#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩২
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
মৃদু কন্ঠে বলল – একবার আমাকে গ্রহন করেই দেখো না কৃষ্ণময়ী। এই আবেগটাকেই তোমার দৃষ্টিতে ভালোবাসায় রূপান্তর করে ছাড়বো আমি।
পূর্বাশা হতাশ হলো। এই ছেলেকে আদও বুঝিয়ে লাভ আছে কি কোনো? মাঝে মাঝে আজকাল পূর্বাশার হৃদয়ও কেমন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে জায়ানকে তবে ছেলেটাকে সম্পূর্নরূপে বিশ্বাস করতে বাঁধা প্রদান করছে তার মস্তিষ্ক। পুরোনো তিক্ত অতীতগুলো বারংবার ভেসে উঠছে মস্তিষ্কের স্মৃতির পাতায়। মেয়েটাকে সাবধানী বানীতে আদেশ দিচ্ছে – কাউকে বিশ্বাস করিস না তুই পূর্বাশা। তোর মতো কুৎসিত নারীকে সত্যিকারার্থে ভালোবাসে না কেউ। সবটাই মায়া মোহ নয়তো অতীতের মতো কোনো বাজী। এই বি’ষ’ম’য় খেলায় পা দিস না তুই পূর্বাশা।
পূর্বাশা শুনলো তার মস্তিষ্কের কথা। অতীতে নিজের হৃদয়ের কথা শুনে ভুল করেছিল। যে ভুলের মাসুল আবার ঐ হৃদয়টাকেই র’ক্তা’ক্ত করেছিল বাজেভাবে। পূর্বাশা কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল – পাগলামী বন্ধ করুন আপনি জায়ান ভাই।
জয়ান মৃদু হাসলো। নরম কন্ঠে বলল – নিজের ব্যক্তিত্ত ভেঙে তোমার ভালোবাসায় পাগলামোটা চলে এসেছে কৃষ্ণময়ী, সে পাগলামো কি আর আদও আমার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব ?
পূর্বাশার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। শক্ত কন্ঠে সে বলল – চাইলে সব সম্ভব।
– হয়তো কিন্তু আমি চাইছি।
পূর্বাশা আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এই লোকের সাথে কথা বলাই বেকার। সে যাই বলুক না কেন সর্বাদা তার কথার উল্টো জবাব তৈরী থাকে জায়ানের। পূর্বাশা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের পানে অতঃপর হনহন করে বেরিয়ে এলো পার্কের বাইরে। জায়ানও ছুটলো পূর্বাশার পিছু পিছু। পার্কের বাইরে যেতেই পূর্বাশা আর জায়ান মুখোমুখি হলো তৃষাম আর চ্যাং এর। তৃষাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পূর্বাশার সম্মুখে, অস্থির কন্ঠে বলল – তুই ঠিক আছিস তো পূর্বা?
তৃষামের কথার মাঝেই চ্যাং তাকালো জায়ানের পানে। অবাক হলো সে। অবাক কন্ঠেই শুধালো – একি ভাই তোর এত সুন্দর ধবধবে মুলার মতো চেহারার মধ্যে এমন গাজরের মতো লাল দাগ পড়েছে কিভাবে? তাও আবার গাজরের পেটের মধ্য থেকে ছোট বড় পাঁচটা পা গজিয়ে গালের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে।
চ্যাং এর কথা শুনে তৃষাম তাকালো জায়ানের পানে। অবাক হলো সেও। একি জায়ানের গালে এমঞ থাপ্পরের দাগ কেন? এই থাপ্পের দাগ থাকার কথা ছিল তো পূর্বাশার গালে। রেগে তো ছিল জায়ান আর ভুক্তভোগী ছিল পূর্বাশা। তাই তো তাদের হন্যে হয়ে এত খোঁজা। কিন্তু এখানে এসে দেখছে উল্টো কে’স। যে থাপ্পরের দাগ পূর্বাশার গালে থাকার কথা ছিল সে থাপ্পর জায়ানের গালে। রাগে হতবিম্বল হয়ে জায়ান আবার নিজের গালে নিজে থাপ্পর মেরে দেয়নি তো? কিন্তু গালে বসা হাতের আকারটা তো ছোট দেখাচ্ছে। তবে কি জায়ানের গালে ছক্কাটা পূর্বাশাই মেরেছে? তৃষাম জয়ানের গালের দিকে দৃষ্টি রেখেই পূর্বাশাকে বলল – পূর্বা তোর হাতটা দেখি তো।
ভ্রু কুঁচকালো পূর্বা। অবাক সুরে শুধালো – কেন?
তৃষাম বিরক্ত হলো। বিরক্তভরা কন্ঠে বলল – আহ দেখা না।
পূর্বাশা হাতটা দেখালো। তৃষাম একটু এগিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে ধরলো পূর্বাশার হাতটা, ওলট পালট করে দেখে তাকালো জায়ানের গালের দিকে অতঃপর হতবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো – আসলে রেগে কে ছিল?
জায়ান এগিয়ে গিয়ে তৃষামের হাত থেকে পূর্বাশার হাতটা ছাড়িয়ে নিল অতঃপর জায়ানের পানে তাকিয়ে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল – তোর ভবিষ্যত দুলাভাই।
এইটুকু বলেই পূর্বাশার পানে তাকালো জায়ান, বলল – তোমাকে না হোস্টেলে ফিরতে হবে? হোস্টেলে চলো।
নিজের কথাটুকু বলে আর পূর্বাশার উত্তরটা শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না জায়ান। নিজেই মেয়েটার হাত টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো জায়ান।
_______________________________
সুদীর্ঘ আঁধারে ঢাকা এক রাত্রি কেটে সকালের দেখা মিললো। রাতের আঁধারে নিস্তব্ধ কলেজ প্রাঙ্গনটা হই হই রই রই করে উঠেছে। ইতমধ্যে ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে অনেকের। পূর্বাশার ক্লাস আজ একটু বেলা করে। ঘড়ি ধরে ক্লাস শুরুর দশ মিনিট আগে হোস্টেল ছেড়ে বেরুলো পূর্বাশা। সাথে প্রতিদিনের ন্যায় সাথী হিসেবে রয়েছে সেনজেই, জেফি আর সুজা। একসঙ্গেই কলেজে যাচ্ছিলো তারা। হঠাৎ কোথা থেকে ইয়ান এসে পথ আটকে দাঁড়ালো পূর্বাশার। ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা। হঠাৎ করে এ আবার কোথা থেকে টপকালো? এমনিই তো জীবনে অশান্তির অভাব নেই। তার মধ্যে এ আবার নতুন এক অশান্তি। কন্ঠে কিছুটা বিরক্তিবোধ নিয়েই পূর্বাশা শুধালো – আপনি! হঠাৎ এভাবে পথ আগলে দাঁড়ালেন যে?
– আমার উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি আমি।
– কিসের উত্তর?
– কাল আমার প্রেম নিবেদনের উত্তর।
– সোজাসাপ্টাভাবে আমার উত্তর না।
– আমার উত্তর আমি তোমাকে ভালোবাসি পূর্বাশা।
– কিন্তু আমি ভালোবাসি না।
– তাহলে কাকে ভালোবাসো? ঐ জায়ানকে?
– না তাকেও ভালোবাসি না।
ইয়ান হুট করেই পূর্বাশার নিকটে এসে দাঁড়ালো। নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে ধরলো পূর্বাশার হাত দুটো। হকচকিয়ে উঠলো পূর্বাশা। বিরক্তিবোধে যেন ছেয়ে গেল তার সর্বাঙ্গ। ইয়ানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা। নাক মুখ কুঁচকে শুধালো – কি করছেন কি হাত ছাড়ুন আমার।
ইয়ান খুব একটা পাত্তা দিল না পূর্বাশার কথায়। সে হাত ছাড়লো না মেয়েটার। বরং আরও গাঢ় ভাবে চেপে ধরলো পূর্বাশার হাত দুটো। কাতর কন্ঠে বলল – দেখো আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। সেই আমাদের প্রথম দেখার পর থেকে তোমার আচার আচরণ বৈশিষ্ট্য সর্বদাই মুগ্ধ করেছে আমাকে। তোমার অন্যের জন্য ভাবা, সুন্দর হৃদয় তোমার প্রতি আমার অনুভূতি জাগাতে বাধ্য করেছে। এতদিন বলতে পারিনি পাছে যদি তুমি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দাও, ভুল বোঝো আমাকে। কিন্তু যখন দেখলাম জায়ান তোমার পিছনে পড়েছে, সেও নাকি ভালোবাসে তোমাকে তখন নিজেকে আর সংবারণ করে রাখতে পারলাম না। তোমাকে হারানোর ভয় তীব্রভাবে জেঁকে ধরলো আমাকে। তাই তো দ্রুতই ছুটে এলাম তোমার কাছে আমার ভালোবাসার দাবি নিয়ে।
পূর্বাশা শুনলো ইয়ানের কথাগুলো। ছেলেটা মিথ্যা বলছে নাকি সত্যি জানা নেই তার। ছেলেটার ভাষ্যমতে সে পূর্বাশার আচার ব্যবহার বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ অল্প কথায় মন দেখে ভালোবেসেছে। কিন্তু আজকালকার যুগে কি সত্যিই মন দেখে ভালোবেসা হয়? উহু হয় না। আজকালকার যুগে ভালোবাসা হয় শারীরিক সৌন্দর্য, লালসা কিংবা টাইম পাসে। ইয়ানের কথা শুনে জোরে হাসতে ইচ্ছে হলো পূর্বাশার কিন্তু সে হাসলো না। বরং শক্ত কন্ঠে বলল – হাত ছাড়ুন আমার। এভাবে হুট করে বিনা অনুমতিতে একজন নারীর হাত ধরা কোন ধরনের অ’স’ভ্য’তা’মো?
ইয়ান পূর্বাশার হাত তবু ছাড়লো না। কাকুতিভরা কন্ঠে বলল – দেখো পূর্বাশা…..
বাকি কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না ইয়ান। তার আগেই ছেলেটার নাক বরাবর সজোরে একটা ঘুষি পড়লো। সাথে সাথেই ছিটকে গেল ইয়ান। আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হলো উপস্থিত সকলে। পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে এলো জায়ানের রক্তলাল মুখশ্রী। ক্রোধে কেমন ফোঁস ফোঁস করছে ছেলেটা। হস্তজোড়া মুষ্টিবদ্ধ এখনও। জায়ানকে দেখেই ইয়ান উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। ফর্সা নাকটায় রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে উঠেছে ইতমধ্যেই। ইয়ানকে উঠতে দেখেই জায়ান ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেল তার পানে। শক্ত করে কলারটা চেপে ধরে বলল – ও হাত ছাড়তে বলছিলো শুনিসনি তুই? তারপরও কেন হাত ছাড়ছিলি না তুই ওর।
কথাটা বলেই ইয়ানকে জোরে একটা ধাক্কা মারলো জায়ান। ক্রোধিত কন্ঠে বলল – আমার কৃষ্ণময়ীকে তোর স্পর্শ করার সাহস কি করে হলো?
তীব্র ক্রোধে দিশেহারা জায়ান তেড়ে গেল ইয়ানের পানে। পূর্বাশা দ্রুত গিয়ে দাঁড়ালো তার সম্মুখে। ছেলেটা এই মুহূর্তে যে পরিমাণ রেগে আছে তাতে না মেরে দেয় ইয়ানকে। রেগে গেলে এই পুরুষকে দ্বারা যেকোনো কাজ সম্ভব। ভয় পেল পূর্বাশা। মেয়েটা বাঁধা প্রদান করলো জায়ানকে, বলল – ঝামেলা করবেন না প্লীজ। উনাকে ছেড়ে দিন।
ক্রোধে উন্মত্ত জায়ানের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো না এ কথা। তার কৃষ্ণময়ীকে কেউ ছুয়েছে হোক তা হাত এ কথা সে কিভাবে মেনে নিবে। গতকাল তৃষাম একটু ছুঁয়েছিল তাই সহ্য হচ্ছিলো না আর আজ এই ব’দ’মা’ই’শ ছেলেটা। ক্রোধের বশবর্তী জায়ান তার সম্মুখ থেকে সরিয়ে দিল পূর্বাশাকে। যদিও সে আস্তে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ক্রোধের কারনে তা ধাক্কায় পরিনত হয়েছে। জায়ানের দেওয়া ধাক্কায় পূর্বাশা ছিটকে পড়লো ইট কংক্রিটে গড়া রাস্তার উপর। কন্ঠে “আহহ” করে ব্যথাতুর ধ্বনি তুললো তৎক্ষণাৎ। হকচকালো সেনজেই, জেফি, সুজা, ইয়ন এবং জায়ান নিজেই। ছুটে গেল পূর্বাশার কাছে। ইয়ানকে ভুলে জায়ানও ছুটলো মেয়েটার কাছে। পাকা রাস্তায় পড়ে পূর্বাশার কপালের এক পাশে একটু কেটেও গেছে। র’ক্ত ঝড়ছে। অস্থির হলো জায়ান। বিচলিত ভঙ্গিতে বলল – তুমি ঠিক আছো কৃষ্ণময়ী? বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেইনি।
ইয়ানও দৌড়ে এলো পূর্বাশার কাছে, অস্থির কন্ঠে বলল – তুমি ঠিক আছো তো পূর্বাশা?
পূর্বশা যেন গর্জে উঠলো এবার। সেনজেই এর সহায়তায় উঠে দাঁড়ালো সে। হাঁটুতে ও কিছুটা ব্যথা পেয়েছে কিনা? তীব্র ক্রোধ নিয়ে মেয়েটা ঝরঝরে কন্ঠে বলল – সমস্যা কি আপনাদের? কি পেয়েছেন আপনারা আমাকে? মজা করার পাত্রী নাকি বিনোদনের খোড়াক। যে নারী নিজের কুৎসিত চেহারার জন্য দেশে অবহেলিত তাকে বিদেশের এত এত সুদর্শন পুরুষ মাত্র এই কয়েকটা দিনে একদম ভালোবেসে উল্টে ফেলেছে এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
– বিশ্বাস করো পূর্বাশা আমি সত্যিই তোমাকে…
এই টুকু বলতেই জায়ানকে থামিয়ে দিল পূর্বাশা। শক্ত কন্ঠে বলল – দেশ ছেড়ে বিদেশে এসেছিলাম একটু শান্তির আশায়। একটু ভালোভাবে বাঁচাতে। এখন দেখছি না আমি এর থেকে দেশেই শান্তিতে ছিলাম।
কথাটুকু বলে একটু থামলো পূর্বাশা অতঃপর আবার বলল – অনেক হয়েছে, আপনাদের অনেক অভিনয় আমি সহ্য করেছি। আর নয় এবার আমার ফিরে যাওয়ার পালা। দেশের মানুষ দেশেই ফিরে যাব অবার। থাকবো না এই ভিনদেশে অশান্তির কা’রা’গা’রে, আমি আবার বাংলাদেশেই ফিরে যাব। আর পারলে আমাকে আপনারা মাফ করবেন আমি আপনাদের কারো ভালোবাসাই গ্রহন করতে পারলাম না দুঃখিত। এত ভালোবাসা পাওয়ার আমার আবার অভ্যাস নেই।
এই টুকু বলে থামলো পূর্বাশা, স্তব্ধ হলো জায়ান। মস্তিষ্কে হানা দিল অনেককাল আগে ঘটে যাওয়া তার অদেখা তবে তার এই ছোট্ট জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঘটনা। সেও তো বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল। যদিও বলে গিয়েছিল সে ফিরে আসবে কিন্তু আর এলো না। তার শৈশব, কৈশোর, জীবনের অনেকটা ভালো থাকার মুহুর্ত কেড়ে নিল অজান্তেই। তবে কি পূর্বাশাও চলে যাবে ঠিক বহুকাল আগের সেই অদেখা ব্যক্তির মতোই? আর আসবে না ফিরে। সেও তার খুঁজে পাবে না পূর্বাশাকে, সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে সে মেয়েটাকে?
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link