তবে_ভালোবাসো_কী ২ #Mehek_Enayya(লেখিকা) পর্ব ১৪

0
361

#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ১৪

সম্পূর্ণ রিসোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখছে মাহানুর আর ইকরা। বিশাল বড় রিসোর্ট আগামীকাল থেকে চারদিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ তাঁদের। দুইপাশে বড় বড় দুইটি ভবন, মধ্যে সুবিশাল মাঠ তার পাশেই লম্বা বাগান আর ভবনের পিছনে একটা সুমিংপুল। পিছনের দিকটা অনেকটা জঙ্গলের মতো ফটোশুট এর জন্য বেস্ট। আরহাম ডেকোরেশন করার লোকদের সাথে কথা বলছিলো। মাহানুর আরহামের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-এই রিসোর্টে সর্বউচ্চ কতজন মানুষের থাকার জায়গা হবে?
-নিম্নে হলেও পাঁচশো হবে। অনেকগুলো রুম।
-হ্যাঁ আমিও সেটাই দেখছি।
রিদ দূর থেকে দাঁড়িয়ে আরহাম আর মাহানুরকে কথা বলতে দেখছে। ইকরা তাঁদের কাছে যেতে নিলে রিদ ঐপাশটা দেখার বাহানা দিয়ে দূরে নিয়ে যায়। সে চায় তার বন্ধু একটু পার্সোনাল টাইমস্পেন্ড করুক নিজের প্রিয়তমার সাথে। আরহাম মাহানুর মিলে লোকদের বলে দিচ্ছে কোথায় কোথায় ফুল দিতে হবে। মাহানুর সামনের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
-কাল কয়টায় রওনা হবে সবাই?
-সকাল দশটায়। আমি কয়েকটা বাস বুক করে রেখেছি সকলে একসাথে বের হবে।
-হ্যাঁ। রাতে তো আবার মেহেদী ফাঙ্কশন।
-হুম। আমার আবার আগামীকাল রাতে একটু চট্টগ্রাম যেতে হবে।
-ওওও!
শান্ত স্বরেই বলল মাহানুর। আরহাম মনে মনে মুচকি মুচকি হাসছে। মাহানুর এই প্রথম তার সাথে ভালোভাবে কথা বলছে। কাজের জন্যই হোক তাও তো বলছে! মাহানুর আরহাম একসাথে হাঁটতে থাকে। মাহানুর হাঁটতে হাঁটতে আনমনে জিগ্যেস করলো,
-আপনি কী নিজের কাজ সিক্রেট রাখেন?
-অনেকটা তাই। আমাদের অতি ক্লোজ রিলেটিভ ছাড়া বাহিরের মানুষ জানে না আমি কে। একজন আর্মির অনেক শত্রু থাকে তাই ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড যত সিক্রেট থাকবে ততো ভালো।
-ওহ আচ্ছা। লম্বায় কয় ফুট আপনি?
অন্যমনস্ক হয়ে প্রশ্নটা করে ফেলে মাহানুর। আরহাম চমকিত নয়নে কিছুক্ষন মাহানুরের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-ছয় ফুট এক ইঞ্চি। যেভাবে প্রশ্ন করলে মনে হলো মেয়ের বাসায় বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে এসেছি!
অনেকটা মজার ছলে বলল আরহাম। মাহানুর জিবে কামড় দিয়ে অন্যদিক তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়ের জন্য নীরবতা পালন করলো দুইজন। মাহানুর বলল,
-আপনি আমার আসীন ভাইয়ের সমবয়সী নাকি! তাহলে এই বুড়ো বয়সেও আপনি সিঙ্গেল কেনো? আপনার তো আমার সমান মেয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল!
মাহানুরের আহাম্মক কথায় আরহাম আকাশ থেকে পরলো। গলা শুকিয়ে এলো তার। মাহানুর মাথা ঘুরিয়ে আরহামকে দেখে মিটমিট হাসছে। সে আরহামকে সরম দিতেই এইরকম কথা বলেছে। তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো না এই বেটার, এখন একদম ইজ্জত দিয়ে দেবে। মনে মনে বলল মাহানুর। আরহাম গলা ঝেরে বলল,
-বয়স কত তোমার?
-২৩ বছর। আমাকে দেখতেই বুড়ি বুড়ি লাগে বাট আমার বয়স অনেক কম।
আরহাম ভেবছেকা খেয়ে গেলো। আড়চোখে মাহানুরের দিকে তাকালো। নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
-আই থিঙ্ক তুমি উল্টো বললে! বাই দা ওয়ে, আমার ত্রিশ বছর মাত্র। একটু বুড়ি বুড়ি দেখতে মেয়ে পেলে বিয়ে করে ফেলবো।
মাহানুর আর কিছু বলতে পারলো না। ওড়নায় আঙুল পেঁচাতে লাগলো। হটাৎ করে তার অসস্তিবোধ লাগতে শুরু করলো। আরহাম তাকে আরেকটু অস্বস্তি দেওয়ার জন্য ধীর কণ্ঠে বলল,
-আমি কিন্তু আমার ঘাড়ে দেওয়া দাগের কথা ভুলিনি। তোমাকে তোমার দাগ ফিরিয়ে দেবো খুব জলদি মাহানুর খান।

ইকরা বিরক্ত হয়ে রিদের সাথে হাঁটছে। রিদকে তার পাবনা থেকে পালিয়ে আসা পাগল মনে হচ্ছে। একা একাই কেমন বকবক করছে। ইকরা বিরক্তকর কণ্ঠে বলল,
-রিদ ভাইয়া এখন আমাদের মাহানুরদের কাছে যাওয়া উচিত।
-আরে বিয়াইন আপনি ঐপাশে তো দেখেন। ওয়াও যত সুন্দর ঐটা।
ইকরা চোখ মুখ কুঁচকে রিদের দেখানো জায়গায় তাকায়। ভোঁতা মুখে বলল,
-ইয়ু! ঐটা তো একটা ডাস্টবিন! এই ময়লা ফালানোর ডাস্টবিন আপনার চোখে সুন্দর লাগলো?
রিদ মেকি হাসি দিয়ে আশেপাশে তাকায়। সে কিসব বলছে নিজেও জানে না। ইকরা যে তাকে আস্ত একটা মেন্টাল ভাবছে এটা সিউর সে। কোনোরকম কথাটা ঘুরিয়ে বলল,
-না মানে এতো সুন্দর করে সাজানো তাই আমি বুঝতে পারিনি আর কী। ঐখানে যাই চলুন।
-চলুন।
কাজ শেষ হলে ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় আসে মাহানুর আর ইকরা। খান বাড়ি এখন সম্পূর্ণ মেহমানে ভরা। মানুষের কথাবার্তা, বাচ্চাদের লাফালাফিতে মেতে উঠেছে বাড়ি। এখন যেনো একটু বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি লাগছে। হাজেরার বাবার বাসা থেকে লোক এসেছে। আয়াসের দুই মামা মামী তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। দুই খালাও এসেছে। লুৎফার বাবার বাড়ি থেকেও মেহমান এসেছে। শুধু আসেনি মাহানুরের নানার বাসার থেকে কেউ। মাহানুরের মা মারা যাওয়ার পর অনেক বড় ঝগড়া হয় তার দাদা বাড়ির সকল সদস্য আর নানা বাড়ির সদস্যের মধ্যে। তারপর থেকে তাঁদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যের মামা, খালা, নানা-নানীকে দেখলে কয়েক সময় মাহানুরের ভীষণ কষ্ট লাগে। তবে কী করার সবাই সব কিছু পায় না! হামজা খানের ছোটকালের বন্ধুরাও এসেছে তাঁদের পরিবার নিয়ে। তাঁদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা এসেছে।
মাহানুর কোনোরকম নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। অহনা বিছানায় বসে বসে নিজের ব্যাগ গুছাচ্ছে। মাহানুরকে দেখে বলল,
-এসেছিস। ভাই এতো মানুষ দেখে আমি কেমন একা একা অনুভব করছিলাম। ভালো হয়েছে জলদি এসেছিস।
-আমি আগে শাওয়ার নিয়ে আসি তারপর কথা হবে।

রাতে ডিনার করে নিজের ব্যাগ অর্ধেক গুছিয়ে বাকিটা অহনাকে করতে দিয়ে আয়াসের রুমে আসে মাহানুর। আয়াস কিছুক্ষন আগে মেসেজ করে বলেছিলো “কিছু দরকার আছে আমার রুমে আয়”। তবে রুমের ভিতরে ঢুকেই এতো মানুষ দেখে অস্বস্তিবোধ করলো মাহানুরের। এখানে আয়াসের খালা আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা আছে। আয়াসের মামাতো ভাইবোনরা ভালো আছে বাট খালাতো ভাইবোনরা একটু অন্য স্বভাবের। আয়াসের খালা মামারা মাহানুরকে ততো একটা পছন্দ করেননা। মা মরা মেয়েকে এতো কিসের আদিখ্যেতা! নিজের বোনকে এইরকম অন্যের মেয়ের প্রতি আলগা দরৎ তাঁদের কাছে অসহ্য লাগে। মাহানুরকে দেখতেই তারা মুখ কালো করে ফেলে। টান টান কণ্ঠে বলে,
-এখন তো ভাইদের রুমে কম আসো মাহানুর। তাঁদের বিয়ে হচ্ছে বউ আসবে তোমার প্রতি বিরক্ত হয়ে যাবে। জানোই তো বিয়ের পর শশুরবাড়ি বউদের হয়ে যায়। তুমিও বিয়ে করো নাহয় একটু কম আসা যাওয়া করো।
মন খারাপ হয়ে গেলো মাহানুরের। অন্যকেউ হলে এখন অনেক কথা শুনিয়ে দিতো জাস্ট তারা বলেই কিছু বলল না। আয়াস নিজের খালাদের মাহানুরের প্রতি এইরকম ব্যবহার একটুও পছন্দ করে না। এখনও রাগে তার শরীর জ্বলছে। তবুও ভদ্র ভাবেই বলল,
-তাঁদের বিরক্ত লাগলে তারা তাঁদের বাবার বাড়ি চলে যাবে নয়তো নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখবে। আমার বোন তো তার বাড়িতে সারাজীবন থাকবে। বিয়ের পরও আগেও।
আয়াসের খালার মুখ চুপসে গেলো। মাহানুর স্মিত হাসলো। আয়াস মাহানুরের উদেশ্যে বলল,
-তোকে কী দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আসতে বলেছি শয়’তা’নের নানী? আমার ব্যাগ গুছাতে সাহায্য কর।
মাহানুর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-তো এটার জন্য অন্যকাউকে বললেই তো পারতি! ম’গা।
-তুই ছাড়া আমার কাজ আর কেউ ভালোভাবে করতে পারবো না।
-আসলেই! চিন্তা নাই ভাবিকেও আমি ভালোভাবে ট্রেনিং দিয়ে দেবো নে।
_____________________
পরেরদিন সকালে সূর্য উঠতে দেরি কিন্তু সকলের ঘুম থেকে উঠতে দেরি নেই। সবাই যার যার মতে তৈরি হতে ব্যস্ত। অহনা মাহানুর সিম্পল টপ্স, পেন্ট পরেছে। আরহাম তাঁদের বাসা থেকে মেহমানদের বাসে উঠিয়ে তারপর খালি বাস নিয়ে আসবে মাহানুরদের বাসায়। সময় নয়টা। সিয়াম, মুহিবও নিজেদের ব্যাগ নিয়ে এসে পরেছে। মাহানুর রাতে তাঁদের বলেছিলো জলদি আসতে। তাইতো বেচারারা অর্ধেক ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে। এখন মাহানুরের রুমে ঘুমে গড়াগড়ি খাচ্ছে দুইজন। অহনা আর মাহানুর তাঁদের কান্ড দেখে মিটমিট হাসছে। সনিয়া কল দিয়েছে মাহানুরকে। তারা সকলে তৈরি হয়েছে কিনা জানতে। কিছুক্ষন কথা বলে কল কেটে দেয় মাহানুর। আরেকবার ভালোভাবে দেখতে থাকে সব কিছু নিয়েছে না কী। চেক করা হলে সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করতে থাকে। এরই মধ্যে নিচ থেকে আওয়াজ আসে বাস এসে পরেছে। মাহানুর ত্বরিত তার ফোন সাইড ব্যাগে ভরে নেয়। দুইজন মিলে তাঁদের ব্যাগপ্যাক গুলো ধরে নিচে নিয়ে আসে। এতক্ষনে অনেকেই বাসে উঠে গিয়েছে। একটি বাস ছেড়েও দিয়েছে। কোথা থেকে দৌড়ে আসে সুনহেরা। মাহানুরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আপু ভালো আছেন?
-আছি আছি। তুমি তোমার ফ্যামিলির সাথে যাওনি ভাবি?
-না। আপনাদের সাথে যাবো।
মাহানুর মৃদু হাসলো। আয়াস কাজে ব্যস্ত। সুনহেরা চোরা চোখে আয়াসের দিকে তাকাচ্ছে। যদি ধরা পরে যায় তাই একটু একটু তাকাচ্ছে। মোটামুটি সব সবাই চলে যায়। এখন শুধু হাতে গোনা কয়েকজন আছে। সর্বশেষে এখন একটি মিনি বাসই খালি আছে। আয়াস এতক্ষনে সুনহেরাকে দেখলো। তাকে ইগনোর করে মাহানুরকে বলল,
-মাহানুর ব্যাগ নিয়ে আয়।
মাহানুর, অহনা, সিয়াম, মুহিব, ইকরা আর সুনহেরা আস্তে আস্তে বাসে উঠে। আয়াস বাড়ি চেক করে নিজেও বাসে উঠে পরে। আরহাম, আয়াস আর সুনহেরার বন্ধুবান্ধবী দিয়ে পিছনের সিট ফুল। রিদ পিছনে বসা ছিল অহনাকে উঠতে দেখে চিৎকার করে বলল,
-ঐ সামনের সিট ফাঁকা কর আমার বেগম বসবো।
সরমে মাথা নত করে ফেললো অহনা। রিদের এমন অদ্ভুত কান্ড তার একটুও পছন্দ না। তাঁদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কয়েকজন শিষ বাজাতে লাগলো। আবার কেউ কেউ শয়তানি করছে।সবাই একে একে বসার পর মাহানুর আর আরহামের জন্য কোনো জায়গাই রইলো না। আরহাম মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিলো। সে যেটা চেয়েছিলো সেটাই হলো। মাহানুর গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে আরহামকে বলল,
-কী বাস বুক করেছেন আমার জায়গাই তো নেই!
-আমি নিজেও বুঝতে পারিনি দুটো সিট টান পরবে।
-মাহানুর তুই আরহাম ভাইয়ের সাথে গাড়িতে করে আয়।
বলল আয়াস। না চাওয়ার সত্ত্বেও কোনো উপায় না পেয়ে মাহানুরকে রাজি হতে হলো। বাস থেকে নামার পূর্বে আয়াস আরহামকে বলল,
-ভাই দেখেশুনে নিয়ে যাইয়েন।
-চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমার থেকে ভালো তোমার বোনকে অন্যকেউ দেখে রাখতে পারবে না।
শেষের কথাটা বিড়বিড় করেই বলে আরহাম। তারা নামতেই বাস ছেড়ে দেয়। মাহানুর এগিয়ে এসে পা’জোড়া উঁচু করে আরহামের শার্টয়ের কলার ধরে রাগী কণ্ঠে বলল,
-এইসব কিছু যে আপনি ইচ্ছে করে করেছেন সেটা আমি ভালো করেই জানি। আমি যাতে ওদের সাথে এনজয় করতে না পারি আপনার প্রতিশোধ পূরণ হয় তাই তো এমন করেছেন?
-তোমার সমস্যা কী? তুমি কী সবসময় শুধু আমার সাথে চিপকে থাকতে চাও?
-শাট আপ।
মাহানুর ছেড়ে দিলো আরহামকে। আরহাম শার্টয়ের কলার ঠিক করে বলল,
-আমি ইচ্ছে করে করিনি ওকে। তোমার থেকে প্রতিশোধ আমি চাইলে অনেক ভাবেই নিতে পারি। বুঝলে?
মাহানুর কিছু বলল না। পিছনে সিটের দরজা খুলে বসতে যাবে তার পূর্বেই আরহাম তাকে বলল,
-কাম অন মেডাম আমি আপনার ড্রাইভার নই। সামনের সিটে এসে বসুন।
মাহানুর নাক ফুলিয়ে ধরাম করে সামনের সিটের দরজা খুলে বসে পরে। রাগে ফুসছে সে। আরহাম বাঁকা হেসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাস্তায় দুইজনের মধ্যে আর একটা কথাও হয় না। আরহাম শুধুই মাহানুরকে দেখছে আর মাহানুর মুখ লটকিয়ে বসে আছে।

বাসে একসাথে বসে আছে আয়াস আর সুনহেরা। সবাই আনন্দে মেতেছে। রিদ তার বেসুরা কণ্ঠে গান গাইছে আর সবাই তালি দিচ্ছে। এতক্ষনও আয়াসকে কিছু বলতে না দেখে সুনহেরা রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-আপনার সাহস কত বড় আপনি আমাকে ইগনোর করছেন?
-ইগনোর কোথায় করলাম! আপনিই তো বলেছেন আপনার সাথে যেনো ভাব না লাগাই।
স্বাভাবিক ভাবেই বলল আয়াস। সুনহেরা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
-আমাকে এটিটিউড দেখাচ্ছেন আপনি! ভুলের যেয়েন না কাল বাদে পরশু আমি আপনার ওয়াইফ হবো।
-তোহ? আমাদের সম্পর্ক কী নরমাল হাসব্যান্ড ওয়াইফের মতো হবে? তাহলে মনে করেও বা কী করবো।
সুনহেরা বড় বড় নিঃশাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। নরম কণ্ঠে বলল,
-আমি ঐদিন আপনার থেকে ঐরকম কিছু আশা করিনি! আপনি ভালোই মারামারি জানেন।
-একটু আরেকটু আর কী।
-আচ্ছা আমরা কী ফ্রেন্ড হতে পারি? শত্রুতা আমার ভালো লাগে না তাই ফ্রেন্ড হয়েও তো থাকা যায়।
আয়াস ঘাড় ঘুরিয়ে সুনহেরার দিকে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-যদি ফ্রেন্ডশিপ না করি?
-তাহলে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো।
মুচকি হাসি দিয়ে বলল সুনহেরা। প্রসন্ন হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো আয়াস। সুনহেরা চমৎকার একটি হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
-ফ্রেন্ডস?
আয়াস স্মিত হেসে চশমা ঠিক করে। সুনহেরার হাতে হাত মিলিয়ে বলল,
-ওকে ফ্রেন্ডস।

রিসোর্টে পৌঁছে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায় এতো সুন্দর রিসোর্ট দেখে। মেনেজার সবাইকে একটি একটি করে রুমের চাবি দিয়ে দেয়। মাহানুররা সবার শেষে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নামার পর আরহাম আচমকা তার স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। মাহানুর ভড়কে গিয়ে বলল,
-কী হয়েছে? সমস্যা কী আপনার?
-তোমার ফোন।
আরহামের হাতে নিজের ফোন দেখে মাহানুর অবাক হয়ে যায়। গাড়ি চলাকালীন সে ফোন টিপছিলো। হয়তো মনের ভুলে ফোন গাড়িতে রেখেই এসে পরেছিল। এক প্রকার কেড়ে আরহামের হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয় মাহানুর। অহনা আর সিয়ামদের সাথে ভিতরে চলে যায়। দূর থেকে আয়াসের খালারা তীক্ষ্ণ নজরে বিষয়টা খেয়াল করলো। একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করতে থাকলো।

মাহানুর মেনেজার থেকে রুমের চাবি নিতে আসে। পাশেই চেয়ার রাখা ছিল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ধপ করে সেটাই বসে পরলো সে। মুহিব মাহানুরের ব্যাগ ধরে বিরক্ত হয়ে বলল,
-বইন আগে রুমে চল তারপর এভাবে বসিস। আমরা তোর বডিগার্ড না।
-ছেলে বেস্টফ্রেন্ড মানেই বডিগার্ড। বুঝলি?
-তোর মুন্ডু!
মাহানুর পাশ ফিরে মেনেজারের দিকে তাকায় ফোনে কথা বলছিলো এতক্ষন। এখন ফোনটা কিনারে রেখে বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-মাহানুর মেডাম যে! কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
-হায়! হ্যান্ডসাম ছেলেরা যখন মেডাম বলে তখন দিলে এসে লাগে!
অনেকটা অভিনয় করে বলল মাহানুর।মেনেজারের সহ উপস্থিত সকলে হাসতে থাকে। গতকাল এসে মাহানুর মেনেজারের সাথে পরিচিত হয়েছে। আয়াসদের বয়সী সে তবে দেখতে অনেক স্মার্ট। লোকটার ব্যবহারও সুন্দর। মাহানুরের মোটামুটি বেশ লেগেছে লোকটাকে। মেনেজার সামনের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
-সুন্দরী মেয়েরা যখন হ্যান্ডসাম বলে তখন নিজেকে ধন্য মনে হয় আমার।
-বাবা! তাই নাকি?
-জি।
অহনা মাহানুরের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলল,
-মেনেজার ভাই রুমের চাবি দেবেন নাকি আমরা এখানেই বিছানা পাতবো?
মেনেজার দুইটা রুমের চাবি বের করে দেয়। এক রুমে অহনা আর মাহানুর থাকবে আরেক রুমে সিয়াম আর মুহিব। ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে আরহাম। মাহানুরকে মেনেজারের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে রাগে কপাল কয়েক ভাঁজ পরলো তার। কল কেটে ফোন হাতে নিয়ে মেনেজারকে বলল,
-কী বেপার মেনেজার সাহেব? কাজ না করে গল্পে মেতেছেন দেখছি।
মেনেজার ভীত হয়ে চুপসে গেলো। মাহানুর পিছনে ফিরে আরহামকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চাবি হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
-আবার কথা হবে মিস্টার হ্যান্ডসাম।
চলে যায় মাহানুর। আরহাম চাবি নিতে নিতে স্মিত হেসে বলল,
-মেনেজার সাহেব কাজে মন দিন। আর হ্যাঁ মাহানুরের সাথে বেশি ভাব লাগানোর প্রয়োজন নেই।
শেষের কথাটা চাপা স্বরে বলল আরহাম। মেনেজার শুধুই মাথা নাড়ালো। এখন সবাই যার যার রুমে যেয়ে রেস্ট করছে। অনেককে আবার বাহিরে ঘুরছে। কেউ কেউ বা রাতে কী পরবে, কী করবে প্ল্যান করছে। মাহানুর অহনা নিজেদের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে সুনহেরার রুমে। অন্যদের রুমের তুলনায় সুনহেরার রুমটা বিশাল বড়। দুইটা বেড নিচেও অনেক জায়গা। সব মহিলা, যুবতী মিলে একসাথে বসে রাতের প্রোগ্রামের আলোচনা করতে থাকে।
______________________
সূর্য ডুবে গিয়েছে কিছুক্ষন আগেই। উজ্জ্বল আকাশ ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠেছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করে নিজেদের আবাসস্থলে চলে যাচ্ছে। আঁধারে পুরো রিসোর্ট সেজে উঠেছে জ্বলমলে কৃত্রিম আলোয়। চোখ ধরানো ডেকোরেশন দেখে যে কেউই মুগ্ধ হয়ে যাবে। আরহাম বিকাল দিকেই চট্টগ্রাম উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। আগামীকাল ভোরে এসে পরবে সে। রিদ, সিয়াম, আসীন আর আরহামের কিছু বন্ধুরা মিলে ঘুরে ঘুরে দেখছে সব ঠিকঠাক আছে কী না। আয়াসও আসীনের সাথে ছিল। মাহানুর আর রিদ জোর করে তাকে রুমে ভিতরে নিয়ে গিয়েছে। যার বিয়ে সে নিজে কিভাবে কাজ করে!
মেয়েরা ব্যস্ত রেডি হতে। পার্লারের মানুষরা এসেছে। সুনহেরার রুমে একে একে সবাইকে সাজিয়ে দিচ্ছে তারা। মোটামুটি সবাই তৈরি শুধু মাহানুর, সুনহেরা আর ইকরা বাদে। অহনা তৈরি হয়ে ফোন নিয়ে সুনহেরার রুম থেকে বের হয়। নিজেদের রুমে যাচ্ছে তার ফোনে চার্জ নেই চার্জ দিতে হবে। লেহেঙ্গা ধরে বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে সে। সামনের থেকে সিয়ামের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে রিদ। অহনা তাকে দেখে তাকিয়ে থাকে। সিয়াম অহনাকে দেখতেই উপহার স্বরে বলে উঠলো,
-বাবা গো দিন দুপুরে শাকচুন্নি বাহিরে ঘুরছে দেখি!
সিয়ামের কথা শুনে সামনে তাকায় রিদ। অহনাকে দেখে বুকে হাত দিয়ে নিচে বসে পরলো সে। অহনা প্রথমে হতবাক হলেও পরমুহূর্তে সরমে লাল হয়ে গেলো। সিয়াম ভেবেছেকা খেয়ে গেলো। রিদ একই ভঙ্গিতে বলল,
-আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব! আকাশের চাঁদ জমিনে কিভাবে আসলো!
সিয়াম হাসতে হাসতে রিদকে টেনে তুললো। অহনা এগিয়ে এসে মুখ বাকিয়ে বলে,
-ফ্লার্টিং করা ছাড়া আর কিছু পারেননা আপনি?
-আসলে তোমাকে দেখলে আমার শুধু ফ্লার্টিংই করতে মন চায়।
অহনা ভেংচি কেটে চলে যায়। রিদ তাড়া দেখিয়ে সিয়ামকে বলল,
-শা’লামিয়া তুমি যাও আমি একটু আসছি।
-ঠিক আছে।
রিদ দৌড়ে অহনার পিছন পিছন তাঁদের রুমে চলে আসে। অহনা ফোন চার্জে দিয়ে পিছনে ফিরতেই রিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। বিরক্তকর কণ্ঠে বলল,
-এখানে কী করছেন আপনি? বের হয়ে যান রুম থেকে।
-জানেমান আমি তো চলে যেতে আসিনি!
রিদ এক পা দু পা করে এগিয়ে যায়। অহনা ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,
-কেউ এসে দেখলে খারাপ ভাববে। আপনি প্লিস চলে যান।
রিদ হাত বাড়িয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে দেয় জানালা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় অহনাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো রিদ। অহনা বিচলিত হয়ে কিছু বলবে এমন সময় যে নিজের কোমরে পুরুষালি শক্ত হাত অনুভব করে। রিদ তার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। অহনা অস্থির হয়ে উঠলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রিদ তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে দেয়। কিছুটা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী আমার মা তারপর আমার ভবিষ্যত স্ত্রী মানে তুমি।
অহনা বরফের মতো জমে গেলো। রিদ এভাবেও কথা বলতে পারে তার ধারণা ছিল না। অহনার কম্পিত শরীর অনুভব করতেই রিদ কুটিল হেসে বলল,
-চিন্তা নাই। তোমার এই ভদ্র প্রেমিক বিয়ের আগে তোমাকে অপবিত্র করবে না জানেমান।

গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে অহনাদের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে মুহিব। তার সাথে আছে মাহানুরের চাচাতো ভাই ফায়াজ। মাহানুরের কাছ থেকে পাওয়ারব্যাংক নিতে আসছিলো সে। ফোনে চার্জ নেই বেচারা গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে পারছে না। ছোট ফায়াজ চকলেট খেতে খেতে বলল,
-ওহ তেরি! মুইব ব্রো মাহানুর আপু আর অহনা আপু তো নিচে সাজুগুজু করছে।
-বেটা আমার নাম মুইব না মুহিব। আর আমি জানি তোমার আপু নিচে।
-ওহ! ব্রো আপনের জিএফ আছে?
মুহিব বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল,
-হো চারটা জিএফ আছে আমার।
-মাত্র চারটা! আমার তো পাঁচটা জিএফ আছে।
মুহিব শুকনো ঢোক গিললো। এইটুকু পিচ্চির পাঁচটা জিএফ আর তার কিনা চারটা! নিজের ওপরই রাগ হলো মুহিবের। কথা বলতে বলতে তারা অহনাদের রুমে এসে পরে। দরজা খোলা আবার রুমের লাইট বন্ধ দেখে মুহিব ভ্রু কুঁচকালো। ভিতরে উঁকি দিতেই তারা অন্ধকারে দুটি ছায়া মূর্তি দেখতে পেলো। ফায়াজ মুহিবের দিকে তাকালো আর মুহিব ফায়াজের দিকে।ফায়াজ আর মুহিব একসাথে বিকট আওয়াজে চিৎকার করে উঠলো,
-ভুতততততততত!
উঠেপুটে দৌড় লাগায় দুইজন। তাঁদের এখন দিনদুনিয়ার কোনো খবর নেই। শুধু ভুতের হাত থেকে বাঁচতে পারলেই হলো। অহনা রিদ নিজেরাও ভয় পেয়ে যায় ওদের এমন চিৎকারে শুনে। রিদ দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে রুম থেকে কেটে পরলো। অহনা বুকে ফুঁ দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মুহিব আর ফায়াজ দৌড়াতে দৌড়াতে নিচতলায় এসে পরলো। মাহানুর মাত্রই রেডি হয়ে বাহিরে এসেছে। সিয়াম আর আসীনের সাথে কথা বলছিলো সে। মুহিব দৌড়ে এসে তাঁদের সামনে থামলো। বুকে হাত দিয়ে দুইজন নিঃশাস নিচ্ছে। ঘেমেনেয়ে একাকার তারা। সিয়াম শয়তানি করে বলল,
-কিরে ভুতের দৌড়ানি খেয়ে এলি নাকি?
-হ্যাঁ সিয়াম ব্রো। ভুত দেখেছি আমরা!
-ভুত!
বিস্ময় হয়ে বলল মাহানুর। মুহিব শ্বাস নিতে নিতে আঁতকে বলল,
-হো দুইটা ভুত দেখেছি বেটা।
-কিসব বাজে বকছিস মুহিবের বাচ্চা!
সিয়াম মুহিবের মাথায় চাপর দিয়ে বলল,
-ভিডিও কলে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দেখেছিস নাকি শা’লা?
মুহিবের কিছু বলার আগেই ছোট ফায়াজ ভয়াত কণ্ঠস্বরে বলল,
-সত্যি মাহানুর আপুদের রুমে দুইজন ভুত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কি’সসি করছিলো সিয়াম ব্রো!

>>>>চলবে।
(আসসালামু ওলাইকুম। সকলের মন্তব্য আশা করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here