#আমার_বাহুডোরে_আবদ্ধ_তুমি
#নুসাইবা_জান্নাত_আরহা
#পর্ব ১৯
একজোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে পেছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে অরনীর। চমকে ওঠে অরনী। মুখ ফুটে কোনো আওয়াজ বের হওয়ার পূর্বেই আগন্তুকটি এক হাতে মুখ চেপে ধরে অরনীর। আগন্তুকটির স্পর্শে জমে বরফ হয়ে যায় যেন অরনী। শিরদাঁড়া বেয়ে তার শীতল স্রোত বয়ে যায়। অজানা শিহরণে তার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে যেন। মানুষটির স্পর্শ যেন তার কত বছরের পূর্ব পরিচিত!
অরনীর কাঁধে ঠোঁট ছুইয়ে ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে ভেসে আসে ‘অরনী’ শব্দটা।
বহুদিন পর চিরপরিচিত এই কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে ঠেকতেই সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় অরনীর। সে নিজের কর্ণকেও বিশ্বাস করতে পারছে না এ মুহুর্তে। অরনীর অবস্থা বুঝতে মুচকি হাসে মানুষটা। অরনীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে চিবুক উঁচু করে ধরে। অরনী পূর্ণ দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় সামনে থাকা মানুষটির দিকে। অস্ফুটস্বরে মুখ হতে শুধু বেরিয়ে এলো, ‘ ‘আরাভ’ তুমি এখানে?
অরনীর প্রতি মানুষটির দৃষ্টি গভীর। তা দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় অরনী। মনের মাঝে ঝড় তুফান বয়ে যাচ্ছে তবে সে তা মুখভঙ্গিতে প্রকাশ করে না। ঝাপসা চোখে মানুষটিকে আরেকবার দেখে নেয় অরনী। চোখে অভিমানি অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমিয়েছে ইতোমধ্যে। ‘কত কাল পর চিরচেনা সেই মানুষটির মুখখানা নজরে এলো তার। আগের মতোই আছে সে। এখনও সেই প্রশস্ত হাসির মায়ায় বারবার জড়িয়ে যায় সে। সবেমাত্র কৈশরে পদার্পণ করেছিল, তখন থেকে এই মানুষটাকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবেসেছিল সে। আরাভ অরনীর কাছে এ জায়গাটা অপরিচিত নয়। আরাভের সাথে অরনী কত ঘুরতে এসেছে ‘নদীর পাড়ে’। সেসব দিন তো কবেই চুকেছে। তারপর আর কখনো আসা হয়নি আর।’ অরনীর সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল এমন সময় আরাভের ডাকে ভাবনার জগৎ হতে বেরিয়ে আসে সে।
অরনীর থুতনিতে আলতো হাত ছুইয়ে আরাভ বলল
-‘ বলেছিলাম না, চাকরি পেলে তবেই তোমার সামনে আসব। আজ এসেছে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। আমি চাকরি পেয়েছি, অরনী।
আজ যেন আরাভের চোখে মুখে উপচে পড়ছে খুশির ঝিলিক! অরনীর মুখেও ইতোমধ্যে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। অবশেষে শত প্রতিক্ষার অবসান ঘটল তবে। মানুষটা তার আপন হতে চলেছে! এতোদিনের দীর্ঘশ্বাস, কান্না, প্রতিক্ষা সব আজ যেন খুশিতে পরিণত হয়েছে।
অরনীর নয়ন হতে দুফোটা অশ্রু ঝরে। সযত্নে তা মুছে দিয়ে আরাভ বলল
-‘ কাঁদছো কেন পাগলী? তোমার কান্নার দিনের অবসান ঘটেছে। বউ নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরব।
অরনী ঠোঁট কামড়ে হাসল। খুশিতে তার চোখ হতে অশ্রু ঝরেছে। মনের মাঝে যেন আনন্দেরা দানা বেঁধে উড়ে চলেছে! আরাভকে দেখে অতি আবেগী হয়ে পড়ে অরনী। কোনো দিকে না তাকিয়ে তাই অরনী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরাভকে। আরাভও পরম যত্নে আগলে নেয় অরনীকে। এতোদিনের সব আবেগ যেন উপচে পড়ছে তার। তাই তো আজ আনন্দে যেন বাকহারা হয়ে পড়েছে সে! আরাভ অরনীকে ফিসফিসিয়ে বলল
-‘ এভাবেই আমার বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখো, অরনী। তোমার ছোয়া পেলে আমি যেন একরাশ শীতলতা অনুভব করি প্রিয়।
অরনী কিছু বলে না। বিনিময়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরাভকে। আরাভ মুচকি হাসে। মেয়েটা তাকে শুরু থেকে ভালোবেসেছে। যাকে সে শূন্য পকেটেও পাশে পেয়েছিল আর আজ যখন সব কানায় কানায় পরিপূর্ণ তখন সেই রমনীকেই তো তার রানী বানানো চাই। এই ভেবে অরনীর মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় আরাভ। হৃদ মাঝারে যেন আবারও পুরনো প্রণয়ের হাওয়া দোলা দেয় তাদের।
হঠাৎ কারো গলার কাখারিতে ভাবনার সুঁতো ছিড়ল তাদের। আরাভ অরনী দুজনেই ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
আদ্রিশ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বলল
-‘ সরি, সরি। আমি কিচ্ছু দেখিনি। আমি তবে চলি।Please continue again…
আদ্রিশের এমন কথায় ভীষণ লজ্জা পায় অরনী। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে ফেলে। এতোদিন পর আরাভের দেখা, অরনী তাই নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি।
আদ্রিশকে দেখে আরাভ ডাক দেয়। থেমে যায় আদ্রিশ। আরাভ এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করে নেয়। আদ্রিশ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
-‘ আপনি কখন এলেন, ভাই?
-‘ এই তো কিছুক্ষণ আগেই। তা বল, কি খবর তোমার? শুনেছি নতুন বিয়ে করেছো, তো বউকে তো একবারও দেখালে না।
আরাভ কথাটা হেসে বললেও শেষোক্ত কথাটায় কিছুটা অভিমানের আঁচ পাওয়া যায়।
আদ্রিশ এক হাতে মাথা চুলকে নেয়। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে তাচ্ছিল্য ভঙিতে বলল
-‘ সবটা এতো দ্রুত হয়ে ছিল যে বলার মতো সময় হয়ে ওঠেনি।
-‘ তাই বলে বড় ভাইকে জানানোরও প্রয়োজন মনে হয়নি।
অভিমানি সুরে আরাভ বলল কথাটা। আদ্রিশ মাথা নিচু করে ফেলে। কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না এ মুহুর্তে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে।
অরনী এবার কিছুটা রাগ নিয়ে আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বলল
-‘ মেহরুনকে ফেলে তুই এখানে কেন এসেছিস? যা নিজের বউয়ের কাছে যা।
-‘ বউ পেয়ে বোনকে ভুলে যাইনি আমি। কোথাও তোর দেখা না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পড়েছিলাম। যদি জানতাম তুই এখানে আরাভ ভাইয়ের সাথে তাহলে আমি কখনোই আসতাম না।
কথাটা বলেই গটগট পায়ে চলে যায় আদ্রিশ। অরনী কয়েকবার ডাকে কিন্তু আদ্রিশ আর পিছনে ফিরে তাকায় না। অরনী বুঝতে পারে, অরনীর এমন কথায় আদ্রিশের মনে অভিমান জমেছে। ছেলেটা বরাবরই এমন! এতো অভিমানিও হয় ছেলে মানুষ! ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অরনী।
এদিকে রিশতা আর আলভির বেশ ভাব জমে উঠেছে। ফুরফুরে বাতাসে চুল উড়ছে রিশতার। বিরক্ত হয়ে তাই চুল খোপা করে নেয় সে। আলভি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে রিশতার দিকে। মেয়েটা সত্যিই চমৎকার! রিশতার দিকে আলভিকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে রিশতা জিজ্ঞেস করল
-‘ আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছো?
আলভি রিশতার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল
-‘ তুমি সুন্দরী তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?
রিশতা হেসে ফেলে। আলভি তবুও এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রিশতার দিকে। এবার কিছুটা লজ্জারা এসে হানা দেয় রিশতাকে ফলে সে চোখ নামিয়ে নেয়। মুখে ফুটে ওঠে লাজুকতা। দু’হাতে মুখ গুজে অন্যত্র চলে যায় রিশতা।
আলভি এক হাতে মাথা চুলকে হেসে ওঠে। মেয়েটাকে মনে ধরেছে তার। আচ্ছা আলভির মতো কি রিশতাও ভালোবাসে তাকে?
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মেহরুনের পাশে এসে দাঁড়ায় আদ্রিশ। সবার জীবনেই ভালোবাসার রঙে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। এতো পরিপূর্ণতার মাঝে নিজেকে কেমন শূন্য শূন্য মনে হয় তার! অথচ তার জীবনটাও তো রঙিন হতে পারত অন্যান্যদের মতো! এতো বেরঙিন হলো কেন তার জীবনটা! তবে কি কারো কারো ক্ষেত্রে ভালোবাসাটা পাপ, যন্ত্রণা ছাড়া কি আর কিছুই নয়। প্রতিনিয়ত প্রণয়ের দহনে পুড়ে ছারখার হতে হচ্ছে তাকে। পাশে থেকেও ভালোবাসার মানুষটা বুঝতে পারছেনা তার মনের অবস্থা। প্রতিনিয়ত অন্তর্দহনে দগ্ধ হচ্ছে। এ অন্তর্দহন নিভবে কবে। মেহরুন কি আদৌও বুঝতে পারবে তাকে?
মেহরুনের কাঁধে হাত রেখে ধরা গলায় আদ্রিশ বলল
-‘ পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছো, মেহরুন?
ফিরে তাকায় মেহরুন। নাক টানলো কয়েকবার। তারপর আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল মেহরুন।
আদ্রিশের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে চাপা আর্তনাদ। এদিকে তার হৃদয় পুড়ে ছারখার, আর মেহরুন তার কাছে থেকেও টের পাচ্ছে না। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহরুনের মুখ চেয়ে আদ্রিশ। দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, সব থাকতেও শূন্যতা তাকে গ্রাস করে ফেলছে যেন। সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলেও আদ্রিশ মেহরুনের ভালোবাসাটা হয়তো এমন বিষাদের আড়ালেই রয়ে যাবে!
মেহরুনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাপা সুরে আদ্রিশ বলল
-‘ আমায় আর কবে বুঝবে, মেহরুন? তোমার আমার ভালোবাসার অংকটা কি তবে অসংজ্ঞায়িতই রয়ে যাবে চিরকাল?
#চলবে ~