স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৩৯

0
442

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৯

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ভয়ে আঁকড়ে ধরলেন ছেলের বাহু। আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠে বলল – আমি যাব না। বাহিরে বেরুলে ওরা আমাকে আবার বেঁধে ফেলবে ঐ শিকল দিয়ে। আমার যে বড্ড ব্যথা লাগে শেকলের ঘর্ষনে। আমি ঐ লোহার যন্ত্রের ভারও বহন করতে পারি না। অত বড় লোহার শিকল তোলার শক্তি কি আমার এই টুকু শরীরে আছে নাকি?

বাবার এমন করুন কথায় হৃদয় ব্যথিত হলো ছেলের। অথচ এই ছেলেই কিনা তার বাবাকে এতদিন ভুল বুঝে এসেছে। বারংবার তার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বারংবার বলে গেছে তার বাবা পালিয়ে গেছে তাদের ছেড়ে। কিন্তু তার সেই হতভাগ্য পিতা কিনা তাদের কাছে ফেরার তাগিদেই আজ এমন করুন পরিস্থিতির স্বীকার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু চোখ বেয়ে অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়লো তার। খুব সংগোপনে মুছেও ফেললো তা। বাবাকে অভয় দিয়ে বলল – আর কেউ তোমাকে আর কখনও বেঁধে রাখবে না বাবা। এখন আমি এসে গেছি যে।

ছেলের আশ্বাসে একটু যেন ভরসা পেলেন জাফর চৌধুরী। তবুও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন – সত্যিই আর কেউ আমাকে ঐ লোহার শক্ত শিকল দ্বারা বেঁধে রাখবে না তো?

জায়ান তার বাহুতে খামচে ধরা বাবার হাত খানা নামিয়ে নিজের মুঠোবন্দী করে নিল। অতঃপর বলল – পৃথিবীর আর কারো সহস আছে নাকি আমার সম্মুখে আমার বাবাকে বেঁধে রাখবে?

জাফর চৌধুরীর শুষ্ক নির্জীব ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। ছেলের হাত ধরে রেখেই নিজের নগ্ন ডান পা খানা বাড়িয়ে দিল ঘরের বাইরে। একটু একটু করে ছেলের হাত ধরে চড়ে বেড়াতে শুরু করলো পুরো বাড়িময়। সাথে ছেলের সাথে বাচ্চাদের মতো তার সে কত গল্প। ছেলেও বিরক্তহীনভাবে কান পেতে শুনে যাচ্ছে বাবার কন্ঠে উচ্চারিত গল্পগুলো। বাড়ির মানুষ গুলোও আজ খুশি বেশ। জাফর চৌধুরীকে আজ এত বছর পর কিছুটা স্বাভাবিক হতে দেখে সকলেই আবেগ আপ্লুত। তবে তার কাছে এই মুহূর্তে যাচ্ছে না কেউই। না আঘতের ভয়ে যে যাচ্ছে না তেমন নয়। আসলে বাবা ছেলের এমন সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয় তারা তাই যাচ্ছে না। মিসেস শীও যোগ দিয়েছেন বাড়ির মানুষদের সাথে। এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের পাশে। দূর থেকেই দু চোখ ভরে উপভোগ করছেন বাবা ছেলের সুন্দর মুহুর্তগলো।

_____________________________________

সময়ের কাঁটা দৌড়ে চলছে নিজ গতিতে। কাউকে কোনো ইঙ্গিত না জানিয়েই সে নীরবে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। এরই মধ্যে দিন দুই কেটে গেছে। জাফর সাহেব এখন কিছুটা স্বাভাবিক। তবে একদম স্বাভাবিক নয়। এখনও সে মানুষ দেখলেই আঘাত করে, আলো সহ্য করতে পারে না। তবে মিসেস শীও এবং জায়ানের কথা রাখেন। তারা কোনো কথা বুঝিয়ে বললে কিংবা কাউকে আঘাত করতে বারণ করলে বাচ্চাদের মতো মেনে নেয় তাদের কথা। তবে স্ত্রী আর পুত্র ব্যতীত আর কারো কথা শোনে না সে। মিসেস শীও আর জায়ান মিলে ইতমধ্যে জাফর চৌধুরীর বাহ্যিক চেহারাও পাল্টে ফেলেছেন অনেকটা। ছেড়া জীর্ণ পোশাক ফেলে দিয়ে কিনে এনেছেন নতুন পোশাক। মাথায় ধারন করা জটাধারী লম্বা চুলগুলোও একদম কেটে মাথায় টাক করে দিয়েছেন। বহু দিনের জট ধরা দাঁড়ি গুলোও কেটে দিয়েছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এখন আর তাকে উন্মাদ বলতে পারবে না কেউ। তবে এই দুই দিনে পূর্বাশার সাথে জায়ানের দেখা হয়নি খুব বেশি। হ্যা পূর্বাশা এ বাড়িতেই ছিল কিন্তু জায়ান তার বাবার পাশ থেকে উঠেনি এক মুহুর্তের জন্যও। এত বছর পর বাবাকে নিজের স্বচক্ষে দেখা, বাবাকে ফিরে পাওয়ার খুশিতে সে বাবাকে জড়িয়েই ছিল সর্বক্ষন। এত দিনের ভালোবাসা যেন দুই দিনেই পুষিয়ে নিতে চাইছে ছেলেটা। কিন্তু মিসেস শীও! এতদিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন। হতে পারে বয়স বেড়েছে তাই বলে কি ভালোবাসা কমে গিয়েছে নাকি? তাদের কি একটু ব্যক্তিগত সময় দেওয়া প্রয়োজন নয়? বাবাকে পেয়ে যেন জায়ানের বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সব। রাত দিন সর্বক্ষন কেমন চিপকে থাকে তার বাবার সাথে। পূর্বাশা ভেবে পায় না তার মতো কলেজ টপার বুদ্ধিমান ছেলে কিনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে বাবাকে পেয়ে এক গাধার পরিচয় দিচ্ছে? নিজের মায়ের হক মারছে? পূর্বাশা কিছুটা বিরক্তি নিয়েই গেল জাফর চৌধুরীর কক্ষে। লোকটা বিছানায় বসে আছে, তার পাশে বসেই তাকে পরম যত্মে খাইয়ে দিচ্ছে জায়ান। আর মিসেস শীও, সে তো অবহেলায় অনাদরে বসে রয়েছে কক্ষের এক কোনের চেয়ারে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো পূর্বাশা। জায়ানের পানে তাকিয়ে বলল – আমি আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি এখন।

জায়ান তার পানে না তাকিয়েই উত্তর দিল – তাড়াতাড়ি আবার ফিরে এসো।

পূর্বাশা হতাশ হলো যেন। এই লোককে নিয়ে কোথায় যাবে সে? এর সেই ধারালো তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা কি সে সেই চীনে ফেলে মাথার মধ্যে কতগুলো গোবর পুরে বাংলাদেশে ঢুকেছে? নির্ঘাত তাই হবে। দাঁতে দাঁত চাপলো পূর্বাশা অতঃপর বলল – শুধু আমি না আপনিও যাচ্ছেন আমার সাথে।

পূর্বাশার কথায় ভ্রু কুঁচকালো জায়ান। চোখ মুখ কুঁচকে বলল – আমি কিভাবে যাব? দেখছো না আমি বাবাকে খাওয়াচ্ছি।

– তাকে আপনার মা খাইয়ে দিবে। আপনি আমার সাথে আসুন।

– না আমি বাবার কাছে থাকবো।

পূর্বাশা একটু এগিয়ে গেল জায়ানের পানে। কন্ঠটা একটু খাদে নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল – সেখানে আমার এক্স আছে। যদি না চান যে তার সাথে আমি আবার ভালোবাসা ভালোবাসা পুকুরে হাবুডুবু না খাই তবে আমার সাথে আসুন।

জায়ান চমকালো। সরু দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে। পূর্বাশার এক্স মানে ও যে ছেলেটাকে ভালোবাসে বলেছিল সেই ছেলেটা? কি এক বিপাকে পড়লো জায়ান। এদিকে বাবাকে ছেড়েও যেতে ইচ্ছে করছে না আবার পূর্বাশাকেও একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।‌ বিশেষ করে ঐ শিয়ালের এলাকাতে তো নয়ই। পরে দেখা যাবে শিয়াল তার একটু পোষ মানা মুরগিকে পুরোপুরি পোষ মানিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেল। জায়ানের মুখশ্রী থমথমে হলো। বাবাকে খাইয়ে দিতে দিতেই সে বলল – তোমার যেতে হবে না। এ বাড়িতেই থাকো।

পূর্বাশা সাথে সাথেই না সূচক জবাব দিল। জায়ানের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল – না আমার বাড়ি যেতে হবে। মাত্র কয়েক দিনের জন্য চীন থেকে বাংলাদেশে এসেছি। এর মধ্যে যদি বাড়িতে এক বারও না যাই বিষয়টা খারাপ দেখাবে। তাছাড়া আমার ভাই বোনও ও বাড়িতে রয়েছে ওদের সাথেও দেখা করতে হবে।

– কিন্তু বাবা….

জায়ানের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সেখানে উঠে এলেন মিসেস শীও। ছেলের হাত থেকে খাবার প্লেটটা নিয়ে নিলে নিজের হাতে অতঃপর বললেন – তুমি যাও ঘুরে এসো পূর্বাশার সাথে আমি তোমার বাবার দেখাশোনা করতে পারবো।

মায়ের কথায় সন্দেহ প্রকাশ করলো জায়ান। সন্দিহান কন্ঠে বলল – ঠিক তো? তুমি পারবে তো?

ছেলের কথা শুনে মিসেস শীও হাসবেন নাকি কাঁদবেন বোধগম্য হলো না। এতদিনকার ভালোবাসার মানুষ তার জাফর চৌধুরী, যার অপেক্ষায় তার প্রতিটি প্রহর কেটেছে এতটা বছর ধরে তাকে দেখাশোনা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তার ছেলে? তাছাড়া সে একজন ডাক্তার।‌ হয়তো এমন উন্মাদ শ্রেনীর লোকদের ডাক্তার তিনি নন। কিন্তু একটু হলেও এ বিষয়ে তো জ্ঞান রয়েছে তার। মিসেস শীও অভয় দিলেন ছেলেকে, বললেন – আমি পারবো।

জায়ান একটু আশ্বস্ত হলো যেন।‌ বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চললো পূর্বাশার সাথে, তৃষামও অবশ্য যাচ্ছে তাদের সাথে।

_____________________________________

সময় গড়ালো। সকালের সূর্যটা নীল আকাশ জুড়ে একটু উজ্জ্বল রূপে ধরা দিয়েছে। ব্যস্ত শহরটাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশ, কোলাহলে ভরে উঠেছে চারদিক। ঘন্টা দুয়েকের ব্যবধানেই জায়ান আর তৃষামকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছালো পূর্বাশা। দোতালা বিশিষ্ট ছোট খাটো একটা বিল্ডিং তাদের। পাখি বেগম এবং আহমেদ সাহেব গতকালই আগেই চলে এসেছেন ও বাড়ি থেকে। জায়ান আসছে এই প্রথম তাদের বাড়িতে। পাখি বেগম কোনো আয়োজনের কমতি রাখতে চায় না যে। জায়ান এবং মিসেস শীওকে বাড়ির সবাই বেশ সাদরেই গ্রহন করেছে। কোথাও না কোথাও এত বছর ধরে তারাও যে বেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন মিসেস শীওর, এখন তো ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে সুদর্শন এক পুত্রেরও দেখা মিলেছে। তারা সকল ভাই বোনেরাই হৃদয়ের কোনে তাদের মেঝ ভাই জাফর চৌধুরীর সুন্দর জীবনের এক টুকরো স্বপ্ন এঁকেছিলেন। সেই স্বপ্ন যে আজ সত্যি হয়েছে। তার ভাইয়ের ছোট্ট এক পরিবার হয়েছে। তবুও তারা প্রথমে জায়ান এবং মিসেস শীওর পরিচয় নিয়ে একটু সন্দিহান প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু যখনই জাফর চৌধুরী নিজে মিসেস শীওকে চিনতে পেরেছে তখনই তাদের ভিতরকার সকল সন্দেহ ত্যাগ করেছে তারা। তাছাড়া মিসেস শীও তার এবং জাফর চৌধুরীর বিয়ে, বাচ্চা সব কিছুর প্রমান দিয়েছেন।

পূর্বাশা বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ড্রইং রুমেই চোখে পড়লো নক্ষত্রকে। সোফায় কি সুন্দর আয়েশ করে বসে রয়েছে। মেজাজ কিছুটা খারাপ হলো তার। এত দিন পর বাড়িতে ফিরে প্রথম এর মুখ টাই দেখার ছিল? আর কেউ কি ছিল না বাড়িতে? আর সব চেয়ে বড় কথা এ এবাড়িতে কি করছে? নিশ্চই এতদিন পর পূর্বাশা দেশে ফেরার খুশিতে তার মা সকলকে দাওয়াত করেছে। মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না পূর্বাশা। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলো সে। তাকে দেখেই বসা থেকে দাঁড়ালো নক্ষত্র। পূর্বাশা কিছু বলার আগেই সে প্রশ্ন করলো – কেমন আছিস পূর্বা?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

এই টুকু বলেই ভিতরের দিকে পা বাড়ালো পূর্বাশা। ঠিক তখনই পিছন থেকে তার কর্ণে ভেসে এলো নক্ষত্রের কন্ঠস্বর, সে বলল – আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলি না যে।

পূর্বাশা পিছু ফিরে তাকালো না। সম্মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই শীতল কন্ঠে উত্তর দিল – প্রতারকদের তো খারাপ থাকার কথা ছিল না। নিশ্চই ভালোই আছে তারা।

কথাটা বলেই ভিতরের দিকে চলে গেল সে। তবে এই টুকু ঘটনাতেই জায়ানের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ধরে ফেলেছে এই নক্ষত্র আসলে কে? সে আর ভিতরে গেল না। ধপ করে বসে পড়লো ড্রইং রুমের সোফায়। ঠিক যেখানটায় এতক্ষন বসে ছিল নক্ষত্র। হঠাৎ তার স্থানে কাউকে বসতে দেখে ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো নক্ষত্রের। তবে সে কিছু বলল না। সোফায় জায়ানের পাশে থাকা খালি স্থানে বসতে নিলেই জায়ান তৃষামের হাত টেনে বসিয়ে দিল সেখানে। নক্ষত্রের কপালে ভাঁজ পড়লো একটু। সরে গিয়ে সে বসলো অন্য পাশে। তবে ভদ্রতাসূচক আলাপ পরিচয় বাড়াতে সে নিজেই জায়ানের উদ্দেশ্যে বলল – হ্যালো, আ’ম নক্ষত্র।

জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। শুদ্ধ বাংলায় সে বলল – আমি বাংলা জানি।

নক্ষত্র ঠোঁট টেনে হাসলো একটু। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল – ওহ, আমি ভেবেছিলাম আপনি বাংলা জানেন না। তাই হোক আমি নক্ষত্র, পূর্বাশার বড় ফুফুর ছেলে।

– ওহ আমি জায়ান ইবনে জাফর চৌধুরী। তবে পূর্বাশার মামাতো ভাই হওয়ার আগে তার কাছের কেউ।

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here