একটা কথা আমি খুব ভালোভাবে মানি যে,

“আপনার ভিতরে যদি ছিটেফোঁটা কোনো ইচ্ছে না থাকে কিংবা যদি আপনি না চান তবে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই আপনাকে জোর করার।”

আমি অবশ্য এই কথাটা বিশ্বাস করি মেঝ মামার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী থেকেই। সেদিন নানাজান জোর জবরদস্তি করে মেঝ মামাকে বিয়ের পিঁড়িতে তো বসিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু কবুল বলাতে পারেননি। কাজী সাহেব যখন কবুল বলতে বলেছিলেন তখন নাকি মেঝ মামা চিৎকার করে বলেছিলেন “আমি বিবাহিত, ভালোবাসি কাউকে। এই জীবনে আমার দ্বারা আর না কাউকে ভালোবাসা সম্ভব আর না কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব।”

বিয়ের পিঁড়িতে বসে যদি কোনো ছেলে এমন কথা বলে তখন কে তাকে মেয়ে দিবে? মামার বিয়েটা তৎক্ষণাৎ ভেঙে যায়। গ্রামের লোকেরা ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেন। নানাজান তখন ভীষন ক্ষুদ্ধ হয় মেঝ মামার উপর। ঘর বন্ধি করে রাখেন তাকে। শুধু মাত্র মাঝে মাঝে খুলে খাবার দেওয়া হতো তাকে। তাও বেশিরভাগই দরজার নিচ থেকেই দেওয়া হতো। একা একা দীর্ঘদিন এক অন্ধকার কক্ষে বন্ধি থাকার দরুন মেঝ মামা নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। আর যখন তাকে এই অন্ধকার ঘর থেকে নানাজান মুক্তি আদেশ দেন ততদিনে তিনি এক বদ্ধ উন্মাদে পরিনত হন। কেউ কাছে গেলেই হিংস্র হয়ে ওঠেন তিনি, আঘাত করেন সম্মুখের ব্যক্তিকে।

এইটুকু বলে একটু থামলো পূর্বাশা অতঃপর আবার বলল – আপনি যে চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলেন সব চিঠিগুলোই মেঝ মামার ঠিকানায় এসেছিল কিন্তু নানাজান তা মেঝ মামার হাতে পৌঁছানোর আগেই লুকিয়ে ফেলেছিল। যার দরুন মেঝ মামা কখনও জানতেই পারেননি আপনি তাকে চিঠি দিয়েছেন। আর তার অল্প সময় পরই মেঝ মামা অসুস্থ হয়ে যান। থাকে নিয়ে শহরে চলে আসা হয়। ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে নানাজান নিজের ভুল বুঝতে পারেন। মেঝ মামার চিকিৎসার স্বার্থে গ্রামের সকল ভিটেমাটি বিক্রি করে শহরেই বসত গড়েন। যার ফলে আপনি যখন মেঝ মামাকে তার গ্রামের বাড়িতে খুঁজতে এসেছিলেন সেখানে তার দেখা পাননি। নানাজানও শেষ বয়সে আপনাকে খোঁজার উদ্যেগ নিয়েছিল কিন্তু আপনার ঠিকানা না জানায় তা আর সম্ভব হয়নি।

মিসেস শীও শুনলেন পূর্বাশার বলা প্রতিটি কথা, জায়ানও শুনেছে। মিসেস শীওর বিশ্বাস আজ সত্যি বলে প্রমানিত হলো। ভালোবেসে ভুল করেনি সে, সঠিক মানুষকে ভালোবেসেছে মিসেস শীও। কিন্তু তাকে ভালোবেসে এই লোকটার আজ এই পরিনতি। বদ্ধ উন্মাদ সে। আবারও চোখ ভরে উঠলো মিসেস শীওর। এতদিন পর ফিরে পাওয়া মানুষটার এই কষ্টকর পরিনতি মেনে নিতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে যেন তার। তবে এখন আর মিসেস শীও কিংবা জায়ানকে বিরক্ত করলো না কেউ। নিজের স্বামী, প্রিয় পুরুষ এবং একজন সন্তানকে তার পিতার সাথে সময় কাটাতে ছেড়ে গেলেন সবাই। শুধুমাত্র যাওয়ার আগে জাহিদ চৌধুরী একটু এগিয়ে ভাইয়ের হাত পা থেকে শিকল খোলার জন্য একটা চাবি দিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেলেন জায়ানের হাতে।

***

সময় গড়ালো একটু। নিজেদের ভিতরকার আবেগঘন কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালো জায়ান। নিজের সাথে নিজের বাবাকেও উঠিয়ে দাঁড় করালো। তার হাত খানা ধরে আস্তে ধীরে নিয়ে আসতে শুরু করলো বাইরের দিকে। বহু বছর পর আজ ছেলের হাত ধরে যেন নতুন ভাবে হাঁটতে শিখেছে জাফর চৌধুরী। দুনিয়ার চিরচেনা নিয়ম অনুসারে সন্তানকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারন করে তার মা আর তাকে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে শিখায় তার বাবা। সেই সৌভাগ্য জায়ানের হয়নি। তবে তার বাবাকে নতুনভাবে হাঁটতে শেখানোর সৌভাগ্য তার হয়েছে। এত বছর শিকলের প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ থেকে যেন হাঁটতে ভুলে গিয়েছিলেন জাফর চৌধুরী। ছেলের হাত ধরে এবার সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চাদের মতো করে এক পা দু পা করে করে হাঁটতে শুরু করলেন সে। কিন্তু দরজার সম্মুখে যেতেই থমকে দাঁড়ালেন লোকটা। ভয়ে আঁকড়ে ধরলেন ছেলের বাহু। আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠে বলল – আমি যাব না। বাহিরে বেরুলে ওরা আমাকে আবার বেঁধে ফেলবে ঐ শিকল দিয়ে। আমার যে বড্ড ব্যথা লাগে শেকলের ঘর্ষনে। আমি ঐ লোহার যন্ত্রের ভারও বহন করতে পারি না। অত বড় লোহার শিকল তোলার শক্তি কি আমার এই টুকু শরীরে আছে নাকি?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here