#রাত্রীপ্রিয়া-১৫
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
“মামনী? আপনার ছোট মেয়ে পরশ, প্রেগন্যান্ট।”
অবিবাহিত ননদ “পরশ” প্রেগন্যান্ট এ কথাখানা শ্বাশুড়ি মা’কে জানাতেই উনি রাত্রীপ্রিয়ার গায়ে হাত তুললেন।পরপর শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“মুখ সামলে কথা বলো, বউমা। আমার মেয়ের নামে এরকম আজেবাজে কথা বলার সাহস হলো কি করে, তোমার?”
শ্বাশুড়ির হাতে শক্ত একখানা থা’প্প’ড় খেয়েও গালে হাত দিয়ে রাত্রীপ্রিয়া মাথা নিচু করে বললো,
“আমি সত্যি বলছি, মামনী। আমি নিজ চোখে পরশের প্রেগনেন্সির রেজাল্ট দেখেছি। তাছাড়া ইদানীং ওর লক্ষণ গুলো খেয়াল করছেন আপনি?আপনার বিশ্বাস না হলে পরশকেই জিজ্ঞেস করুন।”
উনি তেজ নিয়ে ততক্ষণা পরশকে ছাঁদে ডাকলেন। পরশ আসতেই উনি গম্ভীর কণ্ঠে মেয়ে’কে জিজ্ঞেস করলেন,
“এসব কি শুনছি, পরশ? রাত্রী যা বলছে, তা কি সত্যি?”
যা শুনে কেঁপে উঠলো, পরশ। তার গলা শুকিয়ে আসছে। এই বুঝি সত্যিটা জেনে গেলো সবাই। না, এই মুহূর্তে বিষয়টি গোপন করতেই হবে। আগে মুশফিকের সাথে কথা বলতে হবে। সব মিটমাট হলে জানাবে। নয়তো কাউকে এই পাপ জানতে দিবে না, পরশ। এসব ভেবে পরশ বুঝেও না বুঝার ভাণ করে বললো,
“তুমি কি বলছো, আম্মু? কোন সত্যির কথা বলছো তুমি?’
“তুই নাকি প্রেগন্যান্ট?”
ওকে জিজ্ঞেস করতেই বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলো,মেয়েটা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
” মিথ্যে, সব মিথ্যে আম্মু। রাত্রী মিথ্যে বলছে।”
যা শুনে রাত্রীপ্রিয়া শক্ত কণ্ঠে বললাম, “তুই মিথ্যে বলছিস, পরশ। সত্যি করে সবকিছু বলে দে মামনী’কে। ভয়ংকর এ সত্য কতক্ষণ লুকাবি তুই? সময়ের সাথে সাথে এমনিতেই সবকিছু সামনে আসবে। তার থেকে তুই যতো দ্রুত বলবি, ততো দ্রুত তোর সমস্যারই সমাধান হবে।”
“আমি তোর ননদ বলে তুই আমাকে মায়ের কাছে এভাবে ফাঁ’সা’তে চাইছিস, রাত্রী? ছি! নিজেকে ভালো সাজাতে তুই এতোবড় একটা জ’ঘ’ন্য অপবাদ দিয়ে দিলি আমায়? আম্মু বিশ্বাস করো, রাত্রী সব মিথ্যা বলছে। সব।”
নিজের কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়ালো না, পরশ। ততক্ষণাৎ রুমে চলে গেলো।
কথায় বলে না, চোরের মার বড় গলা। রাত্রী জানে, বিয়ের আগে প্রেমিক পুরুষের পা’প ঢাকতে সবকিছু এড়িয়ে যাচ্ছে, মেয়েটা। হয়তো সবার অগোচরে বাচ্চাটা ফেলে দিবে কোনো এক ডাস্টবিনে। পাপতো, যে-কোনো সময় লোকজন জানাজানি হয়ে যাবে। সম্মান যাবে তাদের, মেয়েটা হবে সমাজের কাছে ন’ষ্ট। ননদের উপকার করতে এসে শ্বাশুড়ির কাছে অপরাধী হলো, রাত্রীপ্রিয়া। সাধারণতো কোনো মা’ই অবিবাহিত এক মেয়ের থেকে এমনটা আশা করে না। সেখানে রাত্রীপ্রিয়া কতবড় এক ভয়ংকর সত্য জানালাম উনাকে। উনি কিছুতেই বিশ্বাস করলো না সে কথা। মেয়ের কথায় সায় জানিয়ে, ফুঁসে উঠলো, তানিয়া চৌধুরী। পুনরায় মেয়েটাকে মা’রা’র জন্য হাত বাড়ালো। ঠিক তক্ষুণি তার হাতটা ধরে ফেললো, সানাম চৌধুরী। উনি মা’কে বললো,
“আম্মু! যে হাত একবার আমার স্ত্রীর দিকে বাড়িয়েছো তুমি,সে হাত দ্বিতীয় বারের মতো আর তার দিকে বাড়িয়ো না। আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অধিকার আমি কাউকে দেয়নি। সে ভুল করলে তার বিচার করার জন্য আমি আছি।”
ছেলের থেকে নিজের হাত জাটকা মে’রে ছাড়িয়ে ক্রো’ধি’ত কণ্ঠে বললো, তানিয়া চৌধুরী।
“তোর বউয়ের সাহস কি করে হলো, আমার মেয়ের নামে আজেবাজে কথা বলার?”
যা শুনে সানাম চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“একপাক্ষিক ভেবে বিচার করলে, তুমিও ভুল হতে পারো আম্মু। তোমার উচিৎ ছিলো, সত্য-মিথ্যা যাচাই বাছাই করা।”
“তুই তোর বউয়ের হয়ে সাফাই করছিস, সানাম? ছি!ছি! এতোটা অ’ধঃপ’ত’ন হয়েছে তোর।”
“আম্মু, তুমি আমার জ’ন্ম’দা’ত্রী। তুমি আমার কাছে সম্মানের, শ্রদ্ধার। তুমি সবার উপরে।
তেমনই, আমার অর্ধাঙ্গিনীও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাকে আমি ভালোবাসি। তাকে সুরক্ষিত রাখা আমার দায়িত্ব। আমার স্ত্রী কোনো ভুল করলে, অবশ্যই তাকে শাসন আমিই করবো। তুমি শ্বাশুড়ি হয়ে তার গায়ে হাত তুলতে পারো না।”
মা’কে কিছু বলতে না দিয়ে, সানাম চৌধুরী রাত্রীপ্রিয়া নিয়ে ওখান থেকে রুমে চলে আসলেন। কেননা, এখানে দাঁড়ালেই মায়ের সাথে তর্ক বাড়বে, কথা-কা’টা’কা’টি হবে। যা একদমই চাইছে না, ছেলেটা।তানিয়া চৌধুরী ছেলের আচরণে ফুঁ’সে উঠলো। উনিও ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে গেলো।
রুমে এসে ভয়ে ভয়ে রাত্রীপ্রিয়া তার স্বামী’কে বললো,
“আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি। সব সত্যি বলছি, একবিন্দুও মিথ্যে না।”
“আমি জানি, তুমি সত্যি বলছো।”
সানাম চৌধুরী স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো। যা শুনে রাত্রী প্রিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি আগে থেকেই জানতেন?”
সানাম চৌধুরী আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। যে হসপিটাল থেকে টেষ্ট করিয়েছে পরশ, সেখান থেকেই দু’দিন আগে খবর পেয়েছে সানাম চৌধুরী। বোনের এতবড় এক সত্য শুনে,ছেলেটা ছিলো বাক্যহারা। তবুও দু’টো দিন অদ্ভুত এক যন্ত্রণা পুষে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, ছেলেটা। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো, সানাম চৌধুরী। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, তার আদরের ছোট বোনটা এতবড় একটা ভুল করেছে। এই মুহূর্তে আর নিজেকে সামলানোর শক্তি হলো না, তার। মুহুর্তেই ভে’ঙে পড়লো শক্তপোক্ত পুরুষটা। করুণ কণ্ঠে কেবল বললো,
“প্লিজ বউ, আমাকে প্রশ্ন করো না। আমি এতটুকু জানি, তুমি সত্যি বলছো। আমি বড় ক্লান্ত বউ! এতবড় এক সত্যি আমি নিতে পারছি না। আমায় একটু মানসিক শান্তি দিবে? বুকে বড্ড অশান্তি লাগছে। আমায় একটু স্বস্তি দিবে? পাঁচটা মিনিট জড়িয়ে ধরবে আমায়?”
বড় ভাই হয়ে বোনের এতো অধঃপতন নিতে পারছে না, লোকটা। বড় অসহায় লাগছে তাকে। বুঝতে পেরে, রাত্রীপ্রিয়া আর ছেলেটাকে কিচ্ছুটি প্রশ্ন করলো না। আলগোছে আগলে নিলো বুকে। সমান চৌধুরী একদম নিরব হয়ে গেলো। চুপটি করে, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালালো।
মিনিট দশেক যেতেই সানাম চৌধুরী হঠাৎ করে বলে উঠলো,
“স্যরি বউ! আজকে আমার আম্মুর ব্যাপারটার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। যতোই হোক,পরশ তার মেয়ে। মা হয়ে মেয়ের নামে হঠাৎ করে কেউ এমন কথা বললে, রাগটাই স্বাভাবিক। উনি তো আর সত্যিটা জানেনি।”
“আমি উনার আ’ঘা’তে যতোটা না কষ্ট পেয়েছি, আপনার সঠিক ব্যবহারে ঠিক ততটাই মুগ্ধ হয়েছি। সব পুরুষ মায়ের করা ভুলের সঠিক জবাব দিতে পারে না, বউয়ের হয়ে তো একদমই না। আপনি সেই দুঃসাহসিকতাও দেখালেন। এমন পুরুষের মায়ের উপর রাগ করা যায় না। যান, তখনকার ঘটনাটি মন থেকে মুছে ফেললাম আমি।”
সানাম চৌধুরী আর জবাব দিলো না। মাথা চেপে শুয়ে পড়লো, বিছনায়। রাত্রীপ্রিয়া ততক্ষণাৎ স্বামীর মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে, হাত বুলিয়ে দিলো। ভরসা দিলো,
“নেতা সাহেব, চিন্তা করবেন না। শান্ত হোন আপনি। আমি আছি তো! যা হওয়ার ছিলো, হয়েছে। রিলাক্স! এখন আমরা দু’জন মিলে, সমস্যার সাবধান খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি শক্তপোক্ত পুরুষ! আপনাকে এভাবে ভে’ঙে পড়তে দেখলে আমার ভালো লাগে না। এতো দুর্বল তো আমার নেতা সাহেব নয়!”
সানাম চৌধুরী ভরসা পেলো। নিজেকে শান্ত করতে, ততক্ষণাৎ এক হাতে জড়িয়ে ধরলো তার মনোহরণী’কে। হঠাৎ করেই তার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। বোনের জন্য তার বড়ে মায়া হলো! তার পিচ্চি বোনটার কি হবে এবার? না আর কিছু ভাবতে পারলো না, সানাম চৌধুরী। আপাতত এসব ভাবলেও না সে। যতো ভাববে ততো যন্ত্রণা হবে। এই মুহূর্তে তার একটু মানসিক শান্তি দরকার। পুরুষটা নিজেকে যন্ত্রণা থেকে আড়াল করতে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো, প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীকে। মুখ লুকোলো তার চুলের ভাঁজে। রাত্রীপ্রিয়াও তার নেতা সাহেব’কে পরম মমতায় আগলে নিলো।
মিনিট দশেক চুপচাপ এভাবেই কাটলো তাদের। এবার কিছুটা শান্ত হলো,সানাম চৌধুরী। যা দেখে রাত্রীপ্রিয়া মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“নেতা সাহেব, ভালো লাগছে আপনার? কষ্ট কমেছে কি?”
সানাম চৌধুরী বউয়ের কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
“বিশ্বাস করো বউ!,হাজারো কষ্টের মাঝে তোমারে একটুখানি জড়াই ধরলে আমি এক আকাশ পরিমাণ মানসিক শান্তি পাই!”
রাত্রীপ্রিয়া সকল চিন্তা দূরে রেখে, হাসলো। বললো,
“শুনো, হে পৃথিবী? আমার এই পুরুষটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিলাম আমি। এমন পুরুষ সব মেয়ের ভাগ্যে থাকে না। যে মেয়ে পায়, সে ভাগ্যবতী। পৃথিবীর বুকে যদি সেরা একজন ভাগ্যবতী থেকে থাকে, সেজন তাহলে আমিই হবো।”
সানাম চৌধুরী শতো ডিপ্রেশন কাটিয়ে হাসলো। প্রাণ খোলা হাসি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো, রাত্রীপ্রিয়া। আজকে এই ঘটনা আঁধারের সাথে মিলে গেলো। ওরা চারজন ছাড়া, চৌধুরী বাড়ির কেউ ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি হলো না।
___________
আজ সাত-সকালে ঘুম থেকে উঠেছে, রায়হান চৌধুরী। বাড়ির সকালে এখনো যে যার রুমে, ঘুমোচ্ছে। উনি চুপচাপ
ছেলের রুমে গিয়ে খোঁজ করছে, ছেলেকে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার ছিলো তাকে। কিন্তু ছেলেটা এখনো ঘুমোচ্ছে। আজ জকিংও যায়নি। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আজকাল কেউ কোনো নিয়মনীতি কিছুই মানছে না। সকাল ছয়টা, এখনো সবগুলো ঘুমোচ্ছে। এতে খানিকটা বিরক্ত হলো, রায়হান চৌধুরী।পরক্ষণে উনি ঘুমন্ত ছেলেকে বার কয়েক ডাকলো,
“এ্যাই সায়মন? সায়মন?”
জবাব নেই কোনো। যা দেখে উনি ছেলের গা ছুঁয়ে এবার একটু উচ্চ স্বরেই ডাকলো ,
“এ্যাই, সায়মইন্না? সায়মইন্না? উঠঠঠ।”
সকাল সকাল বাবা’র কাজে চরম বিরক্ত, সায়মন। সে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
“তোমার সমস্যা কি আব্বু? সাতসকালে তোমার বউ’কে রেখে, আমাকে বিরক্ত করছো কেন?”
“এ্যাই, একদম ফা’ল’তু কথা বলবি না তুই।
তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস কেনো? তাড়াতাড়ি ওঠে পড়। কতো বেলা হয়েছে জানিস? উঠ। উঠে একটু ব্যায়াম-ট্যায়ম তো কর! দিনদিন যা মোটু হয়ে যাচ্ছিস, এমন হলে তো তোর কপালে বউ জুটবে না-রে! বিয়ে করতে চাইলে, শরীরে একটু ফিটনেস আন। উঠে পড়। চল বাপ-ব্যাটা মিলে আজ জগিং এ বের হই।”
চলবে…….
[পর্বটা রিচেক দিতে পারিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না। সবাই পেজে রেসপন্স করবেন। ]