#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আর আসবে না ফিরে। সেও আর খুঁজে পাবে না পূর্বাশাকে, সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে সে মেয়েটাকে? না না এ হতে পারে না, সে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না পূর্বাশাকে। ভিতরে ভিতরে উন্মাদ হয়ে পড়লো ছেলেটা। চেয়েও কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না জায়ান। এই কয়টা দিন ঠিক কিভাবে যে ছেলেটা নিজেকে সামলে রেখেছে, বারংবার পূর্বাশার সম্মুখে নিজের ক্রোধকে দমিয়ে রেখেছে তা একমাত্র সেই জানে। জায়ান ছোট বেলা থেকেই কঠোর ব্যক্তিত্ত সম্পন্ন। তার চরিত্রের সঙ্গে ছ্যাচড়া, বেহায়া শব্দ দুটো বরাবরই বেমানান। কিন্তু এই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য, নিজের কাছে রেখে দেওয়ার জন্য সে ছ্যাচড়া, বেহায়া হতেও দুই বার ভাবেনি। আর সেই নারীই কিনা আজ চলে যাবে তাকে ছেড়ে? আজ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না জায়ান। বহুকাল আগে সংগঠিত সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে পারে না সে। পূর্বাশা শুধুমাত্র জায়ানের। আর তার কাছেই থাকবে সারাজীবনের জন্য। না থাকতে চাইলে জোর করে নিজের সাথে বেঁধে রাখবে তবুও হারিয়ে যেতে দিবে না। বিরবিরিয়ে উঠলো জায়ান। ধরা গলায় নিজেকে নিজে শুধালো – পূর্বাশা আমার, শুধুমাত্র আমার। সে আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না।
পরক্ষনেই আবার চিৎকার করে উঠলো ছেলেটা। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে চিৎকার করে সে বলল – না তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো না। আমাকে একা করে দিয়ে তুমি পালিয়ে যেতে পারো না কৃষ্ণময়ী।
জায়ানের হুংকারে কেঁপে উঠলো উপস্থিত সবাই। পূর্বাশা প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষনেই সামলে নিল নিজেকে। শক্ত হতে হবে তাকে। আর কারো সম্মুখে নিজেকে দূর্বল কিংবা নরম প্রকাশ করা যাবে না। লোকচক্ষুর সম্মুখে নিজেকে দূর্বল প্রমান করতে করতেই তো তার আজ এই দশা। পূর্বাশা জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করলো। কন্ঠে কাঠিন্য এটে বলল – আপনি ভুল বললেন জায়ান ভাই। আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, আমি সকলের সম্মুখে সরাসরিভাবে বলে কয়ে চলে যাচ্ছি। আর ভুলে যাবেন না আপনার সাথে আমি কখনওই কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলাম না, হোক তা প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমার কাছে আপনি শুধুমাত্র আমার কাজিনের বন্ধু। তাহলে এখানে আমার আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে? আশ্চর্য!
জায়ান কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পূর্বাশার পানে অতঃপর হুট করেই কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে। কন্ঠে প্রগাঢ় ক্রোধ এটে বলল – আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না কৃষ্ণময়ী। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তুমি।
কন্ঠে ধরে রাখা বাক্যগুলোর সমাপ্তি ঘটিয়েই তাকে নিয়ে কলেজের বাইরের দিকে ছুটলো জায়ান। সেনজেই, জেফি কিংবা সুজা কেউই সাহস পেল না জায়ানকে আটকানোর। এতক্ষন জায়ানের ক্রোধের এক ঝলক দেখেই দিশেহারা তারা। ইয়ান অবশ্য গিয়েছিল জায়ানকে আটকানোর উদ্দেশ্যে কিন্তু পারেনি। এক ঘুষিতেই তার নাক যে আর নাক নেই সুন্দর গোলগাল লাল এক টমেটোতে পরিনত হয়েছে। তার উপর রাস্তায় ছিটকে পড়েও হাতে পায়ে কিছুটা ব্যথা পেয়েছে। দূর্বল শরীর নিয়ে দৌড়ে জায়ানকে ধরতে সে সক্ষম হয়নি। ঘটনা কর্ণে পৌঁছাতে তৃষাম আর চ্যাং ও দৌড়ে এসেছিল এই স্থানে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তারা পৌঁছানোর পূর্বেই পূর্বাশাকে নিয়ে প্রস্থান করেছে জায়ান। তৃষাম যেন অথৈ সাগরের মধ্যভাগে পড়লো টুপ করে। এখন সে কোথায় খুঁজবে ছেলেমেয়ে দুটোকে? এই মুহূর্তে তৃষামের একটা কথা ভীষণভাবে মনে হচ্ছে। সেদিন নিজের উদ্ভট কর্মকান্ডকে প্রাধান্য দিয়ে এয়ারপোর্টে যদি জায়ানকে না পাঠাতো তবে আজ এই দিনগুলো তার দেখতে হতো না। সব দোষ তার। সে কেন পূর্বাশাকে আনতে জায়ানকে পাঠিয়েছিল?
****
ক্ষানিক সময় পরই পূর্বাশাকে নিয়ে জায়ান পৌঁছালো তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে। এবার আর পূর্বাশাকে নিয়ে এদিক সেদিক কিংবা পার্কে সে যায়নি। সোজা কলেজে কাছে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে সে। পথিমধ্যে অবশ্য মেয়েটা অনেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে নিজেকে কিন্তু পারেনি। অমন এক শক্তপোক্ত মানুষের সাথে এত সহজে পেরে ওঠা কি সম্ভব নাকি? ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকেই পূর্বাশাকে নামিয়ে দিল সে। ছাড়া পেয়েই পূর্বাশা ছুটলো দরজার দিকে উদ্দেশ্য পালিয়ে যাবে সে। কিন্তু পারলো না। তার পিছু ছুটে জায়ান তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। পূর্বাশা ছটফটিয়ে উঠলো। এমনিই লোকটাকে আজ অন্যরকম লাগছে তার। কেমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। তার উপর এভাবে তুলে এনে অজানা এক ফ্ল্যাটে আঁটকে দিয়েছে। ভয় লাগছে পূর্বাশার। বক্ষস্থল কেঁপে যাচ্ছে ভ’য়ং’ক’র ভাবে। এখানে একা একটা ফ্ল্যাটে ছেলেটা তার কোনো স’র্ব’না’শ করে দিবে না তো? ভয়ে যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মেয়েটার। পূর্বাশার ভয়ের মধ্যেই জায়ান মুখ গুঁজে দিল পূর্বাশার ঘাড়ে। কাকুতি ভরা কন্ঠে বলল – আমাকে ছেড়ে চলে যেও না কৃষ্ণময়ী। আমি যে মরে যাব তুমি চলে গেলে।
কেঁপে উঠলো পূর্বাশা, জায়ানের কাকুতিভরা কন্ঠে বলা
বাক্যগুলো কর্ণে পৌঁছালো না তার। উল্টো সে ব্যস্ত ছেলেটার গভীরতম স্পর্শটা হজম করতে। ভয় আরও বাড়লো পূর্বাশার। এভাবে কেন তাকে হুট করে ছুঁয়ে দিল জায়ান? এবার যদি সত্যিই তার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে। আজকাল বিশ্বাস করতে কে আছে? আর সেখানে বিদেশি পুরুষরা তো এমনিই একটু অন্য ধাঁচের হয়। ঢোক গিললো পূর্বাশা। নিজের থেকে জায়ানকে ছাড়িয়ে দিল ধাক্কা মেরে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল – আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন? আমি বাড়ি যাব। আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব। আর কখনও আসবো না এই ভিনদেশ চীনের মাটিতে। আমাকে প্লীজ ছেড়ে দিন।
জায়ান যেন উত্তেজিত হয়ে পড়লো আবারও। পূর্বাশা বাংলাদেশে চলে যাবে? আর ফিরে আসবে না? এই ভয়টাই তো সে পাচ্ছিলো এতক্ষন। যাকে নিজের কাছে রাখার এত চেষ্টা সে কিনা বলছে চলে যাবে আর ফিরবে না? নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারলো না জায়ান। ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলো পূর্বাশার গালে। ক্রোধিত কন্ঠে বলল – আমাকে ছেড়ে যাবি? আমাকে? এত বড় সাহস তোর?
জায়ানের থাপ্পর খেয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়লো মেয়েটা। ঠোঁটের কোন ঘেঁষে লবনাক্ত এক র’ক্ত স্রোতের উপস্থিতি টের পেল পূর্বাশা, চিনচিনে ব্যথার আভাস সেখানে। হয়তো কেটে গেছে ওষ্ঠদ্বয়ের প্রান্তভাগ, মাথাটাও কেমন টনটন করে উঠেছে। পূর্বাশা যেন নির্বাক স্তব্ধ হয়ে পড়লো। ওভাবেই বসে রইলো মেঝেতেই।
এদিকে নিজে থাপ্পর মেরে নিজেই যেন হতবম্ব হয়ে পড়লো জায়ান। ছুটে গেল মেয়েটার কাছে। অস্থির কন্ঠে বলল – স্যরি কৃষ্ণময়ী। তোমাকে আঘাত করতে চাইনি আমি। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে আঘাত করে বসেছি। মাফ করো আমাকে।
পূর্বাশা উত্তর দিল না কোনো। মাথা তুলে সে তাকালো শুধু জায়ানের পানে। কলিজাটা ছ্যাত করে উঠলো জায়ানের। ঠোঁট কে’টে র’ক্ত ঝড়ছে মেয়েটার, কপালের এক কোনে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে, পা দিয়ে ঠিক ভাবে দাঁড়াতেও পারছে না, চোখ ভর্তি অশ্রু কনায় আবিষ্ট। কেমন বিধ্বস্ত লাগছে মেয়েটাকে। আর এই সবকিছুর জন্য দায়ী জায়ান নিজেই। সে কিভাবে পারলো মেয়েটাকে এভাবে আঘাত করতে? এভাবে কষ্ট দিতে? পা’গ’লে’র ন্যায় নিজের গালে নিজে সজোরে কয়েকটা থাপ্পর মারলো জায়ান। উত্তেজিত কন্ঠে বলল – সব আমার জন্য হয়েছে সব আমার জন্য।
কথাটা বলেই আবার দৌড়ে গেল সে পূর্বাশার পানে। তার বাহু ধরে অপরাধীর ন্যায় বলল – স্যরি কৃষ্ণময়ী। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। আমাকে মাফ করে দাও দয়া করে।
জায়ানের হয়তো আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু সে আর কিছু বলার আগেই দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো তৃষাম, চ্যাং আর মিসেস শীও। পূর্বাশার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো সবাই। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে তৃষাম ছুটে গেল পূর্বাশার পানে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল জায়ানকে অতঃপর পূর্বাশার হাত ধরে বলল – তুই ঠিক আছিস পূর্বা? এ অবস্থা হলো কি করে তোর? জায়ান মেরেছে?
পূর্বাশা উত্তর দিল না কোনো। সে এখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জায়ানের পানেই। ছেলেটা কেন এমন পা’গ’লে’র ন্যায় আচরণ করছে তার জন্য? জায়ান সত্যিই কি তাহলে তাকে ভালোবাসে? ভালো না বাসলে এত পা’গ’লা’মী তো আসার কথা নয়? না এই পা’গ’লা’মী কখনও অভিনয় হতে পারে না। এতটাও নিখুঁত অভিনয় কখনও কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় যদি না তার হৃদয়ে কোনো অনুভূতি থাকে। পূর্বাশার আজ যেন কেন ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে জায়ানকে বিশ্বাস করতে। শরীরে ব্যথার প্রলেপ লাগলেও হৃদয়ে লেগেছে এক প্রবল অস্থিরতা। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। তবে কি তার ধারনা ভুল? জায়ান নক্ষত্রের মতো নয়, সত্যিই ভালোবাসে তাকে?
পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই তৃষামের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। উত্তেজিত কন্ঠে সে বলল – তুই একদম চিন্তা করিস না পূর্বা। আমি তোকে এখনই এখান থেকে নিয়ে যাব। বাংলাদেশে তোর বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাব। আর এখানে এই কষ্টের মধ্যে থাকতে হবে না তোকে।
পূর্বাশা চোখ ঘুরিয়ে তাকালো তৃষামের পানে। অস্ফুট স্বরে বলল – বাংলাদেশ! বাংলাদেশে নিয়ে যাবে আমাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে?
পূর্বাশা ভাবতে বসলো। বাংলাদেশ কি সত্যিই তার সুখের স্থান? সে সেখানে ভালো থাকবে? যদি ভালোই থাকতো তবে কেন আ’ত্ম’হ’ত্যা’র মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাকে? আর চীনে কি সে সত্যিই কষ্টে আছে? জায়ান কষ্ট দিচ্ছে তাকে? নাকি ছেলেটা নিজেই নিজের ভালোবাসা বুঝাতে না পারার অনলে দগ্ধ হয়ে এমন উন্মাদের ন্যায় আচরন করছে? সে কি তবে নক্ষত্রের করা অপরাধের শাস্তি জায়ানকে দিচ্ছে? পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই তৃষাম আবারও বলে উঠলো – তুই চিন্তা করিস না আমি আজই দেশে ফেরার ব্যবস্থা করবো।
তৃষামের শেষ কথায় যেন নরম হওয়া ক্রোধটা যেন আবারও জেগে উঠলো জায়ানের। ছুটে গিয়ে সে কলার চেপে ধরলো তৃষামের। হিসহিসিয়ে বলল – ও কোথাও যাবে না। ও আমার কাছে থাকবে। বুঝেছিস তুই? আমার কৃষ্ণময়ী আমার কাছে থাকবে।
আজ আর ভয়ে তৃষামও ছেড়ে দিল না জায়ানকে। শক্ত করে ধরলো তার কলারটা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – ম’রা’র জন্য ওকে রেখে যাব আমি তোর কাছে? ওকে আমি এখন এই মুহূর্তে নিয়ে যাব, পারলে তুই আটকা।
জায়ান বলতে গেল কিছু কিন্তু তার আগেই সজোরে তার গালে একটা থাপ্পড় পড়লো। চমকালো সবাই। জায়ান চকিত দৃষ্টিতে তাকালো পাশ ফিরে, দেখতে পেল মিসেস শীও এর ক্রোধিত মুখশ্রী। তৃষামের কলার থেকে হাত দুটো আলগা হলো জায়ানের, ছেড়ে দিল সে তৃষামকে। ফিরে তাকালো মিসেস শীওর পানে, কাতর কন্ঠে বলল – আমাকে তুমি মারলে মাম্মাম!
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link