#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ১২
ড্রয়িং রুমের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে এক নাগাড়ে পড়ে চলেছে মেহরুন। একেবারে নাকের ডগায় তার পরীক্ষা, তাই অনেকটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়তে হচ্ছে তাকে। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে নানান ঝামেলার কারণে ঠিক মতো পড়া হয়ে ওঠেনি তার। তাই আজকে ধরে বেঁধে পড়তে বসিয়েছে আদ্রিশ। আদ্রিশের কড়া নির্দেশ পড়া শেষ না হওয়া অবধি বই ছেড়ে ওঠা যাবে না। অরনীকে বলে গেছে খেয়াল রাখতে যেন পড়ায় ফাঁকি না দেয় মেহরুন।
আজ ছুটির দিন হওয়ায় বাসাতেই আছে আদ্রিশ। ফ্রেশ হয়ে মেহরুনের পাশে এসে বসল সে। যেখানে যেখানে মেহরুনের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল সে জায়গা গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিল আদ্রিশ। এখন সময় কলিংবেলের আওয়াজে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটে মেহরুনের। বিরক্তিতে তাই চোখ মুখ কুচকে ফেলে সে। এমনিতেও পড়তে বসতে চায় না, তবে একবার পড়তে বসার পর যদি ডিস্টার্ব হয় তাহলে আর পড়ায় মন বসে না তার। আদ্রিশ মেহরুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে উদ্যত হয় মেইন গেট খুলতে যাওয়ার জন্য।
দরজা খুলতেই জারাকে এই অসময়ে দেখতে পেয়ে মেজাজ বিগড়ে যায় আদ্রিশের। হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে জারা। ‘এই মেয়েটার কি বিন্দু মাত্রও লজ্জা শরম নেই না নাকি! আদ্রিশ যেভাবে সেদিন জারাকে থাপ্পড় মেরেছিল সেইসাথে আচ্ছা মতো অপমান করার সত্ত্বেও এই মেয়ে এবার তার বাড়িতে এসেই হাজির! সকাল সকাল এই অনামুখোটার মুখ দেখতে হলো, আজকের দিনটাই খারাপ যাবে তার!’ এসব ভেবে আদ্রিশের রাগ হয় ভীষন। আদ্রিশকে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গা জ্বালানি হাসি দিয়ে জারা বলল
-‘ আমাকে এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভেতরে আসতে বলবেন না, ভাইয়া?
জারাকে দেখে আদ্রিশের গা জ্বলে ওঠে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল
-‘ তুমি এখানে কেন এসেছো?
জারা কুটিল হেসে বলল
-‘ কেন আমি আসতে পারি না বুঝি? হাজার হোক আমার বোনের শশুর বাড়ি বলে কথা।
আদ্রিশ কণ্ঠটাকে কিছুটা খাদের নামিয়ে বলল
-‘ আমার হাতের স্পেশাল থাপ্পড় খাওয়ার আবার শখ হয়েছে বুঝি?
জারা হেসে ওঠে। ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলল
-‘ কি যে বলেন না ভাইয়া? এভাবে কি কেউ বলে নাকি, লজ্জা পেলাম তো?
আদ্রিশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই মেয়েটা এতো বেহায়া! আদ্রিশ বেশ বুঝতে পারছে জারা এখানে তাকে হেনস্তা করতেই এসেছে। এসব বেহায়া মেয়েদের সাথে কথা বলার বিন্দু মাত্র কোনো ইন্টারেস্ট নেই তার। তাই সে চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে উঁকি দেয় মেহরুন।
এদিকে আদ্রিশকে সরতে না দেখে কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিলেই জারার হাত ধরে ফেলে আদ্রিশ। জারা খুশি হয় এই ভেবে যে আদ্রিশ হয়তো তাকে মেনে নিয়েছে। পেছন ফিরে তাই আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল সে। আদ্রিশ তা দেখে বাঁকা হাসে।
হাত ধরে টেনে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দিতে যাবে এমন সময় আদ্রিশকে থামতে বলে মেহরুন। ইশারায় ওদের ভেতরে আসতে বলে আবারও বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সে।
মেহরুনের দিকে আদ্রিশ এক পলক তাকিয়ে হির হির করে টানতে টানতে নিয়ে এসে মেহরুনের পায়ের সামনে ফেলে জারাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠে জারা। বেসামাল হয়ে তাই মেহরুনের পায়ে কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে সে। বই হতে মুখ তুলে পায়ের কাছে জারাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয় মেহরুন। ভ্রু কুচকে আদ্রিশের দিকে তাকায় সে। কিছু বলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ করে হু হু করে কেঁদে ওঠে জারা। মেহরুনের হাত দুটো আকড়ে ধরে করুণ কন্ঠে বলল
-‘ আমি এখানে এমনি এমনি আসিনি রে। তোর কাছে বিচার চাইতে এসেছি, আপু।
জারার কথা শুনে মেহরুনের কপালে ভাঁজ পড়ে। ভ্রু কুচকে বলল
-‘ কিসের বিচার, কার বিচার? আমায় দেখলে কি তোর বিচারক বলে মনে হচ্ছে? ল নিয়ে পড়িনি আমি যে বিচার চাইতে আসবি। আমি রীতিমতো একজন রসায়নের ছাত্রী।
চোখ মুখ মুছে নিয়ে জারা হালকা হেসে বলল
-‘ তা তো জানি তবে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার বিচার চাইতে এসেছি এখানে। আদ্রিশ ভাইয়া আমার সাথে…
কথাটা শেষ করার পূর্বেই মুখে ওড়না চেপে কেঁদে ওঠে জারা। মেহরুন জারার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আদ্রিশের দিকে তাকায়। আদ্রিশ কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল মেহরুন। জারার দিকে ফিরে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল মেহরুন
-‘ তোর সাথে কি করেছে আদ্রিশ?
মেহরুনের মুখে এই প্রথম নিজের নাম শুনে ভালো লাগার পরিবর্তে ভয় হচ্ছে আদ্রিশের। জারার প্ররোচনায় পড়ে শেষমেশ তাকে ভুল বুঝে না বসে মেহরুন।
জারা ছলছল চোখে মেহরুনকে বলল
-‘ আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে খুব বাজে ভাবে স্পর্শ…
এতোটুকু বলে থামল জারা। মেহরুন অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকায় আদ্রিশের দিকে। আদ্রিশকে ঘিরে সবেমাত্র সূক্ষ্ম অনুভূতিরা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল তবে এই একটা কথাই যেন সব ভেঙে চুরমার করে দিল। মেহরুনের চোখে অশ্রুকণারা এসে ভীর জমায়।
আদ্রিশ চিৎকার করে বলে উঠল
-‘ ঐ মিথ্যাবাদীর কথা বিশ্বাস করো না মেহরুন। ও যা বলছে সব মিথ্যে।
মেহরুন উঠে এগিয়ে যায় আদ্রিশের কাছে। ছলছল চোখে তাকিয়ে কণ্ঠে খানিকটা বিষাদ ঢেলে বলল
-‘ আপনার সাথে আমায় জড়িয়ে যখন মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিল তখন কি আপনি কোনো প্রতিবাদ করেছিলেন? ঠিকই তো মুখ বুজে সবটা মেনে নিয়ে আপনার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন আমায়। এখন আমার জীবনটাকে নষ্ট করেও ক্ষ্যান্ত হননি, তাই আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্টের খেলায় মেতে উঠেছেন। আপনাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিল আপনি একজন উত্তম ব্যক্তিত্বের মানুষ। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনার আসল রূপটা বেড়িয়ে এলো। ছিহ্ লজ্জা করল না আপনার ঐটুকু একটা মেয়ের সাথে…
এতটুকু বলে থামল মেহরুন। চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু কণারা ঝরে পড়ছে তার। আদ্রিশ মেহরুনের দু বাহু চেপে ধরে। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আদ্রিশ হতে মেহরুন। আহত হয় আদ্রিশ। যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই তবে সত্যি হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-‘ সবকিছুর মূলে ঐ মেয়েটা। ও-ই তো সব ষড়যন্ত্রের মূল…
আদ্রিশকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে জারা মাঝখান থেকে ফোঁড়ন কেটে বলে উঠল
-‘ ওনার কথা শুনিস না আপু। আদ্রিশ ভাইয়ার প্রথম থেকেই আমার উপর নজর ছিল। আমাদের মাঝে একটা সম্পর্কও ছিল, জানিস। কিন্তু উনি হঠাৎ করে তোকে বিয়ে করে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। তারপর কাল বিকেলে আমার কাছে এসে আমাকে সরি বলে নানান ভাবে ব্ল্যাকমেইল করে আমার সব কেড়ে নেয়। তাই তো আর উপায় না পেয়ে এখানে ছুটে আসা। এবার তুই বল কি করা উচিত এখন আমার?
কথাটা বলেই পুনরায় কেঁদে ওঠে জারা। মেহরুন স্তব্ধ হয়ে যায়। আদ্রিশ এতোটা নিচ! ছিহ্। ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে তার। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে মেহরুন। যেন পাথর হয়ে গেছে সে। আদ্রিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এখন বুঝিয়েও লাভ নেই। তবে এখন এসেছে সেই সময়টা। আজকেই সবকিছুর অবসান ঘটাতে হবে তাকে। এই ভেবেই ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে চলে যায় সে।
আদ্রিশ নেই, অরনীরও দেখা নেই, এখনই তো মোক্ষম সুযোগ! জারাকে আর পায় কে। মেহরুনের কাছে এসে নানান ভাবে আদ্রিশের নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে কান ভাঙানি দিতে থাকে। জারার একটা কথাও মেহরুনের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছায় না। ঠায় বসে থাকে সেখানে। পাথুরে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আদ্রিশের যাওয়ার পানে। তার জীবনটা এমন দূর্বিষহ না হলেও তো পারত! আদ্রিশ এতোটা নিকৃষ্ট কিভাবে হতে পারল! ভেবে পায় না মেহরুন।
বাগানের দিকটায় এসে বুক ভরে শ্বাস নেয় আদ্রিশ। যত্নে গড়ে ওঠা গোলাপ, বেলি, জুঁই, জবা, পাসকালি আরও হরেক রকমের ফুল ফুটে আছে। অরনীর বড় বাগানের শখ! এই ফুলগুলো সে-ই লাগিয়েছে নিজ হাতে। অরনীর মন খারাপ থাকলে এই বাগানটাতে এসে সময় কাটায়।
আদ্রিশ এসব ভাবা বাদ দিয়ে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করল। ফোন রিসিভ হতেই অপর পাশের ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে বলল
-‘ সব রেডি তো? যা করার এখনই করতে হবে আমাদের। সময় বেশি নেই হাতে।
অপার পাশ হতে ব্যক্তিটি কিছু বলে উঠে। কথাটা শুনে হেসে ফেলে আদ্রিশ। হাসতে হাসতে বলল
-‘ গুড জব ইয়ার!
আদ্রিশের মুখে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। চুল ঠিক করতে করতে মনে মনে বলল, ‘ তুমি নিশ্চয়ই আমার চাইতে বেশি বুদ্ধিমান নও। তবে আমায় ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই না নিজের জালে জড়িয়ে পড়ো।’
#চলবে ~
অসুস্থতার জন্য গতকাল গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। দোয়া করবেন আমার জন্য সবাই।
আজকের পর্বটা হয়তো কিছুটা এলোমেলো হতে পারে। তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
পরিশেষে হ্যাপি রিডিং~