#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ০৩
[অতীত]
বাড়ি ফিরেই ড্রয়িং রুমে নিজের বাবাকে ম্যাগাজিন হাতে বসে থাকতে দেখতে পায় স্রোত।বাবাকে না দেখার ভান করে নিজের রুমে চলে যায় স্রোত। সিরাজ সাহেব করুণ দৃষ্টিতে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।স্রোত ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে পড়া কমপ্লিট করতে বসে যায়।পড়াশোনায় সে অনেক ভালো।সামনে এতো বড় পরীক্ষা, তারপর তার নামের পাশে ডাক্তার শব্দটা যোগ হবে।তার মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবে।মা পৃথিবীতে নেই তো কি হয়েছে সে মনে করে তার মা সবসময় তার পাশে আছে,তাকে আর মান্ধবীকে দেখছে।পাশ তাকে করতেই হবে।
রাত দশটা।মান্ধবী খাবার নিয়ে স্রোতের রুমে এসে দেখে মায়ের ছবির সামনে গিয়ে স্রোত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“মায়ের কথা মনে পড়ছে আপু?”
“কেনো তোর মনে পড়ে না?” মান্ধবীর কথার জবাব দেয় স্রোত।
“তাতো পড়েই,কিন্তু সয়ে গেছে রে আপু।তবে আমি মনে করি মা আমার পাশেই আছে,আমাকে ঘুম থেকে উঠার জন্য ডেকে দেয়, খেতে না চাইলে জোর করা,পড়ার সময় পাশে বসে থাকা,রাতে ঘুমিয়ে গেলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া,শরীরের উপর কাঁথা দিয়ে লাইট অফ করে দেওয়া সব যেনো মা-ই করে ঠিক আগে যেমনটা করতো।” ধরা গলায় কথাগুলি বলতে বলতে মান্ধবীর চোখ দিয়ে পানি চলে আসে।
স্রোত হাত বাড়িয়ে আগলে নেয় বোনকে আর বলে,
“কান্না করিস না, মা কষ্ট পাবে”
“মা কেনো আমাদের ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো আপু?আমরা কি খুব খারাপ?”
খারাপ শব্দটা শুনতেই স্রোতের তার বাবার কথা মাথায় আসে।বোনকে ছেড়ে দূরে সরে যায় আর ক্ষুব্ধ হয়ে কিছুটা চেঁচিয়েই বলে,
“হ্যা খারাপ,আমরা খুুব খারাপ,আমাদের রক্ত খারাপ।তার জন্যই মা চলে গেছে।”
মান্ধবী বুঝলো স্রোত কথাগুলো বলে তার বাবাকে বুঝিয়েছে।এখন বাবা যতই পরিবর্তন হোক,সত্যি তো এটাই বাবা মাকে প্রচুর কষ্ট দিয়েছে,প্রচুর।হঠাৎ মান্ধবী দেখলো সিরাজ সাহেব দরজার সামনে ছলছল চোখে দাড়িয়ে আছেন।সে দেখতেই সিরাজ সাহেব আড়াল হয়ে গেলেন।
কথা ঘুরাতে মান্ধবী বললো,
“আপু খেয়ে নে। সামনে তোর পরীক্ষা। এতো অনিয়ম করলে মায়ের স্বপ্ন পূরণ হবে না।আমি যাই আমার কালকে প্রেজেন্টেশন আছে।”
মান্ধবী চলে গেলে স্রোত বারান্দায় চলে যায়।
তিনতালায় স্রোতদের ফ্ল্যাট। এই বারান্দাটা ওর অনেক পছন্দের।এখান থেকে অনেক সুন্দর করে চাঁদ দেখা যায়,চাঁদের সাথে কথা বলা যায়,চাঁদ থেকে অনেক দূরে একটা তারা আছে,সবসময় এখানেই থাকে একা একা।স্রোতের মনে হয় এই তারাটা ওর মা,প্রতিদিনই নিয়ম করে কথা বলে সে।
বিকাল ৫ টায় সব কাজ শেষ করে বনলতা বেগমকে দেখতে আসে স্রোত।কেবিনের সামনে এসে দেখে ভেতরে অনেক মানুষ। তাই সে নক্ করে,
“আসবো আন্টি? ”
কেবিনে উপস্থিত প্রতিটা ব্যক্তির নজর এখন দরজার দিকে দাড়ানো মেয়েটির দিকে।
বনলতা অভিমানী কন্ঠে বললেন,
“এতোক্ষণে আসার সময় হলো তোমার?আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না,আমি অচেনা মানুষ,আমাকে বুঝি ভুলেই গেছো”
স্রোত জায়গাভেদে বিভিন্নরকম সত্ত্বার অধিকারি।এক দিনের পরিচয়ে কেউ তার সাথে অভিমানী কন্ঠে কথা বলছে দেখে যেনো অবাকই হলো।যদিও সে প্রথমদিনই বুঝেছিলো বনলতা অনেক মিশুক প্রকৃতির মানুষ।কতটা মায়া তার চোখে মুখে। সে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আন্টি অনেকগুলা স্যরি,এই দেখুন কানে ধরলাম।কি করবো বলুন, আপনাকে তো কালকে সবই বললাম,প্রচুর প্রেশার যাচ্ছে।এসব বাদ দিন, এখন কেমন আছেন সেটা বলুন।”
বনলতা হেসে বললেন,
“ভালো ছিলাম এখন তুমি এসে যাওয়ায় আরো বেশি ভালো হয়ে গেছি।”
তখনই কেবিনের কোনো একজন হাঁচি দিলে ওদের ধ্যান ভাঙ্গে।এরা দুইজন যেনো ভুলেই গিয়েছিলো কেবিনে আরো কিছু ব্যক্তি উপস্থিত আর ওদেরকেই পর্যবেক্ষণ করছে।নোলক সাহেবের মুখে আগেই সবাই সব শুনেছে কে বলবে এদের পরিচয় মাত্র দুইদিনের?
বনলতা সবার সাথে স্রোতের পরিচয় করিয়ে দিলেন।স্রোতের বেশি মানুষ পছন্দ না তারউপর আবার অপরিচিত।হেজিটেটেড ফিল করলেও মুখে হাসি রেখে সবার সাথে পরিচিত হয়।এখানে বনলতার ভাইয়ের মেয়ে নয়না, তার হাসবেন্ড আরিফ,নয়নার ভাই নবীন,বনলতার জা এবং তার ছেলে রায়হান ছিলো।পরিচয়পর্ব শেষে স্রোত বলে,
“আন্টি আমি আজকে যাই।আমাকে এখন খুব দরকারি একটা কাজে যেতে হবে।আসার সময় ডক্টরের সাথে কথা বলেছি আমি।কালকেই আপনি ছুটি পেয়ে যাচ্ছেন।আমি কাল সকাল সকাল এসে দেখা করে যাবো।”
স্রোত চলে যাবে শুনে বনলতা মন খারাপ করলেও স্রোতের চেহারার ক্লান্তিভাব আর অসুস্থ চোখজোড়া দেখে আর আটকালেন না।স্রোত সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
তাড়াতাড়ি করে ছুটতে গিয়ে হাসপাতালের করিডোরেই বিপরীত দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা এক সুদর্শন ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় স্রোত।রাগ উঠলেও হাতে সময় নেই বলে “স্যরি” বলে চলে যেতে নিলে ঐ ব্যক্তি গম্ভীরভাবে বলে উঠে,
“ডিজগাস্টিং, কোথা থেকে এসব অন্ধলোকজন এখানে আসে, ম্যানারলেস্”।
স্রোতকে অন্ধ বলায় ওর ইগোতে লাগে তাই মুখোমুখি হয়ে জবাব দেয়,
“এই কে অন্ধ,কে ম্যানারলেস্? স্যরি যে বললাম কানে যায় নি?আপনি কি কালা?কানে শুনেন না?”
“হোয়াট দ্য!আর ইউ ম্যাড?নিজে ধাক্কা দিয়ে এখন ঝগড়া করছেন”।বিরক্তি নিয়ে বললো লোকটি।
“হাতে সময় নেই বলে ছেড়ে দিচ্ছি,নাহয় বুঝিয়ে দিতাম স্রোতস্বিনী কি জিনিস!যত্তসব।” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে চলে যায় স্রোত।
লোকটি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।স্রোতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে তারমতো একজন সুদর্শন পুরুষকে একটা মেয়ে পাত্তা তো দিলোই না উল্টো কথা শুনিয়ে দিলো,ইন্টারেস্টিং!বিড়বিড়িয়ে বললো,
“স্রোতস্বিনী”
তারপর নিজ গন্তব্যে চলে গেলো।এই সুদর্শন পুরুষটিই মেজর মেহরাদ সাদাফ।রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের স্টুডেন্ট,কর্মসূত্রে এখন চট্টগ্রামে।বয়স তেত্রিশ হলেও সাতাশ- আঠাশ এর বেশি মনে হয় না।মায়ের অসুস্থতার কথা শুনতেই জরুরি ছুটি নিয়ে চলে এসেছে।
মেহরাদ কেবিনে প্রবেশ করতেই সবার আলোচনা থেমে প্রধান আকর্ষণ হয় মেহরাদ।বলা বাহুল্য, এতোক্ষণ সবাই স্রোতকে নিয়েই আলোচনা করছিলো।মেহরাদকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সবাই।মেহরাদ সোজা মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু বনলতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন,উনার চোখে জল।মেহরাদ হয়তো মায়ের অভিমান বুঝলো,
“মা,কথা বলবে না?চলে যাবো?”
“কি দেখতে এসেছো মা ম*রে গেছে কিনা?শেষ কাজ সারার জন্য এসেছো?” চোখে জল নিয়েই কঠিন স্বরে বললেন।
“উফফ মা,কিসব বলছো।আমি দেশের প্রতি দায়িত্বরত মা,তুমি তো জানোই সব।তাহলে এগুলার কি মানে?” গম্ভীর স্বরে বললো মেহরাদ।
“হ্যা,তুমি দেশের দায়িত্বে আছো বলে নিজের মাকে ভুলে গিয়েছো।তুমি ভুলে গিয়েছো যে তোমার বৃদ্ধা মা একা বাসায় থাকে,একা চলাফেরা করে।অন্যকেউ এসে তাকে হসপিটালে ভর্তি করায়।তুমি দেশের প্রতি এতোই নিষ্ঠাবান যে ছয় মাসে একবারো মা’কে দেখার সময় পাও না।”অভিমানী কন্ঠে বললেন বনলতা।
গত ছয় মাসে মেহরাদ একবারো বাসায় আসে নি। ছুটে যে পায় নি তা না,পেয়েছে কিন্তু আসে নি,তার মাথায় কখন কি ভূত চাপে সেই জানে।মেহরাদ মায়ের অভিমান বুঝে হেঁসে আবার তাকে জড়িয়ে ধরলো।মাও ছেলেকে এতোদিন পরে কাছে পেয়ে একহাতে আগলে নিলেন।এখন যেনো বুকটা শান্তি হলো।মেয়েকে তো বছরে একবার বা কোনোবছরে একবারও দেখতে পান না।
মেহরাদ এবার সোজা হয়ে বসে কঠিন স্বরে বললো,
” নিজের কি অবস্থা করেছো মা?তোমাকে বলিনি বাহিরে যাওয়ার সময় রিনাকে নিয়ে যেতে?রিনা কোথায় ছিলো তখন? সাথে নাও নি কেনো ওকে?”
বনলতা এবার চুপ হয়ে গেলেন।উনি তো প্রায়ই এমন একা একা বের হোন,কখনে তো এমন হয় নি।কে জানতো এইবার এমন হবে?
নোলক সাহেব সেখানেই উপস্থিত ছিলেন।এবার তিনি মুখ খুললেন,
“তোর মা প্রায়ই এমন একা একা বেরিয়ে যায়।রিনা জোর করলেও তাকে ধমক দিয়ে বাসায় রেখে যায়।ভাগ্যিস ঐ মেয়েটা ছিলো নাহলে কি হতো আল্লাহ জানেন?”
“কোন মেয়ে?” জানতে চাইলো মেহরাদ।
“স্রোতস্বিনী”
নোলক সাহেব বিস্তারিত সব বললেন।মেহরাদ দূরে থাকায় তাকে শুধু জানানো হয়েছিলো তার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।মেহরাদ বুঝলো একটু আগে যার সাথে ঝগড়া বাঁধতে যাচ্ছিলো এই সেই মেয়ে।ভাবছে,
“তেজস্বী ঐ মেয়ের ভালো গুণও আছে,দারুণ।”
স্রোত হাসপাতাল থেকে সরাসরি বাসায় চলে আসে।মান্ধবী ফোন করে জানিয়েছিলো বাবা নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।যতই অপছন্দ করুক কোথাও না কোথাও একটা টান তো আছেই।মাথার উপর তো বাবা নামক ছায়াটা আছে।বাসায় এসে জানতে পারলো ওদের পারিবারিক ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন, এখন সিরাজ সাহেব সুস্থ আছেন।ডাক্তার আঙ্কেল জানিয়েছেন সিরাজ সাহেব নাকি শরীরের প্রতি অবহেলা করছেন,খাওয়া-দাওয়া করছেন না,ঔষধ নিচ্ছেন না। মান্ধবীর কাছে থেকে সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে যায় স্রোত।
#চলবে…
পর্ব ৮
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928447507294874/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৭
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2928237030649255/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৬
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2927393364066955/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৫
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2926608987478726/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৪
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925928897546735/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ৩
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925756014230690/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ২
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925365577603067/?mibextid=Nif5oz
পর্ব ১
https://m.facebook.com/groups/2794654214007538/permalink/2925296520943306/?mibextid=Nif5oz