#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪০
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
– ওহ আমি জায়ান ইবনে জাফর চৌধুরী। তবে পূর্বাশার মামাতো ভাই হওয়ার আগে তার কাছের কেউ।
জায়ানের থমথমে কন্ঠে বলা বাক্যগুলো বোধহয় বোধগম্য হলো না নক্ষত্রের। বাক্যগুলো একটু সুষ্ঠভাবে বোঝার জন্য সে শুধালো – ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।
– আমার কথা সব শ্রেনীর মানুষের বোঝার কথাও নয়।
নক্ষত্রের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। কিছুটা তীক্ষ্ম কন্ঠে সে বলল – তুমি কি আমাকে অপমান করছো?
ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো জায়ান। ঘাড় কাত করে উত্তর দিল – মান ছাড়া লোকের অপমান হতে শুনিনি তো কখনও।
নক্ষত্র রেগে গেল। তবে বলল না কিছুই। এটা তার মামার বাড়ি। এখানে বসে নিশ্চই কারো সাথে ঝামেলা করাটা খুব বেশি দৃষ্টিনন্দন হবে না। আর তা যদি হয় মামার কুটুম তাহলে তো আরও নয়। একে না হয় পরে দেখা যাবে। হৃদয়ে জাগ্রত হওয়া ক্রোধ হৃদয়েই চেপে রেখে সোফার উপরেই বসে রইলো নক্ষত্র। তখনই হাতে চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে নিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করলো পূর্বাশা। সোফার সম্মুখে দাঁড় করানো ছোট টি টেবিলের উপরে রাখলো সে ট্রে খানা। এক কাপ চা তুলে দিল জায়ানের হাতে। অন্য কাপ তৃষামের দিকে বাড়াতেই বাঁধা দিল জায়ান। পূর্বাশার থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে সে নিজে কাপ খানা বাড়িয়ে দিল তৃষামের দিকে, বলল – আমি দিচ্ছি।
পূর্বাশা আর কথা বাড়ালো না। আরেক কাপ চা তুলে দিতে গেল নক্ষত্রকে তবে এবারও তার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো জায়ান। তবে এবার পূর্বাশার হাত থেকে চায়ের কাপ টেনে নিজে দিল না নক্ষত্রকে বরং কাপটা আবার সে রাখলো ট্রের ভিতরে ঠিক আগের অবস্থানে অতঃপর থমথমে কন্ঠে বলল – তোমার ভাইয়ের হাত সা সব সুষ্ঠভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তার চা তাকেই নিয়ে খেতে দাও।
নক্ষত্র দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো জায়ানের কথাগুলো। তীব্র অপমানে নাক মুখ কুঁচকে গেল তার। চা আর পান না করেই হনহন করে চলে গেল সে বাইরের দিকে। পূর্বাশাও আজ আর তেমন কিছু বলল না জায়ানকে। কারন ঐ নক্ষত্রকে এখন আর সহ্য হচ্ছে না। পূর্বাশা এখানে এসে এই টুকু সময়েই একটা বিষয় বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে যে নক্ষত্রের প্রতি এখন আর তার ভালোবাসার অনুভূতি নেই কোনো। যা আছে সব ঘৃনা। এই যে বাড়িতে এসেই নক্ষত্রের মুখটা দেখলো জায়ান আগের মতো একবারও পূর্বাশার ভিতরে কষ্ট অনুভব হয়নি, বিষাদে ছেয়ে যায়নি হৃদয়টা। একবারও মনে হয়নি -“সে আমার হয়েও আমার হলো না।”
উল্টো মেজাজ খারাপ হয়েছে, বিরক্ত লেগেছে ছেলেটার মুখটাই সহ্য হয়নি।সেদিক থেকে নক্ষত্রকে তাড়িয়ে একটা ভালো কাজ করেছে জায়ান। পূর্বাশা চায়ের ট্রেটা টি টেবিলে রেখেই আবার ভিতরে প্রবেশ করলো। মেয়েটা যেতেই জায়ান কাপে চুমুক দিল। থমথমে কন্ঠে তৃষামকে বলল – পূর্বাশার থেকে দূরে থাকবি।
তৃষাম হতবাক না হয়ে পারলো না। পূর্বাশা তার বোন হয়। আর জায়ান কিনা এখন তাকেও মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে বলছে? তৃষাম কিছুটা হতবাক স্বরেই বলল – আমি পূর্বার ভাই হই।
জায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো তৃষামের পানে। গম্ভীর কন্ঠে বলল – আপন ভাই তো না।
কিছুটা থতমত খেয়ে গেল তৃষাম। তবে পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল – মামাতো ভাই তো।
জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। তীক্ষ্ম কন্ঠেই সে বলল – মামাতো ভাই তো এখন আমিও। কিন্তু আমি আমার মামাতো বোনকে মোটেই বোনের নজরে দেখছি না, দেখছি বউয়ের নজরে।
– কিন্তু আমি বোনের চোখেই দেখছি।
– প্রমান কি?
তৃষাম হা হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা তাকে নিয়েও জেলাস? ঠিক কোন লেভেলের জেলাসি থাকলে মানুষ এমন করে? তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তৃষাম, বলল – কোনো প্রমাণ নেই।
দাঁতে দাঁত চাপলো জায়ান। কটমট করে বলল – তাহলে আমার কৃষ্ণময়ীর আশেপাশে ঘেঁষারও দরকার নেই।
***
ড্রইং রুমে জায়ান আর তৃষামকে পূর্বাশা আরও কিছু নাস্তা দিয়ে চলে এলো নিজের কক্ষে। নিজের কক্ষে একটা শান্তিই আলাদা। কতদিন পর পর এই কক্ষে পা রেখেছে সে। কক্ষটা যেভাবে রেখে গিয়েছিল ঠিক সেভাবেই আছে। নিশ্চই তার মা কাউকে এই কক্ষের আশেপাশেও ঘেঁষতে দেয়নি। কত ভালোবাসে তার মা তাকে। অথচ এই ভালোবাসা সে পায়ে ঠেলে কিনা ঐ বেইমানটার জন্য আ’ত্ম’হ’ত্যা’র পথ বেছে নিয়েছিল? মাঝে মাঝে এখন নিজের উপরই হাসি পায় পূর্বাশার একটা প্রতারকের জন্য জীবনের কত বড় ভুলটাই না সে করতে গিয়েছিলো। পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই নিজের পিছনে অনুভব করলো কাউকে সে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো নক্ষত্র। ভ্রু কুঁচকে এলো মেয়েটার। কিছুটা শক্ত কন্ঠেই সে বলল – একজন মেয়ের কক্ষে এভাবে অনুমতি ব্যতীত চলে আসা নিশ্চই ভদ্র সমাজের কর্ম নয় নক্ষত্র ভাই।
নক্ষত্রের চোখে মুখে কিঞ্চিৎ অবাকতার রেশ পরিলক্ষিত হলো। অবাক কন্ঠেই সে বলল – তোর রুমে আসতে আগেও তো আমি কখনও অনুমতি নেইনি পূর্বা।
পূর্বাশা মৃদু হাসলো অতঃপর বলল – আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন নক্ষত্র ভাই আমাদের আগেকার সম্পর্ক আর এখনকার সম্পর্কের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল নক্ষত্র। শান্ত কন্ঠে বলল – তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে পূর্বা।
পূর্বাশা চোখে মুখে হাসলো। ওষ্ঠের কোনে হাসির রেখা বজায় রেখেই বলল – আমার জানামতে আমাদের সকল কথা সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল নক্ষত্র ভাই।
নক্ষত্র যেন বিরক্ত হলো কিছুটা। বিরক্তিভরা কন্ঠেই বলল – প্রতিটা কথার শেষে এই ভাই ভাই না লাগালে হয় না পূর্বা? আগে তো আমাকে এত ভাই ভাই করতিস না।
– আগে আমাদের সম্পর্কটাও এমন ছিল না নক্ষত্র ভাই। আগে আপনি আমার ভালোবাসার মানুষ ছিলেন আর এখন শুধুমাত্র আবার বড় ফুফুর ছেলে। যদিও এই পরিচয় ব্যতীত আমার কাছে আপনার আরও একটা পরিচয় আছে।
নক্ষত্র ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো – কোন পরিচয়ের কথা বলছিস তুই? আমি তোর প্রাক্তন সেটা?
পূর্বাশা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অতঃপর বলল – উহু আপনি আমার প্রাক্তন নন নক্ষত্র ভাই আপনি আমার এক্স।
নক্ষত্রের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও কুঁচকে এলো। সন্দিহান কন্ঠে সে প্রশ্ন করলো – এক্স আর প্রাক্তনের মধ্যে পার্থক্য কি?
– ইংরেজি এক্স শব্দের বাংলা অর্থ প্রাক্তন হলেও দুইটা শব্দের অনুভুতি ভীষন আলাদা জানেন? আমরা যখন আমাদের কন্ঠে এক্স শব্দটা উচ্চারিত করি তখন অনায়াসেই শব্দটা কন্ঠ থেকে মুখে চলে আসে। ফট করে বলে ফেলি আমার এক্স খারাপ, বাজে, ঠক, প্রতারক কিংবা বেইমান। কিন্তু আমরা যখন কন্ঠে প্রাক্তন শব্দটা উচ্চারিত করি তখন খুব সহজে শব্দটা কন্ঠ থেকে মুখে আসতে চায় না, গলা ধরে আসে, চোখের সম্মুখে প্রাক্তন ভালোবাসার মানুষটার সাথে কাটানো খারাপ ভালো মুহুর্ত গুলো চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে। এক্সদের আমাদের জীবনে কখনও প্রাধান্য থাকে না আর প্রাক্তনরা বিচ্ছেদের বহু যুগ পরেও আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সাথেও উঠে আসে।
কথাগুলো বলে একটু থামলো পূর্বাশা অতঃপর আবার বলল – আপনি আমার প্রাক্তন হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না নক্ষত্র ভাই।
পূর্বাশার কথাগুলো যেন তীরের মতো আঘাত করলো নক্ষত্রের হৃদয়ে। সে খারাপ ছেলে নয় তবুও একটা মজার ছলে আজ সে কারো গল্পে বেইমান। প্রথমে নিজের ভুল নিজের অন্যায় না মানলেও পরবর্তীতে একটু একটু করে সে নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে। পূর্বাশা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মেয়েটার শূন্যতা যেন দিশেহারা করে তুলেছিল নক্ষত্রের সুন্দর জীবনটা। পূর্বাশার কমতিটা সে সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পেরেছিল যখন সে দ্বিতীয়বারের মতো আবারও কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়েছিল। সে পারেনি অন্য কোনো নারীকে প্রেম নিবেদন করতে। হাত কেঁপেছিল তার। যে কন্ঠ থেকে পূর্বাশার জন্য ঐ কুৎসিত কালো মেয়েটার জন্য “আমি তোমাকে ভালোবাসি” বাক্যটা উচ্চারিত হয়েছিল। সেই কন্ঠ থেকে আর কোনো নারীর জন্য ঐ বাক্যটা উচ্চারিত করতে পারেনি নক্ষত্র। মেয়েটাকে হারিয়ে সে বুঝেছে আসলে মেয়েটা ঠিক কতটা স্থান জুড়ে ছিল তার জীবনে। ঐ যে কথায় আছে না “মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না।” নক্ষত্রের অবস্থাও হয়েছিল তেমন। আর যখন সে পূর্বাশার মর্ম বুঝেছিল তখন মেয়েটা তার নিকট থেকে দূরে চলে গিয়েছিল, অনেক দূরে। অনেকবার পূর্বাশার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে নক্ষত্র কিন্তু পারেনি। হয়তো পূর্বাশা তার সাথে যোগাযোগ করতে চায়নি তাই পারেনি। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করেছে মেয়েটার, একটা বার নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে চেয়েছে। পূর্বাশা এসেছেও তার সম্মুখে তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে। তবে এই পূর্বাশার হৃদয়ে আজ আর কোনো স্থান নেই নক্ষত্রের। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো ছেলেটার। ক্ষমা চাইতে এলেও মুখ থেকে কোনো শব্দ আর বের করতে পারলো না সে। গলাটা কেমন ধরে আসছে। নীরবে নিঃশব্দে পূর্বাশার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো নক্ষত্র।
***
বেলা গড়িয়েছে। সূর্যটা তার তেজ বাড়িয়ে মাথার উপরে চলে এসেছে। পাখি বেগম খাবার দিয়েছেন টেবিলে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই খেতে বসেছে সেখানে। বিশেষ করে জায়ান, তৃষাম, পূর্বাশা আর নক্ষত্র। ডালিয়া বেগম মানে নক্ষত্রের মা ছিলেন না এখানে। হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে যেন উপস্থিত হলেন তিনি। হয়তো ছেলেকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে এখনই বাড়ি থেকে এসেছেন তিনি। বাড়িতে ঢুকেই তিনি এগিয়ে এলেন পূর্বাশার পানে। এতকাল যে কন্ঠ থেকে পূর্বাশার জন্য তিরস্কার মূলক কথা ছেড়েছেন আজ সেই কন্ঠ থেকেই পূর্বাশার প্রশংসা করে বললেন – বাহ তুই তো দেখছি চীনে গিয়ে সুন্দরী হয়ে গেছিস। গায়ের রং টা উজ্জ্বল হয়ে বেশ।
এতদিন ফুফুর তিরস্কার মূলক কথাগুলো হজম করতে পারলেও আজ কেন যেন এই প্রসংশা হজম করতে পারলো না সে। কিছুটা ঠান্ডা কন্ঠেই সে উত্তর দিল – মানুষের সৌন্দর্য খুঁজতেও সুন্দর একটা হৃদয়ের প্রয়োজন হয় ফুপি। আমি বোধহয় অসুন্দর কখনও ছিলাম না, শুধু কিছু মানুষের অসুন্দর দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়েছিলাম মাত্র।
ডালিয়া বেগম খুব একটা বুঝলেন না পূর্বাশার কথাগুলো। তাদের মতো আগেকার মানুষ কি আর ঘুরানো পেঁচানো কথা বোঝে নাকি? তারা বোঝে সোজাসাপ্টা সরাসরি কথা। তাই তো মানুষকেও কখনও সরাসরিভাবে অপমান করতে দ্বিধাবোধ করে না। তবে পূর্বাশার এহেন জবাবে বেশ খুশি হয়েছেন পাখি বেগম এবং আহমেদ সাহেব। তারা বরাবরই চেয়েছেন পূর্বাশা নিজের হয়ে জবাব দিতে শিখুক, তাকে করা প্রতিটি অপমানের জবাব সে দিক। এই যে মেয়েটা আজ কি সুন্দর ভাবে জবাব দিল। উৎফুল্ল হয়ে উঠলো আহমেদ সাহেবের হৃদয়। জায়ানও বেশ খুশি হয়েছে পূর্বাশার জবাবে। মেয়েটার পাশেই বসে ছিল সেই। কথা শেষ হতেই ছেলেটা ঝুঁকে গেল পূর্বাশার পানে, ফিসফিসিয়ে বলল – বাহ তোমার গায়ে দেখছি আমার সুগন্ধযুক্ত হাওয়াটা লেগেই গেছে।
জায়ানের কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো পূর্বাশার। কন্ঠটা একটু খাদে নামিয়ে সে প্রশ্ন করলো – মানে?
– এই যে কি সুন্দর আমার বাতাসে জবাব দিতে শিখেছো তুমি।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link
নতুন পর্ব দেন পিলিজ