হিয়ার_মাঝে ৩৯+৪০. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
583

#হিয়ার_মাঝে ৩৯+৪০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

(৩০১৬ শব্দ, তাই ফেইসবুক মেইন অ্যাপে পড়ুন)

ঊষালগ্নেই ঘুম ভেঙেছে নুবাহর। শাশুড়ীর কথামত নামাজ পড়ে সোজা রান্নাঘরে প্রবেশ করে। সকালের নাস্তা তৈরি করতে গেল মাত্র। কিন্তু ঈশিতা তাকে নিষেধ করল। আজ তার ছুটি। নিজের বাড়ি ঘুরে এসে পরে না হয় নাস্তা তৈরি করবে। নিজমনে খুশি হল সে। সত্যি তার ভয় করছিল। কিভাবে কি করবে? তবে ঈশিতার এমন সহায়তায় মন তার একদম হালকা হয়ে গেছে। সকালের নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে ফিরল। মন’টা আজ ভীষণ ফুরফুরে। নিজের বাসায় যাবে, চট্রগ্রামে। মনে হচ্ছে কত বছর হয়ে গেছে। খালার বাসায় এসেছে মাত্র দিন পনেরো। আর দু’দিন হল এই দিলারা কুঠির এ এসেছে। অথচ মনে হচ্ছে কত সহস্র বছর পর চট্রগ্রামে যাচ্ছে। নীলাভ হৃদি রিদানকে নাস্তা শেষে তৈরি হতে বলল।

গত দু’দিন এরা কেউ তার রুমে আসেনি। কিন্তু আজ চারজনেই একসাথে হাজির। হৃদি নীলাভ হা’ হয়ে আছে। নুবাহর রুম এত্ত সুন্দর! বারান্দা দেখেই যারপরনাই অবাক। কত্ত বড়! ঈশিভাবীর রুমটাও সুন্দর। তাদের বারান্দাও বেশ বড়। তবে তার মনে হচ্ছে নুবাহদের বারান্দা তার থেকেও সুন্দর। হৃদি জিতুকে অন্যরুম থেকে বের হতে থেকে বেশ অবাক হল। তার ভাবনা দমাতে না পেরে বলে উঠল,

‘আপু, তুমি এইরুমে, আর দুলাভাই অন্যরুমে কেন?’

নুবাহ আচমকাই এমন প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। কি উত্তর দেবে খুঁজে পেল না। কিন্তু তার উত্তর’টা সহজ করে দিল জিতু। করিডোর পেরুতে গিয়ে হৃদির প্রশ্নটা সে শুনেছে। তড়িৎ জবাব দিয়ে উঠল,
‘তোমার আপু আমার সাথে ঝগড়া করে ঐ রুমে চলে গেছে। এবার দেখ, তোমার আপু কেমন ঝগরুটে। কথায় কথায় ঝগড়া করে। একটা ঝগরুটে মহিলা বিয়ে করেছি আমি।’

হৃদির থেকেও নুবাহ হা’ হয়ে আছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল জিতুর উপর। নিজমনে কয়েক’শ গা’লি ছুঁড়ল। বদলোক একটা। এভাবে তাকে পঁচিয়ে গেল। আর উত্তর খুঁজে পেল না। সময় সুযোগ পেলে সেও শোধ তুলবে। হৃদি নীলাভ মুখ টিপে হাসছে।

বারান্দায় মুঠোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে জিতু। চিন্ময়কে কল দিয়েছে সে রিসিভ করেনি। সানিরও খবর নেই, রকিও লা-পাত্তা। কিন্তু মুবিন, সে কখনও এমন দায়িত্বহীন নয়। চারজনের একজনও কল রিসিভ করল না। মুবিন সানি রকি তিনজনই একসাথে হলে থাকে। মাঝে মাঝে তারা একসাথে হলে গিয়ে আড্ডা দেয়। তবে আড্ডার মিলনস্থল হচ্ছে তাদের সুপারমলের পঞ্চম তলায়। সেখানে সুইমিংপুল আছে এবং পাশে জিমনেসিয়াম। তাই সবার আড্ডা হয় সেই পঞ্চম তলায়। আবার মাঝে মাঝে সৌন্দর্যের নগরী জিমানদের নির্ঝর কোয়ার্টারে। লেকের পাশে হাওয়া খেতে খেতে বিকেলের আড্ডা বসে তাদের। বন্ধুমহলের আড্ডা যেকোনো স্থানে বসে আজকাল।

সে অস্থির হয়ে আছে। তাদের সবাইকে সকাল আটটার মধ্যেই তৈরি হয়ে আসতে বলেছে। সবাইকে নিয়ে নুবাহর বাসায় চট্রগ্রামে যাবে। কিন্তু তার হাড়বজ্জাত বন্ধুগুলো একটাও কল রিসিভ করছে না। মেজাজই চটে গেল তার। বারান্দায় পায়চারি করল কিছুসময়। সে তৈরি হয়ে বসে আছে কখন থেকে। গায়ে সাদা শার্টের সাথে ট্রাই ঝুলানো। পরনে স্যুটের সাথে মিলানো কালো প্যান্ট। চুল স্পাইক করা, তাই সামান্য বাতাসেও উড়ছে। হাতে নেভি ফোর্সের কালো ঘড়ি। কপালে একহাত ঠেকিয়ে বসে পড়ল বেতের সোফায়।

হৃদি জিতুর রুমে এসে হা’ হয়ে আছে। মুখ থেকেই আপনাআপনি বেরিয়ে এল, কি অসাধারণ! রুমের নকশা আর আসবাবপত্র দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু তার সাদা মনে কালো কালো প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে, জামাই বউ দু’জন দু’রুমে থাকে? বিয়ে হতে না হতেই ঝগড়াঝাটি শুরু করেছে। নতুন জামাই বউ এত জলদি কেউ ঝগড়া করে। বড্ড আনরোমান্টিক জুটি এরা। তার আর চিন্ময়ের বিয়ে হলে, সে তো একদমই ঝগড়া করবে না। জামাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে, সারাদিন শুধু আদর খাওয়ার জন্য। ইশশ! সত্যি যদি এমন হত! তাহলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত তার। কিন্তু চিন্ময়কে পেতে হলে তাকে যে সাধনা করতে হবে, কঠোর সাধনা।

নিভানকে তৈরি করে নুবাহ নিজেও তৈরি হল। হঠাৎই ইনশিয়া এসে তাকে গলা জড়িয়ে ধরল। বলে উঠল, ‘চাথীআম্মু, আমি চুন্দোর জামা পরেতি। আমি যাব তো।’
নুবাহ হাসল। গাল টেনে বলল, ‘তুমি না গেলে হবে। আমার মিষ্টি একটা শাশুড়ী, তোমাকেই তো নিতেই হবে।’
ঈশিতা পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। নুবাহর কাছে এসে বলল, ‘আজ জামাইকে পাগল বানানোর ইচ্ছে আছে বুঝি?’

হঠাৎই এমন বাক্যেই নুবাহ চমকালো। আঁখি জোড়ায় বিস্ময়। জবাবে বলল, ‘মানে?

ঈশিতা মুচকি হাসল। নুবাহকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে নিজেকে আয়নায় দেখেছো? কালো শাড়িতে তোমাকে কি যে অপূর্ব লাগছে। জিতু যদি একবার দেখে না, নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে। আজ জিতুর থেকে সাবধানে থেকো কিন্তু।’

ঈশিতার কথা শেষ হওয়া মাত্রই দরজার চৌকাঠে দন্ডায়মান কালো স্যুটকোটে আবৃত এক সুদর্শন পুরুষকে দেখল নুবাহ। তার মুখে তখন লাজুক হাসি। ঈশিতার কথায় হাসছিল। দৈবাৎ আসা সেই সুদর্শন পুরুষের সাথে হঠাৎই দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল তার। ঐ পুরুষকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য সে থমকে গিয়েছিল। তার হৃদস্পদন দ্রুতই উঠানামা করছে। ইস্ততঃবোধ করছিল বেশ। নিজের অস্বস্তি কে দূর করতে নীচু হয়ে ইনশিয়ার সাথে খুঁনসুটিতে মত্ত হল। জিতু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কালো শাড়িতে আবৃত এক সুনয়নার দিকে। আজকে প্রতিদিনের মত মেয়েটার মাথায় আঁচল নেই। শাড়ি পিন করে আঁচল পিঠের পিছনে ছেড়ে দিয়েছে। কোমর সমান লম্বা টেউ খেলানো চুলগুলো বিনুনি পাকানো। গলায় কালো পাথরের সাধারণ হার পরেছে। আজকে আরও একবার বিমোহিত হয়েছে সে। মেয়েটার সবকিছুই কেমন মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ। যেন এক অপ্সরী তার সম্মুখে দন্ডায়মান। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় কোন এক রূপকথার রাজ্যের রূপসী রাজকন্যা তার গৃহে অবস্থান করছে। যাকে সে রোজ চোখে হারায়।

নিশ্চুপতা দু’জনের মাঝে। জিতু গলা খাঁকারি দিল কিছুসময় পর। নুবাহর উদ্দেশ্য বলল,
‘গাড়ি নিচে দাঁড়ানো আছে, তৈরি হলে সবাইকে নিয়ে নিচে আসো।’
নুবাহ কিঞ্চিৎ মাথা তুলে তাকাল। ততক্ষণে জিতু চলে গেছে। ঈশিতা দু’জনের এমন লুকোচুরি দেখে মিটমিট করে হাসল। সে তো মনে এটা চাই। দুজন দু’জনের প্রেমে পড়ুক, সব কিছু পূর্বের ন্যায় হোক। জিতু হাসুক প্রাণখুলে, সুখ ধরা দিক তার মনগহীনে। তার অসম্পূর্ণ জীবন হোক পরিপূর্ণ।

নুবাহ বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিতে গেল। দিলারা কানে কানে বলে উঠল,
‘শোনো সতিন, জামাইয়ের খেয়াল রাখবা। ওরে খুশি রাখলে তয় আমার ভালোবাসা পাইবা। বুচ্ছো।’
দিলারা আকারে ইঙ্গিতে কি বোঝাতে চেয়েছে, সে ভালোই বুঝেছে। তাও নিরুপায়। আলতো করে মাথা নাড়াল। দিলারা খুশি হলেন। ফরিদা ও আজমল নুবাহর মাথায় হাত বুলালেন। সাবধানে যাওয়ার জন্য বলল। ফরিদা ফের আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন, কাল যেনো বিকেলে ফিরে আসে। নুবাহর এই কথায় কিঞ্চিৎ অভিমান হল। মাত্রই তো যাচ্ছে, তার আগেই আসার জন্য হুকুম।

দুটো গাড়ি তৈরি আছে। ইনশিয়া নুবাহর হাত ধরে আছে। ঈশিতা প্রথম গাড়িতে উঠল। এই গাড়িতে মেয়ে’রা যাবে। তার সাথে লরিন সিমি নীলাভ হৃদি বসল। নুবাহও তাদের সাথে উঠল।

দ্বিতীয় গাড়ি ছেলেদের জন্য। জিতু গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাড়বজ্জাত বন্ধুগুলো তার, একটাও কল রিসিভ করছে না। আচমকা সবার হল টা’কি! বেশ ভাবনায় পড়ল। গাড়ির দরজা খুলল মাত্রই ভেতরে প্রবেশ করতে। কিন্তু দরজা খুলে তার আক্কেল গুড়ুম। সবগুলো গাড়িতে আগেই ঘাপটি মেরে বসে আছে। তবে মুবিন চিন্ময় দু’জনের কেউ নেই। সানিকে জিজ্ঞেস করল, ‘মুবিন কোথায়?’ সানি তড়িৎ জবাব দিল, ‘ওর বোধহয় অ্যাসিডিটি বেড়েছে। কাল থেকেই বুক ব্যথা করছে। তাই বলল সে যাবে না।’
জিতুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ছেলেটা শরীর নিয়ে ভীষণ অবহেলা করে। একদমই নিজের যত্ন নেয় না। বুকে ব্যথা করছে, অথচ ডাঃ না দেখিয়ে বসে আছে। ফের আরেকবার চোখ বুলালো। জিমান সানি রকিও উপস্থিত। অন্যগাড়িতে লরিন সিমিকে দেখেছে। কিন্তু জুঁইকেও দেখেনি। এদের আজ কি হল? কেউ না কেউ মিসিং কেন? চিন্ময়কে আবার কল দিল। দীর্ঘসময় পর সে কল রিসিভ করল। জিতু শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় তুই, বাড়িতে না রাস্তায়?’

চিন্ময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিরবে। আক্ষেপের সুরে বলল, ‘এই তো আসছি। তুই তো জানিস, মা কোথাও যাওয়ার সময় কেমন বায়না করে। এখনও আমার শার্টের কোণা ধরে বসে আছে।’

‘আন্টি আসতে চাইলে তাকেও নিয়ে আয়। সমস্যা কোথায়?’

চিন্ময় হতাশার সুর তুলল।
‘না, ভাই সবাই মা’কে নিয়ে মজা করবে। আমার তখন ভালো লাগবে না।’

জিতু জবাব দিল না, কল’টা কেটে দিল। চিন্ময় বেশ আহত হল নিজমনে। ভেবেছিল, হয়তো জিতু তাকে জোর করবে। মনের কোণে একরাশ বিষাদ জমল অভিমানের। ইচ্ছে করে, তারো মা’কে নিয়ে কোথাও ঘুরতে। কিন্তু সে যে বড্ড ভয় পায়। যদি কেউ তার মায়ের মজা উড়ায়। তখন তার সহ্য হবে না। সে তার মা’কে বুঝিয়ে যাচ্ছে, আজকে আসার সময় আরও ভালো খাবার নিয়ে আসবে। সকালে তার মা’কে গোসল করিয়ে পরিপাটি করে রেখেছে। গরম গরম ভাত রান্না করে খাইয়ে দিয়েছে।

তা দেখে তার মামী মুখে আফসোস করল। শুধু শুধু সে কেন এত কষ্ট করছে। তার মামী রান্না করে তার মা’কে খাওয়াতো না। তাকে বলল, ‘তুমি কোথাও যাচ্ছিলে, সেখানে যাও। আমরা কি নেই। তোমার মা, আমার বড় বোনের মত। আমরা তো আছি দেখাশোনা করার জন্য। কুমুদ আছে, সে তো সারাদিন ফুফুর সাথেই থাকে। তোমাকে এত ভাবতে হবে না চিন্ময়। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।’

চিন্ময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য মাত্রই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আচমকাই নিচ থেকে গাড়ির হর্ণের তীব্র শব্দ ভেসে এল। বুঝল না এমন বিদঘুটে হর্ণ কে বাজাল। রুমের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। সে কাদের দেখছে? তার দিকে কয়েক জোড়া চক্ষু তাক করে আছে। হঠাৎই পকেটে থাকা মুঠোফোন কর্কশধ্বনি তুলল। রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে উঠল জিমান,

‘ওই হিরোর বাচ্চা, তুই আসবি না’কি আমরা উঠে আসব। দশ মিনিটের মধ্যে আন্টিসহ নিচে নাম।’

কানের মাঝে তখনও মুঠোফোন ধরে রাখা। ঘাড় ঘুরাতেই দেখল দরজার চৌকাঠে জিতু ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। চিন্ময় যেন বাকশূন্য। দৃষ্টি জোড়া যেন অবাকের চরম শিখরে। আমতা আমতা করল জিতুকে দেখে।
‘শালা, তুই আসতি গেলি কেন? আমি তো যেতামই।’

‘হ্যাঁ, তুই যে কেমন যেতি, তা দেখেছি। হিরোর বাচ্চা, আন্টি কোথায়? জলদি রেডি কর।’

‘কিন্তু?’

পেছন থেকে সিমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল, ‘ঐ হিরো তুই গাড়িতে গিয়ে বস, আমি আন্টিকে রেডি করে আনছি।’

সিমিকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। ও এখানে, তাহলে কি সবাই জেনে গেছে, তার মা প্রতিবন্ধী। জিতুর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি তার। জিতু সামনে এসে চিন্ময়কে গলায় জড়িয়ে ধরল। ক্ষীণস্বরে বলল,
‘ভয় পাস না, আমি কাউকে কিচ্ছু বলেনি। তবে তোর মায়ের অসম্মান হবে এমন কাজ আমাদের বন্ধুমহলের কেউ কখনো করবে না। আন্টিকে বাইরে নিয়ে গেলে মন হালকা থাকবে। তুইও নিশ্চিন্ত থাকবি।’

চিন্ময়ও জিতুকে জড়িয়ে ধরল। চোখের জল যেন বাঁধ ভেঙে উপচে পড়ছে। জিতু পিঠে আলতো হাতে চাপড় মারল। তেতে উঠে বলল,
‘হিরোর বাচ্চা, তোর ঐ নোনাপানি ফেলে আমার স্যুটকোট নষ্ট করবি না। প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।’

চিন্ময় কান্না থামিয়ে জিতুর দিকে তাকাল। আচমকা দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। চিন্ময় এক চোখ মেরে বলল,
‘বউয়ের সাথে তোর সব মিটমাট হয়ে গেছে।’

জিতু এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘আগে তো বউকে পটায়, তারপর না হয় বাকিটাও মিটমাট করে নেব।’

চিন্ময় ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আসলেই, শুনে ভালো লাগল।’
জিতু চিন্ময়ের হাত টেনে ধরল। ‘এবার তো চল।’

সিমি সোনিয়াকে কাপড় পরিয়ে পরিপাটি করে নিচে নামল। চিন্ময় বিস্মিত। তার মা’কে কত্ত সুন্দর লাগছে। কুমুদ আর তার মা’ হতবাক। আচমকাই সোনিয়াকে বাইরে নিয়ে যেতে দেখে। পাগলিকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে কোন ঝামেলা বাঁধায় কে জানে? চিন্ময়কে নিষেধ করার সাধ্যিও নেই তার। কিছু বললে তা যদি একবার কুমুদের বাপের কানে যায় তাহলে তার রক্ষে নেই। সেই ভয়েই সোনিয়ার মত পাগলিকেও সে সহ্য করে যাচ্ছে। চিন্ময় লাখে একটা ছেলে। রূপে যেমন, তেমন গুণেও। এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাই তো হাতছাড়া করতে চাই না সে। কিন্তু আজকাল মন কু গাইছে। এবার কুমুদের বাপ আসলে বলবে দু’জনের আকদ করে রেখে দিতে।

জুঁইয়ের জন্য মাঝরাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মেয়েটা এমন দেরি কখনই করে না। কিন্তু আজ তার কি হল কে জানে। জিতু কিছু একটা ভাবল। একা পেলে জুঁইকে জিজ্ঞেস করবে তখন। মুবিনকে নিয়ে আসতে জিমান চিন্ময় দু’জনেই হলে গেছে। ছেলেটা মুখে কিছু বলে না। কিন্তু তার মনটা বড্ড নরম। অথচ বাইরে থেকে মনে হবে কত গম্ভীর একটা ছেলে। চুপচাপ স্বভাবের মুবিন স্বল্পভাষীও। কিন্তু যখন মুখ খুলে তখন তার কথার মাঝে থাকে মাধুর্য মাখানো। যে কেউ তার কথার জাদুতে মুগ্ধ হবে। ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলে। প্রতিটি বাক্যেই তার অসাধারণ। ছা-পোষা পরিবারের হলেও প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান। হাত পাতা তার কাছে বড্ড অসম্মানের। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি কোচিং, টিউশনি চালিয়ে যাচ্ছে। নিজের খরচসহ পরিবারের খরচও সে বহন করছে। কখন বুঝতেই দেয় না নিজের অসুবিধার কথাগুলো।

প্রায় ত্রিশ মিনিট অতিক্রম হওয়ার পর দু’তারকার দেখা মিলল। মুবিনও আসার পর জুঁইও আসল। দু’জন দু’জনকে দেখে হতবাক। জুঁই বিস্ময় ধরে না রাখতে পেরে বলে উঠল,
‘কি ব্যাপার মুবিন, তুমিও দেরি করেছো?’

মুবিন আলতো হাসল। মুখের কোণে শুকনো হাসি। আজকাল বুকের ব্যথা বড্ড বেড়েছে। ইচ্ছে তো ছিল যাওয়ার। কিন্তু শরীর তার সায় দিচ্ছিল না। তার উপর জিমান চিন্ময় দু’জনে হলে গিয়ে তাকে একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছে। বন্ধুমহলের একটাই সমস্যা, এরা কখনও একা কোথাও যাবে না। তাদের সঙ্গে যেতেই হবে। জিতু এসব কাজে সবার আগে প্রস্তুত থাকে। এর আগেও সে এমন করেছে। প্রথমবার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাবে, তাও বন্ধুমহল নিয়ে। হয়তো বন্ধুমহল সেদিন উছিলা মাত্র বাকি তো আল্লাহ রহমত করেছিল। তাই তো আজ জিতু দিব্যিই সুস্থ। জুঁইয়ের জবাবে হতাশার সুর তুলল।
‘জিতু শ্বশুরবাড়ি যাবে, আর বন্ধুমহলের কেউ বাদ পড়বে। এটা কল্পনা করা যায়।’

জুঁই কিঞ্চিৎ হাসল। কিন্তু সেই হাসি ছিল বিষাদপূর্ণ। কতটা তিক্ততা নিয়ে আজ এসেছে সে জানে। সকালে তার ভাই এসেছে হুমকি দিতে। তার আপন মায়ের পেটের ভাই তার নামে কুৎসা রটায়। তার বড়লোক ছেলে বন্ধু আছে, তাদের একজনের গলায় ঝুলে গেলেই তো সে পারে। বয়স তার চব্বিশ পেরিয়ে পঁচিশে হবে, অথচ সে বিয়ে করতে চাইছে না। তার তো বাইরে প্রেমিকের অভাব নেই। তার ছেলে বন্ধু বিয়ে করেছে, অথচো সে মেয়ে হয়ে বিয়ে করছে না। অবিবাহিত দু’বোন ঘরে পরে আছে। তার বউ শ্বশুর বাড়িতে এসে থাকতেও পারছে না তাদের জ্বালায়। ঢাকা শহরে নিজের একটা একচালা টিনের ঘর আছে। সেটাও তো অনেক কিছু। কিন্তু তাকে বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়। আর কত এদের অত্যাচার সহ্য করবে সে? এবার হেস্তনেস্ত একটা চাই। হয়তো তাকে বিয়ে করতে হবে নয়তো তার জন্য বাড়ির এক অংশ ছেড়ে দিতে হবে।

তার ভাই আরফানের শেষোক্ত কথায় সে হেসে উঠেছিল। তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিয়েছিল,
‘সোজাসাপ্টা বললেই পারতি, তোর বাড়ির ভাগ চাই। শুধু শুধু এত ঘুরিয়ে পেছিয়ে না বললেই হত। আমার এত সময় অপচয় হত না।’

আরফান তেতে উঠল, ‘নিজেকে বেগম রোকেয়া ভাবিস। পড়ালেখা করে কোন অসাধ্য সাধন করে ফেলেছিস? যাস তো ভার্সিটিতে বড়লোক ছেলেবন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে।’

জুঁই জবাব দেয়ার আগে তার আঠারো বছর বয়সী বোন টগর জবাব দিল কঠিন গলায়,

‘হ্যাঁ, তার বড়লোক বন্ধু আছে বলেই আজও নিজের মায়ের আর বোনের পেটে ভাত জুটছে। বড়োলোক ছেলে বন্ধুরা অন্তত মায়ের পেটের ভাইয়ের মত তাকে অসম্মান করে না। তার নামে এমন কেলেংকারী রটায় না। বড়োলোক ছেলে বন্ধু থাকা মানে তার বোন তাদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষে করে খায় না। নিজে রোজগার করে। কোচিং থেকে শুরু করে টিউশন সব করে। পরিবারকে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে। নিজেকে বিশ্রাম দেয়ার সময়টুকুও পায় না। অথচো একজন ভাই হয়ে তুমি বউয়ের কথায় উঠবস কর। মায়ের পেটের বোনদের খরচ তো দূরে থাক নিজের মায়ের খরচও বহন কর না। মায়ের প্রতিমাসে ওষুধ লাগে দু’তিন হাজার টাকার। গত দু’বছর ধরে কখনো জিজ্ঞেসও করনি। মায়ের কিছু লাগবে কি’না? আর আজকে আসছে বাড়ির অংশের ভাগ চাইতে।’

আরফান ক্রোধে ফেটে পড়ল। টগরের গালে তার শক্তপোক্ত হাতের চড় বসিয়ে দিল। টগর তাও দমল না। ঘৃণায় রি রি করে উঠল। ফের বলে উঠল,
‘ভাই হিসেবে এই একটাই কাজেই পারো। এ ছাড়া তোমার আর কোনো মুরোদ নাই। তুমি তো নাম মাত্র পুরুষ।’

তার অসুস্থ মা এসে টগরকে থামাল। কিন্তু আরফান থামল না। বেশ কড়া করে হুঁশিয়ারি দিল। তার বাড়ির ভাগ চাই, চাই মানে চাই। তাকে দিতেই হবে।

জুঁইয়ের দু’চোখ মুদিত। এখনো সেই দৃশ্যগুলো চোখে ভাসছে। কি এমন হত, তারা মাত্র তিন ভাই-বোন। অথচ তার ভাই এত হিংসুটে কবে হয়ে গেল। বড়োলোক মেয়ে বিয়ে করে তার চোখে এখন সবকিছুই ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। বিয়ের তিন’মাসের মাথায় তার বউ শ্বশুর ঘর ছেড়েছে। এমন নোংরা পরিবেশে সে থাকতে পারবে না বলে। সেই যে ঘর ছেড়েছে আর ফেরেনি। কিন্তু অপবাদ দিয়েছে তাদের নামে। তারা দু’বোন মিলে তাকে বেশ জ্বালিয়েছি। সারাক্ষণ কাজ করিয়েছি। অথচ সে কাজ করতে গেলে তার মা’ অসুস্থ শরীর নিয়েও বউয়ের সাথে থাকত। সে তো খুব একটা বাসায় সময় পায় না। টগর যা পেতো টুকটাক কাজ করে দিত। কিন্তু বউয়ের মন ভরেনি। অপবাদ দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি শুধু। নিজের পেটের বাচ্চা না’কি তার মায়ের জন্য নষ্ট হয়েছে। এরকম আরও অজস্র অপবাদ দিয়ে গেছে।

নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জুঁই। গাড়ির ভেতর দৃষ্টি বুলালো। একটা দৃশ্য তার ভালো লাগে নি। নুবাহ তাদের সাথে, জিতু বন্ধুদের সাথে। কিভাবে দূরত্ব ঘোচাবে তা নয়, এরা দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের বন্ধুরা আসলে কোন কাজের নয়, সে জিমানকে কল দিল। কিছু মুহূর্ত বাদেই কল রিসিভ হল। সে চেঁচিয়ে উঠল,

‘তোদের গাড়ি থামা। তোর সাথে আমার কথা আছে।’

জিমান ভাবল হয়ত জরুরি কোন বিষয়। তাই গাড়ি থামাতে বলল। জুঁইও তাদের গাড়ি থামাতে বলল। জিমানকে নামতে দেখে বাকি’রা অবাক হল। জুঁই নুবাহকে জিতুর পাশে বসানোর জন্য বলল। জিমানও এই কথা এতক্ষণ ভেবেছে। কিন্তু তাদের গাড়িতে সব ছেলে’রা। তাই আর অত মাথা ঘামায়নি। জুঁই ভেবে বলল,

‘হৃদি আর আমি তোদের গাড়িতে বসব। সানি রকিকে আমাদের গাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’ জিমান সায় জানালো। সানি রকিকে মেয়েদের গাড়িতে পাঠানো হল। নুবাহ হৃদিকে গাড়ি থেকে বের করা হল। নুবাহ কিঞ্চিৎ অবাক হল। এভাবে অদলবদল কেনো করা হচ্ছে। আগেই তো ভালো ছিল। জিতু আর নুবাহকে পেছনের সিটে পাঠানো হল। মাঝখানে জুঁই হৃদি চিন্ময় বসল। জিমান মুবিন ড্রাইভারের সাথে বসল।

জুঁই অজান্তে হৃদির অনেক বড় উপকার করে দিয়েছে। নিজমনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিল জুঁইকে। তার জন্য চিন্ময়ের পাশে বসতে পেরেছে। এতক্ষন চিন্ময়ের মায়ের সাথে গল্প করেছে। কি সুন্দর মহিলা! মা ছেলের দু’জনের মাঝে পুরো মিল। তার ভীষণ ভালো লেগেছে শাশুড়ী মা’কে। এখন জামাইয়ের সাথে ভাব জমাতে পারলেই হল। চিন্ময় জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। এই মেয়েটা তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী। কিভাবে ছট করে সব ঠিক করে দিল।

শাড়ির উপর নুবাহ বোরকা পরেছে। হিজাব বেঁধে মুখ’টা খোলা রেখেছে শুধু। তবুও জিতুর পাশে বসে হাসফাস করছে। ভাবছে কি’না কি করে বসে এই জিতু। কিন্তু তার ভাবনায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে জিতু চুপচাপ বসে আছে। ডিগি থেকে বের করে একটা বক্স রাখল তার সামনে। তার দিকে না তাকিয়ে বলল,

‘এখানে পানি, চকলেট আর আইসক্রিম আছে। চাইলে তুমিও খেতে পারো। অন্যেদেরও দিতে পারো।’

নুবাহ হতবাক হল। এই লোক কি ভদ্রতা জানে না। বক্স এভাবে কেউ দেয়। বক্স’টা খুলে দিয়ে একটা আইসক্রিম তার হাতে তুলে দিত। তাহলে সে নির্দ্বিধায় নিয়ে নিত। এখন বক্স কিভাবে খুলবে। জিতুর ডিম কোন ভদ্রতায় জানে না। বদলোক কোথাকার। গ্রিফট বক্সটাও এভাবে দিয়েছে। এজন্য ইচ্ছে করে সে খোলে নি। দু’জনেরই মাঝে পিনপতন নিরাবতা বিরাজমান। জিতু সেই নিরাবতা ভেঙে বলে উঠল,

‘তোমার কি আমার গিফট পছন্দ হয়নি।’

নুবাহ তড়িৎ জবাব দিল, ‘কোন গিফট?’

জিতু কপাল কুঁচকালো। বিস্মিত সুরে জবাব দিল, ‘তোমার টেবিলের উপর একটা বক্স ছিল। সাথে চিরকুটও ছিল, পাওনি।’

নুবাহ কুটিল হাসল। রগড় গলায় বলল,
‘না’তো। আমি তো আরও কি’না কি ভেবে ফেলে দিয়েছি।’

জিতু চমকে উঠল। নুবাহর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিল। ‘সত্যিই ফেলে দিয়েছো?’

নুবাহ জবাব দিল না। দেখতে চাইল জিতু এবার কি বলে। সত্যি জিতু এবার তেতে উঠল,
‘তুমি বোকা না’কি? একটা আস্ত গিফট বক্স ফেলে দিয়েছো। এটাতে আমি তোমাকে কতগুলো গিফট দিয়েছি। একটা ডায়মন্ডের হার দিয়েছি, সাথে একটা বেনারসি শাড়ি। তোমার জন্য আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেকবই তার ক্রেডিট কার্ড। আরও কিছু জুয়েলারিও ছিল। তোমার হাত খরচের কিছু টাকা। আর সবচেয়ে যেটা ছিল, তা হল দু’পাতার একটা চিরকুট। আমার ইচ্ছেগুলো নিয়ে লিখা।’

কিছুসময়ের জন্য জিতু থামল। ফের বলে উঠল,

‘ঠিক আছে, আমি তোমার জবাব পেয়ে গেছি। তুমি আসলেই আমাকে,,,,, থাক। তাই তো আমার গিফট খুলেও দেখো নি। উল্টো ফেলে দিয়েছো।’

নুবাহ ক্রোধে ফেটে পড়ল। বেশ দৃঢ়ভাবে জবাব দিল, ‘ভদ্রতা জানেন আপনি? কাউকে গিফট তার হাতে দিতে হয়। লুকিয়ে তার রুমে রেখে আসে না।’

‘কিছু বিশেষ গিফট মাঝেমধ্যে এভাবে দেয়। তুমি তাহলে কিছুই জানো না। না’কি আমাকে তোমার ভালো লাগে না সেটাই বল। মিথ্যে অজুহাতের কি দরকার।’

নুবাহ বেশ বিরক্তবোধ করল। জিতুর ডিম আসলেই পাগল। নিজেই বোকা, আবার তাকে বোকা বলে। মুখ বাকিয়ে ভেংচি কাটলো। জিতুর দৃষ্টি তখন নুবাহর উপর। সে হা’ হয়ে আছে। মেয়েটা তাকে গালি দিচ্ছে নিজমনে। আবার ভেংচিও কাটল। কি বেয়াদব বউ’রে!

চলবে,,,,,

আজকে দু’লাইনের সুন্দর একটা মন্তব্য চাই।।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here