#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৪||
১১২।
রক্তাক্ত প্যাকেটের ভেতর থেকে রাদের দেওয়া শাড়িটা বের করলো আহি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা খুলে গায়ে জড়ালো সে। শেষ মুহূর্তে রাদের বলা কথাটি মনে পড়লো তার।
“সব শাড়ি আর এই শাড়ি এক না। এই শাড়িটা আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে। অনেক বছর পর যখন তুই এই শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবি, আমার মনে পড়বে আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের কথা। মনে পড়বে নিজের টাকায় তোর জন্য আমার প্রথম গিফট কেনার মুহূর্তটি। তোর হাসি দেখতে দেখতে আমি মরেই যাবো বোধহয়। এতো মিষ্টি হাসি তোর! আমার হৃদয়টাই কাঁপিয়ে দেয়।”
আহি শাড়িটা ভাঁজ করে নতুন প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। এরপর আলমারি খুলে প্যাকেটটা ড্রয়ারে রেখে তার উপর আলতোভাবে হাত রাখলো আর বলল,
“আমি জানতে চাই না তুই কোথায় আছিস। আমি সবসময় মনে করবো, তুই আছিস আমার আশেপাশে। তোকে কখনো দেখতে চাইবো না আর। কারণ সত্যটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। লোকে বলে, তুই নেই। আমার জন্য তুই বেঁচে আছিস। বেঁচে থাকবি আমার মেডিসিন হয়ে। আমি তোকে ভালোবাসতে পারি নি। তার মানে এই না যে আমি তোকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছি। তোর মতো বন্ধু পাওয়ার জন্য ভাগ্য লাগে। আমি সব হারিয়েছিলাম, রাদ। লিনাশা ছিল না, আমার ভালোবাসা ছিল না, মা ছিল না, শান্তি ছিল না। শুধু তুই ছিলি। এখন মা আছে, লিনাশাও আছে। কিন্তু তুই নেই। সৃষ্টিকর্তা সবসময় কাউকে পূর্ণতা দেয় না। কিছু না কিছু রেখেই দেয়। তোকে কেন রেখে দিলো রে? আমাকে তো ফেলেই চলে গেলি, রাদ। একবার কথা বলার সুযোগ হতো। বলতাম, সব ভালোবাসায় প্রণয় থাকে না। কিছু ভালোবাসা আত্মার সাথে আত্মার হয়। সব ভালোবাসায় চাওয়া-পাওয়া থাকে না। পাশে থাকলেই শান্তি লাগে। সব ভালোবাসায় স্পর্শ থাকে না। কিছু ভালোবাসা কথার ভীড়েই থাকে। তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তোর পাশে আমি শান্তি পাই। তোর সাথে কতো কথা বলি। শুধু একটা কমতি ছিল। আমি তোর স্পর্শ নিতে চাই নি। আমি তোকে ওভাবে চাই নি, রাদ। তাই বলে এভাবে ফেলে চলে যাবি? সেদিন আমার ব্লেড দিয়ে নিজের হাত না কেটে তাজওয়ারের গলা কাটা উচিত ছিল। যাই হতো, এট লিস্ট তুই তো বেঁচে থাকতি। আমার না, ইউকে যাওয়ায় উচিত হয় নি। ইউকে না গেলে তোর সাথে বন্ধুত্ব এতো গাঢ় হতো না। তোকে আর ফিরে এই দেশে আসতেও হতো না। সব হয়তো আমার জন্যই হয়েছে। আমি তোর জীবনে না আসলে কি এমন হতো? রাদ, প্লিজ দোস্ত। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি তোকে তোর মতো করে ভালোবাসতে পারি নি। কিন্তু যতোদিন বেঁচে থাকবো, তুই আমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকবি। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে, আমার পাশে থাকবি। মানুষ মরে যায়, কিন্তু তার কাজ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। তোর মূল্য কার কাছে কেমন, আমি জানি না। আমার কাছে তুই অমূল্য। তুই কার জীবনে কতোদিনের স্থায়ীত্ব ধরে রেখেছিস, জানি না। আমার মৃত্যু অব্ধি তুই আমার মনে সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবি। তোকে কখনো ভালোবাসি বলা হয় নি। এটাই শুনতে চেয়েছিলি, তাই না? আমি মিথ্যে আশা দিতে পারি না। একজনকে খুব ভালোবেসেছি। তার ঠোঁটে হাসি দেখে আশা নিয়ে ছিলাম, সেও আমায় ভালোবাসে। হয়তো বাসতো, কিন্তু এখন আমার স্থান তার হৃদয়ে কোথাও নেই। তবে যেই আশাটা ছিল, আর সেটাই আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে। আমি তাই তোকে মিথ্যে আশা দেই নি। তবে পাশে থাকার আশা দিয়েছিলাম। যেই আশা ভাগ্য পূরণ করতে দেয় নি। আমি তোকে ভালোবাসি, রাদ। বন্ধুর মতো ভালোবাসি। যেই ভালোবাসায় আত্মার সম্পর্ক থাকে, প্রণয়ের নয়। আর বন্ধু তো প্রিয় পুরুষের চেয়েও আপন হয়। আর কারো আপন মানুষ হওয়াটাই চমৎকার ব্যাপার। পৃথিবীতে প্রেমিক পুরুষ সবারই থাকে, আপন মানুষ সবার থাকে না৷ আমি হেরে যাওয়া একজন আহি, যার জীবনে তুই রাদ হয়ে আসা এক আশীর্বাদ।”
(***)
আহির কাছে বাঁধাই করা ক্যালিগ্রাফি পাঠিয়ে দিলো পদ্ম। সে আজ বেশ খুশি। সে জানে আহি চিঠি পড়ার পর কোনোদিন আফিফের সাথে দেখা করতে আসবে না। দু’দিন পর আফিফ চাকরির জয়েনিং লেটার পেলো। অনলাইনে এসেছে। রাজশাহীতে তার পোস্টিং। এক সপ্তাহের মধ্যেই জয়েন করতে হবে আফিফকে। পদ্ম বেশ খুশি। সবকিছুই তার ইচ্ছেমতো হচ্ছে। জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছে পদ্ম। আফিফা বেগমও টুকটাক ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন। রেনু মায়ের পাশে বসে আছে থম মেরে। আফিফা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললেন,
“জানি তোর কেন এতো খারাপ লাগছে। ছেলে দুইটাকে দেখতে পারবি না, তাই! নিয়াজী থেকে দূরে থাকায় ভালো। তোর অনাগত সন্তানটা তোর সাথেই তো থাকবে। নিয়াজী তো বললো, এই সন্তান তোর কাছেই রাখবে।”
রেনু ধরা কন্ঠে বলল,
“নিয়াজীর কাছ থেকে দূরে থেকে কি হবে, জীবন ধ্বংসকারী যদি আশেপাশেই থাকে?”
“কি বলছিস এসব?”
রেনু উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কিছু না। অনেক হিসেব বাকী আছে। সব তুলতে হবে আমার। রাত-দিন শরীরের আঘাত নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকার শোধ তুলতে হবে। বছরের পর বছর চোখের পানি ফেলার শোধ তুলতে হবে।”
রেনু কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন হতভম্বের মতো। রেনুর বলা কথাগুলো কিছুই বুঝলেন না তিনি।
১১৩।
কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে পদ্মকে দেখতে এলো আহি। আহিকে বারান্দা থেকে দেখে রীতিমতো মতো আকাশ থেকে পড়লো পদ্ম। চিঠি পাঠানোর পরও আহি কেন এলো এখানে? আহির মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না তার। পদ্ম আফিফের কাছে এসে বলল,
“আহি কেন এসেছে, বলুন তো!”
আফিফ অবাক হয়ে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আফিফের পায়ের কাছে বসে বলল,
“আমি আহিকে সব বলে দিয়েছি। আপনি কসম করেছেন, আমি সব জানিয়ে দিলে, আপনি আহির কাছে ফিরে যাবেন না। এখন যান, ওকে আপনি তাড়িয়ে দিন। আপনি এখন যদি আহিকে বের না করেন, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নিবো।”
আফিফ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো তুমি?”
“আমি সত্যি এই কাজ করবো। কারণ আপনি ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
“তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছো, পদ্ম। আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও।”
“শান্তিই তো হবে। এরপর সব শান্তি হবে। আহিকে তাড়িয়ে দিন। এটাতো ওর আর আপনার জন্যই ভালো। আহি বুঝবে, আপনি ওকে এখন আর পছন্দ করেন না। এরপর আহি মুভ অন করতে পারবে। আর আপনাকে তো বলেছিই, আপনি ওর যোগ্য নন।”
আফিফের বুকটা ভারী হয়ে এলো। পদ্ম আফিফকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“যাবেন আপনি? আমি যদি সুইসাইড করি, আপনার জেল হবে। চাকরিটাও যাবে আপনার। রেনু আর মায়ের কি হবে তখন? একবার জেল হলে নতুন চাকরি পেতেও সমস্যা হবে। কেউ কি জানতে চাইবে কে অপরাধী? পেছনের কারণটা কি? সবাই জানবে, আপনি আমাকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছেন, তাই আমি সুইসাইড করেছি। বেশিদিন জেল না হোক, অন্তত একদিনের জেলই তো আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে।”
আফিফ পদ্মের কথা শুনে ধপ করে বিছানায় বসে বলল,
“তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসো নি। তোমার এই আচরণ দেখে আমার তো মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে ভালোবেসেছো। সবটাই তোমার জেদ। আহির সাথে জেদ ধরেছো তুমি। আমি কোনো খেলনা নই পদ্ম যে তোমরা দুইজন আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে।”
পদ্ম শীতল দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে একটা ব্লেড বের করলো। আফিফ ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“পাগলামো করছো?”
“আমি সবাইকে বলে যাবো, আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। আমার রেইপ হয়েছে, তাই আপনি আমাকে স্পর্শ করছেন না। আপনার মা আমাকে মানসিক অত্যাচার করেছে, কারণ আমি সন্তান দিতে পারবো না।”
আফিফ হাতজোড় করে বলল,
“মাফ চাই, আল্লাহর ওয়াস্তে এসব করো না।”
“তাহলে যান। আহিকে বের করে দিন। অপমান করে বের করবেন, যাতে দ্বিতীয় বার আপনার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না থাকে।”
আফিফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পদ্ম চেঁচিয়ে বলল, “যাবেন?”
আফিফের পা চলছে না। ধীর পায়ে সে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো। বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে কোনো গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে, যেখান থেকে বেরুনোর কোনো পথ নেই। আহি বসার ঘরে ছিল। রেনু দরজা খুলে দিয়েছে। আফিফকে দেখে আহি উঠে দাঁড়ালো। রেনু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো। রেনু যেতেই আহি একটা মিষ্টির প্যাকেট আফিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আমি কোম্পানির সিইও হিসেবে জয়েন করেছি। তাই মিষ্টি নিয়ে এলাম। পুষ্প বলল, তোমার না-কি রাজশাহীতে চাকরি হয়েছে। কংগ্রাচুলেশন। পদ্ম তো চাকরির ব্যাপারে আমাকে কিছু বললোই না। আমার সাথে রাগ করেছে হয়তো। যাই হোক, মিস করবো।”
আহি আফিফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্মকে।”
আফিফের বুকটা খালি হয়ে গেলো। নিজেকে শক্ত করে মিষ্টির প্যাকেটের দিকে এক নজর তাকিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো প্যাকেটটি। আহি আফিফের এমন কাজে অবাক হলো খুব। আফিফের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই আফিফ আহির বাহু চেপে ধরে বলল,
“প্লিজ, যাও আমার জীবন থেকে। বের হয়ে যাও। আর কতো বার তোমার মুখটা দেখতে হবে? তোমাকে দেখলে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। আমার আপার মৃত চেহারাটা ভেসে আসে চোখের সামনে। কখন ছাড়বে আমার পিছু?”
আহি আফিফকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পেলো না আফিফ। সে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই রেনুর মুখোমুখি হলো। রেনু কিছু বলার আগেই আহি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আহিকে বেরিয়ে যেতে দেখেই পদ্ম স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আর আফিফ সেখানেই বিধ্বস্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। রেনু ভাইয়ের কাছে এসে বলল,
“কি বলেছো, ভাইয়া? আহিকে কি বলেছো তুমি? মিষ্টিগুলো এভাবে ফেলে দিলে কেন?”
আফিফ মেঝেতে বসে পড়লো। চুল খামচে ধরে বলল,
“আমি ক্লান্ত। আমি খুব ক্লান্ত।”
রেনু আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“ভাইয়া, ওই মহিলাকে ছেড়ে দাও তুমি।”
আফিফ রেনুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। রেনু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“এতো বড় পাপ করেছে, আর তুমি তাকে সহ্য করছো? আমি পারবো না ওই মহিলাকে দেখতে। আমার গায়ে এখনো বেল্টের দাগ। তুমি তাকে মেরেছো কখনো? অথচ তার জন্যই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমি একটা জানোয়ারের সাথে সংসার করে গেছি। বাধ্য করেছে আমাকে ওই মহিলা।”
আফিফ রেনুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“আর কষ্ট করতে হবে না তোকে। আমি আমার বোনকে নিয়ে এসেছি তো।”
“তো? আমার স্বপ্ন তো শেষ। আপাকে তো হারিয়ে ফেলেছো। আমি বেঁচে আছি, কার ভরসায়? আমার জীবনে কি আছে? সংসারটাও ঠিকিয়ে রাখতে পারি নি। গ্রামে গেলে মানুষ কি ভাববে আমাকে? তোমার বউ আমার কপাল থেকে স্বামীর সুখ কেঁড়ে নিয়েছে। তার জন্য আমি একটা অমানুষের স্ত্রী হয়ে পড়ে ছিলাম, আর সে সুখের সংসার করবে? আর আমি বসে বসে দেখবো?”
আফিফ অবাক হয়ে বলল, “তুই কীভাবে জানলি এসব?”
“চিঠি পড়ে জেনেছি।”
রেনু উঠে তার রুমে গিয়ে সেই চিঠিটা নিয়ে এলো যেটা পদ্ম আহিকে লিখেছিল। সেদিন পদ্ম চিঠি লিখে প্যাকেটে ঢুকানোর পর রেনু সেই রুমে গিয়ে প্যাকেটে কি আছে দেখতে গিয়েই চিঠিটা পেলো। সে চিঠিটা সরিয়ে একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করে প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। পদ্ম শেষবার প্যাকেটটি স্টেপল করার আগে সেই সাদা কাগজটাকে চিঠি ভেবে আহির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। রেনু চিঠিটা এনে আফিফকে দিলো। আফিফ চিঠিটা পড়তে পড়তেই পদ্ম রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আফিফ চিঠি পড়া শেষে পদ্মের সামনে চিঠিটা মুচড়ে ফেলে বলল,
“আর কতোটা নিচে নামবে, পদ্ম?”
পদ্ম ভ্রূ কুঁচকে রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কি বলেছো তুমি আমার বিরুদ্ধে?”
রেনু বলল,
“তোমার বিরুদ্ধে কিছুই বলার নেই। তুমি নিজেই তোমার বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো কাজ করেছো। তুমি একটা কালসাপিনী।”
“রেনু! আমি তোমার ভাবী।”
“আমি তোমাকে ভাবী মানি না।”
আফিফ রেনুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“রেনু, আমি আমার সিচুয়েশন হ্যান্ডল করে নেবো। তুই প্লিজ, আমার জন্য নিজের ক্ষতি করিস না। তোর এই মুহূর্তে রেস্ট নিতে হবে।”
রেনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে থামিয়ে দিলো। রেনু চলে যেতেই আফিফ পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।”
পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল, “মরে যাবো আমি।”
“তোমার সাথে থাকলে আমি মরে যাবো, পদ্ম।”
(***)
আহি গাড়ি থামালো জনমানবহীন খোলা মাঠে। গাড়ি থেকে নামতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আহি দৌঁড়ে গেলো সামনে। মাঠের মাঝখানে এসে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। বুকে হাত দিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো সে। আহির কান্নার শব্দ আর বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আফিফ ছাদের মেঝেতে শুয়ে আছে। বৃষ্টির তেজ তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধছে। আর তার হৃদয়ের হাহাকার ক্রমাগত বাড়ছে। সে কাঁদতে পারছে না। কিন্তু ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে ভেতরের সব রাগ, কষ্ট বের করে দিতে। দু’জনের বুক চিরেই বেরিয়ে আসছে একটা প্রশ্ন।
“তোমাকে কি আর জীবনেও দেখার সৌভাগ্য হবে না আমার?”
আফিফা বেগমের চিৎকারে আফিফের হুঁশ ফিরলো। সে ভেজা কাপড়ে ছাদ থেকে নেমে পড়লো। রান্নাঘরের মেঝেতে ছটফট করছে রেনু। পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম তেলের কড়াই। রেনু চিৎকার করে যাচ্ছে। আফিফ বোনকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। উদ্দেশ্য হাসপাতাল। পদ্ম দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে তার শরীর নেতিয়ে পড়ছে। আফিফা বেগম আফিফের পিছু পিছু বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লেন। আজকের এই বর্ষণ মুখর দিনটি কখনোই ভুলবে না তারা।
১১৪।
রেনুর ছেলে হয়েছে। আফিফ রেনুর ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের বারান্দায়। ডেলিভারির সময়ের আগেই হয়ে গেছে বাচ্চাটা। ছোট ছোট আঙ্গুলগুলো আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিলো আফিফ। আফিফা বেগম তা দেখে বললেন,
“কি মিষ্টি ছেলেটা! নানুভাইয়ের নাম কি হবে?”
আফিফ শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলল, “আদ্য।”
“আদ্য কেন?”
“নতুন সূচনা। আদ্য মানেই শুরু। আদ্য আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। রেনুর জীবনের নতুন সূচনা হবে আদ্য।”
আহি বৃষ্টি ভেজা শরীর নিয়ে বাসায় ঢুকলো মাত্র। আর সাথে সাথেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো মোজাম্মেল চাচার নাম৷ কল ধরতেই মোজাম্মেল চাচা যা বললেন, তা শুনেই আহির পুরো পৃথিবী থমকে গেলো।
এদিকে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই আফিফ ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গেলো। ডাক্তার রেনুর বর্তমান অবস্থা জানালো। মেয়েটার শরীরটা জ্বলে গেছে অনেকখানি। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। এদিকে আফিফকে কাল রাজশাহী যেতেই হবে। এই মুহূর্তে চাকরিটা আরো বেশি প্রয়োজন। রেনুর চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের জন্য অন্তত চাকরিটা লাগবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে রেনুকে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ হলো। পুরো সময়টাতে নিলয় সাহায্য করলো তাকে।
(***)
গাড়ির গতি বাড়ালো আহি। ভেজা কাপড়েই পৌঁছে গেলো সুবর্ণ মঞ্জিল। সে গাড়ি থেকে নামতেই দৌঁড়ে এলো মোজাম্মেল চাচা। আক্ষেপের সুরে বললেন,
“স্যার এইডা কি করলো মা?”
আহি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত বাড়িটির দিকে। সুবর্ণ মঞ্জিল, যেখানে তার বেড়ে উঠার গল্প, যার ইট-পাথরের ফাঁকে বাঁধা পড়ে আছে আহির শৈশব। সেই ঘর, যেখানে তার অনুভূতিরা আটকে আছে। আজ সব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি এসেছে। ভেতর থেকে রিজওয়ান কবিরের চিৎকার ভেসে আসছে। আহি কানে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। যারা বাড়ির আশেপাশে ভীড় জমিয়েছে, তারাই বলছে রিজওয়ান কবির নিজেই ঘরে আগুন ধরিয়েছেন। সালমা ফাওজিয়া আহির পিছু পিছু এসেছেন। মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে তিনি দৌঁড়ে এলেন। মায়ের স্পর্শ পেয়ে আহি নেতিয়ে পড়লো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, মা। সবাই শুধু আমাকে একা রেখেই চলে যাচ্ছে।”
সালমা ফাওজিয়া শক্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার বাবা তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছে। তোমার কষ্ট পেতে হবে না, মা। তুমি তো তার ক্ষতি করো নি। সে হয়তো বুঝে গেছে, তার অন্যায়টা কতো বেশি ছিল।”
সালমা ফাওজিয়া কাঁদছেন না। শান্তি লাগছে তার। এতো বছর পর তার বাবার সাথে হওয়া অন্যায়ের শোধ উঠেছে। তার আর আহির জীবনে আসা সব কষ্টের শোধ উঠেছে। রিজওয়ান কবির নিজেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। তিনি একা মরেন নি, সাথে নিয়ে গেছেন তার কোটি টাকার বাড়ি। যদিও এই জায়গাটাও আহির নামে। কিন্তু বাড়িটা রিজওয়ান কবির শখ করেই বানিয়েছিলেন।
এদিকে ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে আফিফ। পেছনে পদ্ম আর আফিফা বেগম বসে আছেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আর পেছনে পড়ে যাচ্ছে সেই চিরচেনা শহর। আফিফের মনটা ভারী হয়ে আছে খুব। এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। জানালার বাইরে তাকালো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল,
“ভালো থেকো, খেয়ালী।”
আহি এখনো সেই পোড়া বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। লিনাশা আহির পাশে বসে বলল,
“যা হয়েছে ভুলে যা। এখান থেকে জীবনের নতুন সূচনা কর।”
আহির দৃষ্টি তার দু’তলা জানালার দিকে। যেই জানালার বাইরে চুল ছড়িয়ে ঘুমাতো সে। আর সেই ঘরে বসেই সে তার এআরের ছবি আঁকতো। আহি সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,
“সুখী হও, প্রিয় অলকানন্দ। তোমার জীবনের নতুন সূচনায় আমার সূচনা হবে। ভালো থেকো, এআর। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি। আর তুমি আমার জীবনে আসা দুঃস্বপ্ন হয়েই রয়ে গেলে। যেই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয় নি। অন্তত তোমাকে দেখার মতো ক্ষমতা দিতে। এখন তো তোমার সামনেও আর দাঁড়াতে পারবো না। এই এক আকাশের নিচে তুমি আর আমি। অথচ কতো দূর আমাদের চলার পথ। তোমাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করেছি আমি। ভুলে যাওয়াটা যদি দুঃসাধ্য না হতো!”
পাঁচ বছর পর……….
চলবে-