হিয়ার_মাঝে ৩৬. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
510

#হিয়ার_মাঝে ৩৬.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

সকালের ঘুম ভাঙল তীব্র কোলাহলে। বাড়িতে মনে হচ্ছে মানুষের ঢল নেমেছে। জিতু চোখ কচলে বোঝার চেষ্টা করছে এত লোকসমাগমের শব্দ আসছে কোথায় থেকে। গায়ের জামা পরিবর্তন করা হয়নি। রাতের সেই কালো টি-শার্ট পরনে। নিজের রুমের দরজা খুলে বের হল। করিডোর পার হতে গিয়ে নুবাহর রুমে কিঞ্চিৎ উঁকি ঝুঁকি দিল। কিন্তু রুমের ভেতর মানুষ আছে নাকি নেই বোঝা গেল না। ফের রুমের মেইন দরজা খুলে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি পেরুতেই তার অক্ষিযুগল পুরো বিস্মিত। পুরো বাসা অতিথিপূর্ণ। নিজেদের আত্নীয়-স্বজন, বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়াসহ পুরো ঘর মানুষে ভর্তি। হৈ হুল্লোড় আর খোশগল্পে মজে আছে সবাই। কেউ উচ্চশব্দে কথা বলছে তো কেউ অট্টহাসিতে সরব। তবে এত লোকসমাগমের হেতু বুঝতে তার কিয়ৎক্ষন সময় লাগল। মনে হতেই নিজমনে তাচ্ছিল্য হাসল। সে যে কাল বিয়ে করেছে ভুলেই বসে আছে।

আচমকাই তার চোখ পড়ল তার দাদুর ঘরের দিকে। সেখান থেকে লোকজন বের হচ্ছে বেশ হাসিমুখ করে। আবার কেউ কেউ নাকও সিটকাচ্ছে। সে পায়ের কদম বাড়াল। হৃদকম্পন ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। তার দাদুর আবার কিছু হয়নি তো। দিলারার দরজার চৌকাঠে পা রাখতেই দেখল ভেতরেও মহিলাদের ভীড়। কিন্তু তাদের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে লাল পাড়ের সবুজ রঙা শাড়ি পরিহিত এক রমণী। মুহূর্তে সে থমকালো। মাথায় লাল পাড়ের আঁচলে গোল করে ঘোমটা টানানো। মেহেদী রাঙানো হাতের মাঝে একগাছি সোনার চুড়ি। কানে সোনার ঝুমকো ঝুলছে। কপালের চুলগুলো সিঁথি করে পিছনে খোপা করে রাখা। লজ্জায় নুইয়ে পড়া তার লতার মত বাঁকানো শরীর। নত মস্তকে মেহেদী রাঙানো এক হাতের উপর অন্যহাত রেখে বসে আছে। হাতগুলো তার ঈষৎ কাঁপছে, লজ্জায় নয়তো সংকোচে।

এই রমণী আর কেউ নয়, তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। আনমনে বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। অযাচিত মনে অজস্র প্রশ্ন আনাগোনা করল। মেয়েটাকে এত সুন্দর হতে কে বলেছে। এই রূপে মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখল। কাল তো বধূ রূপে দেখেছে। আজ নববধূ রূপে। বিয়ের পরের দিন প্রথম সকালে এমন দৃশ্য দেখবে তার কল্পনাতীত। মেয়েটাকে শাড়ি পড়তে কে বলেছে? আজ সারাদিন এই মুখটায় ভাসবে তার চোখে। অসভ্য মেয়ে একটা।
থমকে থাকা তার মুখশ্রী দেখে দিলারা কাছে ডাকল। সে না চাইতেও দিলারার পাশে গিয়ে বসল। দিলারা নাতীর থুতনিতে হাত রাখলেন। নরম সুরে বলে উঠল,

‘কি হয়ছে ইয়াফি ভাই? মুখটা এমন শুকনা হইয়া আছে ক্যান?’

জয়তুন পান চিবাইতে চিবাইতে জবাব দিল, ‘বুবু কি যে কন, নয়া দুলার মুখ শুকনো হইছে ক্যান বুঝেন না। বউ’রে খুঁইজ্জা না পাইয়া ভয় পাইছে। হের ল্যাইগা তো হাঁফাইতে হাঁফাইতে আইলো রুমে।’

রুমের মাঝে মহিলাদের মুখে চাপা হাসি। কিন্তু দিলারার মুখে হাসি নেই। তিনি জানেন নাতী তার অন্য চিন্তায় মগ্ন। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি কিছু বলতে মুখ খোলার আগে জয়তুন ফের বলে উঠলেন,

‘কি নয়াদুলা, আমার বইনের লগে কি ভাবসাব এখনো হই নাই। বইনের চুলও দেখি শুকনো, আপনার চুলও শুকনা। ঘটনা’টা কি?’

রুমের মাঝে এবার উচ্চস্বরে হাসির বন্যা বয়ে গেল। জিতু দাঁতে দাঁত চেপে আছে। কি এক অসভ্য বুড়ি! এত মানুষের সামনে এভাবে কথা বলে কেউ। লজ্জায় তার হাসফাস লাগছে। আঁড়চোখে একবার নুবাহকে পরখ করল। নুবাহর লজ্জায় পড়িমরি অবস্থা। তার নানুর মুখ না এটা ভাঙা ক্যাসেট। বেয়াদ্দব বুড়ি। সে আসার পর থেকেই এভাবেই কথা বলে যাচ্ছে। প্রথমেই তার মাথার ঘোমটা তুলে চুল দেখল। তারপর গলায়, ঘাড়ে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘জামাই কি আদর সোহাগ করে নাই। কই গলায় কোনো দাগ দেহি না ক্যান।’
ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে গর্তে ঢুকে যেতে তার। আর এসব ভালো লাগছে না। এখান থেকে পার ফেলেই ভালো হত।

হঠাৎ করে দিলারার গম্ভীর স্বর ভেসে এল।
‘আপা, আইজকাল চুল শুকানোর লাইগা মেশিন আছে। দুই মিনিট লাগে চুল শুকাইতে। জামাই বউয়ের ব্যাপার হেরা কি সবার সামনে দেখাইয়া করবো নাকি সব। এসব নিয়া কথা না কওয়াই ভালা।’

হুট করে সামনে বসা এক মধ্যবয়সী মহিলা কথা বলে উঠল। তিনি দিলারাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কি যে কন না চাচী, নতুন বিয়ে হইলে জামাই বউ’রে হাত ছাড়াও করে না। সকাল সকাল বউ ঘুম থেকে,,,, মহিলাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলেন দিলারা। শক্ত গলায় বলে উঠল,

‘হ, বুচ্ছি তোমার কথা। বউ দেখা হইছে তাইলে এখন সবাই রুম থেকে যাও।’

সবার মুখ মুহুর্তে চুপসে গেল। যে যার মত বেরিয়ে পড়ল রুম থেকে। দিলারা জরুরি বোটামে প্রেস করলেন। ঈশিতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। উদিগ্ন মুখে বলে উঠল,
‘কি হয়েছে দাদু, ডাকছিলে?’
দিলারা নুবাহর দিকে ইশারা করল। রুক্ষ গলায় বলল, ‘আর কেউ বউ দেখতে আইলে ওরে নিচে নামাই বা না। নাত বউরে নিজের ঘরে নিইয়া যাও এখন।’

ঈশিতা কিছু না বলে নুবাহর এক হাত টেনে ধরল। মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘চল নুবাহ, আব্বু ডাকছে তোমাকে।’

নুবাহ যেতেই দিলারা গম্ভীর গলায় বলল, ‘ইয়াফি ভাই, বউরে শাসন করার হইলে তুমি করবা আবার ভালোবাসার হইলেও তুমি ভাসবা। কিন্তু কোনোদিন কারো সামনে বউরে অপমান করবা না। আর না কারো সামনে বউরে অপমান হইতে দিবা। দাদুর এই কথাখান মনে রাইখো কিন্তু। বউ তোমার, তারে যা বলার তুমি বলবা কিন্তু অন্য জন’রে দিয়া বলাই বা।’

জিতু ঈষৎ হাসল। সত্যি তো নুবাহকে অন্যে’রা কেন কিছু বলবে। বলার হলে সে অবশ্যই বলবে।

ঈশিতা হাঁটা ধরতেই পেছন থেকে জিমি এসে দাঁড়াল। জিমিকে দেখে ঈশিতা খুশি হল। সে নুবাহকে আজমলের রুমে নিয়ে যেতে বলল। নুবাহ জিমিকে দেখে হা’ হয়ে আছে। চিনতে পারল না কে এই মেয়ে। জিমি নুবাহর এক হাত ধরে বলে উঠল,

‘ভাবী কেমন আছো?’

নুবাহ কিছুসময় তাকিয়ে বুঝতে পারল এটা জিমানের বোন। ভাইবোন দু’জনের চেহারায় বেশ মিল। তবে জিমির গায়ের রঙ গৌরবর্ণা আর জিমানের শ্যামবর্ণ। গোলগাল মুখশ্রী আর বেশ লম্বাচওড়া ভাইয়ের মতই। সে জিমির পাশে দাঁড়াতেই নিজেকে লিলিপুট মনে হল। তমার চেয়েও লম্বা এই জিমি। তার উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন’ইঞ্চি। আর তমার ছিল পাঁচ ফুট চার’ইঞ্চি। সে জিমির কাঁধের নিচে পড়ে আছে। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হল। এজন্য লম্বা মানুষের সাথে হাঁটতে লজ্জা করে তার।

জিমি হাঁটতে হাঁটতে নুবাহকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাবী, তুমি কি ভয় পাচ্ছো আঙ্কেলের রুমে যেতে।’
নুবাহ না’ বলে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। জিমি নুবাহর এমন চুপসে যাওয়া মুখ দেখে ফের বলল, ‘তাহলে কি ভাবছো ভাবী? কথা বলছো না কেন? আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি।’

নুবাহ তড়িৎ জবাব দিল, ‘আরে না, আসলে তুমি কত লম্বা, তা দেখেই ভীমড়ি খাচ্ছি।’
জিমি হুট করে হেসে উঠল। জবাবে বলল, ‘এজন্যই এত ঘাবড়ে আছো।’
নুবাহ আলতো করে মাথা নাড়ালো। জিমি হেসেই যাচ্ছে। আজমলের ঘরে আসতেই জিমি হাসি থামাল। নুবাহকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আজমলের ঘরে মুরব্বিদের মিলনমেলা। ফরিদার দু’বোন, ববিতা কবিতা আর কবিতার স্বামী আনিসও উপস্থিত। নুবাহ প্রবেশ করেই সালাম দিল সবার উদ্দেশ্য। আনিস সালাম নিল সবার আগে। নুবাহকে দেখে হেসে উঠল। জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন আছো মা’মণি? গতকাল অনেক রাত হয়ে গেছে তাই আর দেখা করেনি। ভালো আছো তো?’

জবাবে নুবাহ কিঞ্চিৎ হেসে বলল, ‘জ্বী, আঙ্কেল ভালো আছি।’

আজমল নুবাহকে পাশে বসতে বলল। নুবাহ বসতেই তার মাথায় হাত রাখল। মুখের কোণে ঈষৎ হাসি হলেও নেত্রকোণে চোখের জল চিকচিক করছে। আজমলের চোখমুখে চরম অসহায়ত্ব। নরম ভেজানো গলায় বলল,

‘আম্মু, তোমাকে আমি বউ হিসেবে নয় মেয়ে হিসেবে এই বাড়িতে এনেছি। কিন্তু জানি না, সত্যি মেয়ের মত রাখতে পারবো কি’না? তবে আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ওয়াদার বরখেলাপ হতে দেব না। তবে আমার পাগল ছেলেটার দায়িত্ব তোমার হাতে সঁপে দিলাম। তার মেজাজ মাঝেমধ্যে একটু আকটু খিটখিটে হয়ে যায়। তবে আবার নিজ থেকে ঠিক হয়ে যায়। আসলে আমার ছেলেটা এমন ছিল না। বেশ প্রাণবন্ত ছিল। সময়ের পরিহাস, আজ সে এমন হয়ে গেছে। স্ত্রী হিসেবে যদি পারও ওর পাশে থেকো, ওর খেয়াল রেখো। রাখবে তো মা।’

নুবাহ নির্বাক ধূসর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। জবাবের অপেক্ষায় থাকা আজমল যেনো হাপিত্যেশ করছে। কিছুসময় বাদেই নুবাহ হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়াল। সে অবশ্যই চেষ্টা করবে। আজমল হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নুবাহর মাথায় রাখা হাত দিয়ে দোয়া করে দিল।

‘সুখী হও মা।’
নুবাহর হাতে একটা খাম গুজে দিয়ে পুনরায় বলল, ‘এখানে একটা ক্রেডিট কার্ড আছে। আর হাত খরচের জন্য কিছু টাকা। এগুলো সবই তোমার। যখন যা লাগবে, এই বুড়ো বাপকে নির্ভয়ে বলবে। মনে থাকবে তো মা।’

নুবাহ ফের হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়ালো।

ববিতা দীর্ঘসময় ধরে নুবাহকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎই বলে উঠল,
‘দুলাভাই, জিতুর বউ তো জিতুর মত সুন্দর না। গায়ের রঙ একটু মন্দা মনে হচ্ছে না। আমার জিমানের বউ মাশ’আল্লাহ একবার সাদা ধবধবে সুন্দর। লম্বা অনেকটা আমার জিমির সমান।’

আজমল এমন কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। তার ছেলের জন্য সে যোগ্যই বউই এনেছে। রূপে গুণে অন্যান্য তার ছেলের বউ। বেশ রুক্ষস্বরে জবাব দেয়ার জন্য উদ্বত হল। কিন্তু তার আগেই ফরিদা মুখ খুলল,

‘তুই কি আসমানের পরি ববিতা, তোর জামাই তোর থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর। এখন তোর জামাই কি তোর সাথে সংসার করা ছাইড়া দিছে। আমার জিতুর বউ কোন দিক থেকে অসুন্দর। জিতু পুরুষ মানুষ এজন্য দেখতে ওরে এত সুন্দর লাগে। তাই বলে আমার জিতুর বউ সুন্দর না এমন’টা তো নই। আজকে বলসছ, আজকেই যেন শেষ হয়। গায়ের রঙ নিয়া দ্বিতীয়বার আমার সামনে বা পিছনে কখনই কথা তুলবি না ববিতা। সাবধান করে দিলাম।’

ববিতা মুহূর্তে চুপসে গেল। মনের ভিতর অনেক কথায় উঁকি ঝুঁকি দিল। আলালের ঘরের দুলাল জিতু। চান্দের মত ছেলের সাথে এমন মন্দা মেয়ে তার কাছে একদম বেমানান। পারিবারিক অবস্থাও অত ভালো না। তাও কি দেখে তার বোনের জামাই পাগল হইছে, সে বুঝে উঠতে পারে না। কবিতা নুবাহকে পাশে বসাল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘মন খারাপ কর না, আমার ছোট আপা একটু খুঁতখুঁতে। যাই মুখে আসে বলে দেয়। তবে সে মানুষ হিসেবে অত খারাপ না।’

নুবাহ চুপচাপ সব শুনল। মন খারাপ করেনি বলে মাথা নাড়াল। ফরিদা এবার নুবাহর দিকে তাকাল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

‘দেখো ছোট বৌমা, তোমাকে রুমে ডাকার পিছনে কিছু কারণ আছে, তাই ডেকেছি। এখন থেকে তুমি এই বাড়ির বউ। তাই অন্তত দু’মাস নিয়মিত শাড়িই পরবে। রুমের ভেতর কি পরবে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু রুম থেকে বেরুলেই যেন তোমার গায়ে শাড়ি আর মাথায় সবসময় ঘোমটা দেখি। আর মুরব্বি দেখলে দাঁড়িয়েই সালাম দিবা। কারো পা’ ছুঁয়ে সালাম করার দরকার নাই। ভোর বেলায় নামাজ পড়ে সূর্য উঠার সাথে সাথে রান্নাঘরে যেন তোমাকে দেখি। সকালের নাস্তা তুমি বানাবে ময়নার মা’সহ। ঘর ধোয়া মোছার কাজ রবি করে। কিন্তু ঘর গোছানোর কাজ তোমার। জিতুর রুম গোছানোর দায়িত্ব তোমার। ভার্সিটি যেদিন বন্ধ থাকবে সেদিন দুপুরের রান্না তুমি করবে। সাথে ময়নার মা, ঈশিতা তোমাকে সবজি কাটাকুটি করে দেবে। আর হ্যাঁ, যখনি ডাকব সাথে সাথে ছুটে আসবে।’

নুবাহ হতবিহ্বল। এত বড় বাড়ি গোছানো চাট্টিখানি কথা নয়। রান্না মোটামুটি পারে সে। কিন্তু পারবে তো সব সামলাতে? অজান্তেই বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। ফরিদা ফের বলে উঠল,

‘শোনো, জিতুর বন্ধুরা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। এরা উঠলে সবাইকে নাস্তা দিও। জিতুও নাস্তা খায়নি। যাও ওকে নাস্তা দিয়ে আসো। তোমার বোনদেরও ডেকে নাস্তা দিয়ে দাও। ঠিক আছে।’

নুবাহ ফের মাথা নাড়াল। কিন্তু মনের মাঝে ভয়ংকর প্রলয় বইছে। কিভাবে কি করবে সে, কিছুই তো জানা নেই। জিমি কাছে এসে বলল,

‘ভাবী মন খারাপ তোমার? আম্মুর কথায় রাগ কর না। আমার আম্মু একটু এমনই। চল রান্নাঘরে, সেখানে ঈশিভাবী আছে তোমাকে সাহায্যে করার জন্য।’

নুবাহ যেতেই আজমল ফরিদার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘মেয়েটা মাত্রই আসল এই বাড়িতে। এত জলদি রান্নাঘরে না পাঠালে কি হত না। আর কিছুদিন সময় দিতে।’

ফরিদা স্বামীর জবাবে তাচ্ছিল্যের সুর তুলল। ‘বউ শাশুড়ীর মাঝে তুমি কেন, কেউ আসবে না। এই বাড়ি আমার একা নই, ওর নিজেরও। সংসারের হাল নতুন থাকতেই বুঝিয়ে দিতে হয়। ওর দায়িত্ব ওকে বুঝে দিয়েছি শুধু। আরও কিছু কারণ আছে। সেটা এখন তুমি বুঝবে না। সময় আসলে টের পাবে।’

‘দেখ, আমি মানছি। কিন্তু কয়’টা দিন অন্তত সময় দিতে মেয়েটাকে।’

ফরিদা জবাবের প্রতিত্তোর করল না। কিছু কাজ অন্যায় হলেও করতে হয়। আজমল আশাহত হল বউয়ের জবাব না পেয়ে।
____

জিতু বন্ধুদের ঘুম থেকে উঠানোর জন্য মাত্রই ডাকতে উঠল। কিন্তু তার আগেই সবকটা হাজির। দেয়াল ঘড়িতে তখন সকাল নয়’টা ত্রিশ। সবাই ফ্রেশ হয়ে এসেছে। জিতু সবাইকে ড্রাইনিং টেবিলে বসতে বলল। নীলাভ হৃদিও তখন হাজির হল। রিদান নিভান চোখ কচলে মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। হৃদি দু’জনকে জলদি ফ্রেশ হতে বলল। ড্রাইনিং এ বসা চিন্ময় আর জিমানের দিকে চোখ দু’জনের। তারা সোফায় গিয়ে বসল। সানি এদেরকে দেখে তার সেই বুলি আওড়ালো,

‘আরে বেয়ান সাহেবা, আপনাদের ঘুম ভাঙছে তাইলে।’

হৃদি চুপ করে আছে। কিন্তু নীলাভ জবাবে বলল, ‘না ঘুম ভাঙেনি, এখনো ঘুমাই।’

সানি শব্দ করে হেসে উঠল। পাশে থাকা রকি জবাব দিল, ‘তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বুঝি কথা বলেন, বেয়ান সাহেবা।’

এবারের জবাব’টা হৃদি দিল, ‘জ্বী, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলি।’

রকির দু’চোখ রসগোল্লার মত বড় হয়ে গেল। কিন্তু সানিই উত্তর করল, ‘আপ ভূত্নী হো ক্যায়া, লেকিন দেখনে মে’তো ইনসান লাকতি হো।’

বন্ধুমহলের মাঝে তখন চাপা হাসি।

হৃদির মেজাজ চটে গেল। চিন্ময়ের বাচ্চা’টা কথা বলে না কেন। কত দেমাগ এই ছেলের দেখ। না পেরে সে এবার চুপ হয়ে গেল। কোন কথার সে আর জবাব দেবে না। জিতু হৃদি নীলাভ নিভান রিদানকে ডাকল তাদের পাশে বসে নাস্তা করতে। তারাও পাশে গিয়ে বসল। রবি এসে নাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। গরম গরম ঘি’য়ে ভাজা পরোটা, ডাল ভাজি আর গরুর মাংস।

রবি একা হাতে আসতে যেতে সময় লাগছে। ড্রাইনিং এ একত্রে অনেকজন বসায় খাবার দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই জিতু উঠল আরও বাড়তি নাস্তা আনতে। রান্নাঘরে মাত্রই পা রাখল। প্রবেশ করবে তৎক্ষণাৎ নুবাহ ডাল, মাংসের বাটি ট্রেতে সাজিয়ে ড্রাইনিং এর উদ্দেশ্য বের হল। দু’জনেই মুখোমুখি। হঠাৎই দু’জনের মাঝে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। নুবাহ জিতুর ধাক্কা লেগে পুরো ডাল গিয়ে পড়ল জিতুর তলপেট বরাবর। তারপর সেই বাটিগুলোসহ ট্রে নিচে পড়ে ঝনঝন করে শব্দ তুলল। ট্রে ভাঙলো না, কিন্তু বাটি কয়েক টুকরো হল ভেঙে। তবে নুবাহ ভয়ে শেষ, গরম গরম ডাল ভাজি আর মাংস। হুট করে এমন হওয়ায় দু’জনেই হতভম্ব। নুবাহ আমতা আমতা করল,

‘স,,স,সর‍্যিই আপনার জামা তো নষ্ট হয়ে গেল? এক্ষুনি আমি পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছি, দাঁড়ান।’

জিতুর মেজাজ তিরিক্ষি হল। তার যে ময়লার চেয়ে শরীর জ্বলছে, সেটা কি এই মেয়ের আদৌ ধ্যানে আছে। সে আছে জামা নষ্ট নিয়ে, বোকা মেয়ে একটা। ভারী গলায় জবাব দিল, ‘থাক লাগবে না, আমি চেইঞ্জ করে আসছি।’

জিতু চলে গেল। নুবাহ ভ্যাবলাকান্তের মত চেয়ে আছে তার যাওয়ার দিকে। জিতু কি তার উপর রেগে গেল। কিছুই বুঝল না।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here