#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৭
সময় গুলো খুবই দ্রুততার সাথে অতিক্রম করে চলে গেল। দেখতে দেখতে চোখের পলকে কিভাবে যেন সাতটা মাস অতিক্রম হলো। কেউ টের পেলো না আবার কেউ বা কারা টের পেলো অতি গভীর ভাবে। নিগূঢ়তার সাথে। কারো জীবন ছন্নছাড়া হলো তো কেউ হারালো জীবনের লক্ষণ। কেউ বা গা ভাসালো স্রোতের সাথে। কেউ আছড়ে পরলো তাল মিলাতে না পেরে।
কপালে জমা ঘাম টুকু হাত দিয়ে মুছলো তথ্য। ক্লান্ত লাগছে আজ। সোজা হেটে সামনে গিয়ে ঠান্ডা পানি পান করলো কিছুটা। সস্তি শরীর পেলেও মন পেলো না। মন টা আদৌ কি আছে তার সাথে? নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলো না তথ্য। তুষার, খারাপ লোকটা যাওয়ার সময় তার মন সহ সবটা নিয়ে গিয়েছে। রেখে গিয়েছে শূন্য এই দেহটাকে। যেটা টেনে বেড়াচ্ছে তথ্য একা। একা থাকলেই মনে হয় এই বুঝি তুষার এলো। অপেক্ষাটা দীর্ঘ হচ্ছে। তথ্য শ্বাস ফেললো ক্ষুদ্র একটা। সকল মন খারাপ তো তখনই মিটে যায় যখন সেদিন রাতের কথা ভাবে তথ্য। তুষার’কে ক্ষেপাতে গিয়ে নিজেই আহত নিহত হয়েছিলো তথ্য। তথ্য’কে নিয়ে ঐ দিন ই বিয়ে করলো। ঐ অচেনা রাজশাহী শহরে দুটো আর্মির বিয়ে হলো। সাক্ষী রইলো চারজন বড় আর্মি অফিসার আর মেহমান হলো ট্রেনিং এ থাকা জুনিয়র সকলে। কি এক আজব কান্ড ই না ঘটলো। কর্নেল তাহেরের আচরণ ছিলো সবচেয়ে অবাক করা। তুষারের কান্ডে তার উচিত ছিলো রেগে যাওয়া অথচ তিনি রাগ করলেন না বরং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে পড়ালেন।
জুনিয়র গুলো আবার এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিশ মিনিটের ব্যাবধানে তাদের বাসর সাজালো। কিভাবে? কখন? জানা নেই তথ্য’র। কিচ্ছু জানা নেই। ভিডিও কলে তার বাবা মা দেখেছে তাদের বিয়ে।
সেদিনের রাতটা ছিলো স্বপ্নের। তুষারের মতো এত বড় একজন পুরুষ’কে বাগে আনতে পেরে তথ্য’র খুশি যখন বাঁধভাঙা তখনই তুষার রুমে ঢুকে সর্বপ্রথম যা বললো তা ছিলো তার তোঁষা নিয়ে। তার পরিবার নিয়ে। তুষার মনে কিছু রাখে নি বরং তথ্য’কে সবটা জানায়। এটাও জানায় তার জীবনে তোঁষা’র গুরুত্ব ঠিক কতটুকু। তথ্য আগেই জানতো। তবে বোনের প্রতি ভাইয়ের এহেন ভালোবাসা আর পিতা সুলভ আচরন দেখে মুগ্ধ বৈ কিছু হলো না।
তুষার’কে হতাশ করে নি তথ্য। বরং সেদিন রাতটাকে তারা রাঙিয়েছিলো নিজ রঙ তুলির আচড়ে। তথ্য সেখানে ছিলো এক অবলা ক্যানভাস। আর সেই ক্যানভাস জুড়ে তুষা’র এঁকেছে। মন প্রাণ উজার করে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটা আচড় কেটেছে নিজের তুলির। রাঙিয়েছে তথ্য’কে নিজ রঙে। পূর্ণতা পেয়েছে তাদের ভালোবাসা।
এত এত সুখানুভূতিতে লুটোপুটি খাওয়া ক্লান্ত তথ্য সময় পেলো না অনুভূতিগুলো গোছাতে। তার আগেই এক কল এলো। তুষার ভোর রাতে শুধু তথ্য’র কপালে গভীর চুমু খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মানুষটা সেই যে গেলো এখনও এলো না।
ভালেবেসে নিজের প্রাণে’র অপেক্ষা করতে জানে তথ্য। যেখানেই যাক না কেন সে প্রাণে’র টানে ফিরে আসবেই।
___________________
আরহাম দাঁড়িয়ে আছে বিছানা বরাবর। বিছানায় এলেমেলো তোঁষা ঘুমোচ্ছে। সেদিন যখন আরহাম পাগল প্রায় অবস্থা তখন তোঁষা ছিলো জ্ঞানহীন। টানা তিনদিন পর সম্পূর্ণ হুসে ফিরে তোঁষা। তবে মাঝখানে যতবার সে চোখ খুলেছিলো ততবার আতঙ্কিত চোখে দেখেছিলো আরহাম’কে। সেই দৃষ্টি আজও ভুলতে পারে না আরহাম। বিগত সাতটা মাস ধরে সেই দৃষ্টিগুলো ভুলতে পারছে না ও। তোঁষা আরহাম’কে চিনতে পারে নি। কেন পারে নি এর উত্তর জানা নেই। আরহাম যখন কাছে এসে ধরতে চাইলো তখন ই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে তোঁষা। ভরকে যায় আরহাম। কিছুতেই তোঁষা ওকে চিনলো না। এক সময় তড়পাতে তড়পাতে জ্ঞান হারালো। টানা দুই দিন এমন করে তৃতীয় দিন থেকে তোঁষা কিছুটা স্বাভাবিক হয়। প্রায় সপ্তাহ খানিক পর তার মনে পরে সেদিন সে কেক বানিয়েছিলো। এক সপ্তাহ পর তোঁষা আরহামে’র কেক কাটলো। আরহাম আতঙ্কে আতঙ্কে কেক কেটেছে। সে নিজেই তোঁষা’কে দেখে টানা এক সপ্তাহ ঘোরের মাঝে ছিলো।
তবে এরপর থেকে মেডিসিনগুলোর এফেক্ট উল্টো পরলো। চারমাস চলা কালীন সময় থেকে তোঁষা ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করলো। আরহাম তো এটাই চেয়েছিলো। ও চেয়েছিলো ওর তোঁষা সব ভুলে যাক। ভুলে যাক প্রতারকদের। ধোঁকাবাজদের। শেখ বাড়ীর সকলকে। আরহামে’র চাওড়া ধীরে ধীরে পূরণের পথে ছিলো। তোঁষা ভাবশালীন ভাবে থাকা শুরু করলো। সারাদিন একা একা থেকে এর এফেক্ট পরলো ভিন্ন ভাবে। কিছুটা উগ্র আচরণের দেখা মিললো সারে চার মাসের সময়। বিয়ের তাদের বছর পূর্তি হলো। আরহামের স্বপ্ন গুলো পূরণের পথে অথচ আরহাম খুশি থাকতে পারছে না। কোথায় যেন খটকা বেঁধেই যাচ্ছে তার। তোঁষা ধীরে ধীরে সকলকে ভুলতে চলেছে। দিনের আলো ভুলতে চলেছে। এই একটা ফ্ল্যাট জুড়েই তার আনাগোনা। বারান্দায় যেতে দেয় না আরহাম এখন। এর অবশ্য কারণ রয়েছে।
গতমাসে তোঁষা পালাতে চেয়েছিলো। ভাবা যায়? আরহাম থেকে পালাতে চায়? ডোজ কেটে যেতেই তোঁষা মেইন দরজা খুলে ফেলেছিলো। ভাগ্যিস আরহাম ঐদিন তারাতাড়ি বাড়ী ফিরলো নাহলে কি হতো? হারিয়ে যেতো না আরহামে’র তোঁষা। তখন কি করত আরহাম? রাগান্বিত আরহাম সেদিন থেকে বাসা বন্দী না বরং রুম বন্দী করে তোঁষা’কে। তোঁষা প্রথম প্রথম কাঁদলেও গত দুই দিন ধরে কাঁদছে না। আরহাম এতেও খুশি হতে পারলো না। পারছে না। হাজার চেয়েও ও খুশি হতে পারছে না। এর কারণ জানা নেই ওর। ও তো এটাই চেয়েছিলো ওর তুঁষ ওর থাকুক। আরহামে’র বুকে ওর প্রাণ থাকছে। যেভাবে চেয়েছিলো ঠিক সেভাবে তবে আরহাম এখনও সন্তুষ্ট নয়। তার বুকে যেন এখন ছটফটানি বেড়েছে। তুঁষটা আগের মতো নেই? কেন নেই? আগের মতো কেন আদর করে না আরহামকে? কেন সে আরহামে’র সাথে আগের মতো কথা বলে না? সেবার টানা একদিন কথা ছাড়া ছিলো। কি ভয়টাই না পেলো আরহাম। পরদিন যখন কথা বললো তখন ই না আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো।
.
চুলগুলো নিয়ে বিপত্তি বেঁধেছে ইদানীং। আরহাম গোছাতে পারে না। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোঁষা’র এই হাঁটু সমান চুলগুলো ছোট করে দিবে। তোঁষা নিজেই কেমন কেমন করে চুল নিয়ে। ঘুমন্ত তোঁষা’কে সযত্নে বুকে তুললো আরহাম। তোঁষা বেভুর ঘুম। খানিকক্ষণ আগে তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। আরহাম এক হাতে ফোন তুলে কল দিতেই দরজা ঠেলে এক মেয়ে ঢুকলো। মেয়েটা যে কতটা ভীতু হয়ে আছে তা তার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আরহাম ইশারা করতেই মেয়েটা তোঁষা’র হাঁটু সমান চুলগুলো কেটে দিলো। মনে হলো কেউ আরহামে’র বুকে চালান করলো কেঁচি’টা। মেয়েটার ও আফসোস হলো। কত সুন্দর বড় বড় চুল। এভাবে কেউ কাটে? একদম ঘাড়ের ওপর সমান গোল করে কাটা হলো।
আরহাম এমনটাই বলেছিলো। মেয়েটা যেতেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আরহাম। তার বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। অসম্ভব এক যন্ত্রণা।
এই চুলগুলো তো ওর ভীষণ প্রিয়। ছোট্ট থেকেই তুঁষটার ইয়া বড় বড় চুল ছিলো। চোখ মুখ যখন ঢেকে যেতো তখন চাচি চাপ ব্যান্ড পরিয়ে রাখতো। একটু চুল কাটালেই সেই কি কান্নাটাই না করতো। একবার তো আরহাম পিঠে করে বাজার ঘুরালো পরেই না শান্ত হলো।
তোঁষা’কে রেখে কিচেনে গেলো আরহাম৷ কিছু বানাবে এখন৷ তুঁষটা ঘন্টা যেতেই উঠে যাবে।
হঠাৎ তীব্র কান্নার শব্দে ভরকে যায় আরহাম। দৌড়ে আসে রুমে। ফ্লোরে বসেই চুল খামচে ধরে কেঁদে যাচ্ছে তোঁষা। আরহামের চোখের পাপড়িগুলো নড়লো। ভীত হলো কিছুটা। তোঁষা’র পাশে বসে ভীত স্বরে ই ডাকলো,
— তুঁ…তুঁষ? প্রাণ আমার কথাটা শু….
— আমার চুল? আমার চুল কেন কাটলেন? কেন কাটলেন? বলুন কেন কাটলেন? কেন?
বলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো তোঁষা৷ আরহাম কাছে আসতে নিলেই তোঁষা হাত পা দাপড়ে শুরু করলো। ওর একেকটা চিৎকার আরহামে’র হৃদয় যেন এফার ওফার করে দিচ্ছে। তোঁষা দুই হাতে বারান্দায় থাইতে থাপ্পড় মা’রতে মা’রতে ডাকলো লাগলো,
— আম্মু!!!! আম্মু তুমি কোথায়? আব্বু আমাকে নিয়ে যাও। আমি এখানে থাকব না৷ আমাকে নিয়ে যাও। ভাইয়া!!!!
কতক্ষণ দেয়ালে দুই হাত দিয়ে আঘাত করলো তোঁষা। পরণে থাকা ঢোকা টিশার্ট’টা কাঁধ বেয়ে পরে গেলো। আরহাম এক পা করে করে পিছু হটলো। বিরবির করে বলতে লাগলো,
— এটা তুই ঠিক করলি না তুঁষ। আমাকে ছেড়ে চলে যাবি? কোথায় যাবি? আমি দিব যেতে? আমার প্রাণ না তুই? তোর প্রাণ’কে রেখে কোথায় যাবি? আ…আমার কাছে থাকবি তুই।
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেল তোঁষা। নাক মুখ ফুলে লাল হয়ে গেলো। হঠাৎ ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হতেই হাসফাস করতে লাগে ও। বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না চঞ্চল এই হরিণী অথচ আজ এক মাস এই রুম থেকে বের হওয়ার অনুমতি ও তার নেই। আচমকা আরহামের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেউ। এতক্ষণ যাবৎ ধ্যানে থাকা আরহাম হুশ ফিরে পেলো। তোঁষা ওর কাঁতরাতে কাঁতরাতে বললো,
— আ…আরহাম ভাই, শ্…শ্বাস নিতে পারি না। প..পারি ন..না তো….
আরহাম তড়িৎ বেগে তোঁষাকে বুকে শক্ত করে চাপলো। লাভ হলো না। সাফোকেশনে তোঁষা ছটফট করেই যাচ্ছে। তবুও আরহাম ওকে রুম থেকে বের করলো না। কিছুতেই বের করবে না। যদি আবারও পালায় তুঁষ? পাশ থেকে তোঁষাকে কিছু দিতেই তোঁষা শান্ত হয়ে গেলো। চোখ বুজলো খানিক বাদে।
শান্ত তোঁষাকে কোলে তুলে বারান্দায় গেলো আরহাম। আস্তে করে বসে পরলো। বাইশ তলার উপর থেকে অপরুপ সুন্দর দেখায় প্রকৃতি। রাতের এই দৃশ্য টুকু একটু বেশিই সুন্দর।
আর তার প্রাণে’র কপালে চুমু খায়। টুপ করে এক ফোটা পানি পরলো তোঁষা’র চোখে। অল্প কাঁপলো তোঁষা। ঘুমের মাঝেই বললো,
— প্রাণ যাবে না তুুমি। কাঁদব আমি। বলো যাবে না।
আরহাম আরেকটু বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দেহটা। ঘুমন্ত তোঁষা’র ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,
— কোথাও যাব না প্রাণ।
— প্রমিস।
— প্রমিস।
#চলবে…..