#এক_ফালি_সুখ🌼 |২২| [বোনাস পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
বরাবরের ন্যায় শান্তই রইলো মৌরিন। কেবল তার ভ্রুযুগল ইষৎ সঙ্কুচিত হলো, চক্ষুদ্বয় কিছুটা ছোটছোট করে আরো একবার পড়লো চিরকুট টা। এরপর চেয়ারে বসে সামনের দিকে তাকিয়েই ভাজ করলো সেটা। রুবেল কে একবার বলেছে, বারবার তাকে বিরক্ত করাটা ভালো দেখায় না। ফলস্বরূপ এই চিরকুট কে পাত্তাই দিলো না মৌরিন। কোনো বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সেই বিষয়টাকেই অবহেলা করা। এই চিরকুট যে পাঠিয়েছে, সে নিশ্চই মৌরিন এর গতিবিধি লক্ষ্য করছে, দু তিনদিন তাকে শান্ত দেখে নিশ্চই ছেড়ে দেবে এসব।
হাটুতে কনুই ঠেকিয়ে মাথা কিছুটা ঝুকিয়ে নিলো মৌরিন। দুহাতে মাথা চেপে ধরে ওভাবেই বসে রইলো খানিকক্ষণ। চোখ বন্ধ করতেই চোখে গরম অনুভূত হলো,জ্বরটাও বোধ হয় বাড়ছে ধীরেধীরে।
_”কাজ না করতে পারলে আসার কি দরকার?”
কণ্ঠ শুনেই মৌরিন বুঝতে পারলো তূর্য তার সামনে এসে বলছে কথাটা। মাথা থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো মৌরিন। তাকালো সামনের দিকে, তূর্য কিছুটা সামনে এক চেয়ারে বসে ফোন ঘাটছে। মৌরিন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
_”আমি যতটা জানি, এই সময়ে আমার কোনো কাজ নেই। নিজের যতটুকু কাজ,তা আমি করেই এসেছি আর পরবর্তীতেও করতে পারবো। একান্ত না পারলে অবশ্যই আসতাম না।”
তূর্য তাকালো মৌরিন এর দিকে। চেয়ার থেকে উঠে পাশে থাকা টেবিলের উপরের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো কিছুক্ষন। হুট করেই সেগুলো বন্ধ করে পাশ ফিরে মৌরিন এর দিকে তাকালো সে। নিজের একহাতের দিকে তাকিয়ে আবারো মৌরিন এর দিকে তাকায় সে। মৌরিন তাকায়নি সেদিকে,তার দৃষ্টি নিচের দিকেই আবদ্ধ। তূর্য খানিকক্ষণ সেভাবে স্থির থেকে পা বাড়িয়ে মৌরিন এর সামনে দাঁড়ায়। নিজের ডানহাতে থাকা ওষুধটা হুট করেই মৌরিন এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
_”খেয়ে নিও এটা।”
কথাটা বলেই আবারো সেই চেয়ারে গিয়ে বসে পরে তূর্য।মৌরিন কয়েক সেকেন্ড নিজের হাতে থাকা ওষুধটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে খেয়ে নেয় ওষুধটা। বোতলটা পুনরায় ব্যাগ এ রেখে তূর্যের উদ্দেশ্যে বলে,
_”ধন্যবাদ”
অবাক হয় তূর্য। ধীর কণ্ঠে বলে,
_”স্ট্রেঞ্জ! ত্যাড়ামি করলে না?”
মৃদু হাসে মৌরিন। তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে,
_”আমি তো আর অকৃতজ্ঞ নই। উপকার করলেন তাই ধন্যবাদ বললাম। এখানে ত্যাড়ামি করতে যাবো কেন?”
_”কি ওষুধ দিলাম দেখে নিয়েছো?”
_”হুম,আগেও খেয়েছি।”
_”মাইগ্রেন এর প্রবলেম?”
_”অল্পস্বল্প”
_”আমারো। ছিলো আমার কাছে,তাই দিলাম।”
বিপরীতে আর কিছু বলেনা মৌরিন। এরই মধ্যে ডাক পরে তূর্যের, সে নিজেও চলে যায় শুটিং এর জায়গায়। মৌরিন জানে এখন তার ঘুম পাবে,এই ঔষধটা খেলে ঘুম পায়। তাই আগেভাগেই ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রোল করতে লাগলো। ইনবক্স এ অনেক বন্ধুরা মেসেজ দিয়ে রেখেছে, রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করেনা। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এ গিয়ে পরপর অনেকগুলো ডিলেট করলো মৌরিন। অপরিচিত ব্যক্তির রিকুয়েস্ট সে খুব একটা এক্সেপ্ট করেনা। আগেও করতো না, আর এখন নিশ্চিত নাহিদও পাঁচ ছয় টা ফেইক আইডি খুলে রিকুয়েস্ট দিয়ে রেখেছে।
মাঝেসাঝে এগুলো ভেবে আপনাআপনি হাসি পায় মৌরিন এর। হুট করে যেন নাহিদের সুবুদ্ধি হয়েছে, সে মনে করছে সে যা করেছে ভুল করেছে। এখন তারা যায়, মৌরিনকে আবার বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে, বিনিময়ে ব্যাবসার অংশটুকু ফিরিয়ে দেবে। রাজি হয়নি মৌরিন, ম’রে গেলেও তো অমন লোভী লোককে সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে না, আর ইসলামিক দৃষ্টিতে তা সম্ভব ও নয়।
শুটিং শেষ হওয়ার কিছুক্ষন আগেই রুবেল এর থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসে মৌরিন। এখন তার কাজও নেই তেমন,যা ছিলো তা গুছিয়েই এসেছে।
দিনটা বুধবার, মৌরিনদের বাসায় যাওয়ার রাস্তায় সব দোকান বন্ধ থাকে এইদিন। মৌরিন আশেপাশে তাকালো না, কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে হেটে গেলো। পিছন থেকে মেয়েলী কণ্ঠে কেউ ডাক দিতেই থেমে যায় মৌরিন। পিছন ঘুরতেই জ্যোতিকে হাটুতে হাত রেখে হাপাতে দেখে সে। জ্যোতির সঙ্গে মৌরিন এর আলাপ হয়েছিল ভার্সিটি তে। ট্রান্সফার এর কিছু কাজে কয়েকদিন যেতে হয়েছে ভার্সিটি তে,সেখানেই জ্যোতির সঙ্গে কথা হয়েছিল,আরো দুজনেই সিলেটের মানুষ। সখ্যতা জমেছে ভালোই, তবে ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়ে ওঠেনি।
জ্যোতি কিছুক্ষন বাদে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
_”কতক্ষন ধরে ডাকছি তোমায়,শুনতে পাও নি?”
মৌরিন সামান্য হেসে উত্তর দেয়,
_”খেয়াল করিনি বোধ হয়।”
_”এদিকেই বাসা তোমার?”
_”হ্যা এই একটু সামনেই। তোমাকে তো আগে দেখিনি।”
_”না না,আমার বাসা এখানে না তো। এক ফ্রেন্ড এর বাসায় এসেছিলাম।”
জ্যোতি আর মৌরিন একসঙ্গেই সামনে হাটতে শুরু করে। জ্যোতি হাটতে হাটতেই বলে,
_”কি ডেঞ্জারাস গো এই রাস্তাটা! এই ভর দুপুরে কতগুলো ছেলে ওপেন প্লেস এ টিজ করছিলো আমায়।”
কিছুক্ষন চুপ থেকে জ্যোতি জিজ্ঞেস করে,
_”তুমিও তো ওদিক থেকেই এলে, দেখোনি?”
_”উম হু,খেয়াল করিনি।”
_”তোমায় কিছু বলেনি ওরা?”
মুচকি হাসে মৌরিন। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলে,
_”দিনের বেলায় কখনোই আমায় ইভটিজিং এর স্বিকার হতে হয়নি। যা দুয়েকবার হয়েছে, তা সন্ধ্যার পর। তবে আমি এগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবিনা।”
_”বাহ,বেশ সাহসী তো তুমি!”
একইভাবে হাসে মৌরিন,প্রতিত্তর করেনা। সে জানে সে সাহসী, নিজের প্রতিটা গুণ তার চেনা,জানা। অহংকার করা উচিৎ এই নিয়ে,তবে সেটা ভিতর থেকে আসেনা। হয়তো সেটাও একপ্রকার গুণের অন্তর্ভুক্ত।
_______
সন্ধ্যার পর নির্ঝর কে ফোন করে ইমেডিয়েটলি দেখা করতে বলেছে জ্যোতি। তার এত জরুরী কথা শোনার উদ্দেশ্যে নির্ঝর ও তড়িঘড়ি করে হাজির হয়েছে তার বাড়ির ছাঁদে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় জ্যোতি ছাঁদের রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
_”আমাকে এতো জলদি আসতে বলে নিজে হাওয়া খাচ্ছিস? সিরিয়াসলি? আমি ভাবলাম..”
_”কি ভাবলে? বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার?”
পাশ ফিরে কথাটা বলে জ্যোতি,তার মুখভঙ্গি গম্ভীর। নির্ঝর আরাম করে দাঁড়িয়ে বলে,
_”সেটা হলে তো ভালোই হতো। ছাড়,কেন ডেকেছিস সেটা বল। এমন কি কথা যে ফোনে বলা যাবেনা?”
_”বেশি ডিসটার্ব করলাম?”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় নির্ঝর,কিছুটা ধমকের সুরে বলে,
_”সিনেমার ডায়লগ দিবিনা একদম। কি বলবি বল।”
_”আমার বিয়ে করা উচিৎ তাইনা?”
নির্ঝর মজা করে বললো,
_”একদম,অনেকদিন বিয়ের দাওয়াত পাইনা।”
_”হুম, কিন্তু আমার বিয়ে খেতে চাইলে তোমায় অনেএএএক দূরে যেতে হবে।”
_”কেন?” (অবাক হয়ে বলে নির্ঝর)
_”কারণ আমি স্কলারশিপ নিয়ে ইটালি পড়তে যাচ্ছি। তো এদেশি ছেলে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা, সেখানেই একটা ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করে নেবো।”
গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো জ্যোতি। নির্ঝর কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
_”আসলেই?”
_”তো কি নকল?”
_”বিশ্বাস হচ্ছে না।”
সন্দেহজনকভাবে বললো নির্ঝর। জ্যোতি তাতে পাত্তা না দিয়ে বললো,
_”অভিনন্দন জানাও আমাকে।”
নির্ঝর বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে,
_”এটা তোর জরুরী কথা? এটা ফোনে বলা যেতো না? শুধুশুধু টাইম নষ্ট করলাম।”
অবাক হয় জ্যোতি, সে চলে যাবে জেনেও নির্ঝর কিছু বলছেনা? এটা মেনে নিতে কষ্ট হলো জ্যোতির। অন্যদিকে ঘুরে কেবল ক্ষীণ স্বরে বললো,
_”সরি।”
কথাটা বলেই নিচে চলে যায় জ্যোতি। নির্ঝর ও এবার কিঞ্চিত অবাক হয়, হয়েছে টা কি জ্যোতির? নিজে থেকে কিনা সরি বলছে! ঝগড়া না করে? স্ট্রেঞ্জ!..
______
তিন নম্বর চিরকুটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌরিন। পরপর দিনদিন সেই একই কমলা রঙের কালি দিয়ে চিরকুট লেখা হচ্ছে। আজকেও ব্যাগ এর নিচেই রাখা ছিলো। তাতে লেখা,
“মৌরিফুল,
মুখে বলার চেয়ে চিরকুট এর মাধ্যমে কথা বলার বিষয়টা কিন্তু মন্দ নয়। আদিকালের ভাইবস পাওয়া যাচ্ছে কিছুটা। এক্ষেত্রে কথাটা হচ্ছে একপাক্ষিক,হোক। তবে তোমার মুখে এতটুকু বিরক্তিভাব নেই কেন? ভালো লাগছে এই আগন্তুক এর থেকে চিরকুট পেতে? নাকি তুমি অনুভূতি শূন্য, কোনটা? উত্তরের প্রয়োজন নেই, তবে নিজের অনুভূতি জাগ্রত করো। হয় বিরক্ত হও, নাহয় মুচকি হাসো। আমি মনোবিজ্ঞানী তো নই, যে তোমার শান্ত মুখশ্রী দেখেই মনের কথা বুঝতে পেরে যাবো!
ইতি
প্রিয় অথবা অপ্রিয় আগন্তুক”
মুখভঙ্গি পরিবর্তন করলো না মৌরিন। আগের ন্যায় চিরকুট টা ভাজ করে মন দিলো নিজের কাজে। এই চিরকুটদাতা কে হয়তোবা আবারো হতাশ করলো মৌরিন। স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার পরও শান্ত রইলো মৌরিন, যেন সে অমন কিছু পড়েই নি!
#চলবে?
[কাল সকাল সকাল গল্প দিবো। গ্রামের বাড়ি যাবো তো, সেখানে নেটওয়ার্ক পাবো কিনা,আর সেই নেটওয়ার্ক এ গল্প পোস্ট করা সম্ভব হবে কিনা তাও বলতে পারছি না।
হ্যাপি রিডিং।]