আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি #নুসাইবা_জান্নাত_আরহা #পর্ব ১৩ [সত্য উন্মোচন (১)]

0
388

#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ১৩ [সত্য উন্মোচন (১)]

ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকা মানুষজন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে আদ্রিশের দিকে। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে আদ্রিশ। আদ্রিশের চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনে কি চলছে এ মুহুর্তে। জারার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক! এতো যেন মেঘ না চাইতেই জল!

একটু আগে, মেহনত আকবর, লাবিবা রহমান, আলভি, নাজিয়া সুলতানাকে ডেকে এনেছে আদ্রিশ। লাবিবা রহমান আসতে চাননি। তার শরীরটা বড় খারাপ। মেহনত আকবরের জোরাজোরিতে আসতে হলো তাকে। মেহরুনকে দেখে বুকটা ধপ করে ওঠে তার। কতোদিন পর মেয়েটাকে দেখলেন তিনি! কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না, কোথায় যেন একটা বাঁধা কাজ করছে তার। সোফায় মাথাটা এলিয়ে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে রইলেন তিনি। পাশেই বসে রয়েছেন মেহনত আকবর। তিনি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন হয়তো।

নাজিয়া সুলতানা এদিক ওদিক ফিরে ফিরে দেখছেন বাড়িটা। তিনি এর আগে কখনো আসেননি এ বাড়িতে। জারা এসেছিল একবার আলভির সাথে। তখন মেয়ের কাছে থেকে যতটুকু বিবরন শুনেছিলেন এ বাড়ি সম্মন্ধে। তখন থেকেই মা মেয়ের লোভ! জারাকে দেখে মুচকি হাসেন তিনি। মনে মনে বললেন, ‘ আমার মেয়ে বলে কথা, বুদ্ধি তো আমার মতোনই হবে। সাব্বাশ মেয়ে, এই না হলে আমার মেয়ে! এই প্রথম কাজের কাজ করেছে মেয়েটা। এ বুদ্ধি তো আমার মাথাতেও খেলেনি। সত্যিই ওর বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়!’

মেহরুন এখনো ঠিক তার আগের জায়গায় ঠায় বসে রয়েছে। তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। মেহরুনকে এমতাবস্থায় দেখে ছুটে যায় তার কাছে আলভি।

গালে এক হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বলল,

কি হয়েছে মেহু? এমন অবস্থা কেন তোর? কি হলো বল আমায়।

কিন্তু মেহরুন হতে কোনো উত্তর মেলে না। চুপচাপ বসে থাকে সে। আলভি চিন্তিত হয়ে পড়ে। আদ্রিশের দিকে কটমট করে তাকাল আলভি। তা দেখে বিনিময়ে শুধু সূক্ষ্ম হাসল আদ্রিশ।

আদ্রিশ ঠিক কি করতে চাইছে তা এখনো বোধগম্য হয়নি জারার। তবে ওদের ডাকাতে জারার একটু সুবিধেই হলো বোধ হয়। সবার সামনে এখন ন্যাকা কান্নার অভিনয় করে আদ্রিশকে ফাঁসাতে সুবিধে করে দিল আদ্রিশ নিজেই। এজন্যই তো খুশিতে আত্মহারা হচ্ছে সে। মনে মনে সে বলল, ‘আদ্রিশ এতোটা বোকা! নিজের পায়ে নিজে কি কেউ কুড়াল মারে কখনো?’ ভেবেই ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার। ধুর্ত আদ্রিশের চেয়ে এখন নিজেকেই বেশি চালাক মনে হচ্ছে তার! আহা তার নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজেই করল সে।

মায়ের কাছে গিয়ে ন্যাকা কান্না শুরু করে দেয় জারা। কান্নার সূরে বলল

-‘ মা, আদ্রিশ ভাইয়া আমার এ কি সর্বনাশ করল। এখন আমার কি হবে মা? আমার যে আর মরা উপায় নেই।

কথাটা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। জারার কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকাল আদ্রিশের দিকে। আলভি রেগে যায় প্রচন্ড। এমনিতেই তার বোনকে মিথ্যে অপবাদে ফাসানো হয়েছে তার উপর আবার এসব কান্ড। মুহুর্তেই শরীর জ্বলে ওঠে আলভির। গটগট পায়ের আদ্রিশের দিকে এগিয়ে চড় বসাতে গেলেই ধরে ফেলে আলভির হাত। মুখে কুটিল হাসি ফুটিয়ে ভ্রু নাচিয়ে আদ্রিশ বলল

-‘ না না, শালাবাবু। ওটি তো হবে না। শালা হয়ে দুলাভাইয়ের গায়ে হাত তুলছো? তোর সাহস তো কম নয় শালাবাবু।

আলভি গর্জে ওঠে। আলভির কাঁধ চাপড়ে আদ্রিশ চিল মুডে বলল

-‘ আর একটু অপেক্ষা কর ব্যাটার শালা। তারপর সব বলছি রে শালা। আগে তো ধৈর্য ধর শালা। এতো ধৈর্যহারা হলে কি চলে রে শালা।

আলভি কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বে বাড়িতে দুজন লোক প্রবেশ করে। তাদের দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে আদ্রিশের। চোখের ইশারায় কিছু বলে ওদের। ওরা মাথায় নাড়ে শুধু।

মেহরুনের পাশে এসে মেঝেতে বসে পড়ল আদ্রিশ। তা দেখে মেহরুন সরতে নিলেই তার কোমড় চেপে ধরে আদ্রিশ। ছোটাছুটি করতে দেখে মেহরুনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল

-‘ ছোটাছুটি করে লাভ নেই, ছাড়ছি না তোমায়। ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ করে বসে থাকলে তোমার কোমড় ছেড়ে দিব আমি, নইলে কিন্তু ছাড়ব না।

উপায় না পেয়ে তাই মেহরুন বাধ্য মেয়ের মতো শান্ত হয়ে যায়। তা দেখে সূক্ষ্ম হেসে মেহরুনকে চোখ চিপ দেয় আদ্রিশ। মেহরুন চোখ সরিয়ে নেয়।

আদ্রিশ সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল

-‘ হ্যাঁ, আমি অপরাধী। মেহরুনের সাথে আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার।

সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। জারা কথা থামাতে চাইলে মেহনত আকবর জারাকে চোখের ইশারায় থামতে বললেন। থেমে যায় জারা।

আদ্রিশ শুরু থেকে বলতে শুরু করল

-‘ আলভির খুব কাছের বন্ধু হওয়ার দরুন মেহরুন আমার সাথে আগের থেকেই টুকটাক কথা বলত। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটেছিল ফারজানা আপুর বিয়ের রাতে। ঘটনা মূলত ওখান থেকেই শুরু। ছাদে দাঁড়িয়ে আমরা ফারজানা আপুর বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিলাম এমন সময় জারা এসেছিল। সেদিন ওর হাবভাব আমার কাছে তেমন ঠিক লাগেনি। আমাদের কথা বলাকে কেন্দ্র করে বাজে মন্তব্য করায় মেহরুন জারাকে ধমক দেয়। ব্যাপারটা হজম হয় না জারার। সে যে মনে মনে মেহরুনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল তা আমি ঢের বুঝতে পেরেছিলাম। জারা তখন লাবিবা আন্টির কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা অপবাদ দেয় মেহরুনের নামে। আন্টি তখন মেহরুনকে গিয়ে বকাঝকা করে। মেহরুন যখন আমাকে এ কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখন দুটো ছায়ামানব নজরে আসে আমার। তারা যে আমাদের উপর নজর রাখছিল তা বুঝেছিলাম তখনই।

আদ্রিশকে আলভি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল

-‘ ছায়া দুটো কাদের ছিল?

আদ্রিশ জারা এবং লাবিবা রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল

-‘ জারা আর লাবিবা আন্টি।

লাবিবা রহমান চকিত তাকালেন। বলে উঠলেন

-‘ জারা বলেছিল, তোমাদের মধ্যে নাকি অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। সেই রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে তোমরা নাকি কিসব বলছিলে, জারাকে দেখে তোমরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলে। জারা তো আমাকে এমনটাই বলেছিল। তখন আমি মেহরুনকে গিয়ে বলি তোমার সাথে যেন ও আর কথা না বলে। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও জারা আমায় টেনে নিয়ে যায় তোমার রুমের সামনে, তখনই চোখে পড়ল তুমি আর মেহরুন একসাথে দাঁড়িয়ে কিসব যেন বলছিলে। আমি নিজে দেখেছি। নিজের চোখকে কিভাবে অবিশ্বাস করতে পারি?

আদ্রিশ হেসে বলল

-‘ আপনাকে সবটাই মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী শুনিয়েছিল আন্টি। আদোতে আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্কই ছিল না। আমরা সেদিন ফারজানা আপু বিয়ের আলোচনা করছিলাম, ব্যাস এতোটুকুই আর কিছুই না।

লাবিবা রহমান অবাক হয়ে বললেন

-‘ তাহলে তুমি আগে এসব বলোনি কেন?

-‘ আগে বললেও আপনারা বিশ্বাস করতেন? নিজেরাই তো মিথ্যে দোষারোপ করলেন। আমার কাছে তখন কোনো প্রমাণও ছিল না যে জোড় গলায় কোনো কথা বলব।

মেহরুন এতোক্ষণ চুপ থাকলেও, এবার মুখ খুলল। বাজখাঁই গলায় বলল

-‘ ভালো সাজার নাটক করছেন আপনি? সব দোষ এখন ওদের। আপনার কোনো দোষ নেই? তাহলে সেদিন সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিলেন কেন আমায়? চাচি যখন আপনাকে আমাকে নিয়ে মিথ্যে বানোয়াট ছবি দেখালো তখন চুপ ছিলেন কেন? কিছু না করেও কেন আমার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে আমি কলঙ্কিত, এমন মিথ্যে অপবাদ শুনতে হলো? কি হলো চুপ করে আছেন কেন, উত্তর দিন।

এতোটুকু বলে থামল মেহরুন। তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গরিয়ে পড়ল।

আদ্রিশ কিছুটা দম নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল

-‘ সেই রাতে আমি জারার কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আমি ওর সব পরিকল্পনা জেনে ফেলেছি। জারা হকচকিয়ে ওঠে। আদৌও আমি ওর প্ল্যান সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। তখন ওর থেকে সব জানতে ওর হাতে হাত মিলানোর ভান করি। ওর প্ল্যান ছিল মেহরুনের চরিত্রে কলঙ্ক লাগানো, আর চিরদিনের জন্য বাড়ি থেকে তাড়ানো। এমনকি লোক ভাড়া করে মেহরুনকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিল জারা। যাতে করে মেহরুনের এমন কুকৃতির কথা শুনে ওর পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে। আঙ্কেল হার্টের রোগী উনি মেয়ের এমন কথা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়বেন সেইসাথে আন্টিও আর আলভি বোনের জন্য উন্মাদ হয়ে পড়বে। তখন সম্পদ তো সব জারার হবে। আমি যদি তখন সব বলে দিতাম তাহলে কেউ তো বিশ্বাস করতেনই না উল্টে হিতে বিপরীত হতো। জারা অন্য প্ল্যান করত, আর মেহরুন বিপদে পড়ত। আমি এজন্য সেদিন চুপ ছিলাম।

এতোটুকু বলে থামল আদ্রিশ। মেহরুন ছলছল চোখে ভাঙা গলায় বলল

-‘ সেদিন চুপ থেকে আমার অনেক বড় উপকার করেছেন আপনি। আমার দিকে কিন্তু ঠিকই আঙুল উঠেছিল। কোনো পাপ না করেও পাপের বোঝা বইতে হয়েছে সেইসাথে কটুক্তি তো রয়েছেই।

আদ্রিশ অনুতপ্ত। মেহরুন সেদিন যতটা না কষ্ট পেয়েছে ঠিক ততটা কষ্ট সে নিজেও পেয়েছে। এর পিছনে কারণ তো একটাই।

আদ্রিশ ধরা গলায় বলল

#চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here