#হিয়ার_মাঝে ৪২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামল বন্ধুমহল। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে দু’টো গাড়ি নিয়েই এসেছে তারা। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এল প্রায়। হৃদির এক হাতে বন্দি সোনিয়ার হাত। অন্য হাত চিন্ময়ের হাতে। চারদিকের এত মনোরম দৃশ্য দেখে সোনিয়া হাসছে, সেই এক প্রাণবন্ত হাসি। হৃদি অপলক তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর মুগ্ধময় সেই হাসি। এত সুন্দর কেন তিনি? তিনজনই একসাথে দাঁড়িয়েছে উঁচু রাস্তার কর্ণধারে। চিন্ময় হৃদিকে ডাকল,
‘এই পিচ্চি, তুমি আমার মা’কে পটালে কি করে বল তো?’
হৃদি কটমট করে তাকালো। ইচ্ছে করছে কয়েক’টা কটুবাক্য শুনিয়ে দিতে। কত্ত বড় সাহস তাকে পিচ্চি ডাকে। তার পিচ্চি বাচ্চার মা’ হবে সে। আর আসছে পিচ্চি ডাকতে। বেদ্দব জামাই তার। লজ্জা করে না বউকে পিচ্চি ডাকতে। সে চিন্ময়ের কথার জবাব দিল না। চিন্ময় জবাব না পেয়ে হৃদির মাথায় আলতো হাতে চাপড় মারল। ফের বলে উঠল,
‘পিচ্চি ম্যাইয়া, মুখে কি ললিপপ দিছো। জবাব দাও না কেন?’
হৃদি তিরিক্ষি গলায় জবাব দিল, ‘বিয়ে হলে বাচ্চার মা’ হয়ে যাব। আমাকে পিচ্চি বলেন কোন সাহসে?’
চিন্ময় পুরাই থ’, কি বলে এই মেয়ে! তার হাঁটুর বয়সী মেয়ে বিয়ে হলে বাচ্চার মা’ হয়ে যাবে। কি সাংঘাতিক চিন্তাভাবনা! বাপরে, এই মেয়ে’তো তার থেকেও ঠোঁটকাটা। কার কপালে জুটবে এমন বউ? আল্লাহই জানে।
অদূরে দাঁড়ানো জিমান জুঁই মিটমিট করে হাসছে। জুঁইয়ের জহুরি চোখ অনেক কিছুই পর্যবেক্ষণ করল। অযাচিতমনে বলে উঠল,
‘এদের তিনজনকে বেশ মানিয়েছে। দেখতেই মনে হচ্ছে এক সুখী পরিবার। চিন্ময়ের জন্য হৃদি মেয়েটা সবচেয়ে উত্তম হবে, তাই না জিমান।’
জিমানের মুখের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। হতাশার সুরে বলে উঠল, ‘শুধু মানালেই হবে না, অবস্থানও দেখতে হবে। চিন্ময়ের ওসি মামা নিজের মেয়ের জন্য পাত্র হিসেবে আজ নয়, সেই ছোটবেলায় তাকে পছন্দ করে রেখে দিয়েছে। বিয়ে না হলেও পারিবারিকভাবে কথা অনেকটাই এগিয়ে আছে। চিন্ময়ের মাস্টার্স শেষ হবে, কুমুদেরও এইসএসসি শেষ হবে তখন। এরপর বিয়ের সানাই বাজবে দু’জনের। চাইলেও চিন্ময় অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ, তার যে পরিবার আর অভিভাবক দু’টোই তার মামা। সেই ছোটবেলায় মামা তাকে আশ্রয় দিয়েছে। তার অসুস্থ মা’কে তার মামা এতদিন আগলে রেখেছে। সেই প্রতিদান স্বরূপ হলেও কুমুদকে তার বিয়ে করতে হবে। বাস্তবতা বড্ড কঠিন’রে জুঁই।’
জুঁই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিরবে। দৃষ্টি পড়ল মুবিনের দিকে। সুঠাম গড়নের ছেলেটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। দেখলে আজকাল অসুস্থ লাগে। মাথাভর্তি শুধু তার পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা। কিভাবে নিজের পরিবারকে ভালো রাখবে? দু’বোন বড় হচ্ছে। তাদের পড়াশোনা, বিয়ে এসবই ভাবে সারাক্ষণ। অথচ নিজের শরীর যে অসুস্থ, সেই চিন্তা যেনো তার মাথার মধ্যেও নেই। কি অদ্ভুত এই ছেলে! অবশ্য সেও তো একই পথের সারথি। কিন্তু তার সাথে কিছু জিনিস অভিন্ন। তাকে পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সে যে মনের কোণে একজনকে বাক্সবন্দি করে রেখেছে। যদি একবার মুবিন তাকে বলতো, জুঁইফুল আমার মত ছা-পোষা মানুষটাকে বিয়ে করবে? সে নির্দ্বিধায় সম্মতি জ্ঞাপন করত। এখন কি সে মেয়ে হয়ে প্রস্তাব দেবে? যদি মুবিন ফিরিয়ে দেয়। হাপিত্যেশ করল নিজমনে। কিন্তু এখন কথা বলতে দোষ কোথায়। সে পায়ের কদম বাড়াল। বিমূঢ় হয়ে বসে থাকা মুবিনের পাশে বসল। মোলায়েম গলায় বলে উঠল,
‘কি হয়েছে মুবিন? তোমার শরীর অসুস্থ মনে হচ্ছে? কি সমস্যা হয়েছে?’
মুবিন যেন অথৈজলে পড়ল। হুট করে তার পাশে জুঁই এসে বসবে, ভাবিনি সে। শরীর তার বড্ড খারাপ। বুকের ব্যথা বেড়েছে। কিন্তু ডাঃ দেখাবে কখন? নিজেকে নিয়ে এত ভাবার সময় আছে? জুঁইয়ের দিকে আড়চোখে তাকাল। মেয়েটার গায়ে গাড় খয়েরী রঙের জামা। তার সাথে ধূসর রঙা হিজাব পরিহিত। পান পাতার মত মুখশ্রী হিজাবের আদলে ঢাকা পড়েছে। তবুও তার চিবুকের নিম্নভাগে থাকা টোল দৃশ্যমান। মেয়েটার মুখশ্রীতে চিন্তার ছাপ পড়লেও অদ্ভুতভাবে সুন্দর লাগে। তার পাশে বসে চিন্তিত রমণীর মত তাকে শারীরিক সমস্যা জিজ্ঞেস করছে। দেখতে কেমন বউ বউ লাগছে। মুবিন আচমকাই অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। জুঁই বিস্মিত হল। ফের জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে মুবিন? তুমি এভাবে হাসছো কেন? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?’
মুবিন হাসি থামাল। জুঁইকে রাগানোর ইচ্ছে নেই। মেয়েটা এমনিতে অনেক শান্ত, কিন্তু রাগলে বেশ কঠিন হয়ে যায়। নিজের অসুস্থতাকে একপাশে রেখে জুঁইয়ের জবাব দিল। গলা’টা কিঞ্চিৎ কম্পিত।
‘তেমন কিছু না জুঁই, সামান্য বুকে ব্যথা হচ্ছে, এই যা। ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ খেয়েছি ব্যথার।’
‘তুমি একজন রসায়ন বিভাগের ছাত্র। মানব শরীর নিয়ে অনেক ভালই ধারণা আছে। বুকের ব্যথাকে সামান্য বলছো, মুবিন?’
মুবিন ফের চমকালো। মেয়েটা আজকে তাকে শাসন করছে। এভাবে আর কেউ তাকে শাসন করে না। এমন শাসন তো প্রিয় মানুষই করে। তার অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছে। বুকের ব্যথাও যেন খুব দ্রুত সেরে যাচ্ছে। খুব বলতে ইচ্ছে করছে, জুঁইফুল, এভাবে মাঝেমধ্যে শাসন করবে। তাহলে দেখবে আমি দ্রুতই ভালো হয়ে যাব। গলার স্বরে কমনীয়তা। জবাবে বলল,
‘জুঁইফুল তোমার ভয়ে বুকের ব্যথা হাওয়া হয়ে গেছে।’
একবাক্য বলেই কিঞ্চিৎ শব্দ করে হেসে উঠল সে। ফের জুঁইয়ের দিকে দৃষ্টি দিল। নিজের অজান্তেই বলে উঠল,
‘সকালে কি হয়েছিল তোমার? তোমাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তখন। বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে।’
জুঁই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুবিন কিভাবে তার কথা ঘুরিয়ে নিল। নিজের কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো তাকেই প্রশ্ন করছে। রগড় গলায় জবাব দিল, ‘মুবিন তোমার রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিৎ।’
‘রাজনীতি, যেখানে কোনো নীতি নেই। সেখানে কেনো যোগ দেব?’
‘কারণ, তুমি ভালই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো। উল্টো প্রশ্নকর্তাকে প্রশ্ন ছুঁড়তে পারো। দারুণ দক্ষতা আছে এইদিক থেকে। তাই বলছি রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিৎ।’
মুবিন মৃদু হাসল। মেয়েটা রেগে গেছে তার উপর। জবাবে বলল,
‘রাগ করলে না’কি জুঁইফুল?’
জুঁই জবাব দিল না। নিশ্চুপ বসে আছে। দৃষ্টি তার সমুদ্রের পানে। মুবিনও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগে মনোযোগ দিল।
সূর্যাস্তের কিছু মুহুর্ত বাকি। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বন্ধুমহলের সবাই পিচ ঢালা রাস্তায় দন্ডায়মান। দৃষ্টি তাদের পশ্চিম দিকে সমুদ্রের মাঝে থালার মত ডুব দেয়া সূর্যাস্তের দিকে। এমন সূর্যাস্ত নুবাহ গত তিন বছর ধরে বহুবার দেখেছে। কিন্তু আজকের সূর্যাস্ত এসেছে তার জীবনে একরাশ লজ্জা নিয়ে। মুখ লুকিয়ে সে জিতুর আড়াল হয়ে আছে। লোকটার দিকে তাকাতেই লজ্জায় মর মর অবস্থা। এখনও সেই দৃশ্য তার চোখে ভাসছে। লিপষ্টিক মাখানো জিতুর মুখ’টা তার মুখে ঘষে ঘষে নিজের সব দাগ তার মুখে এঁটে দিয়েছে। শেষে তার ঠোঁটে গিয়েও একই কাজ করেছে। বদলোক একটা। কি লজ্জাটায় না পেয়েছে সে। লজ্জানত দৃষ্টিতে হাসফাস করছে। অথচ অজান্তেই তার অবস্থান রাস্তার মাঝামাঝিতে এসে গেছে।
সন্ধ্যাকালীন মূহুর্তে অচেনা মানুষের আগমন বেড়ে যায়। সূর্যাস্ত দেখতেই ছুটে আসে অসংখ্য পর্যটক। এত কোলাহল আর ভীড়ের মাঝে জিতুর দৃষ্টি নুবাহর দিকে। সহসাই ছুটে এল তার কাছে। রাস্তার মাঝ থেকে নুবাহকে দ্রুতই সরিয়ে একপাশে দাঁড় করালো। বেশ জোরে এক রামধমক দিল,
‘অকালে আমাকে বিধবা করার ইচ্ছে আছে না’কি তোমার, বোকা মেয়ে কোথাকার!’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুবাহ। সে কি করল আবার? এই লোক বিধবা হবে কেন? আশ্চর্য তো! নিজমনে অজস্র প্রশ্ন আওড়াল, কিন্তু বলার সাহস নেই এই লোককে। বললে ফের ধমক দেবে এখন। জিতুর রক্তিম অক্ষিদ্বয়, মুখের চোয়ালও বেশ শক্ত। কিন্তু স্বর নমনীয় করলো,
‘পাশ দিয়ে কতগুলো ছেলে গেছে, হুঁশ আছে তোমার। ছেলেগুলোর মুখশ্রীতে স্পষ্টত বিকৃত লালসার ছাপ। এরা তোমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিত এখন। ভীড়ের মাঝে পড়লে তোমার কি অবস্থা হত? মাথায় কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই! আমার থেকে পালিয়ে তোমার কি লাভ হচ্ছে বলতো? উল্টো ক্ষতিটাই হচ্ছে। বোকা মেয়ে কোথাকার!’
দ্বিতীয় বাক্যে বিনিময় ছাড়া নুবাহর এক হাত টেনে নিজের হাতসহ পকেটে ঢুকাল সে। ফের বলে উঠল,
‘যেভাবে হাত রেখেছি, সেইভাবেই হাত রাখবে। একদম আমার কাছাকাছি থাকবে। আমি না বলা পর্যন্ত নড়বেও না।’
নুবাহর নাক ফুলে উঠেছে রাগে। কিন্তু গলার স্বর কম্পমান। জবাবে বলল,
‘এইভাবে হাত ঢুকানোর মানে কি? সবাই তাকিয়ে আছে এইদিকে?’
‘সবাই তাকিয়ে থাকলে আমার কি? পনেরো লক্ষ টাকা নগত মোহরানা দিয়ে বিয়ে করেছি। দশ লক্ষ টাকার সাজপোশাক দিয়েছি, বিয়ের অনুষ্ঠানে খরচ করেছি আট লক্ষ টাকা, বউয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে বিশ লক্ষ টাকা। তার শ্বশুর মশায় চল্লিশ লক্ষ টাকা দামের একটা ফ্ল্যাটও লিখে দিয়েছেন। আরও কত কিছু আছে, সেসব তো বাদই দিলাম। বুঝতে পেরেছো কত দামী বউ আমার। ওদের কাছে এত দামী বউ আছে?’
নুবাহ লজ্জা ভুলে জিতুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। দামী বউ! তাকে এত কিছু দিয়েছে। অহ, এজন্য তাকে দেখে রাখছে। টাকার মুল্যেটাই বেশি হল, মানুষ হিসেবে তার দাম নেই! বেশ অভিমান জমল জিতুর উপর। একটু ভালোবেসেই তো বলা যায়। জিতু ফের একবার নুবাহর দিকে তাকালো। তার বউয়ের মুখশ্রী জুড়ে তিমিরের আঁধার নেমেছে। গলা খাঁকারি দিল নুবাহর উদ্দেশ্য। ফের রগড় গলায় বলল,
‘বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, তোমাকে এই মুহূর্তে কার মত লাগছে। তুমি দেখতে একদম হুবহু তার মত।’
নুবাহ ভাবনায় পড়ল। কার মত লাগতে পারে? কে সেই ব্যক্তি? বেশ গভীর চিন্তায় মশগুল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লম্বা গাছের দিকে ইশারা করল জিতু। আচমকাই বলে উঠল,
‘ঐ গাছের দিকে তাকাও নুবাহ, দেখেছো, তোমার হুবহু কপি কি সুন্দর করে বসে আছে।’
নুবাহ গাছের দিকে তাকালো। ভ্রুদ্বয় মুহুর্তে কুঁচকে গেল। কত্ত বদলোক এই জিতুর ডিম। সে দেখতে ঐ পেঁচার মত! সে জিতুর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিল। হুট করে দু’ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। হঠাৎই নুবাহর এমন অদ্ভুতুড়ে ভেংচি দেখে জিতু নিজের দমবন্ধ করে রাখা হাসি আর থামাতে পারল না। মুহুর্তে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। জিতুর হাসির শব্দ শুনে বন্ধুমহলের দৃষ্টি পড়ল তার দিকে। সবার চক্ষু চড়কগাছ। এটা সত্যিই জিতু তো! ঠিক কতদিন পর এই ছেলেকে এমন প্রাণ খুলে হাসতে দেখছে। এই হাসি যেন জিতুর চক্ষুশূল ছিল। সে হাসতেই ভুলে গিয়েছিল।
নুবাহ চমকালো। সে কি করেছে, নিজেই জানে না। নিজের অজান্তে হুট করেই এমন কিছু করে ফেলেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে এত সুন্দর দৃশ্য দেখবে তা কল্পনার অতীত। জিতুকে সে কখনো হাসতে দেখেনি। আজ প্রথমবার দেখল, লোকটার হাসি এত মুগ্ধময়! আহ! কি স্নিগ্ধতাপূর্ণ সেই হাসি। চিকন সরু দাত, হাসলে দু’ঠোঁটের শেষ প্রান্তে কি সুন্দর দু’টো টোল পড়ে। ছেলেদের হাসিও এত সুন্দর হয়। জিতুর হাসি না দেখলেই জানতোই না। কয়েক মুহুর্তের সেই হাসিতে সে ফিদা হয়ে গেছে। না জানি আরও কত গুণ আছে এই বদলোকের। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সে জিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। জিতু এখনও হাসছে।
চলবে,,,,