অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা ১৪.

0
600

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

১৪.

সেদিনের ঝামেলা মিটিয়েছে হামজা। জয়কে আর ভার্সিটিমুখো হতে দেয়নি। সে গিয়ে প্রিন্সিপাল এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ছোট্ট একটা মিটিং করে ঝামেলা মিটিয়ে এসেছে। তা কতটা মিটেছে, জানা নেই।

রাতের গাড়িতে জয় ঢাকা যাবে। সে ঢাকা যাবার সময় কোনোদিন কার ব্যবহার করেনা, বাসে যায়। এতে তার ইন্টারেস্টটা কী, তা জয় জানে ভালো।

রাত দশটার সময় হামজা ও জয় একসাথে বসে খেল দুজন। এরপর দুটো সিগারেট ধরালো দুজন। জয় সিগারেটে টান দিয়ে হামজাকে বলল, “আমি তিন দিনের ভেতর ফেরার চেষ্টা করবো। তুমি ছেলেদের এলার্ট থাকতে বোলো। আর এত চিন্তা কোরো না, হুদাই। তোমার যে প্রতিদ্বন্দী গুলো ভোট করছে, তাদের লোক টাকা নিয়েও ভোট দেবে না। একটাই অপশন তাদের কাছে, তুমি। মাজহার সুস্থ হতে হতে ইলেকশন শেষ হয়ে যাবে। খুব খারাপ কিছু হবেনা।ʼʼ

হামজা কথা না বলে সিগারেট ঠোঁটে নেয়। জয় ঘরে গিয়ে একটা হাফ-স্লিভ টিশার্ট পরে এলো। জ্যাকেট অথবা গরম কাপড় কিছু নেই। ওভাবেই দৌঁড়ে ছাঁদে গেল। কবুতরের ঘরে পানি দেয়া দরকার। সে চলে গেলে তরু কতটুকু যত্ন করবে এদের, তা বলা যায়না। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে ভালোভাবে দেখল কবুতরগুলোকে। একা একাই দু-চারটা কথাও বলল কবুতরদের সাথে। নেমে এসে তরুকে শাসালো, “কবুতরদের যেন ঠিকমতো পযিচর্যা করা হয়। নয়ত বাড়ি ফিরে সবগুলোকে লাত্থি মেরে বের করবো বাড়ি থেকে।ʼʼ

ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। বের হওয়ার আগ মুহুর্তে রিমির কথা মনে পড়ল। ওকে একটু জ্বালানো দরকার বের হওয়ার আগে। ঘরে ঢুকে দেখল, রিমি কাপড় স্ত্রী করছে। জয় লম্বা করে একটা সালাম দিলো। যেন কতদূর থেকে মেহমান এসেছে। রিমি তাকালো, কথা বলল না। জয় বলল, “রেগে আছেন কার ওপরে, আমার ওপরে?ʼʼ

-“রেগে কেন থাকব?ʼʼ

-“মহিলা মানুষের রেগে থাকার জন্য বিশেষ কারণ দরকার হয়না।ʼʼ

রিমি ঠ্যাস দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আপনি যখন বলছেন তখন তাই। আফটার অল মেয়েলোকের ব্যাপারে খুব জানাশোনা আছে আপনার।ʼʼ

গায়ে মাখলো না জয় কথাটা, প্যাচপ্যাচে হাসি হাসল, “আছে বলেই তো বলছি। সে যাক গে, পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। একটু দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ-টু দিয়ে দেন। আমার তো মা নেই, দোয়া-টোয়া চাইবো কার কাছে?ʼʼ

-“আপনার আবার দোয়া লাগে নাকি? আপনি দোয়াতে বিশ্বাস করেন?ʼʼ

জয় কথা বলল না। রিমি বলল, “মা নেই, মামি তো আছে! তার কাছে দোয়া চান গিয়ে।ʼʼ

জয় বসল বিছানার ওপর, “ভাবী! ভাই এমনিতেই খুব টেনশনে আছে। বোঝেন তো, কত দিকের চাপ। ইলেকশনের ঝামেলা তো বোঝার কথা আপনার, তার ওপর চারদিক বহুত ফ্যাসাদ লেগে আছে। এই সময় ভাইয়ের দরকার আপনাকে। অথচ সপ্তাহ হয়ে গেল, আপনি কথা বলেন না, কোনো কিছুতেই আপনার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তার ওপর দিয়ে কী চলে যাচ্ছে। এখন খুব করে তার আপনাকে দরকার। আপনি তার বউ, তার পেরেশানী দূর করতে আপনার বিকল্প নেই। রাগ করে থাকবেন না এখন আর। আমিও থাকবো না কয়েকদিন ভাইয়ের পাশে। আপনিও মুখ ফিরিয়ে থাকলে…

এবারে গলার নরম স্বর পরিবর্তিত হয়ে জয়ের নিজস্বতা এলো, “সমস্যা বা ঝামেলা যদি আমায় নিয়ে হয়, আমি তো আর ক্ষমা-টমা চাইব না, জানেনই। অথবা আফসোসও করবো না। আপনি কীসের আশায় রেগে থাকবেন তাহলে? অন্তত যতদিন বেঁচে আছি, এভাবেই চলবে হয়ত। তাই বলে তো আর চিরদিন রেগে থাকতে পারবেন না। তো ক’দিন আগ আর পিছ। কেননা, এখনই ঠিক হয়ে যান। আমি জিনিসটাই এমন, ভাবী। যেখানেই আমার অবস্থান, তার আশপাশে কিছু না কিছু ক্ষয় হয়-ই। এটা আমার নিজস্বতা বলা চলে। মেনে নিন। আসি, ভালো থাকবেন।ʼʼ

অকপটে নিজের অশিষ্টতা স্বীকার করে বের হয়ে গেল জয়। হামজা বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোফার হাতলে ঝোলানো শাল চাদরটা ওড়নার মতো গলায় পেঁচিয়ে নিলো।

বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দুটো টিকেট কাটলো হামজা। পুরো দুটো সিট জুড়ে একা লাগে জয়ের। পাশে চায়ের দোকানে বসে দুজন দু-কাপ চা খেল। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিলো জয়। ঘাঁড়ে গামছার মতো ইয়ার-ফোন ঝুলছে। বাসে ওঠার আগে হামজা জয়কে অন্ধকারের দিকে নিয়ে গেল। ওদিক-ওদিক তাকাতে তাকতে জয়ের হাতে চাদরের আড়ালে তার সেমি-অটোমেটিক পিস্তলটা তুলে দিলো। জয় বিরক্ত হলো, “এই শালার কী দরকার? ও আমার হাতে থাকলেই একটা পাপ কাজ হয়ে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, আমি বিপদক্ষেত্র থেকে দূরে যাচ্ছি। তুমি থাকবে এখানে, মালটা তোমার দরকার হবে।ʼʼ

হামজা গম্ভীর স্বরে বলল, “চুপচাপ এটা প্যান্টের বেল্টে গুঁজে ফেল। আমার বাপ হওয়ার চেষ্টা করবি না। আর এটা তোকে পাপ করার জন্য নয়, বরং সেল্ফ-ডিফেন্সের জন্য দিচ্ছি। এই বাসেও তোর সাথে মৃত্যুদূত যেতে পারে। বাসে ঘুমিয়ে পড়িস না যেন। ইয়ারফোনের সাউন্ড হাই রাখবি। পরীক্ষা শেষ করে এক ঘন্টাও ওখানে দেরি করবি না। সোজা দিনাজপুরের বাস ধরবি।ʼʼ

কথা শেষ করে একটা ছোট্ট পকেট ছুরি এগিয়ে দিলো হামজা, “এটা পকেটে রাখ। ভালোভাবে পরীক্ষা দিস। এসব কোনো চিন্তা মাথায় রাখার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা খারাপ হলে আমার কাছে জায়গা হবে না, তোর। সুতরাং, সম্পূর্ণ মনোযোগ যেন শুধু পরীক্ষায় থাকে। বাসের জানালা খোলা রাখবি না। আর টি-শার্টটাই বা পরেছিস কেন? ওটা সহ প্যান্টাও খুলে ফেল। খুব গরম পড়ছে তো, পৌষ মাস বলে কথা, চারদিকে খুব গরম।ʼʼ

জয় হেসে ফেলল নির্লজ্জের মতো, “জ্যাকেট আনিনি সাথে। আমার শীত লাগেনা, জানোই তো। কবীরকে বলে দিয়েছি, ও সবসময় সাথে থাকবে তোমার। মামাকে রাত-বিরাত বের হতে দিও না।ʼʼ

হামজা নিজের জ্যাকেটটা খুলে ফেলল। জয় নিষেধ করার সাহস পেল না। এই পাবলিক প্লেসে হামজা ঠাস করে একটা চড় মারলে, মান-ইজ্জত থাকবে না। জ্যাকেটটা কনুইতে বাঁধিয়ে, পিস্তলটা প্যান্টে গুজে চাদর জড়িয়ে নিলো গায়ে। বাসে উঠতে গিয়ে আবার দৌঁড়ে ফিরে এলো, “লাইটার বা দিয়াশলাই কিছুই নাই আমার সাথে। লাইটারটা দাও।ʼʼ

হামজা লাইটার বের করলে তা হাতে না নিয়ে আলতো করে একবার বুকে বুক মেশালো জয়। পরে লাইটার নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে সবে চলতে শুরু করা বাসে উঠল লাফিয়ে।


পরীক্ষা শুরুর আগে দু’দিন ছুটি ছিল। রাত চারটার দিকে ঘুমিয়ে আবার উঠেছে ছয়টায়। নামাজটা পড়ে আবার শুরু করে দিয়েছে পড়া। আজ প্রথম পরীক্ষার বিষয়–ইন্ডাক্টরি এনথ্রোপলজি । অন্তূর মনেহয় নৃবিজ্ঞান হলো সবচেয়ে বাজে সাবজেক্ট সমাজবিজ্ঞা বিভাগের। বাকিগুলো যে ভালো, তা তো মোটেই নয়। তবে এটা বিরক্তিকর। পড়তে পড়তে কখন বেলা নয়টা বেজেছে টের পেল না অন্তূ। সেই কখন থেকে আম্মু ডাকছে খাওয়ার জন্য। অন্তূ ঠিকমতো জবাবও দিতে পারেনি। দরজার বাইরে থেকে অনুমতি চাইলেন আমজাদ সাহেব, “আসবো?ʼʼ

অন্তূ বিরক্ত হলো, “আব্বু, এই স্বভাবটা যাবেনা তোমার? আমার ঘরে ঢুকতে কীসের অনুমতি?ʼʼ

আমজাদ সাহেব বরাবরের মতো জবাব না দিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালেন, “চল, আমি খেতে বসব।ʼʼ

-“আচ্ছা, তুমি খেয়ে নাও, আমি সময় পেলে খেয়ে বের হবো।ʼʼ

-“আমি খেতে বসবো।ʼʼ

-“আব্বু! আমি পরে খাচ্ছি। ক্ষুধাই লাগেনি, মানে রুচিই পাচ্ছিনা।ʼʼ

ধমকে উঠলেন আমজাদ সাহেব, “কিন্তু আমি এক্ষুনি খেতে বসবো।ʼʼ

অন্তূ হার মানলো। তাকিয়ে থাকলো আব্বুর দিকে। ঘিয়ে রঙা শাল জড়ানো লম্বাটে চেহারা, চাপ দাড়িতে মেহেদী। আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “তাকিয়ে আছিস কেন?ʼʼ

-“একটু বসো তো আব্বু।ʼʼ ছিটিয়ে থাকা বই খাতা সরিয়ে দিলো অন্তূ।

আমজাদ সাহেব বসলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “এভাবে চেয়ে আছিস কেন? কী হয়েছে? প্রস্তুতি ভালো তো?ʼʼ অন্তূর খাতা এগিয়ে নিলেন। তাতে চোখ বুলিয়ে বললেন, “লেখার লাইন এখনও ঠিকমতো সোজা হয়নি।ʼʼ

হাসল অন্তূ, “আমি সোজা হয়েছি?ʼʼ

-“আমি বেত হাতে করা বাদ দিয়েছি যে।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল, “বেত হাতে করলে, ইশ! খামোখা ভয় পেতাম। তখন যদি বুঝতাম তুমি শুধুই ভয় দেখাতে বেত দেখাচ্ছ, এত ডিসিপ্লিনড, ভালো মেয়ে হতাম না আমি, প্রমিস!ʼʼ

হেসে ফেললেন আমজাদ সাহেব, “এখন বেত হাতে তুললে ঠিক মারবো। চল, তোর আম্মা বসে আছে। দেরি হলে একটা ছোট-খাটো ঘৃর্ণিঝড় বয়ে যাবে।ʼʼ

-“একটা প্রশ্ন করব?ʼʼ

-“না, আগে খেতে চল। ধান্দাবাজি আমার সাথে না। না খেয়ে পরীক্ষা দিতে যায় কেউ?ʼʼ

অন্তূ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ আব্বুর দিকে, চোখ দুটো সজল হয়ে উঠল, অল্প পানি ছলছল করে উঠল। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, হিমুরা পকেটে টাকা নিয়ে ঘোরে না।অন্তূ সেটাকে নিজের মতো করে বলে, অন্তূরা কান্না করেনা। কথাটা বলে আবার নিজেই হেসে ফেলে। আজও একবার নিজেকে কথাটা বলে গলাটা কড়া করার চেষ্টা করল, “আব্বু! সবার আব্বু তোমার মতো হয়না তাই না?ʼʼ কথাটা অভিযোগের সুরে বলল, অথচ আমজাদ সাহেব বুঝলেন তার মেয়ে প্রতীকী অর্থে কথা ঘুরাতে জানে আবেগ লুকিয়ে।

বুঝে হাসলেন আমজাদ সাহেব, “পাগল মেয়ে! বাপ সবারই সেরা হয়। আমি জীবনে বিশেষ কিছুই দেইনি তোকে, শুধু নিজের কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি, শেষ অবধি সেটাও সুষ্ঠুভাবে পারিনি। এত ঋণ রাখবি না নিজের ওপর, ঋণ আমার ঘাঁড়েও আছে তোর! আমার তো মা নেই, তোকে মাঝেমধ্যেই মা, মা বলে ডাকি। এই সুযোগটা কেনার সামর্থ্য আমার নেই। তুই বিনামূল্যে দিয়ে রেখেছিস।ʼʼ

অন্তূ সহ্য করতে পারল না। বুকের ভার বাধ মানবে না বেশিক্ষণ। অনুরোধ করার মতো বলে উঠল, “চুপ করো, আব্বু! চুপ করো, আব্বু। ʼʼ

নিজেকে সামলালো। আব্বুর দিকে তাকিয়ে অন্তিকের কথা মনে পড়ে মুখ মলেন হতে গিয়েও হলোনা। যারা কম হাসে, তাদের হঠাৎ হাসি মিলিয়ে দেয়ার সাহস অন্তূর নেই, বিশেষ করে আব্বুর।

হুট করে আব্বুর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। এভাবে ছোটোবেলায় সে আব্বুর উরুতে মাথা রেখে পড়া শিখতো আব্বুর কাছে। ওভাবেই ঘুমিয়ে গেলে, আমজাদ সাহেব আবার ডেকে তুলতেন জোর করে খাওয়ার জন্য। নিষ্ঠুর লাগতো তখন আব্বুকে। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়া। সকালে টেনে তুলে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। অন্তূ রাস্তাটা কোনোদিন আব্বুর হাত জড়িয়ে ধরে পার হয়নি, একটা আঙুলের মাথা ধরতো। তার বকব্য ছিল, পুরো হাত ধরলের সে আব্বুর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু তার নিজের ওপর বিশ্বাস হারানোর নয়, আব্বুর সঙ্গ তো ছাড়ার নয়ই।

আমজাদ সাহেব অন্তূর উস্কো-খুস্কো চুলে আলতো হাত রেখে বললেন, “চল, খেয়ে নিই। তোর মা আজ বাড়িছাড়া করবে আমাদের।ʼʼ

হঠাৎ-ই নিজের জীবনে আব্বু সত্ত্বাটার সমস্তটুকু উপস্থিতি যেন বুকের ভেতর এক থলে তরল আবেগ হয়ে জমেছে, ভার অনুভূত হচ্ছে বুকের ওপর সেই তরল। চোখ ফিরিয়ে নিলো। বইখাতা গোছাতে গোছাতে আনমনে নিজের স্বভাবসুলভ দৃঢ় গলায় বলল,

-“আব্বু! তুমি কোনোদিন আমায় রেখে চলে যেও না। আমি একদম ফুরিয়ে যাব, বিশ্বাস করো। এই দয়াটুকু কোরো, আব্বু! তুমি নিষ্ঠুর হয়ো না আমার ওপরে। তোমার যাওয়ার হলে আমায় সঙ্গে নেবে, প্লিজ? আমি আত্মনির্ভরশীল, কিন্তু পুরোপুরি নই। তোমার আঙুলের ডগা আঁকড়ে ধরার ওইটুকু তো ফাঁকা। এই চলমান পৃথিবীর ভারী পৃষ্টনে একা টিকতে পারার সাহস জুটাতে পারবো না কোনোদিন। তোমার আঙুলটাকে সর্বক্ষণ খুব দরকার আমার।ʼʼ

অন্তূ কোনোদিন এভাবে বলেনি। আজও বলছে, তো বলছে যে স্বরে, সেই স্বরে মানুষ মানুষকে শাসন করে। স্বর নরম নয়, নমনীয় নয়। হুমকির মতো শুনতে লাগল। আমজাদ সাহেব চোখ বুজে হাসলেন। হাই স্কুলের প্রবীণ প্রিন্সিপাল একবার বলেছিলেন, “বুঝলে আমজাদ! অন্তূ হলো তোমার ফটোস্ট্যাট কপি। কিন্তু বোধহয় মেশিনের গড়বরে ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়ে গেছে।ʼʼ

দুজনের সম্পর্ক একদম সেই সকল বন্ধুদের মতো, যারা কোনোদিন বলেনি আমরা কিন্তু বন্ধু দুজন! কেউ বলেনি, বুকটা ফেঁড়ে দেখ, তোর জন্য কতটা জায়গা র ক্তে ধুয়ে পরিশুদ্ধ করে রেখে দিয়েছি, শুধু তোর জন্য।

-“পাগলের মতো কথা বলিস না, অন্তূ। কেউ চিরকাল থাকেনা। যিনি থাকবেন, তিনি তোর রব। আমি কেবল মাধ্যম একটা। আর তুই আমার আমানত। এই ক্ষণস্থায়ী সাক্ষাতে এত মায়া লাগাতে নেই, অন্তূ। মায়া মূর্খদের দেহে পরজীবীর মতো বাস করে। শুষে শুষে খেয়ে ফেলে তাদের জীবন রসকে। তুই তা নিজের ভেতরে রাখবি না।ʼʼ

অন্তূ নিজের ওপর বিরক্ততে নাক-মুখ কুঁচকে, শক্ত গলায় বলল, “আব্বু! হুট করে এত বুকে হাহাকার লাগছে কেন, বলতো!ʼʼ

অন্তূর ওপরের খোলশ বা নাটককে এড়িয়ে ভেতরটাকে আমজাদ সাহেব শুষে নিতে জানেন। অন্তূর দিকে তাকিয়ে সেই দক্ষতা প্রয়োগ করে বললেন, “আমি যতদিন আছি, তুই আমার পাখার নিচে সুরক্ষিত। আমি না থাকার কালে যা আসবে তোর ওপর, তার দায় আমায় দিস না। সাধারণ এক মানুষ হয়ে এত ওজন বয়ে নিতে পারবো না আমি।ʼʼ

অন্তূর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন তিনি, যেন অদম্য এক সাহস তিনি অন্তূর ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালালেন, “আমিও থাকব না চিরকাল। কিন্তু তোকে নিজের জীবদ্দশা কাটিয়ে তবে রবের কাছে ফিরতে হবে। জীবন একটা চক্র, জীবন একটা রণক্ষেত্র। সেখানে তোর হাতিয়ার হলো, আত্মবিশ্বাস আর ঢাল তোর ধৈর্য্যে। এই দুটোকে সবসময় শাণ দিয়ে পিঠে সজ্জিত করে রাখতে হবে। মনে রাখবি, ধৈর্য্যে নামক ঢালটা যেন বেশ পুরু হয়। ছোটোখাটো আঘাতে তার কথাগুলো ছিটকে না যায়। যে পথে পা বাড়াতে চলেছিস, এই সমাজ তোকে ভালো রাখবে না, অন্তূ। ভালো থাকাটা ঠিক আমারও পছন্দ নয়, কারণ যেখানে এই জগৎসংসারে ভালো থাকার একমাত্র অপশনটা হলো, অন্যায়ভাবে জীবনযাপন। সেখানে ন্যায়কে অবলম্বন করে ভালো থাকতে চাওয়ার বোকামি আমি করিনি। তাই তোকেও আর বাঁধা দিইনি এই দুর্গম পথে এগিয়ে যাওয়া থেকে।ʼʼ

আমজাদ সাহেব হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “সবসময় মনে রাখবি, যা ঘটছে, তা ভয়ংকর নয়। কারণ তা তোর সামনে রয়েছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে তা মোকাবেলা করতে পারবি তুই। কিন্তু ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা সম্বন্ধে তোর কিঞ্চিৎ ধারণা নেই, সুতরাং সেটা হলো বেখবরে উঠে আসা তাণ্ডবপূর্ণ ঝড়। যার পূর্বাভাস বা সচেতনতা নেই তোর কাছে। আর যা সম্বন্ধে জানিস না, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না, তাই সেটা ভয়ানক। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে যা আসছে তার তুলনায় সামনে থাকা বিপদ খুব নগন্য, দূর্বল এক ফাঁড়া মাত্র। ভবিষ্যতের অজানা বিপদের চেয়ে এটা দূর্বল, আর এই দূর্বল বিপদের চেয়ে তুই বহুগুণ শক্তিশালী, বহুগুণ।ʼʼ

অন্তূক ভার্সিটি পৌঁছে দিতে বের হলেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ আজ অবধিও কোনোদিন আব্বুকে ছাড়া কোনো ছোটখাটো পরীক্ষাও দিতে যায়নি। স্যান্ডেল খুঁজে পেলেন না, পরে দেখলেন অন্তূ তা পরিষ্কার করছে একটা কাপড় ঘষে। গম্ভীর হলেন আমজাদ সাহেব, তোকে নিষেধ করেছি না, “এসব করতে? স্যান্ডেল পায়ের জিনিস, তা আবার ঘষেমেজে পরিষ্কার করার কী আছে? সুফিয়ানা ভালো না। তুই আর কোনোদিন স্যান্ডেল পরিস্কার করবি না।ʼʼ

অন্তূ পাত্তাই দিলো না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তা পার হওয়ার জন্য। বরাবরের মতো আব্বুর আঙুলের ডগাটা নিজের তর্জনী আঙুলি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল অন্তূ। ভার্সিটিতে ঢুকে বুকের কম্পন বাড়ল। না-জানি কোন দিক থেকে জয় এসে দাঁড়ায়। সেদিন সে অভিযোগ করেছে, তারপর আর ভার্সিটি মুখো হয়নি। আজ কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? যদি হঠাৎ জয় এসে দাঁড়াল! তারপর? কী করবে আব্বুর সামনে? ভাবতেই বুক আঁটকে আসার উপক্রম হলো। অথচ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছেও জয়ের দেখা পেল না। বারবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করল সৃষ্টিকর্তার কাছে। সেদিনের অভিযোগ কাজে দিয়েছে?

আমজাদ সাহেব ফাইলটা অন্তূর হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ উপদেশ দিলেন। যেন অন্তূ কিন্ডার-গার্টেনের শিক্ষার্থী। এবং সে যাচ্ছে পরীক্ষা দিতে, তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ হাসল। আমজাদ সাহেব পকেট থেকে শ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, “আবার নিতে আসতে হবে নাকি? নাকি চলে যেতে পারবি?ʼʼ

অন্তূ ঘাঁড় নাড়ল, “আসতে হবেনা। আমি চলে যাব।ʼʼ

যতক্ষণ অন্তূ বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে বারান্দা পার হলো, ততক্ষণ অপলক চেয়ে রইলেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ আড়াল হলে, অল্প সিক্ত চোখটা ওপরের দিকে তুলে ভেজা ভাবটা শুকানোর চেষ্টা করলেন। আজ অন্তূ দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল দিতে ঢুকছে। ক’দিন পরে এলএলবি চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসবে। তখনও এভাবেই গিয়ে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকবেন তিনি অন্তূ বের হবার অপেক্ষায়। ক’দিন বাদে মাস্টারমশাই থেকে তিনি এডভোকেট মাহেজাবিন আরমিণ অন্তূর বাবা হতে যাচ্ছেন। বুকটা ভরে উঠল, চোখ জ্বালা করতে লাগল খুব। অন্তূটা বড় হয়ে গেল। এই তো ক’দিন আগে হাত ধরে স্কুলড্রেস পরে, মাথায় দুই ঝুঁটি করে স্কুলে যেত অন্তূ। আমজাদ সাহেব চোখ ফেরালেন। আস্তে করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন ভার্সিটির ফটক পেরিয়ে।

পরীক্ষা শেষ না-ই করতে পিয়ন এলো হলে। অন্তূ তখন হিমশিম খাচ্ছে লেখা শেষ করতে। অল্প সময় বাকি। লেখা অনেক। তারই মাঝে পিয়ন জানালো, মনোয়ারা রেহমান নিজের কক্ষে ডেকে পাঠিয়েছেন আরমিণকে। অন্তূর কপালে ভাঁজ পড়ল, ভেতরটা নড়ে উঠল আচমকাই।

চলবে..

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here